#সন্ধ্যালয়ের_প্রণয়
#আফসানা_মিমি
| নবম পর্ব |
❌[কোনোভাবেই কপি করা যাবে না]❌
মুখে রুমাল চেপে বর সেজে বসে আছে নিলয়। চোখে মুখে তার চরম বিরক্তি ভাব। পাশেই গোমড়ামুখো হয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে সন্ধ্যাবতী বসে আছে। লাল জামায় সন্ধ্যাকে নতুন বউ লাগছে। নিলয়ের মা রেহানা বেগম গালে হাত দিয়ে দুজনকে মন ভরে দেখছেন আর মিটিমিটি হাসছেন।
” মা, তোমার দেখা শেষ হলে আমি যেতে পারি? পেটের ভেতর থেকে সব বের হয়ে আসছে।”
রেহানা বেগম এবং সন্ধ্যা মুখ চেপে হাসছে কেননা নিলয় কথা বলে আর দাঁড়ায়নি, দৌড়ে চলে গেছে বাথরুমে। আধা ঘণ্টা যাবত এমনই চলছে। মানুষের ডায়রিয়া হলে যেমন একটু পরপর বাথরুমে যায় নিলয়ের তেমন অবস্থা হয়েছে। বাথরুম থেকে বের হয়ে আসতেই রেহেনা বেগম একটু জলপাইয়ের আচার নিলয়ের মুখে তুলে দেয়। প্রায় দশ মিনিট পর নিলয় কিছুটা স্বাভাবিক হয়। আর কিছুক্ষণ পূর্বে দুজনকে বর বউ হিসেবে বসিয়ে রাখার কারণ হচ্ছে, নিলয় অসুস্থ অবস্থায়ও সন্ধ্যাকে রীতিমতো ধমকে যাচ্ছিল। বেচারি সন্ধ্যা নিলয়ের ধমক খেতে খেতে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে রেহানা বেগম এসে দুজনকে ধমকিয়ে একসাথে বসিয়ে রাখে। এদিকে বাতাসে সন্ধ্যার চুলগুলো উড়ছিল বিধায় মাথায় ঘোমটা টেনে গোমড়ামুখো হয়ে বসেছিল। আর রেহেনা বেগম মনে মনে দুজনকে একসাথে বসিয়ে কিছু একটা চিন্তা করে মুচকি হাসছিল।
আবহাওয়ার পরিবর্তন টা খুবই বিরক্ত লাগছে নিলয়ের কাছে। আকাশ পরিপূর্ণ মেখে ঢাকা।ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে। নিলয়ের মা বিদায় নিয়েছেন সে অনেক আগে। নিলয় ল্যাপটপে কিছু কাজ কমপ্লিট করে নিজের কেবিন থেকে বের হয়ে আসে। উদ্দেশ্যে এখান থেকে সরাসরি কাউকে নিয়ে মিটিংয়ে যাবে।
আকাশ একটা ফাইলে ভুল করে সন্ধ্যার নিকট আসছিল সংশোধন করার নিয়তে। ফাইল মূলত বাহানামাত্র আধঘণ্টা যাবত সন্ধ্যার সাথে তার কথা হয় না। ফাইল দেখানোর ফাঁকে সন্ধ্যার সাথে আড্ডা দিয়ে আসবে সে। ফাইলের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল সে। কারো সাথে ধাক্কা লেগে ফাইল সহ আকাশ নিচে পড়ে যায়। কন্ঠনালী থেকে প্রায় কঠিন বকা বের হয়ে আসছিল কিন্তু নিলয়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চুপ হয়ে যায়। নিলয় আকাশকে দেখছে। হাতে ফাইল নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল ছেলেট। আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই ছেলেটা উঠে আসে। নিলয় নিজের ব্লেজার ঠিক করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
” মিস্টার আকাশ। এখন এই কথা বলবেন না যে, স্যার লাঞ্চ টাইম তাই সন্ধ্যার কাছে যাচ্ছি তার তুলতুল হাতে খাবো বলে।”
আকাশ জিহ্বা কাটে। মাথায় না বোধক ইশারা করে বলে,
” না স্যার, আমি তো আমার গার্লেফ্রেন্ডের হাতেও কখনো খাইনি। আর সন্ধ্যা তো ধানি লঙ্কা, দেখা যাবে কখনো যদি বন্ধু হিসেবে আবদারও করি তাহলে মাছের জায়গায় বোম্বাই খাইয়ে দিবে।”
আকাশের কথা শুনে নিলয় না চাইতে হেসে ফেলে। এদিকে নিলয়ের হাসি শুনে আশেপাশের ডেক্স থেকে কিছু কর্মচারী এগিয়ে আসে তাদের মধ্যে সন্ধ্যাবতীও একজন। আকাশের হাতে ফাইল দেখেই বুঝতে পারে এই ভম্বল নিশ্চয়ই ফাইলের বাহানায় তার কাছে আসছিল আর এখন নিলয়ের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েছে। সন্ধ্যা মনে মনে আকাশকে ভয়ানক গালি দিয়ে নিলয়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। নিলয়ের হাসি দেখে অফিসের সকলেই অবাকপ্রায়।
” অসভ্য দুর্লয়ের আজ মাথা গেছে।”
সন্ধ্যার বিড়বিড় কথাও নিলয় শুনে ফেলে। হাসি থামিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
” আপনারা সকলেই জানেন, আমাদের হাতে নতুন একটি প্রজেক্ট এসেছে। আজ সেই প্রজেক্টের ফাইনাল ডিল হবে। ডিলটা খুব ব্যাক্তিগতভাবে করতে চাইছি আমরা। আপনাদের মধ্য থেকে একজন আমার সাথে যাবে যে খুব চঞ্চল আর বুদ্ধিমান। এখন বলুন কে যাবেন?”
অনেক ভীড়ের মধ্যে যখন কোন ভয়ংকর মানুষ আসে তখন সকলে তাকে রাস্তা করে দেয় বা দূরে সরে দাঁড়ায়, ভয় পায়। নিলয়ের কথা শেষ হতেই উপস্থিত সকলেই দূরে সরে দাঁড়ায়। আকাশ নিলয়ের কথার মর্মার্থ ভাবছিল। সকলে সরে যেতেই তার স্তম্ভিত ফিরে আসে আশেপাশে তাকিয়ে সে ও সরে যায়। সন্ধ্যা চারপাশে লক্ষ্য করে দেখে সে আর নিলয় ছাড়া কেউ নেই। নিলয় সন্ধ্যাকে দেখে বাঁকা হাসে। চোখে সানগ্লাস পরে বলে,
” আমার সাথে থাকতে থাকতে বুদ্ধিমাতী হয়ে গেছে মিস ঐরাবতী। তার জন্যই সকলে আপনাকে ইঙ্গিত করেছে আমার সাথে যেতে।”
সন্ধ্যা কপাল কুঁচকায়। দুই হাত বুকে গুঁজে প্রতুত্তুরে বলে,
” আসছে, বুদ্ধিমান বেশে হনুমান।”
—————————-
শহরের সবচেয়ে নামকরা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে নিলয় গাড়ি থামায়। সন্ধ্যা এত বড়ো রেস্টুরেন্ট দেখে মুখে ভেংচি কা’টে। দুজন একসাথে প্রবেশ করে রেস্টুরেন্টের ভিতরে।
দুজন ছেলে এসে নিলয় এবং সন্ধ্যাকে ফুল দিয়ে স্বাগতম জানায়। ডিল ফাইনাল করার জন্য একটা কেবিন বুক করা হয়েছে। নিলয় এবং সন্ধ্যা সেখানেই বসে অপেক্ষা করে। প্রায় দশ মিনিট পর কাঙ্খিত মানুষগণ আসেন। নিলয় তাদের দেখে দাঁড়িয়ে যায় সন্ধ্যা তখন ফোন ঘাঁটছিল। নিলয়কে দাঁড়াতে দেখে সেও দাঁড়ায়। সোনালী বর্ণের চুল ওয়ালা দুই লোক তাদের সামনে। দেখতে অনেকটা ভিনদেশি। পুরো শরীর সাদা, দেখে মনে হচ্ছে মেকআপের স্তূপ সারা শরীরে। সন্ধ্যা লোক দুটোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করছে। সামনে দাঁড়ানো লোকটার চোখের কাছে আসতেই সন্ধ্যা থমকে যায়। পূর্ব পরিচিত চোখ জোড়া সন্ধ্যাকে টানছে। সন্ধ্যা এগিয়ে যেতে চায় লোকটি দিকে কিন্তু নিলয় তাকে বাঁধা দিয়ে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দেয়। দুজন লোকের একজনের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি আর একজনের বয়স ত্রিশ বা বত্রিশ হবে। বয়স্ক লোকটির নাম হচ্ছে হ্যারি আরের জনের নাম হচ্ছে রাফসান।
প্রায় তিন ঘণ্টা মিটিংয়ের পর ডিল ফাইনাল হয়। পুরোটা সময় সন্ধ্যা রাফসানের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিছু তো আছে রাফসানের মাঝে যা সন্ধ্যার খুব পরিচিত। সন্ধ্যা একবার ইচ্ছে হয় রাফসানকে ছুঁয়ে দেখতে। আবার ভাবে, যদি তাকে বেয়াদব বলে! সবচেয়ে বড় কথা নিলয় তার পাশে। এখন যদি সন্ধ্যা কিছু করেও বসে তাহলে নিলয় তাকে সারাজীবন খোঁচাবে।
কথা ছিল ডিল ফাইনাল হলে উভয় পক্ষের মানুষজন রাতে ডিনার করে তারপর বের হয়ে যাবে। নিলয়ের সমর্থন করলেও আগন্তুকরা নাকজ করে। তারা কোনভাবেই খাবেনা বলে দেয়। নিলয় আর জোর করেনি। ভেবে নেয়, এখন থেকে তো একসাথে কাজ করা হবে সুতরাং এমন আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ অনেক দেওয়া যাবে।
নিলয় হ্যারি এবং রাফসানকে বাহির পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। সন্ধ্যা তখনও রাফসানের দিকে তাকিয়ে। নিলয় আড়চোখে সব কিছুই লক্ষ্য করছে। রাফসান এবং হ্যারিকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে তারা আবার হোটেলে প্রবেশ করে। এদিকে সন্ধ্যার পেছনে তাকিয়ে গাড়ির নাম্বারটা নোট করে নেয় কোন এক কারণে।
——————
নিলয় এবং সন্ধ্যার মাঝে কথার চেয়ে বেশি ঝগড়া হয়। নিলয়ের সন্ধাকে খোঁচাতে ভালোবাসে আর সন্ধ্যা নিলের কথার প্রতিবাদে বাঁকা কথা বলতে ভালোবাসে। একসাথে কাজ করা হলেও সন্ধ্যার সাথে কখনো একসাথে খাওয়া হয়নি। রাত বেড়েছে, সন্ধ্যা ফোনে মত্ত। নিলয় আড়চোখে সন্ধ্যাকে দেখছে।
” ঐ ফোনে কী আছে মিস ঐরাবতী? আমাকে মে’রে’ ফেলার হাতিয়ার নাকি? সর্বক্ষণই যে তোমার নজরে থাকে!”
সন্ধ্যা ফোন থেকে মাথা তুলে তাকিয়ে প্রতুত্তুরে বলে,
” বুদ্ধিটা মন্দ নয়। আপনার আমার পূর্ব শত্রুতার জের ধরে যদি প্রতিশোধ নিতে চাই তাহলে এমন চিকুনী বুদ্ধিই প্রয়োগ করতে হবে।”
” আমি সেই সময়ের অপেক্ষায় রইলাম মিস ঐরাবতী। আপনি বাঘিনী রূপে হাজির হবেন আমি সিংহ হয়ে আপনাকে ভয় দেখাবো।”
খাবার চলে আসে। ইতিমধ্যে নিলয় খাওয়া শুরু করে দিয়েছে কিন্তু সন্ধ্যা! সে খাচ্ছে না, হাত গুটিয়ে বসে আছে। নিলয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বাঁকা হাসে। সন্ধ্যার প্লেটে খাবার পরিবেশন করে বলে,
” মায়ের কাছে শুনেছি, তুমি নাকি ছোট বেলায় গরুর মাংস দেখে খাবার খেতে চাইতে না। এখনও কী তাই করো? নাকি ভয় পাচ্ছো, যদি খাবারে বিষ টিষ মিশিয়ে দেই!”
সন্ধ্যা নড়েচড়ে বসে। খাবারের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলয়ের চোখে চোখ রেখে প্রতুত্তুরে বলে,
” আমার সামনে বসা অসভ্য দুর্লয় যা ইচ্ছা তা করতে পারে। হতেও পারে আমাকে সরিয়ে ফেলতে এখানে বিষ না মিশিয়ে দিয়েছেন।”
” সন্ধ্যাবতী! একটু বেশিই বলে ফেললে না! আমি আমার আপনজনদের কখনো ক্ষতি করব না। প্রমাণ চাই তাই তো! ওয়েট আমি প্রথমে তোমার খাবার টেস্ট করে দেই।”
সন্ধ্যা ভরকে যায়। নিলয় কী করতে চাইছে? সন্ধ্যার প্লেটে খাবার পরিবেশন করে নিলয় কিছু একটা ভাবে। হাত টিস্যু দিয়ে মুছে সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,
” এটা ঠিক না মিস ঐরাবতী? আমি বস হয়ে আপনার খাবার টেস্ট করব আর আপনি বসে বসে দেখবেন? আপনার নজর তো খুব খারাপ!”
” মানে? তো কী করব?”
” প্লেটে হাত নিন এবং সুন্দরভাবে হাতে মাখিয়ে আমাকে খাইয়ে দিন।”
চলবে……….
#সন্ধ্যালয়ের_প্রণয়
#আফসানা_মিমি
| দশম পর্ব |
❌[কোনোভাবেই কপি করা যাবে না]❌
” একে তো করেন চু’রি এখন আবার করতে চাচ্ছেন সিনা চু’রি? আমি পারব না। নিজের হাতে খান।”
” খাবো তো? বিষক্রিয়া পরীক্ষা করতে চাইলে খাইয়ে দিতে হবে।”
” পারব না।”
” ভেবে বলছো তো? আমার সাথে যেহেতু আছো রাতের খাবার খেতেই হবে। আর এখানে অন্য কাউকে দিয়ে যদি পরীক্ষা করাতে চাও তাহলে আমি নিষেধ করব না। বুঝোই তো নামিদামি রেস্টুরেন্ট, বদনাম হলে দোষ তাদের উপর যাবেনা তোমার উপরেই আসবে। এখন ডিসিশন তোমার। কি করবে বলো।”
” অসভ্য দুর্লয়, আমি জানি আপনি আমাকে ইচ্ছে করে এখানে ফাসিয়েছেন।”
সন্ধ্যার কথায় নিলয় বাঁকা হেসে বলে,
” কুইক সন্ধ্যাবতী,সময় খুবই কম।”
গোমড়ামুখো হয়ে সন্ধ্যা এক চামচ খাবার নিলয়ের মুখের সামনে ধরে তা দেখে নিলয় ভ্রু কুঁচকায়
” আল্লাহ তোমাকে এত সুন্দর হাত দিয়েছেন জাদুঘরে সাজিয়ে রাগার জন্য? হাত দিয়ে খাওয়াও।”
আগুনের ফুলকি ঝড়ছে। সন্ধ্যার মুখশ্রী রাগে লাল হয়ে গেছে। অগ্নিরুপ ধারণ করেছে সে। খাবারের চামচ শব্দ করে টেবিলের উপর ফেলে হাত না ধুয়েই লোকমা বানাতে থাকে সে। নিলয় সন্ধ্যার রাগ খুব ভালো ভাবে উপভোগ করছে। এই তেজী সন্ধ্যা নিলয়ের খুব পছন্দের। নিলয়ের মুখের সামনে সন্ধ্যা হাতের লোকমা ধরায় নিলয় আবার বাঁধা প্রদান করে।
” তুমি তো আস্ত খচ্চর মিস ঐরাবতী! তোমার ওই না ধোয়া হাতে কত জীবাণু আছে জানো? এই হাতে আমাকে খাইয়ে দিতে আসছো? দেখা যাবে বাড়ি পর্যন্ত আর যেতে পারব না তার আগেই আমার পেটে সমস্যা হওয়া শুরু করে দিয়েছে। হাত ধুয়ে নাও আগে।”
সন্ধ্যার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। নিলয়ের কথা শোনার পর সন্ধ্যার রাগটাও বেড়ে গেছে তাই হাতের ওই লোকমাটাই নিলয়ের মুখে জোর করে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে,
” আর একটা কথা বলবেন তো সত্যি সত্যিই বি’ষ খাইয়ে মে’রে ফেলব। আমি আপনার বউ না যে আপনার সকল আবদার পূরণ করব।”
” তুমি চাইলে সেটাও হতে পারো। তাহলে আর তিন বেলা আমার নিজের হাতে খেতে হবে না। বউয়ের হাতে খেতে পারব।”
সুযোগের সদ্ব্যবহার করে চলার লোক নিলয়। বিষক্রিয়া পরীক্ষা করার অজুহাতে সন্ধ্যাকে খুব হেনস্থা করেছে সে। সন্ধ্যার মুখশ্রীর ভাবভঙ্গি পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে সে। খাওয়াতে গিয়ে সন্ধ্যার অবস্থা নাজেহাল করে ফেলেছে।
দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়ার মাঝে পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেল। এর মধ্যে দুজনের একজনের ও খাবারের প্রতি ধ্যান নেই। সময়ের কথা খেয়াল হতেই নিলয় সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,
“অনেক কথা হয়েছে। আমি খাবার খেয়েছি। ম’রি’নি বেঁচে আছি সুতরাং তুমি খেতে পারো। আমাদের বাসায় ফিরতে হবে নয়তো দাদা অনেক রাগ করবে।”
নিলয়ের কথায় সন্ধ্যাবতী ভেংচি কাটে বিড়বিড় করে বলে,
” ওই আরিফ সরকারকে কে ভয় পায়?”
” সন্ধ্যা ভয় পায়। শুধু ভয় পায় না বাঘের মত ভয় পায়।”
” মোটেও না।”
নিলয়ার প্রত্যুত্তর করে না। খাবার খাওয়ার দিকে মনোনিবেশ করে। এখন কিছু করলে দেখা যাবে নিলয়ের খোঁচানোতে, এক কথা দুই কথায় সন্ধ্যা আরও ঝগড়া শুরু করবে।
—————–
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। সন্ধ্যা পাশের সিটে মাথা হেলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিলয় আড়চোখে একটু পরপর সন্ধ্যাবতীকে দেখছে। কী সরল সে চাহনি! সারাদিন থাকে তেজী বাঘিনী অথচ ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষটা নিষ্পাপ। নিলয় আনমনে হেসে ফেলে। গাড়ি একপাশে দাঁড় করিয়ে সন্ধার কয়েকটা ছবি তুলে নেয়। তারপর ছবির দিকে গভীর নয়নের দৃষ্টিপাত করে বলে,
” ইরাবতীর পর এই প্রথম কোন মেয়ের ছবি আমার ফোনে ঠাঁই পেয়েছে। সত্যিই তুমি খুবই ভাগ্যবতী মিস ঐরাবতী।”
গাড়ি আবারো চলতে শুরু করে। দুই ধারে উঁচু উঁচু বিল্ডিং কিন্তু নিস্তব্ধ। আকস্মাত নিলয়দের গাড়ির জানালায় কোন কিছুর আঘাতে জানালার কাঁচ ভেঙে পড়ে। কাঁচ ভাঙার আওয়াজে সন্ধ্যার ঘুম ভেঙে যায়। সন্ধ্যাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে ভয় পেয়েছে। নিলয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
” কি হয়েছে? ডাকাত ধরেছে কি?
নিলয় উত্তর দেয় না। সামনের আয়নায় পিছনের দৃশ্য দেখতে চেষ্টা করে কিন্তু আফসোস এই অন্ধকারে কোন কিছু স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে না। নিলয় গাড়ি থামায় না। স্পিড বাড়িয়ে আরো জোরে গাড়ি ছাড়ে। কিছুক্ষণ পর পেছনের জানালার আরেকটা গ্লাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। সন্ধ্যা পিছনের সিটে তাকিয়ে বড়ো পাথর দেখতে পায়। ভয়ার্ত কন্ঠস্বরে বলে,
” বড়ো পাথর নিক্ষেপ করছে। দ্রুত চালান।”
” ভয় পেয়ো না সন্ধাবতী, আমি আছি তো! তোমার কিছু হবে না।”
নিলয়ের কথা শেষ হতেই গাড়িতে ধাক্কা অনুভব করে। নিলয়র আয়নায় দেখতে পায়, একটা বড়ো জিপ গাড়ি ধাক্কা দিচ্ছে নিলয়দের প্রাইভেট কারের পেছনে অংশে। নিলয় আগে থেকে স্পিড আরো বাড়িয়ে দেয়।
নিলয়দের এলাকায় পৌঁছুতেই সে অনুভব করে গাড়িতে আর অবস্থান করা ঠিক হবে না। তাই এলাকার একটা নির্জন স্থানে গাড়ি দাড় করিয়ে সন্ধ্যাকে টেনে বের করে দৌঁড়াতে থাকে। প্রায় এক কিলোমিটার দৌড়ে তারা সরকার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। দুজনেই হাঁপাচ্ছে। নিলয় হাঁটুতে হাত ভড় করে হাঁপাচ্ছে আর সন্ধ্যাবতী ভয়ে ভয়ে এদিক সেদিক দেখছে।
” বাড়ি চলুন এখানে থাকা সেফ না।”
নিলয় আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করে সন্ধ্যার হাত ধরে এগিয়ে যায় সরকার বাড়ির অভ্যন্তরে।
————
সরকার বাড়ি দুজন বাচ্চা মানুষের সাথে কত বড়ো দুর্ঘটনা ঘটে গেল। এই ব্যাপারে বড়োরা কেউ জানে না। অবশ্য নিলয় এবং সন্ধ্যাবতী তাদেরকে জানাতে চায়নি। অযথা তারা চিন্তা করবে। দেখা যাবে দুজনকেই ঘরে বসিয়ে রেখেছে।
নিলয় এইমাত্র গোসল করে বের হয়েছে। মাথার চুল দিয়ে টুপটুপ করে পানি ঝরছে। ফ্যান ছেড়ে দিয়ে বিছানার উপর বসে সে। গভীর মনোযোগে কোন কিছু নিয়ে ভাবছে। আকস্মাত একটা ঘটনা মনে পড়ল নিলয়ের। তার কাছে মনে হল এই ঘটনাটা সন্ধ্যার সাথে শেয়ার করা উচিত। এই অবস্থায় বারান্দায় চলে যায় নিলয়। সে জানে সন্ধ্যা এসময়ে বারান্দায় বসে আছে। দূর নীলিমার তারা গুনছে বা অদূরে বিল্ডিংয়ের রং বেরঙের আলো দেখছে।
নিলয়ের ধারণা সঠিক। সন্ধ্যা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
নিলয় মুঠোফোন বের করে সন্ধ্যাকে কল দেয়
নিলয়ের ফোন আসা দেখে সন্ধ্যার ভ্রু কুঁচকে আসে। অভ্যাস মোতাবেক সেও নিলয় বারান্দার দিকে তাকায়। নিলয় হাতের ইশারায় হাই-হ্যালো বলছে এবং বলছে ফোন রিসিভ করতে।
সন্ধ্যা ফোন রিসিভ করে কানে ধরে কর্কশ স্বরে বলে,
” দিনের বেলা তো শান্তি দেন না। রাতেও কী দিবেন না? কি সমস্যা এখন জ্বালাচ্ছেন কেন?”
” প্রেম করতে।”
” কি বললেন? আরেকবার বলেন, মে’রে আলু ভর্তা বানাব।”
” সব সময় তোমার মাথায় যা ঘুরে তাই বললাম। এতসব বাজে কথা বন্ধ করে এখনই ছাদে আসো। তোমার সাথে আমার দরকারি কথা আছে।”
” পারবনা। শুনছেন আমি ছাদে যেতে পারব না।”
” তুমি না আসলে আমি তোমার ঘরের সামনে চলে আসছি। ওয়েট,,,”
” এই না, না। বাবা দেখলে আমাকে জি’ন্দা ক’ব’র দিবে। আমি আসছি।
নিলয় বাঁকা হেসে ফোন কে’টে দেয়। এরপর ঘরে এসে একটা টি শার্ট গায়ে জড়িয়ে ছাদে চলে যায়।
———-
ছাদে ঠান্ডা বাতাস বইছে। ব্যস্ত শহর এখন ঘুমন্ত। কোথাও কোন সারা শব্দ নেই। অদূরে কিছু কলকারখানার টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছে তবে সেটা খুবই নিচু।
” আপনার মনে ভয় ভীতি বলতে কিছুই নেই? যখন যা ইচ্ছে তাই করবেন? আমাকে কী পেয়েছেন?”
নিলয় আনমনে সন্ধ্যার কথার প্রত্যুত্তরে বলে, ” পার্টনার।”
” কি বললেন?”
সন্ধ্যা গণবিদারক চিৎকার শুনে নিলয়ের স্তম্ভিত ফিরে আসে। নিজের বলা কথা কিছুটা সংশোধন করে বলে, ” অফিসের সহকর্মী।”
সন্ধ্যা তেতে ওঠে। অফিসের সময়সীমা শেষ হয়েছে ঘণ্টা খানেক আগে। তাহলে এখন কীসের কথা।”
সন্ধ্যা মুখ খুলবে তার আগেই নিলয় বলে,
” তোমার মনে আছে! কয়েকমাস পূর্বে আমাদের অফিসের গোপন কক্ষপথে র’ক্ত পড়ে ছিল?”
সন্ধ্যার কয়েকমাস পূর্বের কথা মনে পড়ে। অফিসের গোপন কক্ষপথে র’ক্তে’র ছিটেফোঁটা থাকলেও কোন ব্যক্তির হদিস মিলেনি।
” হ্যাঁ মনে আছে।”
” আমি সেই র’ক্ত পরীক্ষা করার জন্য ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়েছিলাম।”
” রিপোর্ট পেয়েছেন?”
” না। তবে আগামীকাল তোমাকে আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।”
সন্ধ্যা মাথা হ্যাঁ বোধক ইশারা করে দাঁড়িয়ে থাকে। দুজনই নিশ্চুপ। সন্ধ্যা চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিতেই নিলয়ের কথায় দাঁড়িয়ে যায়,
” ভালো খেলেছো মিস ঐরাবতী। ঠান্ডা মাথায় ভয়ংকর প্ল্যান করেছিলে। তোমার চেষ্টায় কোন ত্রুটি ছিল না। ভেবেছিলে আমি গাড়িতে একা থাকব কিন্তু তা আর হলো কই! জোর করে তোমাকে গাড়িতে উঠিয়েছিলাম বলেই আজ বেঁচে গেলাম।”
চলবে………