সন্দেহের কাঁটা পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
5

#সন্দেহের_কাঁটা।
পর্ব:- পাঁচ।(শেষ)
লেখা:- সিহাব হোসেন

তৌফিক নাসিমার বাসায় বসে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিল। নাসিমা তার ঘুমন্ত সন্তানকে বিছানায় শুইয়ে রেখে তৌফিকের কাছে এসে বলল,
– “দেখো, তোমার ছেলেটা একদম তোমার মতোই দেখতে হয়েছে।”
– “বা*জে কথা না বকে কীজন্য ডেকেছো, সেটা বলো।” তৌফিকের কণ্ঠে ছিল তীব্র অধৈর্য।

নাসিমা কিছু বলতে যাবে, ঠিক তার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। সে দরজা খুলতেই দেখল, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই মিলে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন সোজা ঘরে ঢুকে তৌফিককে দেখেই প্রশ্ন করল,
– “এই ছেলে কে? আর এখানে কী করছে?”
নাসিমা থতমত খেয়ে বলল,
– “ও… ও আমার স্বামী।”
– “কিন্তু এর প্রমাণ কী?”

নাসিমা যখন কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন তৌফিক সুযোগ বুঝে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করল। কিন্তু উপস্থিত জনতা তাকে ধরে ফেলল এবং নানারকম জেরা করতে শুরু করল। ঠিক সেই উত্তপ্ত মুহূর্তে, রাহুল আর শ্রেয়া তৌফিকের বাবা-মাকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো। রাহুল তৌফিকের বাবার কাছে পুরো ঘটনা খুলে বলল। সব শুনে তিনি রা*গে, অপ*মানে ছেলের গালে ক*ষে এক থা*প্পড় মা*রলেন। তারপর সবার উদ্দেশ্যে হাতজোড় করে বললেন,
– “আপনারা কেউ কোনো চিন্তা করবেন না। আমি এদের বিয়ের ব্যবস্থা করছি।”
সেখানেই কাজি ডেকে তৌফিক আর নাসিমার বিয়ে দেওয়া হলো। অবশেষে, শ্রেয়ার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার সফল সমাপ্তি ঘটল।

রাহুল আর শ্রেয়া বাসায় ফিরে এল। কিন্তু ঘরের পরিবেশ ছিল থমথমে। শ্রেয়া কোনো কথা না বলে নীরবে নিজের ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। রাহুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “তুমি ব্যাগ গোছাচ্ছ যে?”
– “থাকব না আর এখানে, যতক্ষণ না তুমি নিজেকে পুরোপুরি শুধরে নিচ্ছ।”
– “আমি তো বলেছি, আর কখনো এমন করব না।”
– “আগেও এটাই বলেছিলে, কিন্তু ঘুরেফিরে আবার সেই একই কাজ করেছো। তাই আর নয়।”

রাহুল মরিয়া হয়ে শ্রেয়ার হাত চেপে ধরল। কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল,
– “প্লিজ, যেও না। আমি কথা দিচ্ছি, আর কখনো এমন হবে না।”
– “আমি তোমাকে আর বিশ্বাস করি না।”

রাহুল অনেক অনুনয়-বিনয় করল, কিন্তু শ্রেয়ার মন গলল না। তার ভেতরের বিশ্বাসটা এমনভাবে ভেঙে গিয়েছিল যে, কোনো প্রতিশ্রুতিই আর তাকে আটকাতে পারল না। সে সোজা তার বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

শ্রেয়া চলে যাওয়ার পর রাহুলের পৃথিবীটা যেন শূন্য হয়ে গেল। তাকে ছাড়া এক মুহূর্তও তার ভালো লাগছিল না। প্রতিটি কোণে শুধু শ্রেয়ার স্মৃতি। সে তীব্রভাবে উপলব্ধি করতে পারল, জীবনে সে কত বড় ভুল করে ফেলেছে। কোনো উপায় না পেয়ে সে তার বাবা-মাকে ফোন করে সবটা খুলে বলল। খবর পেয়ে তারা আর এক মুহূর্তও দেরি না করে ছুটে এলেন ছেলের কাছে।
রাহুলের মা ছেলেকে দেখেই ব*কাঝকা শুরু করলেন,
– “তোকে কতবার বলেছিলাম, বন্ধুদের ঘরে আনবি না! তারপরও কেন এনেছিস?”
রাহুলের বাবা গম্ভীর গলায় বললেন,
– “বন্ধু থাকবে বাইরে, ঘরের ভেতরে ওদের নিয়ে কিসের আড্ডা? তোকে কি এইজন্য তাড়াতাড়ি বিয়ে করিয়েছি যে, ঘরে বন্ধু এনে বউয়ের সাথে মিলে আড্ডা দিবি? দিন-দুনিয়ার পরিস্থিতি দেখেও তোর হুঁশ নেই! আজকাল পরকীয়া কতটা বেড়ে গেছে, আর তার বেশিরভাগই গড়ে ওঠে স্বামীর বন্ধুদের সাথে। এতকিছু জেনেও তুই অবুঝের মতো কাজ করলি!”
– “বাবা, আমি তো তৌফিককে খুব বিশ্বাস করতাম। কখনো ভাবিনি ও এমন করবে।”
রাহুলের বাবা রে*গে গিয়ে বললেন,
– “বিশ্বাসের কথা বলিস? মনে রাখবি, বাবা-মা আর নিজের স্ত্রী ছাড়া এই দুনিয়ায় কেউ তোর ভালো চাইবে না। আর স্ত্রীর কথা উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, একজন সৎ স্ত্রী থাকলেই সে তোর ভালো চাইবে, নইলে নয়।”
– “বাবা, আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো এমন হবে না।”
রাহুলের মা এবার একটু নরম হয়ে বললেন,
– “এজন্যই তোকে ওই তৌফিকের সাথে মিশতে বারণ করতাম। কিন্তু তুই তো আমার কথা কানেই তুলতি না। তোর এমন একটা পরিণতি হওয়ারই দরকার ছিল। শ্রেয়া মেয়ে হিসেবে এই যুগের তুলনায় অনেক ভালো। তা না হলে সেও হয়তো ওই ছেলের হাত ধরে চলে যেত। যাই হোক, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে, আমরা আজই শ্রেয়াকে আনতে যাব।”

সেদিন বিকেলে রাহুল তার বাবা-মাকে নিয়ে শ্রেয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। তার মনে একটাই চাওয়া, শ্রেয়া যেন তাকে ক্ষমা করে দেয়, আর একবার সুযোগ দেয় তাদের ভালোবাসার সংসারটাকে নতুন করে গড়ে তোলার।

শ্রেয়ার বাড়িতে পৌঁছানোর পর তাদের সবাইকে খুব আন্তরিকভাবে আপ্যায়ন করা হলো। এরপর সবাই যখন ড্রয়িংরুমে একসঙ্গে বসল, তখন পরিবেশটা ভারী হয়ে উঠল। রাহুল মাথা নিচু করে তাদের মধ্যে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঝামেলার কথা খুলে বলল। সবটা শুনে শ্রেয়ার বাবা শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বললেন,
– “শ্রেয়া যা করেছে, তা তুমিই তাকে করতে বাধ্য করেছো।”
– “হ্যাঁ, আমি জানি আমার ভুল হয়েছে।” রাহুলের কণ্ঠে ছিল গভীর অনুশোচনা।

এবার শ্রেয়ার মা মেয়ের দিকে ফিরে বলতে শুরু করলেন,
– “কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তুই কোনো ভুল করিসনি। রাহুল যতটা ভুল করেছে, তুই তার চেয়েও বড় ভুল করেছিস। রাহুল যখন তার বন্ধুদের বাসায় নিয়ে আসত, তুই বারণ করার পরও যখন সে শোনেনি, তখন আমাদের বা রাহুলের বাবা-মাকে একবার জানাতে পারলি না?”
শ্রেয়া মাথা নিচু করে বলল,
– “তোমরা সবাই টেনশন করবে, তাই কাউকে কিছু বলিনি।”
শ্রেয়ার মা আবার বলতে লাগলেন,
– “আমরা টেনশন করব, এই ভেবে তুই জেদের বশে পর্দা করা, নামাজ পড়ার মতো ফরজ কাজগুলো ছেড়ে দিবি? তুই কি ইসলাম সম্পর্কে জানিস না? ফরজ বিধান মানতে যে বা যারাই নিষেধ করুক, তাদের কথা অমান্য করা যায়, কিন্তু ফরজ বিধান ছাড়া যায় না। নিষেধকারী ব্যক্তি তোর স্বামী হোক, বা তোর নিজের বাবা-মা-ই হোক, এই বিধান সবার জন্য একই।”
– “আমি সব জানি, মা। আমি শুধু তৌফিকের আসল রূপটা সবার সামনে আনতে চেয়েছিলাম।”
– “ওর আসল রূপ সামনে আনার জন্য তোকে মডার্ন হতে কে বলেছে? ওর সাথে মিশতে কে বলেছে? একবার আমাদের জানালে রাহুলের চোখ আমরাই খুলে দিতাম। কিন্তু তুই তো সেই পথে গেলিই না!”

এই বলে শ্রেয়ার মা মেয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। শ্রেয়া আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ফুপিয়ে কেঁদে উঠে সে বলল,
– “আমি এটা শুধু নিজের জন্য করিনি। আমি তো তোমাদের নাসিমার কথা বলেছি। সে যেন তার সন্তানের অধিকার ফিরে পায়, সেজন্যই আমি এসব করেছি।”
– “চুপ কর! একটা মেয়ে যে কি না একবার সংসার করেছে, এমনকি বয়সে তোর চেয়েও পাঁচ-ছয় বছরের বড়, সে কি জানে না বিয়ের আগে এসব ন*ষ্টামির পরিণতি কী হতে পারে? সে কি কচি খুকি যে, তার চেয়ে কম বয়সী একটা ছেলে তাকে যা খুশি বোঝাবে আর সে তাতে রাজি হয়ে যাবে? তোকে কে বলেছে ওরকম একটা মেয়ের হয়ে ওকালতি করতে? আর কখনো করবি এসব?”
– “না। আমি ভুল করেছি। আর কখনো, যা-ই হোক না কেন, আমি এমন কিছু করব না।”
– “মনে থাকে যেন।”
এবার রাহুল বলতে শুরু করল,
– “শ্রেয়া, আমি কথা দিচ্ছি, আর কখনো এমন হবে না। তুমি শুধু একবার আমার সাথে ফিরে চলো।”
রাহুলের বাবা যোগ করলেন,
– “মা, তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমরা এখন থেকে শহরে তোমাদের সাথেই থাকব।”

এই কথাটা শোনার সাথে সাথে শ্রেয়ার মুখের মেঘ কেটে গেল। সে মনে মনে এটাই চাইত, সবাইকে নিয়ে একটা সুখী পরিবার। সেদিনই সে রাহুলের সাথে ফিরে এল। সে গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারল, জেদের বশে সে জেনে-শুনে কত বড় একটা পাপ করে ফেলেছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, জীবনে যা-ই ঘটুক না কেন, সে আর কখনো ফরজ বিধান অমান্য করবে না।

রাহুলও তার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা পেয়েছিল। সে বুঝতে পেরেছিল, যে ছেলের নারীর প্রতি লোভ আছে, সে কখনো আত্মীয়, বন্ধু বা আপনজন দেখে না। সুযোগ পেলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরপর থেকে তাদের জীবনটা আবার নতুন করে, ভালোবাসায় আর বিশ্বাসে ভরে উঠল। তারা সুখে দিন কাটাতে লাগল।

(বন্ধু-বান্ধব যতই আপন হোক না কেন, তাদের কখনোই নিজের স্ত্রীর সাথে অতিরিক্ত পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত নয়। বর্তমান সময়ে অধিকাংশ পরকীয়া সম্পর্কই স্বামীর বন্ধুদের মাধ্যমে শুরু হয়। জীবনে যদি একজন সৎ ও বিশ্বাসী স্ত্রী থাকে, তাহলে বাইরের কোনো বন্ধুর সাথে ততটা ঘনিষ্ঠতা রাখার প্রয়োজন পড়ে না। এই স্বার্থপর দুনিয়ায় দিনশেষে নিজের পরিবার ছাড়া বিপদে কেউ পাশে এসে দাঁড়ায় না।)

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে