সতীনকাঁটা পর্ব ১
তোর কপাল পুড়ছেরে তানজিনা আফা।তোর জামাই নতুন বউ লইয়া আইছে দুয়ার খুইল্যা বাইরে আইয়্যা দেখ।খুবতো তহন ভাইগ্যা বিয়া বইছিলি। এহনতো জামাই হত্তীন লইয়া আইছে।
এমন না আমি দেখেনি ঘটনাটা। সবকিছু দেখেই ঘরে খিল এঁটেছি। তবুও আমাকে বার বার ডেকে কথাগুলো বলে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে বড়জা সানজিদা।
সম্পর্কে আপন চাচাতো বোন আমরা। বয়সেও আমিই সানজিদার চেয়ে চার বছরের বড়। কিন্তু ছোট থেকেই সানজিদা আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না।
সানজিদা কখনো চায় নি আমি খান বাড়ির ছোট বউ হয়ে আসি। এমনকি আমার আর আজুয়াদের রিয়েতে দুই বাড়ির কেউ রাজি ছিলো না।
আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি তো একদমই না। কারণ প্রথমত তারা এখনি তাদের ছোট ছেলেকে বিয়ে করাতে চায় নি৷ দ্বিতীয়ত তারা চেয়েছিলো বড় ছেলের বউয়ের মতো স্বল্প শিক্ষিত আর কম বয়সী মেয়ের সাথে ছোটো ছেলের বিয়ে দিতে ।
সেদিকে থেকে আমি অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ি।আবার বয়সেও আজুয়াদের থেকে মাত্র দু’বছর ছোট। আবার গায়ের রঙটাও হালকা চাপা।
দুই বাড়ির কাউকে আমাদের রাজি করাতে পারছিলাম না। এদিকে আমার মা-বাবা আজুয়াদের সাথে আমার সম্পর্কের কথা জানতে পেরে বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেলেন।শত চেষ্টা করে যখন আমার বিয়েটা ভাঙছিল না তখন একরকম নিরুপায় হয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি আমি আর আজুয়াদ।
বাড়ির মানসম্মান রক্ষা করতে সবাই বাধ্য হয়ে আমাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছিলো।
শ্বশুর বাড়ি, বাপের বাড়ি কিংবা সমাজের মানুষের দেওয়া অপমান-লাঞ্ছনা সব তখনি তুচ্ছ হয়ে গেছে যখন আজ নিজের স্বামী আজুয়াদকে বরের বেশে নতুন বউয়ের সাথে বাড়ির দরজায় দেখলাম।
বদ্ধ ঘরে বসে এসব কথাই ভাবছে তানজিনা ৷
এদিকে আমজাদ খান তার স্ত্রী রেহেনা খাতুনকে জোরে হাঁক দিয়ে বলে,
-আবরারের মা, এত দূর থিকা আইসা আর কতক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকমু? নতুন বৌ ঘরে তুলো।
পান চিবোতে চিবোতে রেহানা খাতুন বলে,
-বউ ঘরে কেমনে তুলুম? আজুয়াদের বউয়ের লাইগ্যা বানানি সব গয়না তো দিয়া দিছি। আর তোমাগো উচ্চ শিক্ষিত বউ তো ঘরে খিল দিছে।
আমজাদ খান বলে,
-আল্লা দিলে তোমারে তো কম গয়না দেই নাই। ঐখান থেকে একটা দিয়া নাহয়..
-তুমি চুপ থাকো শুভ অশুভের একটা ব্যাপার আছে ।ঐ খানদানি গয়নাগুলা আজুয়াদের বউয়ের লাইগ্যা ।হেইগুলাতে নতুন বৌয়ের হক আছে। ঐ গয়না ছাড়া আমি নতুন বৌ ঘরে তুলুম না।
আমজাদ খান বিরক্ত হয়ে তানজিনার ঘরের দিকে গেলেন।
অনেকবার ডাকার পর কোন সাড়া না পেয়ে। একসময় রেগে গিয়ে বলে,
-এবার যদি বাইর হইয়া না আসো তবে দরজাটা ভাইঙ্গা ফালামু ছোট বউমা।
তানজিনা ভেতরে থেকে শ্বশুরের গলা শুনতে পায়।
তানজিনা ধীর পায়ে খিল খুলে দেয়।
-ছোট বউমা ভালা কইরা হুনো(শুনো)। পুরুষ মাইনসের চাইরডা বিয়া জায়েজ। এহন বিয়া হইয়া গেছে নতুন বউয়ের সাথে বইনের মতো থাকবা। যাও দেহি অহন তোমার শ্বাশুড়ির দেওয়া খানদানি বালাজোড়া লইয়া নতুন বউরে বরণ করতে আসো।
চোখে পানি চলে আসে তানজিনার। অস্ফুটস্বরে শ্বশুরকে বলে,
-বাবা, আমি বরণ করবো!
-তুমি নাইলে আর কে করবো?এ বাড়ির বউ হিসাবে তোমার একটা দায়িত্ব আছে না?যাও অহন জলদি করো, আর কথা বাড়াইয়ো না। নতুন বৌ সারাদিন বাইরে দাড়াইয়্যা থাকবো নি?
তানজিনা চুপচাপ আলমারি থেকে গয়নার বাক্সটা বের করে। বালাজোড়া দেখে তার অতীত মনে পড়ে।
যেদিন তানজিনাকে তার শ্বাশুড়ি বালা পরাচ্ছিলো পাড়া-প্রতিবেশী সবাই ছিলো।
একসময় পাশের বাড়ির সালেহা বলে উঠে,
-কিছু মনে কইরো না আবরারের মা তোমার ছোট বউয়ের রঙটা একটু ময়লা। ধলা অইলে বালা জোড়া হাতে ফুইট্টা থাকতো।
-কপাল সবই কপাল গো আফা। নাইলে পোলা এমুন কাম করে? শত্তুর পেটে ধরছি।
-হুনছি তোমার ছোট বৌ আর আবরারের বউয়ের বইন লাগে?
-ঠিকই হুনছো। হেরা হুদ্দোর(আপন) চাচাতো বইন।
-তয় এগো রঙে এত ফারাক কেন?
এই কথা শুনে পাশ থেকে সানজিদা বলে উঠে,
-চাচী আমাগো পুরা বংশে সবাই ধলা। খালি জেঠী মানে তানজিনা আফার মায় কাইল্যা। আফা হের মা’র মতো হইছে।
-অ্যঁ, বলে মুখ বাঁকায় সালেহা বেগম।
-আর দুইন্যার বেবাক মাইয়া থুইয়্যা আমার পোলার ওরেই বিয়া করা লাগলো। না আছে রূপ, না আছে বয়সে তালগোল। এই মাইয়্যা লইয়া আমার আজু যে কেমনে ভাত খাইবো কে জানে?
– ছোট বউমা হলো তোমার।
আমজাদ খানের ডাকে বর্তমানে ফিরে আসে তানজিনা।
-আসছি বাবা, বলে গয়নার বাক্সটা আলমারিতে রেখে বালা জোড়া নিয়ে বের হয়।
তারপর মাথানিচু করে সেটা শ্বাশুড়ির হাতে দেয়।
রেহানা খাতুন নতুন বৌকে বালা জোড়া পরিয়ে বরণ করে।
-দেখছো নি আম্মা নতুন ভাবীর হাতে বালা জোড়া কি সুন্দর ফুটছে।, কথাটা বলে আজুয়াদের ছোট বোন আফিয়া।
-ফুটবো না? হাজারে এক নতুন বৌমা। গায়ের রং তো না যেনো কাঁচা অলদি(হলুদ) ।
আজুয়াদ এসব আর নিতে পারছিলো না তাই গটগট করে ভেতরে চলে গেল।
বাকিরা নতুন বৌকে ঘরে নিয়ে যাবে সেই সময় সানজিদা ফোঁড়ন কাটে,
-নতুন বউরে কোন ঘরে নিমু আম্মা?
-এ আবার কেমুন কথা বড়বৌমা? নতুন বৌ তার সোয়ামীর ঘরে যাইবো।
সানজিদা তানজিনাকে শুনানোর জন্য জোরেই বলে,
-তাইলে তানজিনা আফা কই থাকবো?
রেহানা খাতুনও উঁচু গলায় বলে,
-হেয় দরকার হইলে আইজ আফিয়ার ঘরে থাকবো। নিজের সোয়ামীরে আঁচলের বাইন্ধা রাখুনের লাইগ্যা রূপও লাগে হেইডা হের অহন বুঝোন লাগবো।
আফিয়া তানজিনাকে খুব একটা পছন্দ করে না। তাই মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-আমি কারো লগে এক ঘরে থাকবার পারুম না। তাছাড়া ছোট ভাবীরও তো একটা আলগা ঘর লাগবো নাকি?
আমজাদ খান ধমকের সুরে বলে,
-এই বাড়িত কি ঘর কম নাকি?দরকার হইলে ছোটবউ এহন থিইকা দক্ষিণের ঘরে থাকবো। যাও তোমারা, এই নিয়া আর কোন কতা না। নতুন বৌ লইয়া ঘরে যাও সে অনেকক্ষণ দাড়াইয়া আছে।হের কষ্ট হইতাছে।
শ্বশুরের এমন কথা দুঃখের মধ্যেও হাসি পেলো তানজিনার।
যেদিন বিয়ে করে এসেছিল টানা আট ঘন্টা খান বাড়ির প্রধান ফটকে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো সে।
যখন তার বাবা আর ছোট চাচা এসে মাফ চেয়েছিলো তখন তাকে ঘরে তোলা হয়েছিল ।
কিন্তু আজ সেই আমজাদ খান নতুন বউয়ের কষ্ট খুব সহজেই বুঝতে পারছে ।
বুঝবে নাই-বা কেন?
নতুন বৌ যে আর কেউ না তারই ছোট বোনের একমাত্র মেয়ে রাফিয়া।
নিজের ভাগ্নীকে কি করে কষ্ট দিবেন তিনি।
গতকাল হঠাৎ আজুয়াদকে নিয়ে তার বাবা আমজাদ খান তার ফুপুর বাড়ি গিয়েছিল। যাবার সময় বলেছিলো, আম-কাঁঠালের দাওয়াত নিয়ে যাচ্ছে ।সেখান থেকে আজ ফিরলো।সাথে রাফিয়াকে নিয়ে এলো খান বাড়ির বউ বানিয়ে।
-পাত্তরের মত খারাইয়্যা না থাইক্যা ঘরেত্তে জিনিস-পত্তর নিয়া আসেন।
আফিয়ার কথায় সম্বিত ফিরে পায় তানজিনা।
অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– আমাকে কিছু বলেছো আফিয়া?
-আপনেরে কমু না তয় কারে কমু? মা’য় কইছে আপনার জিনিসপাতি নিয়া দক্ষিণের ঘরে যাইতে। দেরী কইরেন না নতুন ভাবী জিনিস গুছাইয়া গোসল করবো। বৈকালে পাড়া-প্রতিবেশী আইবো বউ দেখতে। জলদি করেন।
আফিয়ার এমন ব্যবহারে তানজিনা মোটেও আবাক হয় নি। কারণ এবাড়িতে আসার পর কেউ তার সাথে ভাল ব্যবহার করে নি।
যার কাছ থেকে তানজিনা ভালবাসা আর সম্মান পেয়েছিলো সে ছিল তার স্বামী আজুয়াদ। কিন্তু আজ সেই স্বামীই তাকে জীবনের চরম আঘাত দিলো।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে জিনিসপত্র গুছাতে চলে গেলো।
ঘরে গিয়ে দেখে তার শ্বশুর আর আজুয়াদ ছাড়া সবাই আছে।সবার মধ্যমনি হয়ে খাটের উপর বসে আছে রাফিয়া।
তানজিনার মনে হচ্ছে কেউ তার বুকের ভিতরে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করছে। কষ্টে দু’ফোটা পানি বের হয়ে এলো। কারও নজরে আসার আগেই সেই পানি মুছে ফেলে সে।
তানজিনা চুপচাপ জিনিসপত্র গুছানো শুরু করে দিলো। সে তার কাপড়-চোপড় ব্যাগে ভরছিলো আর ফাঁকে ফাঁকে আঁড়চোখে নিজের ঘরটা দেখছিলো।
ঘরের প্রায় সব জিনিসই তানজিনার বাবার দেওয়া। গয়না থেকে শুরু করে সংসার সাজানোর সব জিনিসই দিয়েছিলো তানজিনার বাবা তারেক ভুঁইয়া। তিনি ভেবেছিলো এসব জিনিস দিয়ে মেয়ের অপরাধ ঢেকে দিবেন।
কিন্ত একবারও এটা ভাবেন নি যে ছেলেটা তার মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছিলো সেও সমান অপরাধী।না এটা সমাজের কেউ ভোবতেই পারে না। কারণ এসব ক্ষেত্রে ছেলেকে কখনোই অপরাধী সাব্যস্ত করা হয় না।
জিনিস গোছানোর সময় সবার কিছু ভাসা ভাসা টিপ্পনী তানজিনার কানে আসছিলো,
-রূপ না থাকলে খালি মিষ্টি কতায় কিছু হয় না।
-কই তানজিনা কই আমাগো রাফিয়া। মাশাল্লাহ দেখতে একদম আসমানের পরী। রঙটাও পাইছে অক্করে নানির লাহান ।
চোখের পানি আটকানোর অনেক চেষ্টা করছিলো তানজিনা। কিন্তু তানজিনার মনে হলো আজ নিজের চোখের পানিও তার শত্রু হয়ে গেছে। যতই বাধা দিচ্ছে আবার দ্বিগুন গতিতে দু’গাল দিয়ে বেয়ে পড়ছে।
রেহানা খাতুন তানজিনাকে তাড়া দিয়ে বলে,
–বলছি এখন যা লাগে খালি সেগুলান নিয়া ঘরটা খালি করো।বাকি জিনিস পরে নিও।এতো ভারী শাড়ী গয়না পইরা রাফিয়া আর কতক্ষণ থাকবো?
সানজিদা আগুনে ঘি ঢেলে বলে,
-ব্যাগ গুছাইতে এতো সময় লাগে না আম্মা। তানজিনা আফা এড্ডু বেশিই কানতাছে তাই সময় লাগতাছে।
হুংকার দিয়ে ওঠে রেহানা খাতুন,
-তোমার চক্ষের পানির কারণে যদি আমার আজু আর রাফিয়া সংসারে কোন অশান্তি হয় তোমার খবর আছে। আরে কেমুন ইস্ত্রিরী তুমি সোয়ামির ভালা বুঝো না।
তানজিনা কোনরকমে কিছু কাপড়-চোপড় গুছিয়ে ঘর হতে বের হয়ে যাচ্ছিলো, তখনই আজুয়াদ তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
-তুমি কোথায় যাচ্ছো,তানু?
তানজিনা এই ঘটনার পর আজুয়াদের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেনি। আর তার ইচ্ছেও করছেনা তাকাতে তাই মাথা নিচু করে রইলো।
রেহানা খাতুন খাটে বসেই জবাব দিলো,
-রাফিয়া নতুন বৌ। তাই তোর আব্বা আর আমি ঠিক করছি ছোটবৌমা কয়েকদিনের জন্য দক্ষিণের ঘরে থাকবো।
এই কথা শুনে ক্ষোভে ফেটে পরলো আজুয়াদ। চিৎকার করে রাফিয়ার দিকে আঙুল তুলে বলে,
-আমার ঘরে থেকে কেউ বের হলে এই মেয়ে বের হবে তানু না।
কথাটা শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে গেল আর রাফিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো।
-চলবে?
#সতীনকাঁটা পর্ব -১
লেখিকাঃNosrat Monisha
বিঃদ্রঃএটা একটা সামাজিক গল্প।
আমার কাছে সামাজিক কাহিনি মানে পল্লীসমাজ, গৃহদাহ, বিষবৃক্ষ ইত্যাদি উপন্যাস। যা শিখেছি সমাজের সেসব কমতি নিয়ে লিখতে চেষ্টা করেছি।
আমি ইসলামি কিছু সর্ট ফ্লিম করতে চাই আমাকে কি কিছু গল্প দিতে পারবেন
০১৯২০৩৮০৩০২ আমাদের নাটকে কোন মেয়ে থাকবে ন বা দেখাতে পারব না।
এবং ইসলামি নাটকে কিছু শিক্ষানিয় বিষয় থাকতে হবে।
দূঃখিত ভাইয়া। লেখিকার নিষেধ আছে।যেহেতু লেখিকার অনুমতি নেই আপনি তার লেখা নিলে কপিরাইট আইনের আওতায় মামলা খেতে পারেন।