#সব_সম্পর্কের_নাম_হয়_না💗
পর্বঃ০৮
#লেখাঃ #বাশরুন_বর্ষা
ভোরের শিশিরে ভেজা সবুজ ঘাস।চারদিকে রঙ্গনফুলের গাছে ভরপুর। গাছ ভর্তি থোকা থোকা টকটকে ফুল।ঠিক তার মাঝেই একটা ছোট্ট চিলেকোঠার ঘর।পুরো ঘরটার দেয়াল আঁকিবুঁকি করা।ঠিক যেনো ঠাকুমার ঝুলি।উচ্ছ্বাস গাড়ি চালিয়ে এই জায়গাটাতেই আসে।আর কথাকে ঘুম থেকে জাগায়।গাড়ি থেকে নেমে কথা শুধু হা করে চেয়ে আছে। সদ্য ঘুম জড়ানো চোখে এরকম দৃশ্য আগে কখনো দেখে নি কথা।রঙ্গনফুল এর আগেও দেখেছে কথা কিন্তু এরকম এতোগুলো গাছ ভর্তি এতো এতো ফুল একসাথে কখনোই দেখে নি সে। প্রকৃতি টা আসলেই অনেক বেশিই সুন্দর।চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে কথা।হঠাৎই উচ্ছ্বাস এসে সামনে দাঁড়ায়।হাতে এক থোকা রঙ্গন ফুল। কিন্তু ফুলগুলো কথাকে দেয় না উচ্ছ্বাস। নিচে থাকা দূর্বাঘাসে রেখে শিশির ভেজা ঘাসের উপরেই বসে পরে। আর সাথে সাথেই কথার হাতটা টেনে ওকেও বসিয়ে দেয় ভেজা ঘাসের ওপর।
“থ্যাংকস। আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আসবে না আমার সাথে।
কথাকে সামনে বসানোর পর কিছু একটা বুঝাতে যায় কথা।কিন্তু তার আগেই বাধা দেয় উচ্ছ্বাস,
“জানো এই জায়গাটা না আমার সবচেয়ে কাছের আর ভালোলাগার জায়গা। এই যে চারপাশে এতো গাছ দেখছো না এইসবগুলো গাছই না আমার নিজের হাতে লাগানো।আর এই যে ছোট্ট ঘরটা দেখছো এটা কার পছন্দে বানানো জানো? আমার দাদাভাইয়ের।দাদাভাই আমায় সবচেয়ে বেশি আদর করতো জানো? যতোদিন উনি বেঁচে ছিলেন একদিনও বাদ ছিলো না যে আমাকে নিয়ে এখানে আসতো না।আমার স্কুল ছুটি হতেই আমরা এখানে চলে আসতাম।ঘন্টার পর ঘন্টা এখানে কাটিয়ে তারপর বাসায় যেতাম।দাদাভাই নিজে আমায় পড়াতো জানো? আমরা ওই সিড়িটায় বসে পড়তাম। এই চারপাশে এতো এতো রঙ্গন গাছ দেখছো না আগে কিন্তু এই গাছগুলো ছিলো না।আমাদের স্কুলে একটা রঙ্গন ফুল গাছ ছিলো। আমার খুব ভালো লাগতো সেই গাছের ফুলগুলো।কিন্তু কখনো ছুয়ে দেখা হয় নি।কারণ গাছটা যে স্কুলে ছিলো।তখন আমার ৭ বছর বয়স হবে।একদিন না আমাদের ক্লাসের একটা ছেলে সেই ফুল হাতে নিয়ে ঘুরছিলো। ছেলেটা ছিল আমাদের প্রিন্সিপাল ম্যামের ছেলে। আমি ওর কাছে ফুলটা চাইতেই ও আমায় ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। আর তখন আমার হাতে অনেকটা কেটে যায়। আমার খুব রাগ হয়েছিলো আমিও ওঠে গিয়েই ওর গলা চেপে ধরি।আমার রাগটা তখন এতোটাই বেড়ে গেছিলো হয়তো আর কয়েক সেকেন্ড ওইভাবে থাকলে ছেলেটা মরেই যেতো। সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে আমি আর ওই স্কুলে যাই নি।চাইলে আর যেতেও পারতাম না। কারন সেদিনই প্রিন্সিপাল আমার জন্য টি.সি লিখে দিয়েছিলো।
কথা একপলকে চেয়ে আছে উচ্ছ্বাসের দিকে।অনেকটা হয়রান হয়ে গেছে উচ্ছ্বাস। কারণ কথার সাথে কিছু বলতে গেলে যে শুধু মুখ চালালে হয় না উচ্ছ্বাসের। হাত নাড়িয়ে ওর ভাষায় বোঝাতে হয় ওকে।কিছুক্ষন থেমে আবার শুরু করে উচ্ছ্বাস,
“সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলাম জানো? দাদাভাই সেদিনই প্রথম আমাকে বকেছিলো সারাটা পথ কাঁদতে কাঁদতে এসেছিলাম এখানে।কিন্তু এখানে পা রাখার পরেই না খুব বেশিই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমি। আধঘন্টার রাস্তা আসতে না আসতেই দাদাভাই কোথায় থেকে যেনো এইসবগুলো রঙ্গনফুলের চারাগাছ নিয়ে এসেছিলো। সেদিন আমরা দুজন মিলে এই গাছগুলো লাগিয়েছিলাম জানো? আমি না পাক্কা একমাস একটানা এই ঘরটাতেই রাত কাটিয়েছি দাদাভাইয়ের সাথে শুধু এই ভেবে গাছগুলো যদি মরে যায়।কিংবা কোন ছাগল এসে খেয়ে ফেলে।যেদিন এই গাছগুলোতে প্রথম ফুল ফুটেছিলো না সেদিনও ঠিক এইরকমই একটা ভোর ছিলো জানো? চারপাশটা এরকমই সুন্দর ছিলো।সেদিন আমি না বুঝেই দাদুকে একটা কথা বলেছিলাম।দাদাভাই বিয়ের পর আমি বউ নিয়ে এখানে থাকবো। ঠাকুমার ঝুলির রাজকুমার আর একটা রাজকুমারীর সাথে।আমার কথা শুনে দাদাভাই কি হাসিটাই না হেসেছিলো।
উচ্ছ্বাসের শেষ কথাটায় না চাইতেই হেসে দেয় কথা।৭ বছরের বাচ্চা ছেলেটার কি আজব ইচ্ছে। তখনই বউয়ের স্বপ্ন।কথা ওঠে দাঁড়ায় আর হালকা দৌড়ে গাছগুলোর ওখানে যায়।ফুলগুলোর ওপরে এখনো শিশিরের ফোটা।ছোট গাছগুলো নাড়া দিতেই পুরো গাছের শিশির পানি এসে পরে কথার গায়ে মুখে।মুহুর্তের চোখ দুটো বন্ধ করে অনুভব করে মুহুর্তটা। এভাবেই একটা একটা করে প্রতিটা গাছের কাছে গিয়ে এভাবে শুধু শুধুই ভিজতে লাগে কথা।উচ্ছ্বাস শুধু দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে মেয়েটার কান্ড।কে বলবে এই মেয়েটাকে উচ্ছ্বাস সেদিনও কতো কি বলেছে।শুধু কি বলেছে খুব বাজে ভাবেই বলেছে।আর সামান্য এটুকুতেই সবটা ভুলে গেলো। আসলেই কি ভুলে গেছে?নাকি আর কিছু ভাবার আগেই খেয়াল হয় কথা পুরো আধভেজা হয়ে গেছে।এগিয়ে গিয়ে কথার হাত টা ধরে টেনে নিয়ে আসে উচ্ছ্বাস,
“এটা কেমন পাগলামো বলো তো? পুরো কাকভেজা হয়ে গেছো।এখন কিভাবে কি করবে? আর এতো সকালে আমি কোথায় কি পাবো বলো তো।চলো আমার সাথে।
কথাগুলো বলতে বলতেই উচ্ছ্বাস কথার হাত ধরে টানতে টানতে ঘরের ভেতরে নিয়ে যায়।ভেতরে এসে কথা পুরো হা। ঘরটা বাইরে থেকে যতোটা সুন্দর ভেতরে তার চাইতে আরও বেশি অনেক বেশি সুন্দর।এতো দেখি রুপকথার ছোট্ট একটা রাজপ্রাসাদ। কি সুন্দর করেই না সাজানো। পুরো ঘরটা জুড়েই যেনো সাদার মেলা। রুমের মাঝটায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক চেয়ে দেখছে কথা।ছেলে মানুষের পছন্দ এতোটা সুন্দর হয় কখনো? তাও আবার ঘর সাজানো নিয়ে।কথার ভাবনার ছেদ ঘটে উচ্ছ্বাসের হাতের তুড়িতে।
“ঠান্ডা লাগছে না তোমার?
মাথা নাড়িয়ে না বোঝায় কথা।
হঠাৎ কি ভেবে যেনো উচ্ছ্বাস পাশে থাকা রুমের ভেতরে যায়।খানিক বাদেই আবার চলেও আসে।উচ্ছ্বাসের হাতের দিকে তাকাতেই দেখে হাতে শাড়ি টাইপ কিছু একটা।কপাল কুচকে তাকায় কথা,
“এটা কোথায় পেলেন?
“তোমাকে একটা কথা বলাই হয়নি।দাদাভাইয়ের যখন নতুন নতুন বিয়ে হয়েছিলো তখন নাকি প্রায়ই তারা এখানে এসে থাকতেন।শাড়িটা মনে হয় দাদিরই হবে।
এতোক্ষনে বিষয়টা পুরোটাই ক্লিয়াল হয় কথার এই ঘর উচ্ছ্বাসের পছন্দে সাজানো না।বরং দাদিমার পছন্দেই সাজানো।তবুও জানার আগ্রহটা থেকেই যায় কথার।তাই জিজ্ঞেস টা করেই ফেলে,
“এই ঘরটা কে সাজিয়েছে?
“এটা আমার পছন্দে সাজানো।আর ভেতরের ঘরটায় দাদির পছন্দের জিনিস আছে দেখবে চলো। আচ্ছা আগে চেঞ্জ করে নাও আমি ওখানে আছি।কথার হাতে শাড়িটা দিয়েই উচ্ছ্বাস ভেতরে থাকা রুমটায় চলে যায়।কথা চেঞ্জ করে ভেতরের ঘরটায় ঢুকে দেখে ঘরটার সমস্ত জিনিসই অনেকটা পুরোনো ধরনের। অনেকটা জাদুঘর টাইপ।সামনের রুমটা যতটাই চোখ ধাধানো এই রুমটা ঠিক ততোটায় অন্যরকম।রুমে এসেই কথার কেমন ভয় ভয় লাগে।হাস্যকর হলেও সত্যি কথা কখনো জাদুঘরে যেতে চায় না শুধু এই জন্য।ওর নাকি এসব দেখলেই ভুতুরে মনে হয়।কথার চোখ মুখ এরকম দেখে বিছানা থেকে ওঠে আসে উচ্ছ্বাস।
“কিছু হয়েছে?
উচ্ছ্বাসের হাতটা ধরেই বাইরে নিয়ে আসে কথা।খুব জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে।বাগানের পাশে থাকা দোলনাটায় গিয়ে বসে কথা।
“কি হলো তোমার হঠাৎ?
“ওই ঘরটা জানি কেমন কেমন।ভুতুরে লাগছে।
কথার এমন ভাবনায় বেশ শব্দ করেই হাসতে লাগে উচ্ছ্বাস। এটা দেখে কথার অনেকটা রাগ হয়। ওঠে যেতে নিলেই হাতটা ধরে আবারও পাশে বসিয়ে দেয় উচ্ছ্বাস।
“শাড়িটায় ভীষণ অন্যরকম লাগছে তোমায়।অনেক বেশিই মায়াবী।
কিছু বোঝায় না কথা।শুধু এটায় বোঝায় এখন যেনো বাড়িতে পৌঁছে দেয় ওকে।কথার হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে নেয় উচ্ছ্বাস,
“চলনা এখানে থেকে যাই আমরা।ছোটবেলায় তো না বুঝে বলেছিলাম।কিন্তু আমি এখন সত্যি সত্যিই এখানে থাকতে চাই কথা।তোমায় সাথে নিয়ে থাকতে চাই।চলো না একটা বাসা বানাই।চড়াইপাখির ছোট্ট একটা বাসা।অনেক তো হলো প্লিজ কথা ফরগিভ মি।আর পারছি না আমি বিশ্বাস করো।অপরাধবোধ টা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে আমার নিজের ওপর।তুমি একটাবার আমার চোখের দিকে তাকাও কথা।একটা বার বোঝার চেষ্টা করো না আমায়।
উচ্ছ্বাসকে কি বোঝাবে ভেবে পায় না কথা।যাবে কি মানুষটার সাথে? গেলেই কি সব নতুন করে শুরু হবে? নাকি আবারও সেই অপমান আর অবহেলা সহ্য করতে হবে? চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে উচ্ছ্বাসের।ওঠে দাঁড়ায় কথা,
“আমি যাবো আপনার সাথে। কিন্তু আজ না। আমি ওই বাড়িতে সেদিনই যাবো যেদিন আমাকে সবাই আমার প্রাপ্য সম্মান টা দিবে।
“তোমায় তো কেউ অসম্মান করে নি কথা। শুধু তো আমিই তোমাকে..
“সত্যিই কি শুধু আপনিই করেছেন এমনটা? আর কেউ কিছু করে নি?
মুহুর্তেই উচ্ছ্বাস মাথাটা নিচু করে নেয়।
“মা??
“হ্যাঁ আপনার মা।উনি তো আমায় কখনো মানুষ হিসেবে দেখেই না।অভিশাপ ভাবে আমায়।অপয়া ভাবে। শুধু আমায় না আমার মাকেও ভাবে। কারণ আমার জন্মের পরেই বাবা মারা গিয়েছিলেন আবার আমিও হয়েছি একটা বোবা।
আর দাঁড়ায় না কথা নিজের মতো করেই যেতে লাগে।উচ্ছ্বাসও সাথে গিয়ে কথাকে গাড়িতে বসায়।সিট বেল্ট টা লাগিয়েই কথাকে বোঝায়,
“তুমি যা চাও তাই হবে।মা গিয়েই নিয়ে আসবে তোমায়।
”
সকালের মিষ্টি রোদটা মুখে নিয়ে ক্যান্টিনে বসে আছে বৃষ্টি। সামনেই একটা গরম চায়ের কাপ। হাতে থাকা বইটা ওল্টে পালটে দেখছে আর একটু একটু করে চা টা শেষ করছে। খানিক দূরেই অন্য পাশ থেকে অনেকক্ষন ধরেই এই দৃশ্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে উজ্জ্বল। ফর্সা গালে পুরো রোদটা এসে লেগেছে।এক্কেবারে হলদে চকচকে লাগছে বৃষ্টির মুখটা।বইয়ের পাতা থেকে মুখ সরিয়ে চায়ের কাপে আরেক চুমুক দেওয়ার সময় হঠাৎই চোখে পরে উজ্জ্বলকে।চোখাচোখি হতেই বৃথাই ফোনের দিকে চেয়ে কিছু একটা চেষ্টা করে উজ্জ্বল। মুহুর্তেই আবার বৃষ্টির দিকে তাকায়।দেখে যে টেবিলে বৃষ্টি নেই।উজ্জ্বল উঠে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে সেদিনের সেই পার্কটাতে যায়।দেখে বৃষ্টি ঠিক একই জায়গায় বসে আছে।পেছন থেকে বৃশু ডাকে ঘুরে তাকায় বৃষ্টি,
“এসো বসো?
“হঠাৎ ম্যাজেস করলে যে? তাও আবার এখানে আসতে বললে?
“একা একা বোর হচ্ছিলাম। তাই ভাবলাম কারো সাথে একটু সঙ্গ দেই। কেনো তুমি বিজি?
“হুম তবে এখানেই। অন্য কোথাও না।
“তুমি বেশ কথা শিখে গেছো।
“বলছো?
“হুম।
“আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না যে তুমি এখানে গল্প করার জন্য ডেকেছো আমায়।
“কেন কি ভাবছো তোমায় এই লেকের পানিতে চুবিয়ে মেরে ফেলবো?
কথাটা শেষ করেই হাসিতে গড়িয়ে পরে বৃষ্টি ।উজ্জ্বল শুধু চেয়ে আছে।কখন জানি মুখ ফসকে বলেই ফেলে,
“তুমি হাসলে না তোমায় বেশ লাগে বৃশু।মাঝে মাঝে এভাবে একটু হেসে দেখো না।একেবারে অন্যরকম লাগবে তোমায়।
মুহুর্তেই থেমে যায় বৃষ্টি,
“আমায় কি তুমি কখনো কাঁদতে দেখেছো তুমি? আমি তো সবসময়ই হাসি।
“উহু। ওটাকে হাসি বলে না।ওটাকে বলে ফাঁকি দেওয়া।নিজেকেই নিজের কাছে ফাঁকি দেওয়া। যেটা তুমি সবসময়ই করো বৃশু। একটা মানুষ সবসময় কখনো হাসতে পারে না। চাইলেও সম্ভব না।মানুষের কষ্ট থাকবে দুঃখ থাকবে সুখ থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক তাই না? একটা মানুষ কখনোই সবটা সময় খুশি থাকতে পারে না।বরং অভিনয় করে যেতে পারে।মিথ্যে হাসি দিয়ে অভিনয়।যেটা তুমি সবসময়ই করো।মিথ্যে হাসি হেসে নিজেকে সুখী দেখানোর অভিনয়।
“তুমি মনে হয় ইঞ্জিনিয়ার থেকে সাহিত্যিক হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছো নাকি গো।না বাবা এখানে আর থাকা যাবে না উঠছি আমি।তোমার উপন্যাস গড়া শেষ হলে চলে যেও কেমন?
বৃষ্টি ওঠে দাড়াতেই হাতটা ধরে বসে উজ্জ্বল।
“আবার কি?
“গল্পটা আমায় বলবে বৃশু? তোমার না বলা কথাগুলো বলবে আমায়।শুনাবে আমায় তোমার গল্পটা। বৃষ্টি দাড়িয়েই আছে এখনো।আর উজ্জ্বলও বসে থেকে চেয়ে আছে বৃষ্টির দিকে।হাতটা এখনো ধরেই আছে।
চলবে.
#সব_সম্পর্কের_নাম_হয়_না💗
পর্বঃ০৯
#লেখাঃ #বাশরুন_বর্ষা
আমার তখন ১৬ বছর বয়স।এসএসসি পরিক্ষা শেষ করে আপন মনে সময় কাটাচ্ছিলাম।না পড়াশোনার চিন্তা না অন্য কোন কাজের।৯দি পরেই রেজাল্ট। তখন থেকে একটু একটু চিন্তা হচ্ছিলো।আব্বু আম্মুকে সারাক্ষনই জ্বালাতাম তখন।ও আম্মু যদি রেজাল্ট খারাপ হয়ে যায় সত্যিই কি আমায় রিক্সাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে?কিন্তু আমার এরকম প্রশ্নে আম্মু খুব বিরক্ত হতো। অনেকটা বিরক্তি নিয়েই বলতো এখন তুমি ছোট নেই বৃষ্টি।নেকামি অন্য কোথাও গিয়ে করো।অথচ এই একই কথা যখন আমি আমার পিএসসি রেজাল্টের আগে বলেছিলাম আম্মু তখন হাসতো।পরক্ষনেই বলতো নাহ তোকে বাদামওয়ালার সাথে বিয়ে দিবো।রমনার পাশে যে লোকটা বসে না শুনেছি লোকটার নাকি ৪ বাচ্চা আছে কিন্তু বউ নেই।ভাবছি ওনার সাথেই তোর বিয়ে টা দিবো।আমি সেই সময়টাতে একরাশ অভিমান নিয়ে ছলছল চোখে চলে যেতাম নিজের ঘরে।১০ মিনিট কান্না করার পরই দেখতাম আব্বু এসে আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছে ঘুরে তাকাতেই সব অভিমান শেষ হয়ে যেতো। কারণ আব্বু তখন খালি হাতে আসতো না আমার জন্য দুটো আইসক্রিম মাস্ট ছিলো। খুব সুখের ছিলো আমাদের পরিবার টা তখন। আমার যখন ১০ বছর বয়স তখন আমার একটা ছোট্ট ভাই হলো নাম ছিলো শ্রাবণ। আমার নামের সাথে মিলিয়েই রেখেছিলো।আমার ভাই হওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আমিই ছিলাম বাড়ির মধ্যমনি।দাদিমা,নানিমা যে আমায় কি পরিমান আদর করতো তা বলার বাইরে ছিলো।কিন্তু আমার ভাই হওয়ার পর থেকেই ওনারা কেমন পালটে গেলো।সাথে পালটে গেলো আমাকে আদর করার ধরনটাও।আব্বু আম্মু আমার সাথে একটু বেশি কথা বললেই দাদিমা কেমন জানি করতো।শ্রাবনকে জোর করেই আব্বু আম্মুর মাঝখানে রেখে যেতো। আমি বুঝতাম না কেন এমন করে।
সেদিন আমার এসএসসির রেজাল্ট দিয়েছিলো আমি জিপিএ-৫ পেয়েছিলাম।সেদিন আমি ছাড়া আর কারো মুখে তেমন খুশির চিহ্ন দেখি নি।আমার রেজাল্টের খবর শুনে আব্বু ফুপিকে বাসায় আসতে বলে।বিকেলেই দেখলাম ফুপি হাজির।কিন্তু আসা মাত্রই হাতের সব খাবার জিনিস গুলো শ্রাবনকে দিলো।অথচ কয়েক বছর আগেও আমিই সব পেতাম।ফুপির একটা ছেলে ছিলো নাম ছিলো রেহান।নাম মাত্র পড়াশোনা করতো কোন একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে।ওই লোকটাকে আমার একটুও ভালো লাগতো না।সুযোগ পেলেই আমার সাথে খুব বাজে ব্যবহার করতো।যখন তখন গায়ে হাত দিতো।আমি কয়েকবার আম্মুকে বলেছিও কথাটা।আম্মু কথাটা আব্বুকে বলতেই আব্বু আমাকেই দোষী করতো।আমি নাকি রেহান ভাইয়ার গা ঘেষে থাকি সবসময়। আর এটা নাকি ওনার একদম পছন্দ না। তাই ফুপিকে আমার নামে বিচার দিয়েছিলো আর সেটাই ফুপি আব্বুকে বলেছে।তারপর থেকে রেহান ভাইয়া বাড়িতে আসলেই আমি রুম থেকে বের হতাম না।কিন্তু তাও কিভাবে যেনো অনেক জঘন্য কাজের দায় পরতো আমার ওপর। সবার আদরের বৃষ্টি হয়ে গেছিলো সবার অবহেলা আর অবিশ্বাসের বৃষ্টি।
সেবার ফুপি এসেছিলো বেশ কিছুদিন এ বাড়িতে থাকবে বলে। আমি শুধু সকালে ফ্রেশ হওয়া আর খাবার সময়টা ছাড়া রুম থেকে বের হতাম না কখনো। একদিন রাতে আমার খুব মাথা ব্যাথা করছিলো। আজকাল আমার অসুস্থতাতেও কারো কোন কিছু আসে যায় না।তবুও বেহায়ার মতো কোন রকম বিছানা ছেড়ে ওঠে আম্মুর কাছে যাচ্ছিলাম।রুমে গিয়ে দেখি কেউ নেই।ভাবলাম হয়তো দাদিমার রুমে আছে।তাই সেদিকেই যাচ্ছিলাম। ফুপি আসলেই দেখতাম সবাই মিলে দাদিমার রুমে অনেকক্ষন সময় ধরে কিসব গল্প করতো।দড়জায় গিয়ে নক করার আগেই কানে এলো দাদিমার কান্নার আওয়াজ।
“কোথাকার কোন জঞ্জাল এখনো আমার বাড়িতে রেখে দিয়েছিস।কে জানে কোন পাপের ফল এনে ফেলে গেছিলো সেদিন।আর সেটাকেই তোরা খাইয়ে দাইয়ে বড় করছিস।আমার নাতিটার দিকে ফিরেও তাকাস না।
দাদিমার সাথে সাথে ফুপিও শুরু করলো,
“দেখো ভাই ভাবি তোমরা আসলে একটু বেশিই দয়ালু ভাব দেখাচ্ছো।পর পরই হয় বুঝেছো।যখন তোমাদের সন্তান ছিলো না তখন ও এখানে ছিলো ভালো ছিলো। কিন্তু এখন তো তোমার রক্ত এখানেই আছে তাই না।কেন শুধু শুধু এই জঞ্জালের পেছনে খরচ করছো।এসব পরিচয়হীন ছেলেমেয়ে কি রকম হয় তার প্রমান কি পাচ্ছো না তোমরা।আমার ছেলেটাকে দুটো মিনিট শান্তিতে থাকতে দেয় না এই বাড়িতে। সুযোগ পেলেই বাজে ভাবে ইঙ্গিত দেয়।নেহাত আমার ছেলেটা ভালো মানুষ।
আব্বু অনেকটা রাগী স্বরেই বললো,
“আমাকে কেন বলছিস এসব।আমি তো ওকে সেদিনই চিনে গেছি যেদিন তুই রেহানের ব্যাপারটা বলেছিলি।তোর ভাবিকে বল।ওনার তো দরদ ওতলে ওতলে পরে। আমারই ভুল হয়েছিলো। সেদিন ডাস্টবিনের পাশ থেকে ওঠিয়ে না আনলেই পারতাম।মরতো মরতো ওখানেই মরতো।
আমার হাত পা কেমন কাপছে।মাথাটা আরও বেশিই ঘুরছে।এসব কি শুনছি আমি? আমি রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া কেউ।আমার কোন জন্ম পরিচয় নেই।এমনকি আমি কারো কোন বৈধ নাকি অবৈধ সন্তান তারও কোন নিশ্চয়তা নেই?কোনরকম হেটে এসে রুমে আসলাম।আমার চোখে পানিও আসছে না।তাহলে এই জন্যই আমার প্রতি এতো অবহেলা।এতো এতো অভিযোগ। কিন্তু আমার এখন কি করার আছে।আমি কোথায় যাবো।এটাতো কোন সিনেমা বা নাটক না যে আমি বাড়ি থেকে চলে যাবো।কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই খুব জোরে কাঁদতে শুরু করে দিলাম।কান্নার এক সময় দেখলাম কেউ আমাকে টেনে বিছানা থেকে নামাচ্ছে।চেয়ে দেখলাম রেহান ভাইয়া।আমার হাতে খুব লাগছিলো।ফ্লোর দিয়ে টেনে টেনে আমায় নিয়ে গেলো ডাইনিং রুমে।এরপর চিৎকার করে বাড়ির সবাইকে ডাকতে লাগলো।আমি ওনার কোন কিছুই ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। বাড়ির সবাই এসে হাজির।
ফুপি এগিয়ে এসে নেকা সুরে বলতে লাগে,
“রেহান বাবা কি হয়েছে।তুমি তো বলেছিলে তোমার আজকে কি পার্টি আছে বন্ধুর বাসাতেই থাকবে।
রেহান ভাইয়া দাঁতে দাঁত রেখে বলতে লাগে,
“সে উপায় কি আমার আছে মা? তোমার ভাইজির কি আমাকে দেখলেই মাথা খারাপ হয়ে যায়?
“কি হয়েছে বাবা।
রেহান ভাইয়া নিজের পকেট থেকে ফোনটা বের করে ফুপিকে দেখালো ফুপি রক্তচুক্ষ নিয়ে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আব্বুর কাছে গেলো।এরপর আম্মুও হাতে নিলো ফোনটা।আমি কিছুই বুঝে ওঠতে পারছিলাম না।হঠাৎ আব্বু এগিয়ে আসলো আমার দিকে।এসেই আমার দুই গালে ইচ্ছে মতো চড় বসাতে লাগলো।আমি শুধু অবাক হয়ে আম্মুর দিকে দেখছিলাম।চোখে কি রকম খুশির আভাস।আব্বুকে একটু নাও করছে না।আব্বু আমাকে মারছে আর বলছে,
“এর জন্য আমি তোকে ফোন কিনে দিয়েছিলাম? এইসব নোংরামি করার জন্য।এই বয়সেই এইসব করে বেরাস।তাও আবার আমার ভাগ্নের সাথে।তোকে আজ মেরেই ফেলবো।এবার আর আমার দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হলো না মাথা ঘুরে ওখানেই পরে গেলাম।জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই পরে আছি।এরপর আব্বু আমার ফোনটা আমার হাতে দিতেই আমি খুব অবাক হলাম।আমার ফোনটা তো আমি সেদিন থেকেই পাচ্ছি না যেদিন ফুপিরা এই বাসায় এসেছে।কাউকে যে বলবো সেই সময়টাও তো কারো নেই আমার জন্য।আম্মু এসে আমাকে ম্যাসেজগুলো দেখাতেই আমার চোখ ছানাবড়া। এতো জঘন্য জঘন্য ম্যাজেস আমি পাঠিয়েছি তাও আবার রেহান ভাইয়াকে।আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না আমার ফোন কেন চুরি হয়েছিলো।আম্মু আমাকে দাড় করিয়ে আমার রুমে চলে গেলো।একটু পরেই একটা ব্যাগ নিয়ে বাইরে চলে আসলো।আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না আজকেই হয়তো এই বাড়িতে শেষ দিন আমার।আম্মুর পায়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন কিন্তু শোনে নি।সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম সম্পর্ক বলতে কিছু হয় না।না হলে এতো রাতে এইভাবে একটা কুকুরকেও কেউ বাড়ি থেকে বের করে দেয় না।
খুব ভয় করছিলো রাস্তা দিয়ে যখন হাটছিলাম।ব্যস্ত শহরটা রাত বাড়ার সাথে সাথেই কেমন নীরব হয়ে গেলো।আমারও ভয়টা আরও বাড়তে লাগলো।কিছুদূর ভয়ে ভয়ে এগোনোর পর দেখলাম একটা মহিলা আমার দিকে এগিয়ে আসছে।আমার মনে একটু সাহস এলো আমিও দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম তার দিকে।সামনে যাওয়ার সাথে সাথেই মহিলাটার পায়ে গিয়ে পরলাম।
“প্লিজ আমায় আজকের রাতটা আপনার বাসায় থাকতে দিন।আমি সকাল হলেই চলে যাবো।মহিলাটা কিছু বললো না শুধু একটা তৃপ্তির হাসি দিয়ে আমাকে তার সাথে নিয়ে গেলো।বিশাল বড় ছিলো বাড়িটা।একটা রাজপ্রাসাদ মতো।আমাকে রাতের খাবার টা নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে একটা রুম দেখিয়ে দিলো।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আবারও সকালের নাস্তা টা সে নিজের হাতেই খাইয়ে দিলো।আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে ওনাকে সবকিছুই বলে দিলাম।কিন্তু আমার কথা শুনে ওনার চোখে মুখে কোন কষ্টের ছাপ দেখি নি আমি।বরং একটা খুশির ছাপ দেখেছিলাম। আমায় অবাক করে দিয়ে তিনি বললো,
“তোমার এতো ভালো রেজাল্ট নিয়ে এখনো ভর্তি না হয়ে আছো কেন?
আমি কিছু বললাম না। তিনি আবারও শুরু করলেন,
“স্কুল থেকে সব কাগজপত্র উঠিয়েছো? আমার তখন মনে পরলো আমার সাথে থাকা ব্যাগটার কথা।আমি দৌড়ে রুমে গিয়ে ব্যাগ থেকে সব নামাতে লাগলাম।হ্যাঁ আমার প্রশংসা পত্র এখানেই আছে।সব কাগজপত্র নিয়ে নিচে নেমে এলাম।ওনি তখনি আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পরলেন। কিন্তু কোন কলেজে গেলেন না।বরং বড় একটা শপিংমলে গেলেন আর আমাকে খুব দামি পোশাক কিনে দিয়ে পার্লারে নিয়ে যায়।আর ইচ্ছেমতো সাজাতে লাগে।আয়নায় নিজেকে দেখে চিনতে পারছিলাম না।মনে হচ্ছিলো আমি মনে হয় ২০ বছরের কোন যুবতী। কেনাকাটা সাজগোছ করতে করতে বের হয়ে দেখি রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে।ওনি আমাকে নিয়ে গাড়িতে ওঠে বসলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়িটা থামলো কোন একটা নিরব রাস্তায়। আমি গাড়ি থেকে নামতেই চোখ পড়লো কিছুদূরে।সেখানে কিছুদূর পর পরই মেয়েদের গোল মিটিং। একেকজন পুরুষ যাচ্ছে আর আসছে।আমি তখনো জানতাম না জায়গাটা কোথায়। ভেতরে যাওয়ার পর আমাকে আরেকটা মহিলার সামনে নিয়ে গেলো।পরনে একেবারে সিল্কের একটা শাড়ি।চোখে মুখে সস্তার গারো মেকাপ।সবাই ওনাকে আম্মা আম্মা বলে ডাকছে।আমি সামনে গিয়ে দাড়াতেই আম্মা বলে মহিলাটা আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো আমি কিছুই বুঝলাম না।ততক্ষণে আমার সাথে থাকা মহিলাটা আম্মাকে বলতে শুরু করে দিয়েছে,
“একেবারে কচি আছে।ক্লাস টেন পাস করছে মাত্র।পার্লার থিকা সাজায় আনার জন্যে এইরকম যুবতী লাগতাছে।টাকা কিন্তু আমার ২০ হাজারই লাগবো আম্মা।ওনার কথা শুনে আমি প্রশ্ন করলাম।
“কিসের টাকা? আর আমরা এখানে কেন এসেছি।জায়গাটা খুব বাজে।আমি এখনি চলে যাবো।কথাটা বলেই আমি চলে আসতে লাগি।ওই মহিলাটা আমার হাত টেনে ধরে।কতোগুলো মেয়েকে ইশারা করতেই মেয়েগুলো আমায় টেনে নিয়ে যেতে লাগে।আমি ছটফট করতে লাগি কিন্তু নিজেকে ছাড়াতে পারি না।একটাসময় আমার হাতে থাকা ফাইল টা পরে যায়।তখন আম্মা ওঠে দাঁড়ায় আর ওদেরকে ছেড়ে দিতে বলে আমায়।এগিয়ে এসে আমার ফাইলটা থেকে আমার স্কুলের সব কাগজগুলো দেখতে লাগে।আর আমাকে নিয়ে যায় আলাদা একটা ঘরে।
“নাম কি তোর?
“বৃ বৃষ্টি।
“বয়স কতো?
“ষোলো।
না জাইনাই আইসা পরছা এইখানে তাই না?
আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না শুধু কেঁদেই যাচ্ছিলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে আম্মা আমাকে ওনার কোলে শুইয়ে দিলেন।আর আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
“কাঁদিস না পাগলি।।আর ভয়ও পাস না। আমি আছি তো। এতো ভালো পড়াশোনা করছোস তুই তোর লিগা এই পাপের কাজ না।তোর তো বড় হওয়া লাগবো।অনেক বড়।ওনার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই আমি ওনার কোল থেকে ওঠে গেলাম।আর জোরে জোরে বলতে আরম্ভ করলাম,
“আশা দেখাবেন না আমায়।একদম আশা দেখাবেন না।ওই যে ওই মহিলাটাও আমায় এই স্বপ্ন দেখিয়েই নিয়ে এসেছে আমায়।।আপনিও এরকমটাই করবেন আমি জানি।আমি জানি আমি পালাতে পারবো না এইখান থেকে।কিন্তু আমি এখন মরে যাবো। হ্যাঁ এই যে ব্লেড আমি এখন মরে যাবো। টেবিলে থাকা ব্লেড টা হাতে নেওয়ার আগেই আম্মা এসে আমায় বুকে জড়িয়ে নিলো। শরীরে থাকা অতিরিক্ত পারফিউম এর গন্ধ আমার ঠিক সহ্য হচ্ছিলো না।আমি সরে গিয়ে দাড়ালাম।
“এইখানে বস।কষ্ট হইতাছে তোর? আমারে ক। এই আম্মারে ক আমি সব কষ্ট দূর কইরা দিমু ক আমারে।
আমি ওলটো রাগ নিয়েই বললাম,
“কাউকে কিছু বলবো না আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না। সবাই সুযোগ খুজে।সবাই স্বার্থ খোজে।সবাই।
“ঠিকই কইছোস তুই এই দুনিয়ার সবাই স্বার্থের কাঙ্গাল।কেউ একটু ভালোবাসা খোজে না খোজে নিজেগো সুখ।আনন্দ। আর হাসিল হইলেই ছুইড়া ফালায় দেয়।যাহ তুই জাহান্নামে যা এই বইলাই ফালায় দেয় তাই না রে।
চোখ তুলে আম্মার মুখের দিকে তাকালাম আমি। ওনার চোখে পানি। হয়তো অনেকদিনের জমানো পানি। সাথে সাথেই ওনার চোখ মুখ স্বাভাবিক করে ফেললেন।
তখনি আমার হাতটা ধরে সেই পতিতালয়ের বাইরে বেরিয়ে আসলেন।রাত তখন ৯ টা। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কিছুই বুঝে পাচ্ছিলাম না।কিছুদূর যাওয়ার পর একটা হোস্টেলে গেলাম।কোন একটা লেডিস হোস্টেল।আম্মা সেখানেই আমায় শিফট করে দিলো। কিন্তু তবুও বিশ্বাস হচ্ছিলো না কিছু। মনে হচ্ছিলো এর পেছনে নিশ্চয় কোন না কোন কারণ আছে। এভাবেই চললো দিনের পর দিন।আম্মা আসতো আমায় দেখে যেতো।কখনো আমায় একটা টাকাও দেয় নি। বলতো এটা পাপের টাকা। তোরে দেওয়া যাইবো না।কোথায় কোথায় ঘুরে আমার জন্য টিউশনি জোগার করেছিলো কে জানে।আমি এভাবেই শুরু করেছিলাম আমার অনিশ্চয়তার জীবন।শুধু ভয় হতো না জানি আবার কোন নতুন পরিক্ষার মুখে পরতে হয়।মানু্ষের সাথে মিশতে ভয় হতো। বিশ্বাস করতে ভয় হতো। একা থাকতেই বেশ ভালো লাগতো। আর সেই আম্মা টা কে জানো উজ্জ্বল সে আম্মা টাই আমার আন্না।যেখানে আমি মাঝে মাঝেই যাই।হ্যাঁ সেই আন্নাই আজকে আমাকে এখানে এনেছে।আমি পতিতালয়ে যাই উজ্জ্বল কিন্তু শুধুই আন্নার সাথে দেখা করতে।
এখনো আমার রাতে ঘুম হয় না উজ্জ্বল। আমার শুধু একটা প্রশ্নই মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় আমি কে? কি আমার পরিচয়? আমি কি কোন সৎ বাবা মায়ের হারিয়ে যাওয়া সন্তান নাকি কোন অমানুষের ভুলের মাসূল।আমার খুব কষ্ট হয় উজ্জ্বল আমারও কাঁদতে ইচ্ছা করে। আমার জীবনটা এমন কেন আমারও জানতে ইচ্ছা করে।কেনই বা সেদিন ওই বাবা মা নামক মানুষগুলো আমায় তাদের বাড়িতে নিয়ে গেছিলো আর কেনোই বা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ওইটুকু মেয়েকে রাস্তায় বের করে দিয়েছিলো।আমার জানতে ইচ্ছে করে খুব ইচ্ছে করে।
ওপরে খোলা আকাশটা নিচের সবুজ ঘাস সেখানেই হাটুগেরে বসে ইচ্ছেমতো কাঁদছে বৃষ্টি। খুব জোরেই চিৎকার করে কাঁদছে।আশেপাশের মানুষগুলো আড়চোখে চেয়ে দেখে চলে যাচ্ছে।উজ্জ্বল চেয়ে চেয়ে শুধু দেখছে মেয়েটার কান্না।মোটেও থামানোর চেষ্টা করছে না।উজ্জ্বল চায় তার বৃশু কাদুক।একটু বেশি করেই কাদুক।ভেতরে থাকা জমানো কষ্ট গুলো একটু হলেও বের করুক।
”
রাত তখন ১২ টা উচ্ছ্বাসের চোখে ঘুম ঘুম ভাব।হঠাৎই নক করে কেউ দড়জায়।খানিক বিরক্তি নিয়েই ওঠে আসে দড়জা খুলতে।দড়জা খুলেই চোখটা একবার পরিষ্কার করে নেয় উচ্ছ্বাস। অস্ফুট স্বরেই বলে ওঠে,
“কথা
চলবে,