সতীনকাঁটা ৭ম পর্ব এবং শেষ পর্ব

0
1380

#সতীনকাঁটা পর্বঃ ৭এবং শেষ
লেখায়ঃ( Nosrat Monisha)

সদ্য জন্মানো একটা শিশু মারা গেলো।

আমজাদ খান বাকরূদ্ধ। নিজেকে বার বার সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে গেছে।তবুও তার মনের এক কোণে একটা খটকা লাগছে তখন যদি দাইয়ের কথা শুনে তানজিনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতো তবে কি বাচ্চাটাকে বাঁচানো যেতো।

ভেতর থেকে বিলাপের স্বর ভেসে আসছে।
তানজিনা ঠুকরে ঠুকরে নিজের বাচ্চার লাশ ধরে কাঁদছে।
এত যন্ত্রণার পর জন্ম দেওয়া সন্তান, যখন আধ ঘন্টার মধ্যেই মারা যায় তখন একজন মায়ের কান্না ছাড়া আর কি-ই-বা করার থাকতে পারে?

আমজাদ খান নিজের মায়ের কবরের কাছে চলে গেলেন।
বড় কাঁঠাল গাছের নিচে বাঁধানো উঁচু কবরটা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় সবার চোখে পড়ে। জীবনে যেকোন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমজাদ খান একান্তে মায়ের কবরের পাশে কিছু সময় কাটান।
আজকেও সেজন্যই এসেছেন।
কিছুক্ষণ পর
আমজাদ খান ফিরে যায়।


পুরোনো খান বাড়ি।
আঁতুড় ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আমজাদ খান গলা ঝাড়া দেয়।

-আমি এড্ডু বিতরে আইতাম। বউমার গতরের(শরীরের) কাপড় ঠিক করো।

রেহানা বেগম, রাফিয়া, সানজিদা সবাই সেখানেই ছিলো। তারা বুঝলো আমজাদ খান বাচ্চার মৃত্যুতে কষ্ট পেয়ে তানজিনাকে তাড়ানোর জন্য আসছে।
তাই সব ঠিকঠাক করে আমজদ খানকে ভেতরে ডাকলো রেহানা বেগম।

ভেতরে গিয়ে তিনি দেখলেন তানজিনা মরা বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে আছে।

-বাইচ্চাডারে কব্বর দেওন লাগবো। সব কাম শেষে ছোড বউমা লও(চলো) বাইত যাওন লাগবো । বাড়িডা তুমারে ছাড়া খাঁ খাঁ করতাছে।

পাশ থেকে খেঁকিয়ে উঠে রেহানা খাতুন,
-তুমার মাতা ঠিক আছে নি?এই আলীক্কীরে(অলক্ষী) আবার ঘরে নিবা। আরে তুমার নাতি মইরা গেছে।
বংশের পত্থম বাত্তি নিইব্বা(নিভে) গেছে এইডার লাইগ্যা।

-কতা কম কও আবরারের মা। আমি যা কইছি তাই অইবো। আজু আইলে রাফিয়ার লগে হের তালাকের কামডা সাইরা ফালামু।

তানজিনা এতক্ষণে হুঁশ ফিরে পায়। সে আমজাদ খানের কথা শুনে চমকে উঠে।
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।

-বাবা আমি তো আপনাকে নাতি দিতে পারি নি। সে তো জন্মের পরই চলে গেলো তাহলে?

শক্ত হয়ে আজম খান বলে,
-বৌমা আমারে তুমি নাতি দিতে পার নাই ঠিকঐ। তয় আমি যে অত দিন বাদে আমার মায়ের দেহা পাইছি।
-বাবা!

-বৌমা আমার মায় যহন মরে আমি খুব ছোড। বইনে অইতে গিয়া মায় মইরা গেল।মায়ের মুকখান ছাড়া অহন আর কিছু তেমুন দিশ(মনে) করবার পারি না।
তহন অত ডাক্তর বদ্যি আছিল না তাই আমার মায় বাঁচে নাই৷ আইজ সব থাইক্যাও আমার নাতি বাঁচে নাই।হের কারণ আমার জিদ। আমি পাপী তাই পাশ্চিতির করুম। হের আগে তুমি মাফ করো আমারে।

-বাবা এরকম বলে আমাকে আর কষ্ট দিবেন না।

-তয় আমার মায়রে লইয়া বাইত চলো যাই।
বলে তানজিনার পাশে ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে তুলে নেয় আমজাদ খান।

হ্যাঁ তানজিনার জমজ বাচ্চা হয়। ছেলেটি আঁতুড়েই মারা গেছে।

সবাই অবাক হয়। একটা মেয়েকে আমজাদ খান এভাবে আদর করে মেনে নিবে তা সবার কল্পনাতীত ছিলো।

-জানো ছোড বউমা। দাই যহন হেরে দেহাইতে আমার বারাত(কাছে) নিল আমি মনে মনে কইতাছিলাম মাইয়্যার মুক দেইকা কি করুম বংশের বাত্তিঐ যহন নিইব্বা গেলো।
কিন্তুক দাইয়ে কতায় একবার চাইয়া দেহি এইডা অক্করে তুমার মাইয়্যার মুক অক্করে আমার মায়ের মুহের(চেহারা) লাহান। তুমি আমার মায়েরে ফিরত দিছ। তুমি যা চাইবা তাই অইবো। চলো।

আমজাদ খানের মুখের উপর কথা বলার সাহস কারও নেই। তাই বাচ্চার দাফনের পর অগত্যা সবাই তানজিনাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো৷


দুদিন পর আজুয়াদ ফিরে এলো। সে মেয়েকে দেখে যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেল।আবার ছেলের জন্য দুঃখও পেলো।
আজুয়াদ যখন বাবার সিদ্ধান্ত জানলো খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো।


আজ আমজাদ খান তার শেষ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলো যে কালকেই রাফিয়াকে তিনি বাপের বাড়ি রেখে আসবেন।
রাতে তানজিনা মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলো। হঠাৎ মেয়ে জেগে ওঠলে তারও ঘুম ভেঙে যায়৷ মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে খেয়াল করে আজুয়াদ ঘরে নেই।
শরীর খারাপ থাকা সত্ত্বেও আজুয়াদকে খুজতে বের হয়। সব কয়টা ঘরে খুঁজে। একবার নিজের মনের সন্দেহ দূর করার জন্য রাফিয়ার ঘরেও দেখে,কিন্তু পায় না। রাফিয়ার ঘর দেখে মনে হলো রাফিয়া কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে আছে ।

পরক্ষণেই মনে হলো,হয়তো সিগারেট পান করতে বাড়ির পেছনে গেছে । তানজিনা মনে মনে খুশি হলো যে আজুয়াদ তার কথা শুনে এখনও ঘরে সিগারট খায় না আজুয়াদকে তার কিছু বলার ছিলো। তাই মেয়েকে খাইয়ে চারপাশে বালিশ দিয়ে দরজা লাগিয়ে বাড়ির পেছন দিকে যায়৷


খান বাড়ির পিছনদিকটা হাসনাহেনা ফুলের সৌরভে বিমোহিত হয়ে আছে।

তানজিনা গিয়ে দেখে রাফিয়া আজুয়াদের পায়ে ধরে কান্না করছে। তানজিনা বুঝতে পারে মেয়েটা আবার একটা তালগোল পাকাবে। তাই একটু জোরে হেঁটে কাছে যায়।

-সারা জেবন আপনেগো দুইজনের বান্দি গিরি খাটুম। তাও আমারে খেদাইবেন না।

তানজিনার খুব মেজাজ খারাপ হলো। সিদ্ধান্ত নিল এবার এই মেয়েকে উচিৎ শিক্ষা দিবে। চুলের মুঠি ধরে এ বাড়ি থেকে বের করবে। কিন্তু কিছু একটা শুনে থেমে যায়।

-আপনে যুদি অহন আমারে ছাইড়া দেন আমার পেডের বাইচ্চার কি অইবো।

তানজিনার পায়ের নিচের মাটি সরে যায়।
না আর কোন ভনিতা নয়।
সে সোজাসুজি গিয়ে আজুয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-এই মেয়েটার পেটে তোমার বাচ্চা? সত্যি কথা বলো।
আজুয়াদ নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করে বলে,
-হ্যাঁ।
-কেন করলে এটা।তুমি মিথ্যে বলছো না তো? তুমি তো এই মেয়েটাকে কখনো মেনে নিতে পারো নি।
-তানু এতে তোমারও দোষ আছে। এই কয়মাস আমাকে নিজের কাছে ঘেঁষতে দাও নি।তোমার কাছে গেলে দূর দূর করেছো। আমি ঢাকা থেকে এসে কতবার তোমার কাছে থাকতে চেয়েছিলাম প্রতিবার তুমি আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলে। তুমি কেন বুঝ না, আমারও তো একটা চাহিদা আছে।তুমি চিন্তা করো না আমি রাফিয়াকে…

না আর কোন কথা শুনলো না তানজিনা। ধীর পায়ে সেখান থেকে বাড়ির ভেতরে যাচ্ছে আর শরৎ বাবুর বলা দুটো লাইন ভাবছে,
-যাহার ভালবাসা পাইয়াছি বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছি, সেইখানে ভুল ভাঙিয়া যাওয়াটাই নিদারুণ।

আজ তানজিনার ভুল ভেঙেছে।

আমজাদ খানের দরজায় তানজিনা জোরে জোরে কড়া নেড়ে ডাকছে।
মাঝরাতে তানজিনার গলা শুনে আমজাদ খান ভয় পেয়ে যায়। মনের মধ্যে কুডাকে। একবার মনে হয় মেয়েটার আবার কিছু হলো না তো।

তারপর দরজা খুলতেই তানজিনা কাঁদতে কাঁদতে দরজা ধরে নিচে বসে পড়ে।


২৭ বছর পর।
সময়ের স্রোতে আমজাদ খান, তানজিনার মা,বাবা, চাচা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও বাকি সবাই রয়ে যায়।


খান বাড়ি।
খান বাড়ির এখন আর আগের মতো সমৃদ্ধশালী নেই ।

হাসনাহেনা গাছটা মরে গেছে।

বাড়ির দালানগুলোতে শেওলা জমেছে, ছাউনির টিনগুলোতে জং পড়েছে, কাঠের দরজা-জানালাগুলোতে ঘুন ধরেছে।

খান বাড়ির উঠোন।

বয়সের ভারে নুয়ে পড়া রেহানা খাতুন ময়ালা আধা সেলাই করা একটা কাপড় পড়ে, ময়লা ফেটে যাওয়া একটা বাসন নিয়ে রান্না ঘরের সামনে বসে আছে।সে এখন লাঠি ভর দিয়ে হাঁটে।
রেহানা খাতুনের আগের তেজ এখন নেই।এখন তাকে দেখলে যে কারও অন্তর কেঁপে উঠবে।

একটা মলিন হাসি দিয়ে করুন সুরে আবদার করে,
-আমারে দুইলা(অল্প) বাত(ভাত) দিবা? সহালেত্তে(সকাল) কিচ্ছু খাইতে দেও নাই অহন বিহাল(বিকেল) অইয়্যা গেছে। পেডর(পেটে) ভুক(খুদা) লাগজে।

সামনে থাকা মহিলাটি দাঁত খিঁচিয়ে জবাব দেয়।
-বুড়ি খালি বাত কেরে? আমারেও খা। তর জামাই জমিদারি থুইয়্যা গেছে, এড্ডু পরে পরে খালি কয় পেডর ভুক লাগজে। অত খাছ যায় কই? কামের বেলা তো খুইজ্যা পাই না।

-রাফিয়া আম্মারে এমনে কইয়্যো না।
গরুকে খড় দিতে দিতে সানজিদা কথাটা বলে।

-এহ আইছে আরেক আলীক্কী(অলক্ষী) , বান্জা(বাঁজা) মাইয়া মানু। তর খাওনঢা তুই বুড়িরে দিলেই পারস। নিজের সোয়ামীরে খাইয়্যাঅতো পরান জুরায় নাই, অহনতো আমার সংসারে বইয়্যা বইয়্যা খাস।

ভেতর থেকে আজুয়াদদের গলা শুনা যায়,
-রাফিয়া মুখ বন্ধ করো। ওদের ওরকম করে বলো না। টাকাতো আমার খেতের ধান থেকেই আসে।

-ওরে গোলামের-গরের-গোলাম(গালি বিশেষ)। আমারে টেহার খুঁডা দেছ তুই।খেতে কাম করে কেডা? আমার পোলায়।ক্ষেমতা নাই উট্টা বইবার তক্ক করে। তর কপালো উঁস্টা মারি।
আর কতদূর (কতটুকু) খেত আছে তর? তর বাপে তো বেবাকতা তর বড় বউরে দিয়া গেছে। বাহি(বাকি) যদ্দূর(যতটুকু) আছিন তর বইনের বিয়ার সম বেইচ্যা হেরে দিছে। তাও যুদি তর বইনে বালামত ঘর সংসার করবার পারত,দুইদিন বাদে বাদে জামাইয়ের কেচ্যা(মাইর)খাইয়্যা আমার বাইত আইয়্যা উঢে। আমার মুক খুলাইবি না।
আর আমার লগে বাড়াবাড়ি করলে আইজ তর
গু-মুত সাফ করতাম না। এমনেঐ পইরা থাকবি।

আজুয়াদ চুপ হয়ে যায়। কারণ আজ সে এমন অবস্থানে পড়ে আছে যেখানে থেকে রাফিয়াকে কিছু বলা তার পক্ষে অসম্ভব।সে এটাও জানে রাফিয়া মিথ্যা বলছে কারণ আমজাদ খান তানজিনাকে পুরাতন ভিট আর ভিটের সামনের এক বিঘা জমি ছাড়া কিছুই লিখে দেয় নি।

দশ বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আবরার মারা যায় আর আজুয়াদের কোমড় ভেঙে যায়। তখনই আজুয়াদের চাকরিটা চলে যায়। চার বছর আগে আমজাদ খান মারা যায়। তখন থেকেই পুুরো পরিবারের কর্তী হয় রাফিয়া।

সানজিদা তার বাবার বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু সেখানে কেউ তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার আগ্রহ দেখায় নি। তাই বাধ্য হয়ে এখন খান বাড়িতে রাফিয়ার কাজের লোকের মতো থাকে।

-আম্মা।
বলে ডাক দেয় রাফিয়ার একমাত্র ছেলে রফিক।

-আব্বা আইছো?দেহো তুমার লাইগ্যা মুরোগ রাইন্দা কহনেত্তে বইয়্যা আছি।যাপ মুক-আত দুইয়্যা আইয়্যো।

হাত মুখ ধুয়ে রফিক খেতে বসে। সে মুরগীর রানের টুকরো দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে আর বাইরে থেকে রেহানা খাতুন আর সানজিদা খালি পেটে অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখছে।
এতে তাদের দুজনের লজ্জা বা রাগ কিছুই হচ্ছে না।
দৃশ্যটা ঘরে শুয়ে থেকে দেখছে আজুয়াদ। আর নিরবে চোখের পানি ফেলছে।

এটা এ বাড়ির নিত্য ঘটনা। রাফিয়া নিজের খেয়াল খুশিমতো এদের দুজনকে খাবার দেয়।


খান বাড়ির পুরোনো ভিটায় এখন একটা পাকা দালান উঠছে।
সেই বাড়ি বাইরে বড় একটা মুরগির খামার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। খামারে পাশের পুকুরের কিছু মাছ লাফাচ্ছে।

এসব কিছুর মালকিনই তানজিনা।সেদিন রাতে আজুয়াদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে সে চিরদিনের মতো ঐ বাড়ি ছেড়ে এ বাড়িতে এসে ওঠে । আমজাদ খান সব জানতে পেরে দুইটি জায়গা তানজিনাকে লিখে দেয়।
সাবিহা বেগমের গয়না বিক্রির টাকা দিয়ে জামালের মাকে সাথে নিয়ে একটা ছোট মুরগির খামার শুরু করেছিলো। সেখান থেকে লাভের টাকা জমিয়ে এই ভিটায় পাকা দালান তুলেছে,খামারটা বড় করেছে, আবার এখন একটা পুকুরও কেটেছে।

সন্ধ্যার পর।
বাড়ির প্রধান ফটক ধরে এক যুবক বাজার হাতে ভেতরে যাচ্ছে।

উঠানে লেবু গাছটায় নতুন ফুল ফুটেছে।

সেখানে দাঁড়িয়েই সে আওয়াজ দেয়,
-খালাম্মা ও খালাম্মা। খাদিজা ।

তানজিনা বের হয়ে দেখে যুবকটি ব্যাগ ভর্তি বাজার আর চার-পাঁচ কেজি ওজনের একটা রুইমাছ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

-আরে জামাল কি হইছে?এতো বাজার দিয়ে কি হবে?তোর মাথা ঠিক আছে।

-হ আমার মাতা ঠিক আছে।এই যে আইজকার আন্ডা(ডিম) বেচার টেহা। আরে এই খাদিজা কই গেলা তুমি? বাইরে আহ।
বলে অনেকগুলো টাকা তানজিনার হাতে দেয়।

ভেতর থেকে ছয়-সাত মাসের গর্ভবতী এক মহিলা বের হয়ে বলে,
-আমি এহানেই। কও কি কইবা।

-এই বাজারগুলান ঘরে নেও। এই মাছডা কাইট্টা আগে ফিরিজ রাহো। বড় একটা দেশি মুরগও আছে। কাইল পোলাও, গোশত আর মাছর মাতা দিয়া মুরিঘন্ড রানবা। আর মাছের পেডিঢি কড়া কইরা ভাজবা।

-পুস্কুনিত অতো মাছ থাকতে বাজারত্তন মাছ কেরে আনলা যে।

-পুস্কুনির মাছ ছুডু। বইনের জন্মদিবসো ছুডো মাছ কেমনে খাওয়াই?এর লাইগ্যা মুন্সি বাড়ির পুস্কুনীত্তে জালোরে(জেলে) দিয়া বড় মাছ ধরাইয়্যা আনলাম। কাইল সহাল সহাল রাইন্দো।

খাদিজা হলো জামালের স্ত্রী। জামালের মা কখনোই তানজিনাকে ছেড়ে যায় নি। সেই সুবাদে মায়ের মৃত্যুর পরও জামাল তানজিনার কাছে থেকে যায়। খাদিজাকে তানজিনাই পছন্দ করে বিয়ে করায়৷

-যাক এ বাড়িতে কারও অন্তত মনে আছে কাল আমার জন্মদিন। নাহলে মানুষ (তানজিনাকে উদ্দেশ্য করে) জানতো আমার বিয়ে ভেঙে গেছে সেই নিয়ে চিন্তা করছে আর মরাকান্না কাঁদছে।
ভেতর থেকে বের হতে হতে কথাগুলো বললো তানজিনার মেয়ে তারিন।

-বইন এইড্ডা তুমি কি কতা কইলা? তুমার জম্মদিবস আমি ভুইল্যা যামু এইডা অয়।

তানজিনা একটু রেগে বলে,
-তাই বলে এতো বাজার। আর তুই ভুলে যাস কেন খাদিজা গর্ভবতী এত কাজ করা তার পক্ষে কষ্টের।

জামাল কিছু বলার আগেই খাদিজা বলে,
-খালাম্মা, আপনে এত চিন্তা করুইন না। আমিতো খালি রানদি। আর বেবাক ভারি কাম তো আপনে আর আপনের পোলায়ই করেন। ডাক্তরেও কইছে এড্ডু গতর খাঢাইতে এইডা পেডের বাইচ্চার লাইগ্যা বালা।আপনেরা তো কুনো কামঐ করবার দেন না।

-কিন্তু তোরা যার জন্য এত কাজ করবি, সে দেখ কেমন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।বলি সে আমাদের কোন কাজে কোনদিন সাহায্য করেছে?

জামাল একটু রেগে গিয়ে বলে,
-খালাম্মা এইতা কি কতা কইন। আমার বইনে অইল রাইজকইন্যা। খাদিজা কাম না করবার পারলে, বেবাক কাম আমি করুম। তাও আমার বইনেরে কুনো কাম করবার দিমু না।

-তুমি থামোতো। খালাম্মা, আমার লাহান এতিম এই বাইত আইয়া মা পাইছি, বইন পাইছি।বড় বইন বাইচ্যা থাকতে ছোড বইন কাম করবো এইডা অয়?

-তোরা দুইজন লাই দিয়েই তারিনকে মাথায় তুলেছিস। নাহলে পাত্র পক্ষের সামনে এভাবে কথা বলে।

-এনার সাথে কথা বলে লাভ নেই সারাদিন মাথায় বিয়ে ঘুরে। চলো ভাবী বাজারগুলো আমাকে দাও নিয়ে যাই। দুজনে তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিই। আজকে আমি আমার ভাতিজিকে শেক্সপিয়ার পড়ে শুনাবো।

তারিন ভেতরে যাচ্ছিলো তখন তানজিনা বলে,
-জন্মদিনে একবার বাবার সাথে দেখা করবে না?

এবার তারিন ক্ষেপে যায়।
-দাদা যেদিন মারা গেছে সেইদিন ঐ বাড়ির সাথে আমার সব সম্পর্ক মুছে গেছে। ঐ বাড়ির লোকের প্রতি তোমার দয়া থাকলেও আমার নেই।আমি তো এটাই বুঝতে পারি না এত বছরেও তুমি ঐ লোকটার কাছ থেকে তালাক কেন নাও নি।

তারিন খাদিজাকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো।

তানজিনা মেয়েকে কিছু বলতে পারলো না। কিন্তু মনে মনে বললো,
-তুই বুঝবি নারে মা। কারণ তোকে আমি আর পাঁচটা মেয়ের চেয়ে আলাদা করে গড়ে তুলেছি।তোর বাবাকে তালাক দেওয়া মাত্রই আমার গায়ে তালাকপ্রাপ্ত মহিলা হওয়ার পোস্টার লেগে যেতো। তখন চারপাশ থেকে কিছু পুরুষ শকুনের মতো আমার উপর নজর দিতে। কিছু মহিলা আমার নামে কুৎসা রটনায় ব্যস্ত হয়ে পড়তো। তখন সমাজ আমাকে একঘরে করে দিতো। আর তোকে নিয়ে আমি এই সমাজে বাঁচতে পারতাম না। তারচেয়ে একজনের নাম সাথে জড়িয়ে যদি একটু ভালভাবে সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারি তাহলে ক্ষতি কি।

-খালাম্মা।
জামালের ডাকে ধ্যান ভাঙে তানজিনার।
-হ্যাঁ, বল।
একটু অভিযোগের স্বরে জামাল বলে,
-খালাম্মা আপনে বইনের উপরে রাগ করেন কেন? বইনে কত বড় চারহি করে। আমাগো গেরামে কলেজো ইংরাজি পড়ায়। যহন ডাক্তরে কইলো আমার মাইয়্যা অইবে তহন ঐ ঠিক করছি আমার মাতায় কুনোদিন লেহা-পড়া ঢুহে নাই তয় কি অইছে? আমার মাইয়্যারে বইনের মতো শিক্ষিত বানামু।

-তোরা বুঝতে পারবি না জামাল আমার কষ্টটা কোথায়৷ মেয়েতো আমার হীরের টুকরো কিন্তু জহুরি যে পাই না।এতো বয়স হয়ে গেছে এখনো বিয়ে হয় নি।নানান লোকে নানান কথা বলে। মরার আগে মেয়ের স্বামী -সংসার দেখে যেতে পারবো কি-না কে জানে।

-খালাম্মা আল্লায় যেদিন চাইবো হেইদিন সব অইবো।

-আর কবে? কতগুলো বিয়ে তো সব ঠিকঠাক হওয়ার পর ভেঙে গেলো।

-খালাম্মা হেইডাতো রফিক্যা করছে। হেই বাড়ির হেরা জ্বলে, আমনের বালা চায় না। এর লাইগ্যা ঐত্তো যত্তবার বইনের বিয়ার পাক্কা কতা অইছে রফিক্যা পোলার বাইত গিয়া উল্ডা-পাল্ডা কতা কইয়া বিয়া বাঙানি(ভেঙে) দিছে। আর বাকিগুলান তো বইনেই বাঙছে কারণ পোলারা টেহা(টাকা) চাইছে।

জামাল চলে গেলো।

রাফিয়ার কারণে আজও তানজিনার জীবনের সুখ বিঘ্নিত। নিজের ছেলেকে দিয়ে বার বার রাফিয়া তানজিনার ক্ষতি করেছে৷
কখনো পুকুরে বিষ দিয়েছে, কখনো ফসলের ক্ষেত আগুন লাগিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে বার বার তারিনের বিয়ে ভেঙে দিয়ে ।

সতীনকাঁটা এখনো তানজিনার জীবনে ফুটে আছে।

তানজিনা একটু বির বির করে বলে,
-মা তুমি বেঁচে থাকলে দেখতে এই সমাজটা আজও বদলায় নি। মেয়েরা যতই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাক না কেন, তাদের পাশে স্বামী নামের একটা সাইনবোর্ডের প্রয়োজন হয়।


রাতে তারিনের আওয়াজ শুনা যায়।
তানজিনা উঁকি দিয়ে দেখে। তারিন খাদিজাকে পড়ে শুনাচ্ছে,

Blow, blow the winter wind
Thou(you) are not so unkind
As man’s ingratitude

তানজিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে চলে যায়।
সে ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে,
অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত।

তানজিনা খেয়াল করে, বাইরে ঝিঁ ঝিঁ পোকাগুলোর আওয়াজ অন্ধকারটা ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর করে তুলছে।


(সমাপ্ত)

বিঃদ্রঃ গল্পের সমাপ্তি কিংবা কাহিনি পছন্দ না-হলে আমাকে দোষ দিবেন না। এর জন্য শরৎ বাবু আর জহির রায়হান সাহেব দায়ী।
সমাজিক গল্প বলতে যা শিখেছি, প্রথম তাদের গল্প পড়েই শিখেছি।
তাদের দুইজনের গল্প পড়েই আমি শিখেছি গল্পের শুরুতে যা ভাবি শেষটা কখনো তেমন হয় না। সামাজিক গল্প তখনই সফল হয় যখন তাতে অপূর্ণতা আর আফসোস মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে