#সতীনকাঁটা পর্বঃ৬
লেখায়ঃ(Nosrat Monisha)
-আম্মু এই সিদ্ধান্তটা আমি নেই?
মেয়ের কথায় সাবিহা বেগম একটুও অবাক হয় না।
-জীবনটা তোমার তানু। তাই তোমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।তবে এইবার আর ভুল করো না।
তানজিনা মুচকি হেসে বলে,
-সেটা তো সময় বলে দিবে আম্মু। এইতো পাঁচ মিনিট আগেও আমি তোমার কথামত নতুন একটা জীবনের স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু নিয়তি আবার তার খেলা দেখালো।যখন আমি একা ছিলাম আমার সিদ্ধান্ত একরকম ছিল। কিন্তু এখন আমার সাথে আরেকটা জীবন জড়িয়ে আছে। তাই তাড়াহুড়ো করে আমি কিছু করতে চাই না।
-কি করতে চাও তুমি?
-বলছি তার আগে আমি আব্বুর সাথে কিছু কথা বলতে চাই। আম্মু তুমি খুব খেয়াল করে শুনবে কথাগুলো।
তারপর তানজিনা নিজের বাবাকে বলে,
-আব্বু আজুয়াদ আমাকে তালাক দিলে তুমি কি সারাজীবন আমাকে আর আমার বাচ্চাকে তোমার বাড়িতে থাকতে দিবে।দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের ব্যবস্থা না হয় আমি নিজেই করে নিবো।
তানজিনা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তাকে থামিয়ে পাশ থেকে আজুয়াদ বলে উঠে,
-আমার দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ তোমাকে আমি তালাক দিবো না।
-আমি আমার বাবার সাথে কথা বলছি। তুমি একটু চুপ থাকো না হয় বাইরে চলে যাও৷
বলে আজুয়াদকে ধমক দেয়। তানজিনার ধমক শুনে আজুয়াদ চুপ হয়ে যায়।
-যা বলছিলাম আব্বু তুমি বলো। তুমি কি আমাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারবে যে, আমাকে কেউ কোন দিন বাপের বাড়ি থাকার জন্য খোটা দিবে না বা সেখানে কখনো আমাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে বাধ্য করা হবে না। বাবা আবেগী হয়ে আমি আবার ভুল করতে চাই না। তাই তুমিও সত্যটা বলো কোন লুকোচুরি না।
জমির ভুঁইয়া নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো।তার সেই ছোট্ট অবুঝ কল্পনা বিলাসী মেয়েটা আজ কত বাস্তববাদী হয়ে গেছে।
-তুই সারা জেবন এলহা থাকতে চাছ?এমনে কি জেবন চলে?
-আব্বু কথা ঘুরিয়ো না। সরাসরি উত্তর দাও।
-না এইডা ত অয় না। এক বস্সর, দুই বস্সর না অয় মাইনা নিলাম। বাদে?বাদে কি অইব?মাইনসে কি কইবো?
-আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি।
বলে সে তার মায়ের কাছে যায়।
-আম্মু, তোমার মেয়েকে নিয়ে তুমি যতই স্বপ্ন দেখো না কেন আমাদের এই সমাজটা এখনো একটা মেয়েকে স্বপ্নপূরণের পুরোপুরি অধিকার দেয় নি।
আম্মু আমরা মেয়েরা যতই শিক্ষিত আর প্রতিষ্ঠিত হই না কেন আমাদের পাশে স্বামী নামক একটা সাইনবোর্ড লাগে। নাহলে এই সমাজ আমাদের একঘরে করে দেয়। এখন তোমার সাথে গেলে তাই হবে যা বাবা বললো। প্রথম প্রথম মানুষ সহানুভূতি দেখাবে পরে আবার তারাই আমার নামে কুৎসা রটনা করবে। আমার সন্তানকে বলবে তোর মা কলঙ্কিনী তাই স্বামীর ঘর করতে পারে নি।
আর আবার বিয়ে করলেই যে সেই বাড়িতে সম্মান পাবো তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে? তারা যদি আমার সন্তানকে মেনে না নেয় তখন। মা আমি বলছি না সবাই খারাপ। কিন্তু আম্মু আমি ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘেও ভয় পাই। তাই আবার বিয়ে করে নতুন কাউকে নিয়ে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সাবিহা বেগম বলে,
-বুঝতে পারলাম তোমার কথা কিন্তু তুমি কি করতে চাও একটু খুলে বলো।
-মা আমি আজুয়াদকে ক্ষমা করবো কি-না সেটা আমার বাচ্চা জন্মের পর ঠিক করবো। আমিও দেখি ছেলে না মেয়ে? আল্লাহ কি চায়? আমি আজুয়াদের সাথে থাকি, না ওর থেকে আলাদা হই।তাছাড়া তুমিই তো বললে গর্ভে সন্তান থাকলে তালাক হয় না।তবে আম্মু একটা কথা মনে রেখো, সতীনের সাথে এক সংসারে তোমার মেয়ে থাকবে না। কিন্তু আজুয়াদের সাথে আমি থাকবো কি-না সেটা আল্লাহর হাতে।
সাবিহা বেগম কিছু বলবেন তার আগেই তানজিনা আবার বলে,
-আম্মু আর একটু বাকি আছে। বাবা আপনার সাথে কিছু কথা আছে।
আমজাদ খান একটু নড়েচড়ে বসে বলে,
-কি কইবা কও
-বাবা রাফিয়ার সাথে আমি এক বাড়িতে থাকবো না। কিন্তু আপনি তো বলে দিলেন যে, রাফিয়া এই বাড়িতেই থাকবে।
-তয় তুমি কি কয়ডা মাসের লাইগ্যা বাপের বাইত যাইবার চাও।
-না বাবা। সেখানে যাওয়ার হলে আব্বুকে বলতাম। আপনাকে না।
-তয় কই যাইবার চাও?
-আব্বা আমি এই কয় মাসের জন্য পুরাতন বাড়িতে গিয়ে থাকতে চাই আপনি ব্যবস্থা করুন।
আমজাদ খান চমকে গেল। কারণ কোন মেয়ে যে পাকা দালানের ঘর ছেড়ে জীর্ণ-শীর্ণ ভাঙা টিনের বাড়িতে থাকার কথা ভাবতে পারে সেটা তার জানা ছিলো না।
রেহানা খাতুন এ কথা শুনে গরম তেলে দেওয়া কই মাছের মতো টগবগ করে ফুটে উঠে।
-বলি আক্কেল জ্ঞিয়ান কিচ্ছু আছে নি তোমার। পেট লইয়া পুরান বিডাত(ভিট) যাইবার কিতা কও। মাইনসের লগে মুক দেহাইতে পারুম?
-মা আমি কথাটা বাবাকে বলেছি। আর মুখ না দেখাতে না পারার কি আছে? আপনার ছেলের বউ চলে যাচ্ছে না শুধু অন্য বাড়ি থাকছে তাও আবার আপনাদেরই৷কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবেন দুই সতীনের ঝগড়া হবে তাই আপনারাই পাঠিয়ে দিয়েছেন, মিটে গেলো।
আমজাদ খান স্ত্রীকে চোখ রাঙিয়ে বলে,
-হারামজাদি, বেত্তমিজ মাইয়্যা মানু কুমবালাত্তে (অনেকক্ষণ) কইতাছি চুপ কর। হুনে নি আমার কতা। এইবার মুক খুললে তরে পোলার হউর বাড়ির মাইনসের সামনে ছেঁছুম(মার দিবো)।
এবার রেহানা খাতুন ভয় পেয়ে চুপসে গেল ।
-ছোড বউমা তুমি কও। হেইহানে তুমারে দকবো কেডা?
-বাবা আজকে এক মুহূর্তের জন্য আমাকে নিজের মেয়ে ভেবে বলুন এই বাড়িতে আমাকে দেখার মত কে আছে?এত অন্যায় অবিচারের মধ্যে কি আমি ভালভাবে বাচ্চার জন্ম দিতে পারবো?আপনি বলুন আপনারা কখনো কি আমার সাথে দুটো ভালো কথা বলেছেন? সেখানে গেলে অন্তত এইসব মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো৷
আমজাদ খানের জীবনে প্রথমবার তানজিনার জন্য খারাপ লাগলো। সত্যিতো মেয়েটা এ বাড়িতে শুধু অত্যাচার সহ্য করে গেছে।সবার সব কাজ করেছে।
-ঠিক আছে। তয় এলহা এলহা পুরান বিডাত তুমারে দেই কেমনে কও দেহি?
আজুয়াদ বলে,
-আব্বা আমি সাথে যাবো।
-তুই কেমনে যাবি? পরের সাপ্তা থেইক্যা তোর অপিস যাওন লাগবো।তাই আমি কই কি ছোড বউমা তুমি বাপের বাড়িতে যুদি যাইতে চাও যাইতে পারো ।
-না বাবা, আমি পুরানো বাড়িতেই যেতে চাই। আমি জামালের মা’কে বলবো আমার সাথে থাকতে। সে এমনিতেও দুধের ছেলেটাকে নিয়ে খাবারের কষ্ট করে। জামালের বাবা মারা যাওয়ার পর দু’বেলা খাবারের আশায় দেবর -ভাসুরের সংসারে চাকরানীর মতো খাটে। আমার সাথে থাকলে তো সেটা করতে হবে না।
আমজাদ খান দেখলেন এটা সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি এতে মানসম্মান আর নিজের ভাগ্নীর সংসার দুটোই বেঁচে যায়।
-আইচ্চা তয় আমি বেবাক বাউ করি।
-বাবা, আরেকটা আবদার। আমার ঐ বাড়িতে সময় কাটবে না তাই যদি কিছু বই নিয়ে যেতে দিতেন।
-হ নিবা। পোয়াতি থাইক্যা বই পললে আমার নাতি বিদ্যা লইয়া জম্ম নিবো। তয় আমার রাইত লইয়া ডর, ভাঙ্গা টিনের ছাড়ফা (বেড়া)।
-বাবা আপনি শুধু শুধু ভাবছেন। জামালের মা থাকবে তো, আর আপনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় একবার ঘুরে আসবেন।
আর আপনি কি এত ভাবছেন বলুন তো, খান বাড়ির বউয়ের দিকে কে নজর দিবে? এমন সাহস কারও আছে।
-এইডা অক্করে খাঁডি কতা কইছো তুমি।
।
।
আবারো মা-মেয়ে একান্তে।
তানজিনা মা’কে জড়িয়ে ধরে বলে,
-আমার উপর আবার তোমার অনেক রাগ হচ্ছে তাই না আম্মু?
মেয়েকে ছাড়িয়ে সাবিহা বেগম বলে,
-সত্যি বলতে, তোমার উপর একটু আগে অনেক রাগ হয়েছিলো। কিন্তু এখন ভেবে দেখছি তুমি ঠিক বলেছো।
তানু, তুমি তখন অনেক ছোট। তোমার বাবা আর আমার মধ্যে সামান্য একটা বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। তিনি আমাকে খুব মেরেছিলেন। আমার অনেক রাগ হয়েছিলো। আমি তোমাকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। প্রথম দুই তিন দিন সব ঠিক ছিলো।
এরপর থেকে শুরু হলো সবার কথা, তোর স্বামী কোথায়? কবে আসবে?
একদিন তোমার নানা ডেকে বলে ,
তিনি তোমার বাবাকে খবর পাঠিয়েছে আমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। আমি যেন তার সাথে ফিরে যাই, যদি তা-না করি তাহলে যেন আমি তোমার বাবাকে তালাক দিয়ে দেই৷ আর তোমাকে তোমার বাবার সাথে পাঠিয়ে দেই। কারণ তার কথা ছিলো তালাক প্রাপ্ত কালো মেয়েকে কেউ হয়তো বিয়ে করবে, কিন্তু বাচ্চা থাকলে তা প্রায় অসম্ভব ।
-এরপর?
-আমার পক্ষে তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারা সম্ভব ছিলো না বলে তোমার বাবার সাথে ফেরত চলে এলাম। তিনি সবার সামনে কথা দিয়েছিলেন আর কখনো আমার গায়ে হাত তুলবেন না।
কিন্তু কি বলোতো,কিছু পুরুষ মানুষ হয় কুকুরের লেজের মতো কখনো সোজা হয় না। তিনি আবার একই কাজ করেছিলেন।তবুও আমি বাবার বাড়ি যাই নি। কারণ বাবার বাড়ি গেলে আবার সেই এক ঘটনা ঘটতো।
তাই মার খেয়েও সংসার করে যাচ্ছি । তোমার বাবা আমাকে খুব বেশি মারতেন না কিন্তু একটা দুটো থাপ্পড়ই যথেষ্ট ছিলো আমার ভেতরটা ভেঙে দেওয়ার জন্য।এমনকি তোমাদের সামনেও কত মার খেয়েছি।সেই জন্য হয়তো তোমারও আমাকে কখনো সেভাবে মূল্য দাও নি।
-আম্মু
-জানোতো তোমার নানাকে প্রশ্ন করেছিলাম,
আমি তার মেয়ে আমার কি কোন হক নেই? কেন ঐ বাড়িতে আমি সারাজীবন থাকতে পারি না। তিনি জবাব দিয়েছিলো, হক ততক্ষণ পাবো যতক্ষণ সাথে স্বামী নিয়ে যাবো, অথবা সব অতীত মুছে দিয়ে ফেরত যাবো।
আমি বুঝতে পারছি, যে কথা আমি বাবার বাড়িতে দু’দিন থেকে বুঝেছিলাম সেটা তুমি এখন বুঝে গেছো।
তবে তোমাকে একটা কথা বলি, যা-ই হোক আমাকে লুকিয়ে যেও না। আমি হয়তো তোমাকে ঐ বাড়িতে সবসময়ের জন্য রাখতে পারবো না কিন্তু তোমার লড়াইয়ের সাথী হতে পারবো। নিজেকে কোনদিন একা মনে করবে না। মনে রাখবে তোমার মা তোমার মা তোমার সাথে সবসময় আছে।
ভুঁইয়া বাড়ির লোকজন চলে গেলো।
।
।
কিছুদিন পর রাফিয়া আর আজুয়াদের বৌভাত হয়।
এরপরই তানজিনা খানদের পুরানো বাড়িতে উঠে যায়।
আজুয়াদ ঢাকা চলে যায়।
একমাস পর পর শুক্রবারে আজুয়াদ আসে তানজিনার কাছে। তানজিনার সাথে তার শুধু কুশলাদি বিনিময় হয়।
।
।
তখন তানজিনার সাতমাস চলে। তার নানা কিছু খেতে মন চায়।
তানজিনার শ্বশুর প্রতিদিন একবার এসে খোঁজ নিয়ে পরদিন বাজার পাঠিয়ে দেয়। ইদানিং তিনি তানজিনাকে খুব সমীহ করে।
বাইরে চুলায় গরুর মাংস রান্না করছে জামালের মা। জামাল উঠানে আতাগাছটির নিচে মাটি নিয়ে খেলছে।
তানজিনার খুব মিষ্টি কুমড়া দিয়ে গরুর মাংস খেতে মন চাইছিলো। তাই এ রান্না।
মাংসের গন্ধ নাকে পৌঁছাতেই ঘর থেকে একটা বই নিয়ে এসে উঠানে বসে তানজিনা।
সে কপালকুণ্ডলা পড়ছিলো।
হঠাৎ আজুয়াদ এসে দাঁড়ায়।
তানজিনা কেবল বইয়ের এই লাইনটা পড়েছে,
যেখানে কপালকুণ্ডলা নবকুমারকে বলছে,
-পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?
আজুয়াদকে দেখে তানজিনার তাই মনে হলো সে পথ হারিয়েছ৷
জামালের মা ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷
-বাইজান আমনে বিতরে গিয়া বহেন।আমি শরবত কইরা আনি৷
তানজিনা ধীরে ধীরে উঠে ঘরে চলে যায়। আজুয়াদও যায়।
-তানু তুমি ভালো আছো?
-তোমার বাড়ি থেকে অনেক বেশি। তা হঠাৎ কি মনে করে?
-কেন আমিতো এখানে আসি।
-সেটা মাসের প্রথম শুক্রবারে আজ তো মঙ্গলবার আবার মাসের শুরুও নয় ।
-জমির একটা মামলা ছিলো। তার হাজিরা দিতে এসেছি ভাবলাম তোমাকে দেখে যাই।
-ভালো করেছো, খেয়ে যেও। কিন্তু তুমি তো মিষ্টি কুমড়া খাও না। আমি জামালের মাকে বলে আসি একটু তরকারি আলাদা করে রাখতে।
-থাক না। একদিন খেলে কিছু হবে না। তুমি বসো।
-যা অপছন্দ তার জন্য জীবনের একমুহূর্তও ব্যয় করা উচিত না। তাতে বিরক্তি বাড়ে।
বলে তানজিনা চলে যায়।
এই কয় মাস আজুয়াদ তানজিনাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করতে চেয়েছে, যদি মেয়ে হয় তবে সে কি করবে? কিন্তু আজকেও জিজ্ঞেস করতে পারে নি।
এভাবে আরও দুই মাস কেটে যায়।
একদিন ফজরের সময় জামালের মায়ের চিৎকার শুনা যায়।
-ওরে কেউ আছুননি? ছুড়াইয়া(জলদি) বাইর অইন নাইলে সব্বনাশ অইয়া যাইবো।
চিৎকার শুনে খান বাড়ির সবাই বের হয়ে উঠানে আসে।
রেহানা খাতুন বিরক্ত হয়ে বলে,
-কি লা? এমনে চিল্লাছ কেন জামাইল্যার মা? কেউ মরছে নি।
বিলাপ করে জামালের মা বলে,
-আল্লা বিবিসাব ইতা কিতা কইন? ভাবীর বেদনা উঠছে। ছুড়াইয়া কিছু করুইন।
রেহানা খাতুন মুখ বিকৃত করে,
-উঁহ! খুব এলহা থাহুনের সক উতলাইয়া উঠছিন অহন।
আমজাদ খান স্ত্রীকে উদ্দশ্য করে বলে,
-হারামজাদি তরে মনডায় চাইতাছে কিযে করাবার লাইগ্যা। কিন্তুক অহন সময় নাই৷ জামাইল্যার মা তুই যা দৌড়াইয়্যা গিয়া দাই আর ঐ বাড়ির করিম মুন্সির বউরে ডাইক্যা লইয়া আয়। আর তোমরা হগ্গলতে লও পুরান বাইত যাওন লাগবো।
জামালের মা চলে যায় দাই ডাকতে।
রেহানা খাতুন মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-হেন কি মেমানি নাহি? যে হগ্গলতের যাওন লাগবো।লও তুমার লগে আমি যাই আর হেরা বাইত থাহুক। আফিয়া তুই বেইল(দিন) উঠলে মুরগীডি ছাইড়া খাওন দেইছ।
সানজিদা বলে,
-কইছিলাম কি আম্মা এমুন সময় আমি না থাকলে মাইনসে নিন্দা করবো। লাক কতার এক কতা, হেয় তো আমার বইন।
-অঁহ! আইছে বইন। এই সাতমাসে একবার বইনের মুকও দেহ নাই। অহন ঢং কইরো না।
আমজাদ খান খেঁকিয়ে উঠে,
-তুমরা কি এহানে খারাইয়্যা তামশাই করবা নাকি, যাইবাও।
-আরে তুমার ছোড বউমা মইরা যাইতো না। আইবোদ আমারও অইছে লও যাই।
তারা তিনজন যাচ্ছিলো তখন রাফিয়া এসে বলে,
-আব্বা আমিও লগে যামু।দেহি আমার কপালো কি লেহা আছে।
কেউ কিছু বলতে পারলো না। কারণ আজ সত্যি সবাই দেখতে চায় ওদের কপালে কি লেখা আছে।
চারজন মিলে পুরনো বাড়ি গেলো।
আমজাদ খান বাইরে অস্থির পায়চারি করতে লাগলো।
ভেতর থেকে রেহনা খাতুন আর দাই বের হয়ে এলো।
একরাশ আশঙ্কা নিয়ে রেহানা খাতুন বলে,
-আবরারের আব্বা হুনেন, ছোড বউয়ের অবিস্তা তো বেশি বালা না।
আমজাদ খান তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
-কি কও এইগুলান তুমি।
দাই একটু বিলাপের সুরে বলে,
-হরে আমজাত। আইজ চল্লিশ বস্সর আমি দাইয়ের কাম করি এমুন দেহি নাই।যা খুশি অইবার পারে৷ তুই হেরে এড্ডা ডাক্তরের বারাত লইয়া যা।
আমজাদ খান কথাটা শুনে দমে যায়। তারপর গুরুগম্ভীর গলায় বলে,
-আপনের আতে গেরামের বেবাকতের আইবোদ অইছে আজুর বউয়েরটাও অইবো।
এই গেরামে বেবাক ডাক্তর বেডা। খান বাড়ির বউরে বেগানা(পর) পুরুষ মাইনসে আত লাগাইবো আমি আমজাদ খান বাঁইচ্যা থাকতে হেইডা অইবো না।
দাই যেন একটু রেগে যায়।
-তয় কেউ মরলে আমারে দুশ দিছ না।মাও মরতারে, বাইচ্চাও।
বলে দাই ভিতরে গেলো। পিছন পিছন রেহানা খাতুন।
রাফিয়া উঠানে আতাফল গাছটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ছে।
আর সানজিদা ভেতরে তানজিনার পাশে বসে মনে মনে দোয়া করছে যেন মেয়ে হয়, না হলে যেন বাচ্চাটা মারা হয়। কারণ খান বাড়ির প্রথম ছেলের জন্ম সে দিতে চায়।
পূর্বাকাশে নতুন সূর্য রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে।
তখন আমজাদ খান ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। কিন্তু আওয়াজটা একবারই হয় তারপর থেমে যায়।
রাফিয়ার বুকের ভিতরটা ধুকপুক শুরু করে।
আমজাদ খান দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ বেরিয়ে আসে না।
আমজাদ খানের মনে ভয় ঢুকে যায়।
তিনি মনে মনে বলে,
-তয় কি কুনো বদ(খারাপ) খব্বর(খবর)?
চলবে