#সন্ধ্যালয়ের_প্রণয়
#আফসানা_মিমি
| সতেরো তম পর্ব |
❌[কোনোভাবেই কপি করা যাবে না]❌
প্রভাতীর লগনে প্রকৃতির পরিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে দুজন। মাথার উপর ঝাঁক ঝাঁক বেঁধে পাখিরা নিজ গৃহে থেকে খাবারের সন্ধানে যাচ্ছে কিন্তু দুই মানব মানবীর বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই নিজের কর্মস্থলে ফিরে যেতে।
শহরের সেই পুকুরের পাড়ে পা ভিজিয়ে বসে আছে নিলয় এবং সন্ধ্যাবতী। সন্ধ্যার মন বিষন্নতায় ঘিরে আছে। সারারাত দুজন একসাথে এই পুকুর পাড়ে বসে। নিলয় সন্ধ্যাকে কোন সেই ঘটনার পর আর কোন প্রশ্ন করেনি। সে জানে সন্ধ্যা নিজ থেকেই তাকে সব বলবে। অবশেষে সেই সময় আসে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সন্ধ্যার ভয়ও কেটে যায়। দূর আকাশের নীলিমায় তাকিয়ে সন্ধ্যা মনের অবক্তব্য প্রকাশ করে।
” আপনি জানেন রাব্বি বেঁচে আছে?”
” মরলে তো বেঁচে থাকবে?”
সন্ধ্যা বিরক্ত হয়। তার পাশে বসে থাকা অসভ্য দুর্লয় সবসময়ই পাল্টা প্রশ্ন করে। সন্ধ্যার ইচ্ছে করে তখন তাকে গলা টিপে ধরতে। কিন্তু নেহাতই বড়ো ভাই এবং সবচেয়ে কাছের বন্ধু নয়তো সন্ধ্যার ভাবনার কাজ করে ফেলতে দু-দণ্ড সময় ব্যয় করতো না।
” ত্যাড়াবাঁকা কথা বললেই নয় কী?”
নিলয় হাসে। সন্ধ্যা তাকে লক্ষ্য করে ভেবে মনে প্রশান্তি অনুভব করে।
” সেদিন রাব্বির কিছু হয়নি। যেই লোককে আমি তুমি এবং সবাই দেখেছিল সে অন্যকেউ ছিল। সারামুখে র’ক্ত ছিল বিধায় আমরা কেউ চিনতে পারিনি।”
” রাব্বি কেন এমন করেছিল?”
” সেটা তুমিই জানো।”
সন্ধ্যা ক্ষেপে গিয়ে নিলয়ের পিঠে দুরুম করে কিল বসিয়ে দেয়।
” আমি কীভাবে জানবো। আমি তো আপনার সাথেই ছিলাম। বলুন না!”
” এত জানার আগ্রহ ভালো না সন্ধ্যাবতী।”
সন্ধ্যা কিছুটা অভিমানী হয়ে অন্যদিকে ফিরে বসে। নিলয়ের কাছে মুহূর্তটা অসাধারণ লাগছে। সন্ধ্যাকে এখন কোথাও লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে।
নিলয় সন্ধ্যাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে এনে বলে,
” আপনজনের সাথে অভিমান করা যায় মিস ঐরাবতী। আমি কী আপনার আপনজনের কাতারে পড়ি?”
” না।”
সন্ধ্যা দুষ্টুমি ভরা হেসে মুখ ফিরিয়ে বসে রয়। নিলয় হাতের বন্ধনীতে দৃষ্টিপাত করে সময় দেখে নেয়। বসা থেকে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,
” এই মুহূর্তে বাড়ি ফেরা সম্ভব না সন্ধ্যা। চলো অফিসে যাই। আজ রাফসানদের সাথে জরুরী কাজ আছে।”
সন্ধ্যা তাই করে।
—————————–
কাল পরিবর্তনের সাথে সাথে নিলয়ের কোম্পানীরও পরিবর্তন ঘটে। সন্ধ্যা নিজ পরিশ্রম এবং সাফল্যতায় নিলয়ের বরাবরের পদ পায়। প্রায় একমাস আগে আরিফ সরকার অফিসিয়ালিভাবে সন্ধ্যাকে কোম্পানির দায়িত্ব দেন যতটুকু দায়িত্ব নিলয়কে দেওয়া হয়েছিল। আজকাল সন্ধ্যা নিজের মরজিতে চলাফেলা করে। নিলয়ের সাথে কথা বলার সময়টুকু তার নেই।
ঘড়িতে সময় নয়টা বাজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। নিলয় এখনো বিছানায় শুয়ে। চোখ থেকে ঘুম সরছেই না। রেহানা ছেলের নড়চড় না দেখে চিন্তায় পড়ে গেলেন। ঘরে এসে ছেলের কপোলে হাত রেখে পর্যবেক্ষণ করেও হতাশ হলেন। জ্বর নেই তবে এত সকাল অব্দি ঘুমানোর কারণ কী? ছেলের পাশে বসে কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
” মা! বাবা কী কাজে কখনো অবহেলা করেছে?”
রেহেনা বেগম নিঃশব্দে হাসেন। ছেলের মাথায় আরেকটু গভীরভাবে হাত বুলিয়ে বলেন,
” তোর বাবার কাজ আগে ছিল। তিনি কাজের প্রতি অনেক দৃঢ়তার সাথে পালন করতেন ঠিক তোমার মতো।”
” আমি বাবার মতো হতে পারিনি মা! এই দেখো, আজ প্রথম আমি আমার কাজকে অবহেলা করেছি।”
” তোর কী শরীর খারাপ?”
” না তবে বল পাচ্ছি না।”
“তৈরি হয়ে নে।”
রেহেনা চলে যায়। ছেলের হতাশায় নিজেও চিন্তিত হয়।
অফিসে পৌঁছে নিলয় সন্ধ্যাকে রাফসানের সহিত খোশগল্প করতে দেখতে পায়। হাতের বন্ধনীতে তখন সময় দেখে নেয় সে। এই সকালে রাফসানকে এখানে দেখে নিলয় ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। সন্ধ্যা এতোটাই রাফসানের প্রতি মশগুল যে নিলয়ের আগমনের আভাসও পায়নি। নিলয়ের রাগ হয় নিজের কেবিনে প্রবেশ করে একটু জোরেই দরজা আটকে দেয়।
পাঁচ মিনিট পর সন্ধ্যা দুই মগ কফি হাতে নিলয়ের কেবিনে প্রবেশ করে। নিলয় তখন কম্পিউটারে কি যেন দিখছিল। সন্ধ্যার আগমনে তার মনোযোগ কম্পিউটার থেকে বিন্দু পরিমাণ সরেনি।
” আজ এতো দেরি করলেন যে?”
নিলয় নিশ্চুপ হয়ে ল্যাপটপের কিবোর্ডে কিছু একটা চেপে যাচ্ছে। নিলয়ের পক্ষ থেকে কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে সে আবারও বলে,
” মিস্টার রাফসান আপনার সাথে দেখা করবে বলে অপেক্ষা করছে। শুনছেন! কফি এনেছি।”
” আমি এখন ব্যস্ত। কফি টেবিলের উপর রেখে যেখান থেকে এসেছেন আবার সেখানে ফিরে যান। এমন যেন না হয়, আপনি এখানে থাকলে আমি খারাপ কিছু করে বসি।”
সন্ধ্যার ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। নিলয়ের রাগের কারণ সে বুঝতে পারছে না। মনে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে সন্ধ্যা নিলয়ের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালে নিলয় কাঁধে হাত রাখতেই নিলয় চেয়ার ঘুরিয়ে সন্ধ্যার হাত ধরে নিজের কোলে এনে বসায়। সন্ধ্যার হাত শক্ত করে ধরায় সে খুব ব্যথা পায়। সন্ধ্যার চোখে পানি চলে আসে। সন্ধ্যা কিছুটা আর্তনাদ করে বলে,
” আঘাত করছেন কেন? আমি কি করেছি?”
” আপনি খুব ভালো করে জানেন। আমার রাগের আপনার ধারণা আছে মিস ঐরাবতী। আমার রাগ হলে আমি কাউকে মানি না। আপন পর কেউ আমার সামনে কিছুই না। তবুও কোন সাহসে আপনি আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছেন? আপনি কি বুঝতে পারছেন না! আমি অনেক রেগে আছি। একবারও কি জিজ্ঞেস করেছেন কেন আমার এই অবস্থা?”
” আপনার মনের ভেতর কী ঢুকে বসে আছি? আমি দাদার কাছে বিচার দিব। আপনি একটু বেশি বেশি করছেন।”
” যার কাছে ইচ্ছা তার কাছে নালিশ কর। আমি কাউকে ভয় পাই না। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরো না সন্ধ্যাবতী! আমি ভালোর ভালো, খারাপের খারাপ।”
সন্ধ্যার চোখে জল চিকচিক করছে, ঠোঁটগুলো তিরতির করে কাঁপছে, কপালের ভ্রু যুগলের মাঝে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফুটে উঠেছে। নিলয় রাগ কমে আসে। সন্ধ্যার জলের টুইটুম্বর হয়ে যাওয়া আখিদ্বয়ের গভীরে ডুব দেয় সে। নিলয়ির কি হয় নিজেও জানে না। সে একটু নিচে হয়ে সন্ধ্যার চোখে অধর ছুঁয়ে দেয়।
এদিকে সন্ধ্যাবতী নিস্তব্ধ বনে যায়। নিলয়ের পক্ষ থেকে এমন কিছু আসে কখনো করে নি সে।
নিলয় সন্ধ্যাকে ছেড়ে দেয়। টেবিলের উপরে রাখা কফির কাপে চুমুক এঁকে বলে,
” আমার আপনজনকে নিজের আশেপাশে রাখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি।”
সন্ধ্যা কোন প্রত্যুত্তর করে না। নিলয়ের কেবিন থেকে কিছু না বলেই বের হয়ে যায়। সে এখন একটি ঘোরের মধ্যে রয়েছে। মনে হচ্ছে জীবনে নতুন কিছু আগমন ঘটতে চলছে।
————
সুমি নীরবের সামনে বসে আছে। নীরবের কঠোর আদেশ পালনে নাকজ করছে সে। সুমির শত অনুরোধ নীরবের কাঠিন্য মন গলাতে পারেনি। অবশেষে সুমি নীরবের উদ্দেশ্যে বলে,
” তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে ওয়াদা করেছিলাম, সুখে, দুঃখে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার পাশে থাকব।”
” তো ওয়াদা পূরণ করো।”
” তোমার কষ্ট হচ্ছে না নীরব? আপনজনদের বিরুদ্ধে এমন ঘৃণিত কাজ করতে?”
নীরব সরকার মুখ ফিরিয়ে নেয়। হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে জানালার পাশে গিয়ে বলে,
” তারা আমার সাথে এর চেয়েও জঘন্য কাজ করেছে সুমি। আজ আমার অপারগতা বলে তুমিও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? সামান্য কাজই তো দিয়েছি। তোমায় শুধুমাত্র এই কাগজগুলো তাদের কাছে পৌঁছে দিতে বলেছি। তুমি সেখানে যাবে আর আসবে। তোমার সাথে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকবে। আমি এ কাজটা সন্ধ্যাকে দিতে পারতাম কিন্তু সে একজন জ
যুবতী মেয়ে একা সেখানে গেলে বিপদ হতে পারে।”
প্রিয়তম স্বামীর কথা শুনে সুমির তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। চোখের পানি মুছে কাতার স্বরে বলে,
” তোমার কাছে মেয়ে প্রিয়, স্ত্রী নয়। তা আবারও তুমি প্রমাণ করলে নীরব। আসছি, নিজের খেয়াল রেখো।”
সুমি চলে যেতেই নিরব গভীর নিঃশ্বাস ফেলে
হাতের মুঠে রাখা একটা লকেট বের করে সেখানে সুমির ছবির উপর হাত বুলায়, বিড়বিড় করে বলে,
” পরিস্থিতি আমাকে কঠোর হতে বাধ্য করেছে সুমি। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু যখন আমার পঙ্গুত্ব জীবনের কথা মনে হয় ততবারই মনে হয় তোমার পাশে আমাকে মানায় না। এজন্যই তো খারাপ ব্যবহার করি। তোমাকে কষ্ট দেই।”
————
দুপুর থেকে নিলয় সন্ধ্যার তলব করে যাচ্ছে কিন্তু সন্ধ্যার কোন খোঁজ খবর নেই। নিলয় সন্ধ্যার কাছে ক্ষমা চাইবে। নিজের ইমোশনালকে কন্ট্রোল করা উচিত ছিল তার। নিলয় ভাবছে সন্ধ্যা হয়তো সকালের ব্যবহারটা মেনে নিতে পারছে না। নিলয়ের মনে ভয়ের বাসা বাঁধে। সন্ধ্যা যদি তাকে ভুল বুঝে! যদি দূরে সরে যায়! নিলয় তো তা সইতে পারবে না।
নিলয় অফিস থেকে বের হবে এমন সময় কিছু পুলিশ এবং কিছু স্যুটবুট পরিহিত লোক অফিসের প্রবেশ করে। নিলয় কিছু বলবে তার আগেই পিছন থেকে একজন মেয়ের শক্ত স্বর শোনা যায়। সে বলছে,
“আপনারা যেই অপরাধীর খোঁজ করছেন সে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিস্টার নিলয় নীলাভ। এই লোক ই সরকার কোম্পানির সকল টাকা আত্মসাৎ করেছে। ”
নিলয় অবিশ্বাস্য চোখে মেয়েটির দিকে তাকায়। এরপর পুলিশদের কিছু বলবে তার আগেই নিলয়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয় একজন পুলিশ। এরপর সেখান থেকে টেনে নিয়ে যায় অফিসের বাহিরে।
চলবে……….