#সন্ধ্যালয়ের_প্রণয়
#আফসানা_মিমি
| সপ্তম পর্ব |
❌[কোনোভাবেই কপি করা যাবে না]❌
নিলয়ের বাহুতে সন্ধ্যাবতীর ছোট্ট দেহখানা আবদ্ধ। সন্ধ্যাবতীর দৃষ্টি স্থির। বারবার রাব্বির র’ক্তা’ক্ত মুখশ্রী সন্ধ্যার দৃষ্টিতে ভেসে উঠছে। পুলিশ এসেছিল, রাব্বির লা’শ এবং অ’স্ত্র নিয়ে গেছে ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা করার জন্য। পুলিশের সামনে নিলয় পুরো ঘটনাটা এক্সিডেন্ট হিসেবে তুলে ধরেছে। সন্ধ্যা পুলিশকে রাব্বিকে খু’ন করা হয়েছে বলে দাবী করেছিল কিন্তু আফসোস পুলিশকে নিলয় মিথ্যা বলে পুরো ঘটনাকে এক্সিডেন্ট হিসেবে তুলে ধরেছে।
সন্ধ্যার নীরবতা নিলয়ের সহ্য হচ্ছে না। গোডাউনের অভ্যন্তের স্থান সুবিধাজনক লাগছে না। বাহিরের কেউ এখানে উপস্থিত আছে ধারণা করছে সে। সন্ধ্যাকে কোলে তুলে নিলয় বের হয়ে আসে।
এই প্রথম নিলয় সন্ধ্যাকে ভয় পাচ্ছে। সন্ধ্যা চুপ করে থাকার মেয়ে না। নিলয় সন্ধ্যার রাগ দেখেছে, ভয় দেখেছে, কিছুক্ষণ আগে কান্নাও দেখলো আর বর্তমানে নিশ্চুপতা। নিলয় আফসোস করছে, আজকের দিনটা তাদের জীবনে যদি না আসতো! তাহলে আগাম ভয় মনে ভর করতো না। জোরে গাড়ির ব্রেক করাতে সন্ধ্যা কিছুটা সামনে ঝুঁকে পড়ে। নিলয় বাম হাতে সন্ধ্যাকে আগলে নেয়। সন্ধ্যা একবার নিলয়ের দিকে তাকায় পরমুহূর্তে সম্মুখে দৃষ্টিপাত করে বলে,
” আপনি কী কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন?”
সন্ধ্যার আকস্মাত প্রশ্নের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
নিলয়ের ত্রিশ বছর বয়সের জীবনে প্রেম একবার এসেছিল। কিছু সময় থেকেও ছিল কিন্তু একদিন সব শেষ করে চলে গেলো। এই কথা সন্ধ্যাবতীকে কীভাবে বলবে সে?
” হঠাৎ এই প্রশ্ন? প্রতিশোধ নিবে নাকি?”
” প্রতিশোধ নেওয়ার আমি কে? তবে যার যার কর্মের ফল সে একদিন পাবে।”
উভয়ের মধ্যে নিশ্চুপতা। সন্ধ্যা জানালার বাহিরে সূর্যোদয় দেখছে। জীবনের এই মুহূর্তটা বড্ড পুড়াচ্ছে তাকে। রাব্বির সাথে কিছু দুষ্টু মিষ্টি মুহূর্তের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায় সে। সরকার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে এসে নিলয় গাড়ি থামায়। ঘুমন্ত সন্ধ্যাবতীকে মন ভরে দেখে নেয় সে।
” তোমার দুঃখ সব আমার হোক, তোমার দুয়ারে যেন আঁধার না নামুক। তুমি হাসলে মুক্ত ঝড়ুক, তোমার হাসিতে আমার অন্তর সিক্ত হোক।”
—————–
ধরণীতে নতুন দিনের আগমন ঘটেছে। যেখানে পুরো পৃথিবীর মানুষ কর্মস্থলে যাওয়ার তাগাদায় মগ্ন সেখানে নিলয় বাগানে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যাবতীর জানালায় আড়চোখে তাকাতে ব্যস্ত। নিলয় সন্ধ্যার জানালার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
” আমি কেন তোমার কথা ভাবছি! তোমাকে দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে আছি। তুমি তো আমার নও, নও বন্ধু। তবুও তোমার তেজে পুড়েছি, ছাই হয়ে যাচ্ছি। বাতাসে মিশে এসে দেখো, উড়ে যাবো।”
নীলিমার ঘুম আজ দেরীতে ভেঙেছে। স্কুল ড্রেস পরিধান করে মুখে পরোটা গুঁজে তাড়াহুড়োয় বের হয় সে। বড়ো ভাইয়াকে দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখে অবাক হয়। নিলয় বাড়ি থেকে আরো বিশ মিনিট পূর্বে বের হয়েছে। মুখের খাবার চিবোতে চিবোতে এগিয়ে আসে ভাইয়ের দিকে।
” কী ব্যাপার? আমার ভাই তো কখনো কাম চোর ছিল না? আজ বিশ মিনিট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ভাইয়ের অফিসে যাওয়ার কোন খোঁজ খবর নেই যে?”
” কাম চোর কে? একদম ঠাটিয়ে দেব চড়। আমি তো ব্যায়াম করছিলাম।”
” হ্যাঁ খুব করে দেখতে পাচ্ছি। পর-নারীর জানালায় তাকিয়ে কেমন ব্যায়াম করা হচ্ছে। তোমাকে বলে রাখি! আজ আপু অফিসে যাবে না।”
” তুই কিভাবে জানলি যে সন্ধ্যা আজ অফিসে যাবে না?”
” বলবো না। আগে আমার পকেট গরম করো তাহলে খবর পাবা।”
নীলিমা কোথায় নিলয় ভ্রু কুঁচকে ফেলে। আড় চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে মানিব্যাগ থেকে একশত টাকার একটা নোট দিয়ে বলে, “এবার বল।”
” আজকাল কাউকে দেখেছো? ছোট বোনকে একশত টাকা দেয়?”
” আমি কীভাবে দেখবো।”
” এত কথা জানি না। জলদি জলদি পাঁচশত টাকার নোট বের করো। নয়তো খবর এই নীলিমার মুখ থেকে বের হবে না।”
নিলয় দাঁতের দাঁত চেপে পাঁচশত টাকার একটা নোট বের করে নীলিমার দিকে এগিয়ে দেয়। নীলিমা একশত টাকা সহ পাঁচশত টাকা একসাথে হাতে নিয়ে দেয় ভৌ দৌড়। নিলয়ের কাছ থেকে দূরে গিয়ে চিৎকার বলে,
” উল্লু বানায়া বারা মাজা আয়া।”
নিলয় তাজ্জব বনে গেল। নিজের থেকে পনের বছর বয়সের ছোট বোন তাকে বোকা বানিয়ে চলে গেলে আর সে কিছুই করতে পারলো না বলে আফসোস করতে লাগলো।
নিলীমার দুষ্টুমিতে নিলয় সন্ধ্যার কথা ভুলে যায়। সন্ধ্যার জানালার দিকে আনমনে দৃষ্টিপাত করে দৃষ্টি সরাতে দেখতে পায়, কেউ একজন পর্দা একটু ফাঁকা করে তার পানে তাকিয়ে আছে। নিলয় জানে মানুষটা কে? চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে তার উদ্দেশ্যে বলে,
” অফিসে দেরি করে আসলে কিন্তু রিজাইন লেটার লিখতে হবে বলে দিলাম, মিস ঐরাবতী।”
————-
অফিসের সকলে খুবই চিন্তিত। বিশেষ করে, অফিসের পুরাতন কর্মীরা কিছু আশঙ্কায় আছে। নিলয় অফিসে প্রবেশ করে সকলের দিকে একবার তাকায়। পুরাতন কর্মকর্তাদের বিষন্ন মুখ তার চোখে এড়ায় না। কাউকে কিছু না বলে নিলয় কেবিনে প্রবেশ করে।
নিলয়কে একটা বিষয় খুব ভাবাচ্ছে। সন্ধ্যা যে লা’শের কথা বলছে সে লা’শ মূলত কার? নিলয় টেলিফোনে আকাশকে কেবিনে আসার জন্য খবর পাঠায়।
আকাশ মাত্র নিজের কাজে হাত দিচ্ছিল। নিলয়ের ফোন পেয়ে কেবিনে প্রবেশ করে।
” অফিসের সকল কর্মচারীদের লিস্ট চাই। তোমার কাছে আধা ঘণ্টা সময় আছে। উপস্থিত অনুপস্থিত সকলের খোঁজ খবর নিবে তুমি নিজে। দ্রুত।”
আকাশ সম্মতি জানিয়ে চলে যায়। সকলের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে শুকনো ঢোক গিলে বলে,
” বস আর কাউকে পেল না দায়িত্ব দেওয়ার জন্য। এই সন্ধ্যা আজকে আসছে না কেন? কই ম’রে আছে কে জানে।”
সমর পার হয়েছে কিন্তু সন্ধ্যা অফিসে আসেনি। নিলয় আপাতত সন্ধ্যাবতীর ব্যাপারটা ভাবছে না। ভাবছে সরকার বাড়ির বি’স্ফো’র’ণে’র কথা।
দরজায় কড়াঘাতের আওয়াজে নিলয়ের ভাবনায় বিচ্ছেদ ঘটে। আকাশ এসেছে হাতে একটা ফাইল নিয়ে।
” স্যার সন্ধ্যা এবং সাত্তার আঙ্কেল ব্যতীত এখানে সবাই উপস্থিত আছেন। সাত্তার আঙ্কেলের বাসায় খোঁজ নিয়েছিলাম উনি বাসায় নেই। এমনকি গতকাল রাত থেকে উনি বাসায় ফিরেনি। মানে আপনাদের বাড়ির অনুষ্ঠানের পর থেকে উনি বাসায় ফিরেনি।”
নিলয় মনোযোগ সহকারে লিস্ট গুলো দেখছে। সাত্তার সাহেব অনুপস্থিত। চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করছে সাত্তার সাহেবের চেহারা এবং সন্ধ্যার বলা সেই লাশের বর্ণনা। নিলয় চেয়ারে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়,
” আকাশ, সাত্তার সাহেব কিন্তু আমাদের অনেক পুরনো কর্মচারী। তোমার কি মনে হয় সাত্তার সাহেব নিজ ইচ্ছায় গা ঢাকা দিয়েছেন?”
” কখনোই না স্যার। উনি খুব ভালো মানুষ। পরিবারকে ভালোবাসেন। পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া একজন মেয়েও আছে।”
নিলয় কিছুক্ষণ ভেবে আকাশের উদ্দেশ্যে বলে,
” তোমাকে কিছু কাজ দিব। আশা করি নিষ্ঠার সাথে পালন করবে এবং এই কথা যেন বাহিরে কেউ জানতে না পারে।”
আকাশ এবং নিলয়ের কথার মাঝে নিলয়ের ফোনে একটি ইমেল এর প্রজ্ঞাপন আসে। নিলয়ের চোখ বড় হয়ে আসে। তরতর করে ঘামতে থাকে সে। আকাশের উদ্দেশ্যে বলে,” তুমি যাও এখান থেকে।”
আকাশ চলে যায়। নিলয় ভাবতে থাকে, তার দ্বারা এমন কাজ কীভাবে হতে পারে?
————
সে ঘটনা আর দুই মাস পার হয়ে গিয়েছে। নীরব সরকারের বাড়ি পুরোই নিস্তব্ধ। ভেতরে কোন পাখ পক্ষী আছে কিনা সন্দেহ। এদিকে আরিফ সরকারের বাড়ি একদম জীবন্ত। মানুষজনের হৈচৈ চলছে, আনন্দ ফুর্তি চলছে, বিনোদন চলছে।
আজ দুই মাস পর সন্ধ্যা ঘর থেকে বের হবে। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় এতদিন নিজেকে শক্ত করে তুলতে চেয়েছে এবং পেরেছও। অনেক হিসাব-নিকাশ বাকি আছে সেগুলো আদায় করতে হবে তার। লাল টকটকে রংয়ের একসেট থ্রি পিস পরিধান করে সন্ধ্যা, চুলগুলো মাঝখানে সিঁথি করে ছেড়ে দেয়, কপালে ছোট কালো টিপ, চোখে গাঢ় কাজল, আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। মেয়েকে তৈরি হতে দেখে সুমি এগিয়ে আসে। টেবিলের উপর থেকে কাজল নিয়ে কিছুটা কাজল সন্ধ্যার কানের লতিতে একে দিয়ে বলে,
” আমার মেয়েটার উপর কারো নজর না লাগুক। এত সাজগোজ করে কোথায় যাচ্ছো?”
” অফিসে যাচ্ছি মা। বাবা কোথায়?”
” নিজের ঘরে বিষন্ন মনে বসে আছে। আমি বুঝিনা তোদের বাবা-মেয়ের মতিগতি। দুজনই একই ধরনের। মেয়ে মানুষ থাকবে দুষ্টু মিষ্টি হাসি খুশি। কিন্তু তা না হয়ে গম্ভীরভাবে থাকিস বাবার মত। এখন তো আমার তোদের সাথে কথা বলতে ভয় করে। কখন না যেন আমাকে আঘাত করে বসিস তোরা।”
মায়ের দুঃখ ভারাক্রান্ত কথায় সন্ধ্যা মাকে জড়িয়ে ধরে প্রতুত্তুরে বলে,
” পৃথিবীর সবাই একদিকে আর তুমি বাবা একদিকে। তোমাদের জন্য আমি সব করতে পারি। কারো শত্রু হয়েও সারা জীবন বেঁচে থাকতে পারি, কারো ঘৃণার পাত্রী হয়েও সারা জীবন চলাফেরা করতে পারি। কিন্তু তোমাদের অন্তরে কখনো কষ্ট দিতে পারি না। আমি তোমাকে এবং বাবাকে খুবই ভালোবাসি তোমাকে আঘাত করার আগে যেন আমার মরণ হয়।”
” একটা দিব চড়। মরণের কথা বলে না মা!”
সন্ধ্যা মাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকে। আজ অনেকদিন পর পুরো পরিবার একসাথে সকালের নাশতা করেছে। আর তার সবকিছু কৃতিত্ব সন্ধ্যার। সন্ধ্যা যেমন নীরব সরকারের কথা মানে, ঠিক তেমন নীরব সরকার মেয়ের কথা শুনে। সন্ধ্যা নিজে বাবাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে খাবার টেবিলের পর্যন্ত নিয়ে আসে। অনেক বছর পর হাসিখুশি হৈ-হুল্লোড়ে সকালের নাশতা গ্রহণ করে সবাই।
নিলয় ফোনে কথা বলছিল একজন ডিলারের সাথে। আনমনে সিঁড়ির দিকে তাকাতেই নিলয়ের চোখ আটকে যায়। ব্যস্ত পায়ে একজন লাল পরী কানে দুল পরতে পরতে নিচে নামছে। নিলয় হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সে পরীর দিকে। নিলয়ের মা আসছিলেন ছেলের সাথে দুইটা কথা বলতে। ছেলেকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে। ছেলের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকায়।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নিচে নেমে আসে। চলাচলের দিকে অমনোযোগী থাকায় ধাক্কা খায় নিলয়ের মায়ের সাথে। চঞ্চল সন্ধ্যাবতীর ছোটবেলার চঞ্চলতা চলে আসে মুহূর্তে।
” মাফ করে দাও বড়ো মা! এত সুন্দর করে সাজগোজ করেছি কানের দুল না পরলে হয় নাকি? তুমিই তো আমাকে সবসময় বলতে, কানের দুল ছাড়া আমাকে বিধবা বিধবা লাগে। এই যে দেখো, আজ কানের দুল পরতে গিয়ে কি করে ফেললাম!”
সন্ধ্যার চঞ্চলতা দেখে নিলয়ের হাত থেকে ফোন প্রায় পড়েই গিয়েছিল। এদিকে নিলয়ের মায়ের চোখে জল চলে আসে। আজ এত বছর পর সন্ধ্যার বড়ো মা ডাক শুনে। তিনি নিজেকে আটকে রাখতে পারলেন না জাপটে ধরলেন সন্ধ্যাকে।
” আমার মেয়েটা সেই আগের মতই রয়ে গেছে। কেন এত দূরত্ব রাখছিস বলতো? আমার সাথে কথা বল! আমি তো তোর বড়ো মা। আমাকে না মা বলে ডাকিস? মায়ের সাথে কি কেউ রাগ করে থাকে?”
সন্ধ্যা নিজের কৃত্রিম সত্তাকে কিছু সময়ের জন্য ভুলে গিয়েছিল। বড়ো মায়ের সামনে সেই ছোট্ট বাচ্চা হয়ে গিয়েছিল। নিলয়ের মায়ের জড়িয়ে ধরার পর সন্ধ্যার চিন্তন ফিরে আসে। কপালে কারো অধরের স্পর্শ পেয়ে সন্ধ্যা সেদিকে চিন্তন করে। নিলয়ের মা তাকিয়ে আছে হাস্যজ্জল মুখে, চোখের জল চিক করছে।
” আর রাগ করে থাকিস না মা! অন্ততপক্ষে আমার সাথে কথা বল? আমি আমার সেই দুষ্টু মিষ্টি সন্ধ্যাবতীকে দেখতে চাই। এমন গম্ভীর্য তোকে একটুও মানায় না।”
সন্ধ্যাবতী কিছু বলছে না। আড়চোখে নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বড়মার উদ্দেশ্যে বলে,
” আমি যার তার সামনে কথা বলি না। তোমার ছেলেকে আগে বাহিরে পাঠাও। তারপর তোমার সাথে কথা বলব।”
নিলয়ের ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে ফোনে কল আসার বাহানায় কানে ফোন নিয়ে হ্যালো হ্যালো করতে করতে বাহিরে চলে যায় সে।
নিলের মা এবং সন্ধ্যা হাসছে নিলয়কে নিয়ে।
সন্ধ্যা এবার বড়ো মার উদ্দেশ্যে বলে,
” দুপুরে এসে তোমার হাতের গরুর কালা ভুনা খাব। এখন অফিসে যাচ্ছি। তোমার হিটলার ছেলের অত্যাচার সহ্য করতে।”
” আচ্ছা যা। নিলয়ের সাথে যাস।”
নিলয় মায়ের কথা শুনে সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে যায়। সদর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
” তোমার ওই ছেলের সাথে যেতে আমার বয়েই গেছে। নিজে যেমন আমাকেও তেমন বানাতে চায়।”
” আমার ছেলে কিন্তু খুব ভাল। তোর ক্ষতি করতে চাইবে না।”
—————
গাড়িতে বসে আছে দুইজন। উভয়েই নিশ্চুপ, সন্ধ্যা চেয়েছিল দৈনন্দিন এর মত অফিসে যেতে কিন্তু নিলয় তা হতে দিল না। সন্ধাকে টেনে গাড়ির ভেতর নিয়ে আসে। সন্ধ্যা নিলয়ের দিকে তাকাচ্ছে না। কঠোর দৃষ্টিতে সম্মুখে তাকিয়ে আছে। নিলয় আজ গাড়ি চালাচ্ছে না। সে সন্ধ্যার ধৈর্য পরীক্ষা করবে। কতটুকু সময় সন্ধ্যা নিলয়কে সহ্য করতে পারে তা দেখে ছাড়বে।
সন্ধ্যার নিলয়ের সঙ্গ ভালো লাগছে না তাই সে বিরক্ত হয়ে নিলয়ের উদ্দেশ্যে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
” এভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন? আমি মানুষ, খাবারের বস্তু নই যে লোভনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন। গাড়ি চালান। অফিসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
সন্ধ্যার ঝাঁঝালো কথা শুনে নিলয়ের ঠোঁটে হাসি ফোটে উঠে। গাড়ি স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে প্রত্যুত্তরে বলে,
” অফিসের বস তুমি না আমি? নিলয় নীলাভ সময়ের ব্যবহার করতে জানে।”
” আর সন্ধ্যাবতী সেই সময়ের সদ্ব্যবহার করতে জানে।”
” অবশেষে তুমি ফিরে এলে মিস ঐরাবতী! এখন কি করবে? রিজাইন লেটার লিখবে নাকি অফিসে কাজ করবে।”
” অন্যান্য কর্মচারীরা যেমন ভাবে চলাফেরা করে আমি ঠিক সেভাবে চলব। অন্যান্য কর্মচারীদের সাথে দুই মাস পর যে ব্যবহার করবেন আমার সাথেও তাই করবেন।”
নিলয় গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সন্ধ্যার দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে বলে, ” তোমার চোখ আজকে অন্য কথা বলছে, মিস ঐরাবতী।”
সন্ধ্যা প্রস্তুত ছিল না নিলয়ের এহেন কাণ্ডে। নিলয় কাছে আসায় সন্ধ্যার অন্তর কেঁপে ওঠে, অস্বস্তি হতে থাকে। ইতস্তুত বোধ করে সে বলে,
” কি বলছে?”
” আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো না তো ঐরাবতী?
জানো তো মিস ঐরাবতী! তোমার দুই চোখে নিজের ধ্বংস দেখতে বেশ লাগে। কি আছে তোমার ওই দুই চোখে? বাঘিনীর চোখ হয়তো হার মানবে। তোমার ওই চোখের জালে ভেসে যাবে পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিক পুরুষ। তবে আমি তাকাবো না তোমার ওই চোখে, কেননা আমি চাইনা খুন হতে।”
সন্ধ্যা হাসে। নিলয়ের থেকে কাছে গিয়ে বলে,
” আগুন নিয়ে খেলা আপনি শুরু করেছেন সমাপ্ত করব আমি। আগুনে পুরে ভষ্ম হবেন কিন্তু উড়ে যাবেন না।”
চলবে……..
#সন্ধ্যালয়ের_প্রণয়
#আফসানা_মিমি
| অষ্টম পর্ব |
❌[কোনোভাবেই কপি করা যাবে না]❌
আকাশে মেঘ জমেছে। এই বুঝি বৃষ্টি নামবে। সন্ধ্যার আগমনে অফিসের সকলেই আনন্দিত। ডেক্সে বসতেই সকলেই এগিয়ে আসেন সন্ধ্যার সাথে দেখা করতে। নিলয় মনিটরে সব কিছুই পর্যবেক্ষণ করছে। সন্ধ্যাবতী হেসে হেসে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করছে। নিলয়ের হাতে আজ নতুন প্রজেক্ট এসেছে। সকালে এক ডিলারের মাধ্যমে প্রবীন এক কোম্পানি কাজ করতে রাজি হয়েছে। সন্ধ্যা লগনে দুই কোম্পানির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে।
নিলয়ের দেওয়া কাজ সমাপ্ত করে মাত্র আকাশ অফিসে প্রবেশ করেছে। সন্ধ্যার ডেক্সের সামনে ভীর দেখে মন আনন্দে নেচে উঠে। হাতের ফাইল নিচে ফেলে দিয়ে প্রফুল্লবাবু সেজে ভীড় ঠেলে সন্ধ্যার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। সন্ধ্যাবতী প্রস্তুত ছিল না। আকাশের পিঠে দুরুম দারুম থাপ্পড় বসিয়ে একপাশে টেনে নিয়ে আসে,
” আজ তোকে জীবন্ত কবর দিব আক্কাইস্সা। যখন তখন আমাকে জড়িয়ে ধরিস কেন? আমি তোর প্রেমিকা হই নাকি?”
” আর মারিস না মেরি মা! আমি তো আনন্দের ঠ্যালায় তোকে জড়িয়ে ধরেছি। তুই তো জানিসই আমি তাকেই ভালোবাসি। তুই তো আমার জানের বন্ধু।”
” ভালোবাসিস না ছাই! একজনকে ভালোবাসবি আর আমাকে জ্বালাবি।”
” মাইন্ড করিস না। কতদিন পর তোকে দেখেছি। আবেগ কন্ট্রোল করতে পারিনি। বল কেমন আছিস?”
” ভালো আছি।”
সন্ধ্যাবতী কী আদৌও ভালো আছে? নিলয় মনিটরে সন্ধ্যাকে লক্ষ্য করছিল। হঠাৎ মনে হলো সন্ধ্যাকে কিছু সময় রাগানো হয়নি। নিলয় সন্ধ্যাকে জ্বালাতন করার বুদ্ধি এঁটে বাঁকা হেসে সন্ধ্যাকে ফোন করে।
সন্ধ্যা আকাশের সাথে কথা বলছিল তখন মুঠোফোন বেজে উঠায় নিজের ডেক্সের দিকে যায়। ফোনের স্কিনে অসভ্য দুর্লয় নামটা ভেসে ওঠে। সন্ধ্যা বিরক্ত হয়, ফোন রিসিভ করে কানে নিয়ে বলে,
” রাজার আসনে বসে কী হুকুম করতে চাইছেন শুনি?”
সন্ধ্যার ত্যাড়াবাঁকা কোথায় নিলয় হাসে। গম্ভীর স্বরে বলে,
” মুখ সামলে কথা বলুন মিস ঐরাবতী। এখনই আপনি আমার কেবিনে আসবেন। আর হ্যাঁ! অবশ্যই নিজ হাতে বানানো দুই কাপ কফি সাথে করে নিয়ে আসবেন।”
কল কেটে যায়, সন্ধ্যার মেজাজ খুবই খারাপ হয়। সন্ধ্যা খুব সুন্দর কফি বানাতে পারে। নিলয়কে জব্দ করার জন্য সন্ধ্যাবতীর মাথায় একটা দারুন প্ল্যান আসে। সন্ধ্যা জানে নিলয় কফির সাথে আধা চা চামচ চিনি খায়। অতিরিক্ত সুগারে নিলের সমস্যা হয়। সন্ধ্যা নিলয়কে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য কফির কাপে প্রায় চার পাঁচ চামচ চিনি ঢেলে দেয়।
নিলয়ের কেবিনের সামনে এসে অভ্যাস মোতাবেক প্রবেশ করতে নিলেই পূর্বের নিলয়ের করা ব্যবহার মনে পড়ে যায়। হাতে কফির ট্রে বিধায় একটু জোরেই অনুমতি চায় সে,
” আসবো?”
” কে?”
সন্ধ্যার রাগ উচ্চ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দেয়,
” ঢং না করে দরজা খুলুন। আমার দুই হাত বন্ধ।”
নিলয় হাসে। সন্ধ্যার কথা শুনে মনে হচ্ছে পাক্কা গৃহিণী। নিলয় নিজে এসে দরজা খুলে দিয়ে চেয়ারে এসে বসে। সন্ধ্যা মুখে ভেংচি কেঁটে টেবিলের উপর কফির ট্রে রাখে।
” আপনার কফি। দুটোই খান। গিলে গিলে খান, গলা ভর্তি করে খান। আমি এখন যাই।”
” আমি কি আপনাকে যেতে বলেছি, মিস ঐরাবতী? বসুন, আমার একটা বদ অভ্যাস আছে, একা একা কফি পান করতে পারি না। সঙ্গর প্রয়োজন। আজ না হয় আপনি আমার সঙ্গী হয়ে পাশে বসে কফি পান করেন।”
সন্ধ্যা এটাই চাইছিল। নিজ চক্ষে নিলয়ের অস্থিরতা দেখবে আর মজা নিবে। নিলয় কফির কাপে চুমুক দিতেই ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে। সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যা মুচকি হাসছে। নিলয় বুঝতে পারে সন্ধ্যা ইচ্ছে করেই কফিতে চিনি মিশিয়েছে। সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলে, ” কফি ঠিক আপনার মত তেতো হয়েছে, মিস ঐরাবতী।”
সন্ধ্যা ভরকে যায়। নিজের কফিতে চুমুক দিয়ে পরীক্ষা করে নেয়, কাপ অদলবদল হলো কি না। সঠিক কাপ নিলয় নিয়েছে এবং মজা করে খাচ্ছে। তার দৃষ্টি সন্ধ্যার দিকেই নিবদ্ধ। সন্ধ্যা শুকনো ঢোক গিলে। নিলয় শাস্তি দিবে ভেবে এক নিশ্বাসে কফি পান করে ফেলে।
” আমার হয়ে গেছে। অনেক কাজ বাকী আছে। আমি যাই?”
নিলয়ের শরীর খারাপ করছে। অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়ার ফলে পেটের ভেতর সব গুলিয়ে যাচ্ছে যেন এক্ষুনি বমি করে দিবে। সন্ধ্যার কথার প্রত্যুত্তরে “বসো” বলে চলে যায় ওয়াশরুমে।
প্রায় পাঁচ মিনিট পর নিলয় বের হয়ে আসে। সন্ধ্যা চেয়ারে বসে তখন দাঁত দিয়ে নখ কাটছিল। নিলয়কে দেখে সে দাঁড়িয়ে যায়। নিলয় ঢুলুঢুলু শরীরে কোনরকম কেবিনের একপাশে রাখা বড়ো সোফায় গা এলিয়ে দেয়। সন্ধ্যা এবার প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। আলগোছে নিলয়ের দিকে এগিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
” আমি দুঃখিত অসভ্য দুর্লয়। আমি দুষ্টুমির ছলে আজ একটু বেশিই করে ফেলেছি।”
নিলয় হাসে। দুর্বল স্বরে প্রত্যুত্তরে বলে,
” প্রতিশোধ নিলে?”
” একদম না।”
” তাহলে আমার কষ্ট দেখে আনন্দ পেলে?”
” ইয়ে মানে,,,,,
বমি করায় নিলয় অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। মাথায় সন্ধ্যার হাতের উপর হাত রেখে বলে, ” মাকে ফোন করে আসতে বলো।”
সন্ধ্যা তাই করতে যায়। নিলয়ের কাছ থেকে উঠে বড়ো মাকে ফোন করবে বলে কেবিন থেকে বের হতে নেয়। তখনই নিলয়ের দুর্বল স্বর আবারো সন্ধ্যাবতীর কর্ণধারে আসে।
” দাঁড়াও সন্ধ্যাবতী! আগে শাস্তি স্বরূপ বাথরুম পরিষ্কার করে নাও। না করলে ডাবল শাস্তি হবে।”
সন্ধ্যা রেগে যায়। কিছুক্ষণের জন্য নিলয়ের জন্য মনে আসা মায়াকে বিসর্জন দিয়ে বকতে বকতে চলে যায় বাথরুমে।
চলবে……
———–