#সম্পর্কের_মারপ্যাঁচ
পর্ব-৮
#tani_tass_ritt
রুদ্র পিছে ফিরে তাকিয়ে দেখলো তার মা দাড়িয়ে আছেন।
রুবি বেগমের চোখে পানি।সে নিজেকে প্রস্তুত করছেন তার ছেলেকে আজ সব বলবেই।কিন্তু বলতেই গিয়েও কোথাও যেনো একটা বাধা দিচ্ছে।
“মা”
রুবি বেগম কিছু না বলে সেখান থেকে বেড়িয়ে গেলেন।তার হাত পা কাঁপছে।সে এতদিন শুধু সন্দেহের বশে সব করছিলো।তার ছেলে যে সত্যি ই প্রভাতিকে এতোটা ভালোবাসে জানা ছিলো না তার।কিন্তু এই ভালোবাসার পূর্নতা সে কোনো দিনো পেতে দিবে না।সে কোনোদিন প্রভাতিকে তার একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে পারবেনা।কেনোনা প্রভাতিকে দেখলেই তার মনে পরে যায় অতীতের সেই বিদ্ধস্ত স্মৃতি গুলো।যা তাকে আজও তারা করে বেড়ায়।
রুবি বেগম ঘুমোতে পারছেন না।রুদ্র প্রভাতির বিয়ের কথা জানলে কিভাবে রিয়্যাক্ট করবেন ভাবতেই তার মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ঘড়িতে রাত ২ টা বেজে ২০ মিনিট।প্রভাতি পাক্কা ১০ মিনিট ধরে রুদ্রের রুমের বাহিরে পায়চারি করছে।কিন্তু এই রুদ্র বের হওয়ার নামই নেই।আর না পেরে প্রভাতি নিজ থেকেই দরজায় নক করলো।
রুদ্র দরজা খুলে ভুত দেখার মতো চমকালো।যেই মেয়ে নাকি তার ধারের কাছেই আসে না সে এসে এখন তার দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে তাও নিজ থেকে।ব্যাপারটা বড্ড অদ্ভুত ঠেকলো রুদ্রের।
“ভেতরে আয়।”বলেই রুদ্র দরজা থেকে সরে দাড়ালো। প্রভাতি ভেতরে ঢুকার পর রুদ্র দরজাটা লক করে দিলো কেনোনা তার মা এসে দেখলে কেল্লাফতে হয়ে যাবে।
প্রভাতি চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।তার কেমম যেনো লজ্জা লাগছে।আজব এখানে লজ্জা পাওয়ার কি হলো সে নিজে ভেবেই কূল পাচ্ছে না।
রুদ্র প্রভাতিকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে।এতোদিন পর এতো কাছ থেকে দেখছে।প্রভাতি বেশ বড় হয়েছে। কিন্তু প্রভাতি এমন লজ্জা পাচ্ছে কেন এটা ভেবেই রুদ্র মাথা চুল্কাচ্ছে। সে কি প্রভাতিকে তার মনের কথা টা বলে দিবে।মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করছে।
তখনি প্রভাতি বলে উঠলো,
” রুদ্র ভাইয়া আমার তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।”
“বল” রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বললো।তার মেজাজটাই চটে গেলো।মেয়েটা আর কথা বলার সময় পেলো না।হাদারাম কোথাকার।
“ভাই আসলে ভাইয়া।”
“কি কখন থেকে ভাইয়া ভাইয়া করছিস। কেন রে তোর কি জীবনে ভাই ছাড় আর কিছু নেই? ভাই ছাড়া দুনিয়াতে শব্দের অভাব পরেছে রে।তুই কি ভাইয়া ভাইয়া বলার পণ করে রেখেছিস?ভাই শব্দটার উপর পিএচডি করেছিস?”কিছুটা ধমক দিয়ে বললো রুদ্র।
প্রভাতি বোকা বনে গেলো।
” যাক বাবা কি বলতে এলাম আর এই ছেলে কি বলছে!”মনে মনে বললো প্রভাতি।
“চুপ করে আছিস কেন?কি বলছিলি বল।”
প্রভাতি সব তাগোলপাকিয়ে ফেলেছে।তার দ্বারা যে আর কিছুই বলা সম্ভব না বুঝতে পেরেছে সে।কই নিজের সংশয় দূর করতে এসেছিলো উল্টো এখন তার মেজাজটাই বিগ্রে গেলো।
প্রভাতি উঠে দরজার সামনে এলো।কিন্তু দরজার সিটকিনি খুলতে পারলোনা।দরজার লক তার নাগালের বাহিরে।সে লাফিয়ে চেষ্টা করেও পারলো না।হঠাৎ সে খেয়াল করলো তার পিছে রুদ্র দাড়িয়ে আছে।খুব কাছে দাড়িয়ে আছে।একদম তার গা ঘেষে দাড়িয়েছে
প্রভাতির নিঃশ্বাস কেমন যেনো ভারি হয়ে যাচ্ছে। তার পুরো শরীরে অন্য রকম এক শিহরণ কাজ করছে।আলাদা এক অনুভূতি যা আগে কখনো হয় নি।তার হাত পা অনবরত কাঁপছে।
রুদ্র ব্যাপারটা বুঝতে পারছে।তার বেশ মজাই লাগছে প্রভাতির এই অবস্থা দেখে।সে ইচ্ছে করে আরো গা ঘেষে দাড়িয়েছে।তারপর হাত টা উঁচু করে দরজার লক টা খুলে দিলো।
দরজা খুলতেই প্রভাতি এক দৌড় দিলো।রুদ্রের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।পরক্ষনেই তার মনে পরলো প্রভাতিকে তো তার মনের কথাটাই বলা হলো।
“উফ এই মেয়ে সামনে থাকলে সব যে ভুলে যাই কেনো।” মনে মনে বললো রুদ্র।
রুদ্র বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পরলো।এতোদিন পর আরামের ঘুম দিলো।
প্রভাতি কোনোভাবেই স্থির থাকতে পারছে না।বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে।তার কি হচ্ছে কেনো হচ্ছে কোনোভাবেই তার মাথায় ঢুকছে না।
১১ টার দিকে হৈচৈ এর শব্দে ঘুম ভাংলো রুদ্রের।কেউ এসেছে বলে তার মনে হচ্ছে।সে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো।চোখে মুখে পানি দিয়ে বাহিরে বেরুলো। দেখলো ড্রইং রুমে তৌকির আর তার মা বসা।
তৌকির কে দেখেই রুদ্র বেশ খুশি হয়ে গেলো।সে তৌকিরকেই সব বলবে যাতে তার সাহায্য করে।আর তৌকির অলটাইম তার মায়ের ফেভরেইট।
“আরে তৌকির ভাইয়া কেমন আছো? আন্টি ভালো আছেন?”
তৌকির রুদ্রকে দেখে উঠেই হাগ করলো।
“কতদিন পর তোকে দেখেছি।”
“রুদ্র বাবা তুমি ভালো আছো।।”
“জ্বি আন্টি।”
রুদ্র তৌকিরের কাছে এসে আস্তে আস্তে বললো,
“ভাইয়া আমার তোমার সাথে জরুরি কিছু কথা আছে।”
“কি কথা? কাউকে পছন্দ করিস? আন্টিকে ম্যানেজ করতে হবে?”
রুদ্র ক্ষানিকটা লজ্জা পেয়ে গেলো।
“মানে আসলে।”
“হইছে আর কিছু বলতে হবে না।”
“তোমরা এখানে এতো সকাল সকাল।”
“কেন বাবা তুমি জানো না আর তৌকির আর প্রভাতির এনগেজমেন্ট। রুবি তোমাকে কিছু বলেনি?”
রুদ্র যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।সে ঠিক শুনছে না ভুল।এতো বড় একটা সত্যির জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না। তার মাথা ঘুরছে।সে একদৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
“কি ব্যাপার রুদ্র তুই কিছু বলছিস না।” তৌকির বললো।
রুদ্র পাথরের মূর্তির মতো দাড়িয়ে আছে।কারো কথাই যেনো তার কানে যাচ্ছে না।সে কিছু বলতে যাবে তখনি রুবি বেগম তাকে টেনে ঘরে নিয়ে গেলেন।
রুদ্রের চোখে পানি ছলছল করছে।
“মা এগুলো কি হচ্ছে বাহিরে?তোমরা আমার সাথে মজা করছো তাইনা?
” এখানে কোনো মজা হচ্ছে না।তৌকির আর প্রভাতির বিয়ে ঠিক করেছি আমি।আশা করি তোর কোনো সমস্যা নেই।”
রুদ্রের ভেতরটা যে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে এটা কি তার মা বুঝতে পারছে না।
“মা প্লিজ এমন করোনা।আমি প্রভাতিকে ভালোবাসি।আমি ওকে ছাড়া বাচঁবোনা।প্লিজ মা তুমি এনগেজমেন্ট আটকাও।আমি তোমার কোনো কথা শুনবোনা।প্রভাতি শুধু আমার।আমি কিছুতেই এই এনগেজমেন্ট হতে দিবনা।” বলেই রুদ্র রুম থেকে বের হতে নিলেই
“তুই আজ যদি এই এনগেজমেন্ট টা না হতে দিস তাহলে তুই আমার মরা মুখ দেখবি।আশা করি তুই তোর মাকে ভালো করেই চিনিস।”
রুদ্র আর এক পাও আগাতে পারে না। সে পিছে ফিরে তার মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
রুবি বেগম রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।
আজ আটকাতে পারলেও বিয়ের আগে কোনো না কোনো কান্ড করবে তার ছেলে সে তা খুব ভালো করে জানে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রভাতি জানতে পেরেছে তার আর তৌকিরের এনগেজমেন্ট আজকে।এটা শুনার পর থেকেই সে কেমন যেনো চুপ হয়ে গিয়েছে।তার ভিতর কি চলছে সে নিজেও বুঝতে পারছেনা।
রুবি বেগম নিজে এসে প্রভাতিকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছেন। প্রভাতিকে কেমন যেনো প্রাণহীন মানব লাগছে।মূর্তির ন্যায় সে রুমে বসে আছে।
তৌকিরের সব কিছুতেই বেশ খটকা লাগছে।রুবি বেগম প্রভাতিকে ড্রইং রুমে নিয়ে এলেন। প্রভাতিকে দেখেই তৌকিরের মনটা বেশ ভালো হয় গেলো।
প্রভাতি এইদিক ওদিক তাকিয়ে রুদ্রকে খুঁজছে।কিন্তু কোথাও দেখতে পাচ্ছেনা।তা খুব কষ্ট হচ্ছে।এক অদ্ভুত কষ্ট। মনে হচ্ছে সে তার খুব প্রিয় কিছু হারিয়ে ফেলছে।
রুবি বেগম প্রভাতিকে নিয়ে তৌকিরের পাশে বসালেন
।
“আন্টি রুদ্র কোথায়? ওকে ডাক দিন।না থাক আমি যাচ্ছি।”
“তুমি বসো আমি যাচ্ছি।” বলেই রুবি বেগম রুদ্রের রুমের দিকে পা বাড়ালেন।
রুমের দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো।
রুদ্র ফ্লোরে গুটিসুটি মেরে বসে আছে।কিছুক্ষনের মধ্যেই তার উপর দিয়ে প্রবল ঝর বয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। বড্ড অস্বাভাবিক কাগছে রুদ্রকে।
“রুদ্র বাবা”
রুদ্রের তাকানো দেখে রুবি বেগম ভয় পেয়ে গেলেন।চোখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে।
রুবি বেগম কিছু বলার সাহস পেলেন না।সে উঠে দরজা অব্দি গিয়ে আবার ব্যাক করলেন।
“বাবা আমাকে ভুল বুঝিস না।আজ আমি তোকে সবটা বলবো।তোর যদি তোর মায়ের প্রতি নূন্যতম ভালোবাসা থাকে তাহলে এই এনগেজমেন্ট ভালোয় ভালোয় হয়ে যেতে দে।বলেই রুবি বেগম সেখান থেকে চলে গেলেন।
রুদ্র মেঝেতে বসে আছে।
সে ভাবতেই পারছে না সে তার মায়াপরীকে চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলছে।নাহ এটা হতেই পারেনা। তার পাগল পাগল পাগল লাগছে।
” আমি আমার মায়াপরিকে কারো হতে দিবোই না।”বলেই রুদ্র দরজার দিকে পা বাড়ালো। দরজার কাছে যেয়েই সে থেমে গেলো।তার মায়ের শেষ কথাটা মনে পরলো।রুদ্রের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পরছে।নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে সজোরে বারি দিলো দেয়ালে।
রিং পরানোর সময় প্রভাতির হাত থর থর করে কাঁপছে।সে দরজার দিকে চেয়ে আছে।আই বুঝি রুদ্র এলো।কিন্তু নাহ রুদ্র আসেনি।প্রভাতি আর তৌকিরের এনগেজমেন্ট টা হয়ে গেলো।
প্রভাতি নিজের রুমে যাওয়ার সময় রুদ্রের রুমের দিকে তাকিয়েই আৎকে উঠলো।ঘরের অবস্থা বিদ্ধস্ত।মনে হচ্ছে ভুমিকম্প বয়ে গেছে।
রুদ্রের রুমটা এক কর্নারে হওয়ার জন্য ভিতর থেকে কোনো শব্দ সহজে বাহিরে আসে না।
প্রভাতি রুমে ঢুকে চারিদিকে তাকিয়েও রুদ্রকে দেখতে পেলো না।সে নিজের রুমে এসে দরজা আটকে দিলো।
প্রভাতি রুমে যেয়ে শাড়ি টানদিয়ে খুলতে চেষ্টা করলো।পিনের সাথে বেজে শাড়িটা ছিড়ে গেলো।এতে তার কোনো খেয়ালই নেই।শাড়ি এই সাজ সব তার বিরক্ত লাগছে।বিষের মতো লাগছে।
তৌকির আর ওর মা ঐদিন রুদ্রদের বাসায়ই থেকে গেলো। রাত ১২ টায় রুদ্র বাসায় এলো।রুদ্র বাসায় ফিরার সাথে সাথে রুবি বেগম ছেলের রুমে গেলেন।
রুদ্রকে দেখে খুব মায়া হচ্ছে।মাত্র কয়েকঘন্টার ব্যাবধানে রুদ্রের চেহারায় বিষন্নতার ছাপ পরে গিয়েছে।কিন্তু তার বিশ্বাস সব কিছু জানার পর রুদ্র সব কিছু বুঝতে পারবে।
” আমার তোর সাথে কিছু কথা ছিলো।”
রুদ্র কোনো উত্তর দিচ্ছে না।সে চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে।
তোকে আজ আমি আমার জীবনের একটা কালো অধ্যায় বলবো।
রুদ্র তার মায়ের দিকে তাকালো।
“তোর তো মনে আছে তাইনা আমার মা যে ছোটবেলায় মারা গিয়েছিলো।বাবা তার ২ মাস পরই নতুন বিয়ে করে আনে।আমার তখন ১০ বছর বয়স মাত্র।আর আয়শার ৭ বছর।
নতুন মা আসার পর আমরা খুশি থাকলেও সে খুশি হতে পারেনি আমাদের দেখে।আমাদেরকে নিয়ে বাবার কাছে নালিশ করতো।বাবাও তার কথা বিশ্বাস করতো।আমাদের কে ইচ্ছা মতো পেটাতো।এমনকি খেতেও দিতোনা।ভাতের মার খেয়ে থাকতাম।এভাবেই দিন যেতে থাকে।তাদের অত্যাচার বন্ধ হয়নি।আয়শা ছোট ছিলো বিধায় মার টা আমাকেই বেশি খেতে হতো।”
এক নিঃশ্বাসে বললেন রুবি বেগম।
রুদ্র অবাক হয়ে তার মায়েরদিকে তাকিয়ে আছে।এগুলো সে আগে জানতো না।
“আমার যখন বয়স ১৬ তখন আমার জীবনে নতুন আলো আসে।আমি বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পাই।তখন আমি বুঝতে পারিনি এটাই আমার অন্ধকার জীবনের সূচনা।যার রেশ এখনো আমাকে বয়ে বেরাতে হচ্ছে।”
রুদ্র কিছু বলতে যাবে তখনি,
“তুই কিছু বলিস না।আগে আমাকে সব বলতে দে।আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে প্রস্তুত করেছি।ছেলের সামনে এভাবে এসে বলা লাগবে কোনোদিন চিন্তাও করতে পারিনি।”
রুবি বেগম তার হাতে থাকা দুটো ছবি রুদ্রকে দেখালেন।ছবি গুলো বেশ পুরনো অনেকটা ঝলসেও গিয়েছে।
রুদ্র ছবিটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখলো।দেখেই সে চমকে গেলো।তার মাথা কাজ করছে না।এটা কিভাবে সম্ভব।
চলবে……..