সমুদ্র বিলাস পর্ব-০৫

0
1999

#সমুদ্র_বিলাস
#Rahnuba_mim
পার্ট:৫

সারাদিনের ক্লান্ত শরীর নিয়ে কুহেলিকা বিছানায় শুয়ে পড়ে।সৌকতে কাঁটানো মুহূর্ত ভাবতে থাকে।সে কত আনন্দ করেছে।সমুদ্রের স্নিগ্ধময় তরঙ্গমালা এসে যখন তার পা ছুঁতে আসে সে খুশিতে খিলখিল করে হেসে উঠে।কুহেলিকার মনের গহীনে আজীবন সমুদ্র বিলাস মনে থাকবে।কুহেলিকার ক্লান্ত চোখ যখন গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যাচ্ছিল তখন রুমে আহিল প্রবেশ করে।
আহিলের আসার শব্দ শুনে কুহেলিকা শুয়া থেকে উঠে বসে।আহিল রক্তবর্ণচক্ষু বলে আজ সারা দিন নিরবের সাথে ছিলে?

কুহেলিকার উত্তর দিতে ভালো লাগছে না।তবুও সে বিরক্তের লেশ নিয়ে বলে হুম,তাতে আপনার কি?

আহিল কুহেলিকার হাত চেপে ধরে বলে আমার কি তাই না,আমারেই সব।খবরদান কখনো যেন তোমাকে নিরবের আশপাশে না দেখি।ফের যদি এমন করো তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।

কুহেলিকা তার হাত ছাড়ানোর জন্য মুচড়াতে মুচড়াতে বলে আহ লাগছে,ছাড়েন বলছি।

লাগার জন্যেই তো চেপে ধরেছি।ব্যথা পাচ্ছ না আমারো খুব ব্যথা লেগেছে।ঠিক বুকের বা পাশে।

আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন না তাহলে এত জেলাসি হচ্ছেন কেনো?কেনো সেদিন সবার সামনে বলেছেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন না।আপনি টিকটিকির মতো কেনো?

কুহেলিকার কথা শুনে আহিল নিশ্চুপ হয়ে যায়।আহিলের মৌনতা দেখে কুহেলিকা বলে আপনি কখনো আমার সামনে আসবেন না।আপনাকে আমি ঘৃনা করি।আপনাকে আগে যতটা ভালোবেসে ছিলাম তার চেয়েও বেশি ঘৃনা করি।আপনি প্রতারক।শুধু প্রতারক না সাথে মানুষকে সম্মানহানী করেন।প্লিজ বেড়িয়ে যান।

আহিল কি বলবে বুজতে পারছে না।তাই মাথা নিচু করে চলে যায়।আহিলের চলে যাওয়ার পরপরে কুহেলিকা তার হাতের দিকে দৃষ্টি দেয়।আহিলের হাতের চাপের কারণে তার হাত ঘড়ি ভেঙ্গে হাতে বসে গেছে।কুহেলিকা আস্তে আস্তে কাচগুলো খুলে।মাঝে মাঝে ব্যথায় কুকিঁয়ে উঠছে।
বিকালের দিকে আনজুমা এসে কুহেলিকাকে বলে কুহি প্রত্যেক রুম মুছে ফেল।এদিকে আমি বাজারে গিয়ে কিছু কিনে আনি।

কেনো মা কেউ কি আসবে।

হুম,তর কাকা কাকি আসছে।

বড় কাকি?

হুম,সন্ধ্যায় তারা এখানে থাকবে।

আচ্ছা তুমি বাজারে যাও এদিকে আমি সব করছি।

কুহেলিকার তিন চাচা।তার বড় চাচা তার সন্তান নিয়ে বিদেশে থাকেন।তার বড় চাচার দুই মেয়ে এক ছেলে।প্রথম মেয়ে অদ্রিজা,যে কুহেলিকার সমবয়সি।আর দ্বিতীয় মেয়ে অহি যে ক্লাস নাইনে পড়ছে। আর তার আদরে ছেলে আদিল ।সে বর্তমানে ডাক্তারি পড়াশুনা শেষ করে দেশে এসে ক্লিনিক খুলার পরিকল্পনা করেছে।সাথে ঢাকা মেডিক্যাল থেকে তার জন্য প্রফেসরের দায়িত্ব রয়েছে।আদিল একেবারের জন্য দেশে চলে আসছে তাই তার পরিবারের সবাই চলে আসছে।

কুহেলিকা রুম মুছতে শুরু করে দেয়।হাতে ব্যথা আর গতকালকে ইটের আঘাতে তার শরীর জখম হওয়াই তার মুছতে কষ্ট হচ্ছে।ব্যথা নিয়েই সে মুছতে থাকে।

হাতে কি করে আঘাত পেয়েছ?

কোনো পুরুষালি কন্ঠ পেয়ে কুহেলিকা মাথা তুলে দেখে নিরব।কুহেলিকা বলে এই তো গ্লাস ভেঙ্গে হাতে পড়ে।
কুহেলিকার উত্তর নিরবের বিন্দু মাত্র বিশ্বাস হয়নি।তবুও তার মুখশ্রী দেখে মনে হচ্ছে সে পুরোটা বিশ্বাস করেছে।
নিরব কুহেলিকার কাছে বসে বলে দেখি কতটা লেগেছে।
কুহেলিকা তার হাত গুটিয়ে নেয়।নিরব কুহেলিকার হাত টেনে নিজের কাছে এনে জখমের স্হানে হাত বুলাতে বুলাতে বলে ব্যান্ডেস করো নি কেনো?

কুহেলিকা তার হাত নিরবের থেকে ছাড়িয়ে বলে ব্যান্ডেস করতে হবে না।এভাবেই ঠিক আছি।

ঠিক আছো বললেও তুমি ঠিক নেই।শীতের দিনে জখম শুকাতে দেড়ি হয় তার উপর আরো ব্যান্ডেস নেই।সাধে কি তোমাকে তপস্বিনী বলি।

ব্যান্ডেস করার কোনো প্রয়োজন নেই।তুমি এখান থেকে যাও।আমার অনেক কাজ করতে হবে।

সারাদিন কাজ করো তাহলে কখন পড়াশুনা করো?

কুহেলিকা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলে আমারও পড়া।

তুমি সবদিক দিয়েই বেখেয়ালি।উঠ আমি ব্যান্ডেস করে দিচ্ছি।
নিরব কুহেলিকার হাত ধরে টেনে এনে সোফায় বসায়।খুব যত্ন সহকারে ব্যান্ডেস করে।কুহেলিকা নিরবের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে আহিল কখনো তাকে এমন কেয়ার করেনি।বরং সারাক্ষন কষ্ট দিতে জানে।
নিরব হয়তো ভাই হিসাবেই এমন কেয়ার করছে।
ব্যান্ডেস শেষে নিরব বলে এভাবে তাকিয়ে না দেখে নিজের দিকে তাকাও।মুখকে তো একপ্রকার ক্ষণভঙ্গুর গোছের ।মনে হয় জোড়ে বাতাস আসলে শরীর কোমর হতে হেলে পড়বে।বেশি করে খেতে পারো না।

হয়ছে আর বড় ভাইয়ের মতো দায়িত্ব দেখাতে হবে না।

নিরব মুখশ্রী ম্লান করে বিরবির করে বলে ভাই হিসাবে দায়িত্ব পালন করছি না,বরং ভবিষ্যতের বর হিসাবে।

কিছু কি বললে।

কই না ।

কি বর যেন শুনলাম।

নিরব কপালে পড়ে থাকা চুল পিছনে টেলে দিয়ে বলে বলেছিলাম আদিল ভাইয়াকে বর হিসাবে কেমন লাগবে বলতো?

ভালো, আদিল ভাইয়া কি বিয়ে করতে আসছে।

হু আচ্ছা আমি যাই।
নিরব বিলম্ব না করে চলে যায়।মনে মনে বলে কুহেলিকার শ্রবনশক্তি এত প্রখর কেনো?

দিগন্তের লালিমা বিলীন হয়ে যাওয়ার পর আদিলের পরিবার বাসায় এসে পড়ে।রাতের খাওয়া দাওয়ার পর সবাই ছাদে মাদুর বিছিয়ে গল্প করতে বসে।কুহেলিকা কফি আনতে কিচেনে যাই।তখনি কারেন্ট চলে যায়।চারপাশ অন্ধকার আচ্ছন্ন করে।কুহেলিকা তখন কফি বানাতে ছিলো।অন্ধকারে তার ভয় হতে থাকে।
পিছন থেকে আরো চলার শব্দ শুনে কুহেলিকা পিছনে দৃষ্টি দিয়ে চিৎকার করতে চাইলে কেউ তার মুখে চেপে ধরে।কুহেলিকা ভয়ে কাঁপতে থাকে।
আহিল কুহেলিকার মুখ আরো চেপে ধরে বলে একদম চিৎকার দিবে না।

কুহেলিকা আহিলের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলে আপনি এখানে কেনো?

ভাবলাম তুমি ভয় পাচ্ছো তাই আসছি।

যান এখান থেকে।কতবার বলছি আপনাকে আমি ভালোবাসি না।বেহায়ার মতো বউ রেখে আমার কাছে আসেন কেনো?

আহিল রাগে কুহেলিকার দিকে এগিয়ে আসলে সে সিঁড়ির দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিরব আসছে।তাই সামনে না এসে অন্ধকারে মিলিয়ে যাই।
নিরব কুহেলিকার কাছে এসে বলে কফি বানানো হয়েছে।সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

কুহেলিকা চারপাশে তাকিয়ে দেখে আহিল নেই।তবুও তার মনে হচ্ছে নিরব চলে গেলে পুনরায় সে আসবে।তাই সে আতঙ্কে নিরবের হাত ধরে বলে নিরব ভাইয়া একটু দাঁড়াও আমি এখনি বানিয়ে ফেলছি।

নিরব অনুধাবন করতে পারে কুহেলিকা ভয় পাচ্ছে।তাই সে বলে আচ্ছা আমি আছি তুমি তাড়াতাড়ি বানাও।
কুহেলিকা কফি বানিয়ে নিরবকে নিয়ে ছাদে দিকে চলতে থাকে।
সবাই মাদুরে বসে নানার রকম গল্প করতে থাকে।সারার মুখে এত উৎসাহ নেই।এই কয়দিন আহিল তাকে এ্যাভয়েড করে চলছে।কিছু না হতেই ঝগড়া করে।মাঝে মাঝে বলে উঠে তোমাকে আর আমার ভালোলাগে না।
সারাকে চুপ থাকতে দেখে অহি বলে ভাবির মনে হয় আহিল ভাইয়া সাথে ঝগড়া হয়ছে?

না,

তাহলে মন খারাপ করে বসে আছেন কেনো?

শরীরটা ভালো লাগছে না।

আস্তে আস্তে তাদের আড্ডা জমতে থাকে।সবাই এক এক করে গল্প বলতে থাকে।কুহেলিকার গতকাল ঘুম হয়নি বিধায় মাঝে মাঝে সে তন্দ্রায় নয়ে পড়ছে। আদিল হঠাৎ বলে অনেক গল্প বলা হয়ছে এখন নিরব গান গায়বে।

না না,আমি গান পারি না।আর আমার কন্ঠ এতো ভালো না।

একদম মিথ্যা বলবি না।

পারি না তো।

সবার তখন নিরবকে গান বলতে পিড়াপিড়ি করতে থাকে।সবার অনুরোধে নিরব গানের সুর ধরে।ধীরে ধীরে তার সমস্ত সুর গানের মাঝে ঢেলে দেয়।সবাই পলকহীন ভাবে নিরবের গান শুনতে থাকে।যেনো তার গান থেকে মুক্তমালা ঝঁড়ছে।এত সুন্দর কারো কন্ঠস্বর হয় তা আজ নিরবের গান না শুনলে কেউ বিশ্বাস করতো না।

গান শেষে অদ্রিজা বলে তোমার মাঝে এত বড় প্রতিভা লুকিয়ে আছে তা আমরা জানি না।

নিরব বিনময়ে মৃদু হাসল।গল্প শেষে সবাই ছাদ থেকে নেমে পড়ে।কুহেলিকা আসতে না দেখে আদিল নিরব ও অহিকে নিয়ে এসে দেখে কুহেলিকা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন।

আদিল কুহেলিকার ঘুম দেখে হাসতে হাসতে নিরবকে বলে কুহির ছোট বেলার স্বভাব এখনো গেলো না।
অহি হাসতে হাসতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে।নিরব কুহেলিকার মাথায় আলতো করে বুলিয়ে ডাক দেয়।কুহেলিকা তন্দ্রার ভাব নিয়ে তাকিয়ে দেখে সবার মুখে হাসি।
কুহেলিকা বোকার মতো তাকিয়ে রইল।

সকাল নয়টায় কুহেলিকা কলেজে যায়।বহুদিন পর তার ফ্রেন্ডের সাথে সাক্ষাৎ হলে সে অনেক খুশি হয়।সারাদিন ধরে তারা গল্প করে।কলেজের ছুটির পর কুহেলিকা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে আসতে থাকে।রাস্তা পাড় হওয়ার সময় এক দ্রুতগামী গাড়ি তার দিকে আসতে থাকে।সবাই রাস্তার পাশ থেকে চিৎকার করে কুহেলিকাকে সড়তে বলে।কিন্তু কুহেলিকার কর্ণকুহরে কোনো শব্দই প্রবেশ করছে না।সে আপন মনে রাস্তা পাড় হচ্ছে।দোকানের লোকগুলো বলাবলি করছে আহারে মেয়েটার নিশ্চিত গাড়ি চাপা পড়বে।
তখন কুহেলিকার হাত থেকে বইগুলো পড়ে যায়।বই তুলার জন্য হালকা নিচে ঝুঁকে।তখন তার চোখে গাড়ির চাকাগুলো ভেসে উঠে।মাথা তোলার সাথে সাথে তাকে গাড়ি ধাক্কা দিয়ে চলে যায়।কুহেলিকার রক্তমাখা শরীর রাস্তার কিণারায় লুটিয়ে পড়ে।চোখ বন্ধ করার আগে সে মানুষের ভিরের মাঝে চেনা মুখ খুজে।কিন্তু সে ব্যর্থ হয়।তার চারপাশে অন্ধকার দেখতে থাকে।আস্তে আস্তে কুহেলিকার চোখ বন্ধ হয়ে যায়।

চলবে,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে