সংসার পর্ব-১৫

0
1491

#সংসার
#পর্ব_১৫

#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি।

নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছি না। চিৎকার করে ডুকরে কেঁদে ওঠলাম। নাহ আমার রুদ্র এসব করতে পারে না, কখনোই না। অনেক বেশি ভালোবাসি। মন কিছুতেই চোখের দেখাকে বিশ্বাস করছে না।
আচ্ছা আমার মন যেটা বলছে সেটা কী সত্যি নাকি চোখের দেখা সত্যি?
সত্যিই কী তবে রুদ্র পূর্ণতার জন্য ভালোবাসার নাটক করছে?

মনের ভিতর হাজার প্রশ্ন আসলেও মনকে শক্ত করে ওঠে দাড়াই। এটা আমার সংসার রুদ্র মানুক আর না মানুক কখনোই আমি এই সংসার কাউকে দিব না। এই সংসার এই স্বপ্ন সব আমার গুছানো। এই কয়টা মাসে সবাইকে আপন করে নিয়েছি কাউকে ছেড়ে কোথাও যাব না কখনোই না। আমার সংসার, আমার ভালোবাসা, আমার মেয়ে কাউকেই আমি ছাড়তে পারব না সবাইকে চাই। আর যতকষ্ট হোক আমি সবাইকেই ধরে রাখব।

২৯.
আমি ওঠে ফ্রেশ হয়ে পূর্ণতার পাশে শুয়ে পরি। তখনই রুদ্র স্যার রুমে আসে। আমার দিকে কিছুক্ষণ অপরাধি দৃষ্টিতে তাকালে আমি পাত্তা না দেওয়ায় ওয়াশরুমে চলে যায়। আজ না চাইতেও রুদ্র স্যারের সামনে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তাই আমি রুদ্র স্যার ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার আগেই রাইমা আপুর রুমে চলে যাই। আজকের রাতটা ওখানেই থাকব।

আমাকে রাইমা আপু তার রুমের সামনে দেখে বলে-
“মেঘ তুমি এখানে, কিছু বলবে? নাকি ভাইয়া কিছু বলেছে।”

“না আপু তেমন কিছুই না। তুমি দুইদিন পর চলে যাবে মন খারাপ লাগছিল তাই তোমার কাছে চলে আসলাম।”

আমি আপুর কাছে বসতেই আপুকে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি ডুকরে কেঁদে ওঠি, ভিতরের অভিমানগুলো কান্না বেরিয়ে আসে। আমি আপুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করছি। তখনই রুশা ম্যাম রাইমা আপুর ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে আসে।

“কান্নাকাটি করছো কেন মেঘ? রাইমা চলে যাবে ভেবে মন মানছে না কি?”

আমি রুশা ম্যামের কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ উত্তর দেই। রুশা ম্যাম মাত্রই শাওয়ার নিয়েছে। হাতে ভিজানো জামা যেটা আমি তখন ছাদে পরা দেখেছি। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় জিঙ্গেস করলাম।

“ম্যাম এত রাতে গোসল করলেন যে গরম লাগছে নাকি?”

রুশা ম্যাম মুচকি হেসে বলল-
“মেঘ তুমি কি ছোট নাকি, মেয়েদের বিশেষ কিছু মুহূর্ত পর গোসল করতে হয়। তুমি জানো না, আর তাছাড়া তোমার তো বিয়ে হইছে জানার কথা ছিল।”

আমি রুশা ম্যামের কথায় তার দিকে আরো সন্দেহের চোখে তাকাই। কোন বিশেষ মুহূর্তের কথা বলছে রুশা ম্যাম তার তো এখনো বিয়ে হইনি তবে কি আমার ভাবনাই ঠিক?
আমি রুশা ম্যামকে প্রশ্ন করব তার আগেই রুশা ম্যাম রুম থেকে চলে যায়। তাই আমি রাইমা আপু প্রশ্ন করলাম-
“আপু রুশা ম্যাম তোমার ওয়াশরুমে আসলো কেন? আর তাছাড়া আপু বিশেষ মুহূর্ত বলতে কি বুঝিয়েছে।”

আপু আমার কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে ঔঠল। মনে হচ্ছে আমি কোন মজার জোকস শুনিয়েছি।

“ওহহ মেঘ তুমি কি বাচ্চা মেয়ে? আপু কথা বলার ভঙ্গি দেখে বুঝনি সে তোমার সাথে মজা করছে আর তুমি কি না সিরিয়াসলি নিয়ে নিলা। পাগল আপুর কি বিয়ে হইছে?
আর আজ এমনিতেই আমার রুমে এসে বলল তোর ওয়াশরুমে একটু ইউজ করা যাবে গরম লাগছে খুব গোসল করব। আর সেই সাথে তোমাকেও কল দিয়ে রুমে ডাকতে বলল দুদিন পর চলে যাব তাই গল্প করতে। কিন্তু তুমি তো কল দেওয়ার আগেই চলে আসলে।”

আমি রাইমা আপুর কথা শুনে কিছু না বলে চুপচাপ গুটিয়ে পাশে শুয়ে পরলাম। কি করে বলব সবটা তাকে? রুশা ম্যাম মজা করে না ওটা সত্যিই বলেছিল।

সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গতে দেখি আমি রুদ্র স্যারের বুকের মাঝে শুয়ে আছি। আমি তো রাতে রাইমা আপুর কাছে শুয়ে ছিলাম তবে এখানে কি করে আসলাম। ভাবতে না ভাবতেই বাসার মেইন দরজার কলিং বেল বেজে ওঠলো।

কালকে রাইমা আপুর বিয়ে। বাড়িতে প্রায় সব মেহমান এসেছে, রাতে সবাই মিলে মজা করায় অনেক রাত পর্যন্ত জেগেছে। তাই এখন সকাল ৭ টা বাজলেও কেউ ঘুম থেকে ওঠে নাই।

আমি ওঠে মেইন দরজা খুলে দিয়ে দেখি দুইজন ছেলেমেয়ে দাড়িয়ে আছে। দুজনই দেখতে রুদ্র স্যারের বয়সি হবে। মেয়েটা দেখতে অনেকটা বিদেশিদের মতো গায়ের রং ধবধবে ফর্সা, চুল গুলো হালকা লালচে কালারের। আমি কিছুক্ষণ দাড়িয়ে পর্যবেক্ষন করলাম কারা হতে পারে?
তখনই মেয়েটা বলে ওঠলো।

“হেই ইউ, কি ভাবছো আমাদের ভিতরে ডুকতে দিবে না?”

আমি চুপচাপ দরজা ছেড়ে পাশে দাড়ালাম। তারা আমাকে ঠেলে সরাসরি উপারে রুদ্র স্যারের রুমে চলে গেল। আমিও দরজাটা লাগিয়ে তাদের পিছুপিছু উপরে চলে আসলাম।

রুদ্র স্যার এখনো ঘুমিয়ে আছে। আর তারা দুইজন গিয়ে রুদ্র স্যারকে তুলছে। ফর্সা দেখতে বিদেশি মেয়েটা রুদ্র স্যারকে তার বাহুতে তুলতেই রুদ্র স্যারের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ঘুম চোখে বলে-
“‘উফফফ জেনি ছাড় তো। রাতে ঘুম হয়নি একটু ঘুমাতে দে।”

তারা দুইজন চমকে গিয়ে বলল-
“রুদ্র তুই অবাক হসনি আমরা আসছি দেখে?”

“এখানে অবাক হওয়ার কি আছে। তোরা আজ না তো কাল আসতি জানতাম। এখানে অবাকের কি আছে। যা তো একটু ঘুমাতে দে।”

৩০.
তখনই বেডের পাশ থেকে ছেলেটা গ্লাসের পানি নিয়ে চোখের উপর ঢেলে দিয়ে বলল-

“শালা বিয়ে করে বউয়ের সাথে সারারাত রোমান্স করে এখন আর বন্ধুদের চিনিস না। এত কষ্ট করে রাত বারোটার বাস ধরলাম সকাল সকাল এসে তোকে চমকে দিব। কিন্তু তোর ভার্সিটি লাইফের মত এসে আজও শুনতে হলো ‘এখানে অবাক হওয়ার কি হয়েছে?’ সালা তুই কি মাবন না এলিয়েন ধুররর।”

রুদ্র স্যারের চোখে পানি পরতেই চোখ ডলে বিরক্ত মাখা ভঙ্গিতে ওঠে বসে।
“কুল ব্রো কুল। সে কপাল আমার নাই রে বউয়ের সাথে রোমান্স সে তো স্বপ্নেই দেখি বাস্তবে আর হবে না।”

রুদ্র স্যারের কথায় তারা তিনজন হেসে ওঠে।
“যদি বউয়ের সাথে রোমান্সই করতে না পারিস তবে এই রকম হিরোদের মতো চেহারা আর বডি দিয়ে কি হবে বল? আমাকে দেখ বিয়ে ঠিক করে নিয়েছি আর হবু বউকে নিরাপদে রেখে অন্যমেয়েদের ও পটিয়ে নিচ্ছি।”

তখনই পাশে থাকা মেয়েটি রেগে সেই ছেলেটির গায়ে কয়েক টা কিল দিয়ে বলল-
“সালা তোর একটা দিয়ে হয়না, আরো লাগে? দাড়া সব বের করছি।”

“মাফ কর বুইন। আমার মনে ছিলো না তুই যে পাশে আছিস। তোর মতো বউ থাকতে আর কি লাগে।”

রুদ্র স্যার তাদের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে-
“তোরা একটুও পরিবর্তন হবি না? দেখবি তোদের যখন বেবী হবে তাদের টম এন্ড জেরি দেখার প্রয়োজন হবে না। তোদের দেখেই দিন পার করে দিবে।”

আমি এতক্ষণ তাদের কথা দরজার সামনে দাড়িয়ে শুনছিলাম আর তাদের দেখে এটা বুঝলাম তারা হয়ত রুদ্র স্যারের বেস্ট ফ্রেন্ড নয়তো রুদ্র স্যার কারো সাথে এত ফ্রি না। হঠাৎ বেডের পাশে আমার ফোন বেজে ওঠায় আমি রুমে ডুকে বেড থেকে ফোন নিতে যাই।

তখনই মেয়েটা চিৎকার করে বলে ওঠে-
“এই এই রুমে এসো না। এই রুমের ভিতরে ডুকছো কেন? কে তুমি এই বাড়িতে নতুন আসছো বুঝি?”

আমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি। আমার রুমের ভিতরে আমি ডুকব না, কিন্তু কেন?

“এই জেনি তুই কি আমার বউকেও আমার রুমে আসতে দিবি না।”

রুদ্র স্যারের কথা শুনে মেয়েটি বলল-
“এটা তোর বউ, আহারে আগে বলবি তো। ভাবি এসো এসো। আগের বার তুই তোর রুমে বাহিরের একটা ছেলে ডুকছিলো বলে, তুই সেদিন যে কান্ড করলি মনে পরলে এখনো গায়ে কাটা দেয়।”

“রুদ্র তুই আবারো আমাকে ছ্যাকা দিলি। আমি দরজা খুলার সময় সামনে ভাবিকে দেখে ভাবলাম হয়ত লাইন মারার জন্য আরো একটা মেয়ে পাইছি কিন্তু তুই মাত্র যে কথাটি বললি তাতে আমি হার্ট এ্যাটাক করলেও করতে পারি।”

ছেলেটির কথা শুনে পাশের মেয়েটি তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠলো। দুই একটা পিঠে কিল বসালো।

রুদ্র স্যার আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ছেলেমেয়ে দুটার নাম জেনি আর আকাশ দুজনেই কাজিন সেই সাথে তারা ফিওন্সি। স্কুল জীবন থেকে তাদের তিনজনের বন্ধুত্ব। কলেজ ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় পড়লেও ভার্সিটিতে আবার পরিচয় হয় এবং সেই থেকে তাদের বন্ধুত্বটা গভীর হয়। ভার্সিটি শেষ হওয়ার পর চাকরির জন্য তিন জনে তিন জায়গায় থাকলেও ভার্চুয়ালে নিয়মিত যোগাযোগ হয়।

জেনি আপুর সাথে কথা বলে বুঝলাম সরল প্রকৃতির রাগী একজন মেয়ে তবে রাগটা যখন তখন শুরু আবার শেষ। আর আকাশ ভাইয়া যত যা করুক জেনি আপুর উপর ভালোবাসা অনেক। যতগুলো গার্লফ্রেন্ডের কথা বলছে সবার কথা সরল মনে জেনি আপুর সামনে বললে আপু রাগে কয়েকটা কিল বসিয়ে একটু গালি দিয়ে রাগ শেষ। আর ভাইয়াকে দেখে মনে হচ্ছে সে আপুর এই রাগটাকে বেশ ইনজয় করে।
আমি তাদের দুষ্টুমি ভরা কথা শুনে মুহূর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেল। আমিও তাদের কথায় সাই দিলাম।

“মেঘ জানু তুমি নাকি আমার একমাত্র সুইটি কুইটি বেস্টুকে রোমান্স করার সুযোগ দাও না? আরে না পারলে বলো, আমি তোমাকে রোমান্স শিখাব।”

“একদম না ভাই, তোর রোমান্স শিখাতে হবে না। পরে দেখা যাবে তোর থেকে শিখে আমার বউও কথায় কথায় বকা আর কিল দিবে। আমি আকাশের মতো আমার পিঠ আর কান সরকারি করে দিতে পারমুনা ভাই। তোর প্যাঁচানো কথা আর কিল বাপরে বাপ। তার থেকে আমার বউ যেমন আছে তেমনই থাকুক। রোমান্স ছাড়া জীবনে কান আর পিঠের অনেক প্রয়োজন আছে।”

রুদ্র স্যারের কথায় আকাশ ভাইয়া দুঃখ প্রকাশ করল। আবার তিনজনই শব্দ করে হেসে ওঠলো। আমি একদৃষ্টিতে রুদ্র স্যারের নিঁখুত সেই হাসির দিকে তাকিয়ে রইলাম। কি নিঁখুত সেই হাসি কে বলবে এই হাসির পিছনে কত বড় প্রতারনা লুকিয়ে আছে।

জেনি আপু আর আকাশ ভাইয়াকে একটা রুম দেওয়া হলে সেখানে গিয়েও তারা গন্ডগোল পাকালো।

“রুদ্র আমি এই আকাইশ্যার সাথে এক রুমে থাকমু না। এমনিতেই ওর চরিত্র ঠিক না।”

“হুমম রুদ্র আমিও এই কুটনির সাথে থাকমু না। ওর কিল খেতে খেতে দেখবি পরের দিন আমি তক্তা হয়ে গেছি।”

“আরে বাপ মাফ কর, তোদের তো বিয়ে হবে তবে এত কথা কেন। যদি না থাকতে পারিস তাহলে বিয়ের পর কিভাবে থাকবি? এখন বাড়িতে অনেক মেহমান দুজনকে দুটো রুমে কি করে থাকবি বল?”

“আমি এসব জানিনা রুদ্র, কিন্তু আকাইশ্যার সাথে থাকমু না। তারপর বিয়ের আগে দেখবি আমার সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। দরকার পরলে আমি তোর সাথে থাকব তবুও ওর সাথে না।”

তাদের কথা শুনে আমি বললাম।
“রুদ্র স্যার আর আকাশ ভাইয়া এক সাথে ঘুমাক আর আমি রাইমা আপু আর জেনি আপু এক সাথে থাকব।”

আমার কথা শুনে সবাই রাজি হলেও রুদ্র স্যার কিছুক্ষণ করুন চোখে তাকালেও আর কিছু করার ছিল না তাই কিছু বলল না।

আমিও কিছুদিন রুদ্র স্যারের সাথে থাকতে হবে না ভেবে খুশী হলাম অন্তত কিছুদিন তো দূরে থাকি। এই মুহূর্তে তার সাথে থাকলে রাইমা আপুর বিয়েটা উপভোগ করতে পারব না।
মনে মনে সব কিছু ঠিক ভাবলে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে।
“আমি পারবো না রুদ্র, কখনই পারবোনা তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে। হারানো জিনিস ফিরে পেয়ে হারানোর ব্যাথা কি সেই জানে কতটা কষ্টের।”

আমি চোখের জল মুছে সিদ্ধান্ত নিলাম এভাবে কষ্ট পাব না। রুদ্র স্যারের নিজের মুখ থেকে সবটা শুনব কেন করল এমন? এর পিছনে শুধু কি আমার ভুল নাকি অন্য কোন সত্যিই লুকিয়ে আছে। যতই যা হোক এটা আমার সংসার। আমি গুছিয়ে রাখব আমার সংসারের যত্নে গড়া ভালোবাসার জিনিস গুলো।

#চলবে,,,,,,

[কোথাও কোন লেখা ভুল হলে ক্ষমা করবেন। ভালোবাসা নিবেন।💚]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে