সংসার পর্ব-১২

0
1750

#সংসার
#পর্ব_১২

#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি

আমি রাইমা আপুর কথা শুনে লজ্জায় চোখ নিচে নামিয়ে নিয়ে আসি। এভাবে সাজানোর কারন জিঙ্গেস করলে চোখ টিপে বলে সারপ্রাইজ আছে।

কিছুক্ষণ পর রাইমা আপু আমার হাত ধরে উপরে ছাদে নিয়ে যায়। ছাদে ওঠে একটা কালো কাপড় দিয়ে আমার চোখ বেঁধে দিয়ে রাইমা আপু আমাকে ছাদের মাঝখানে নিয়ে আসে। আমার চারপাশে মানুষের চুপচাপ নিরবতা বুঝতে পারছি। এখানে হয়ত আরো অনেকে আছে কিন্তু কেন এসেছে। আর আমার চোখ বেধেঁয় বা কেন রেখেছে।

২২.
মনের মাঝে হাজার প্রশ্ন উকি দেয়, তখনই রাইমা আপু আমার চোখের উপর কাপড় খুলে হ্যাপি বার্থডে বলে চিৎকার করে ওঠে। সাথে সাথে রাইমা আপুর গলার সাথে গলা মিলিয়ে উপস্থিত সবাই হ্যাপি বার্থডে বলে ওঠে।

আমি অবিশ্বাস্য চোখে পিটপিট করে সবার দিকে তাকাই এতক্ষণ চোখ বন্ধ থাকায় কিছু দেখতে পারছি না। চোখ বুঝে আবার সবার দিকে তাকায়। রুদ্র স্যার, শাশুড়ি মা, খালা শাশুড়ি, বাবা, ফুপি, পূর্ণতা ফুপির কোলে, রাইমা আপু আর রুশা ম্যাম সাথে বাড়ির সব কাজের লোক দাড়িয়ে আছে। বাহিরের কেউ নেই।
ছাদের চারপাশ খুব সুন্দর করে ফুল আর রঙিন লাইট দিয়ে ডেকারেশন করা।

আমি সবকিছু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখতে থাকি। আজ যে আমার জন্মদিন ভুলেই গেছি। কখনো এতো সুন্দর করে জন্মদিন পালন করা হয়নি। বৃষ্টির জন্মদিন উদ্দেশ্যে ফুপি পায়েশ রাধলে সেটাই আমি আমার জন্মদিনের সারপ্রাইজ হিসেবে নিয়ে নিতাম।

হঠাৎ রুদ্র স্যারের গলায় বাস্তবে ফিরে আসি।
“মেঘ কেক টা কাটো তাড়াতাড়ি।”

আমি রুদ্র স্যার কথায় তার দিকে তাকায়। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে তাকে খুব মানিয়েছে। চেহারায় বাচ্চা বাচ্চা একটা ভাব ফুটে আছে। ঠোট দুটো হালকা লালচে কালারের। সব মিলিয়ে পাঞ্জাবিতে আজ খুব সুন্দর লাগছে।
হঠাৎ রুদ্র স্যারের পাশে রুশা ম্যামকে দেখে কপাট রাগ হয়। রুশা ম্যাম স্যারের এক বাহু ধরে দাড়িয়ে আছে। এভাবে লেপ্টে থাকার মানে কী? আর রুদ্র স্যারই বা তার পাশে দাড়িয়ে আছে কেন?

রুশা ম্যাম এতক্ষণ এসব অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে ফিসফিস রুদ্র স্যারকে বলছে-
“রুদ্র তুমি যে বললে সারপ্রাইজ আছে। মেঘের জন্মদিন এটাই কী সেই সারপ্রাইজ? আর এই জন্য এতক্ষণ এত গুলো জামা চেইঞ্জ করে পরলাম? আমি কিনা ভাবলাম তুমি আমাকে সারপ্রাইজ দিবে কিন্তু তুমি মেঘের জন্মদিনের জন্য এসব করেছো?”

রুদ্র স্যার মাথা নেড়ে মুচকি হেসে বলল-
“হুমমমম, ফ্রেন্ডের প্রিয় মানুষটির জন্য একটু আধটু সাজতে তো হয়ই। আর তোকে বললে তো আসতি না আর সাজতি তো দূরের কথা।”

রুদ্র স্যার কথায় রুশা আপু রেগে চিৎকার করে বলে- “উফফফ বারবার এই মেঘ মেঘ,,,,”

এতটুকু বলতেই সবাই তার দিকে তাকায়। সবাই কেক নিয়ে আসতে বিজি ছিল তাই রুশা আপুর ফিসফিসিয়ে কথা কেউ শুনেনি হঠাৎ এই ভাবে চিৎকার করে ওঠলে সবাই হতবাক হয়ে তাকায়।

রুশা আপু তার বোকামি বুঝতে পেরে মুখে জোর করে হাসি টেনে বলল-
“মেঘ হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, তাড়াতাড়ি কেক কাটো। আমার তো আর অপেক্ষা সহ্য হচ্ছে না।”

আমি রুশা আপুর ভিতরের অবস্থা বুঝতে পেরে পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। ভিতরে ভিতরে হাসিতে দম আটকে আসছে। আমি ঠোঁট চেপে কোন রকমে হাসি থামিয়ে কেক কাঁটি। একে একে সবাইকে খাইয়ে দেই।

আমি খুশিতে রুদ্র স্যারকে সবার সামনে জড়িয়ে ধরি। আস্তে আস্তে আমাদের দুজন কে রেখে ছাদ থেকে সবাই নিচে চলে যায়। সবাই চলে যেতেই রুদ্র স্যার আমাকে কোলে ওঠিয়ে ছাদের উপরে ফুল দিয়ে সাজানো দোলনায় বসিয়ে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে।
আমি চুপচাপ কিছু না বলে পা দিয়ে ছাদের উপর ধাক্কা দিয়ে আস্তে আস্তে দোল খাচ্ছি। হঠাৎ রুদ্র স্যারের দিকে চোখ পরতে দেখি সে নেশা লাগানো চোখে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি তাকে আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জায় অন্য দিকে তাকাই।

“বুঝলে মেঘ তোমাকে আজ অনেক বেশি হট লাগছে।”

আমি রুদ্র স্যারের কথা শুনে আরো বেশি লজ্জা পাই। স্যার যে লজ্জায় উপরে আরো লজ্জা দিতে ভালোই পারে সে বিষয়ে আমার বিশেষ জ্ঞান অর্জন করা হয়ে গেছে।

রুদ্র স্যার আমাকে লজ্জা পেতে দেখে শব্দ করে হেসে ওঠে। আমার কোল থেকে ওঠে এক লাফে দাড়িয়ে যায়। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো-

“ওঠো ওঠো, এভাবে লজ্জা পেলে এখানেই রাত কাটিয়ে দিতে হবে। আর সেই সাথে আমার প্লান ডুবে মারা যাবে। ঘরোয়া ভাবে সব কিছু করলাম যাতে তাড়াতাড়ি সব কিছু শেষ হয় আর তোমাকে নিয়ে আজকের রাতটা নিজের মতো কাটাতে পারি। তাড়াতাড়ি ওঠো তো”

আমি হাত ধরে ওঠতে নিলে, স্যার কিছু একটা ভেবে আমাকে কোলে তুলে বাসার বাহিরে নিয়ে বাইকে উপর বাসিয়ে দেয়।

২৩.
আস্তে আস্তে করে বাইক চলছে। চারপাশে মনমুগ্ধকর পরিবেশ। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে দু একটা ট্রাক যাচ্ছে। তাছাড়া দিনের কোলাহল পরিবেশ রাতের আকাশে সব মুক্ত হয়ে চারদিকে মুগ্ধতায় ভরপুর।
ছোটবেলা থেকে সব সময় আমার রাতের এমন পরিবেশ দেখতে ইচ্ছে হলেও বাবা কখনো বের হতে দেয়নি।

রুদ্র স্যার এর মাঝে বেশ কয়েকবার তাকে ধরে বসতে বললেও আমি লজ্জায় ধরি নাই। তাই এবার বেশ জোড়ে ব্রেক করায় আমি পরে যাওয়ার ভয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলে স্যার মুচকি হেসে আমার বাইক চালাতে শুরু করে।

বাইক এসে আমার চিরচেনা পছন্দের জায়গা নদীর পাড়ে থামে। রাতের আকাশে নদীর সৌন্দর্য আরো ফুটে ওঠেছে। মাঝে মাঝে নদীর বুক থেকে ধমকা হাওয়া আসছে। আমি নদীর তীরে নেমে প্রকৃতি অনুভব করি তখন রুদ্র স্যার গুটিগুটি পায়ে পিছনে এসে আমার চুলের ক্ষোপা খুলে দেয়। কোমর ছড়ানো চুল গুলো ধমকা হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছে।
আমি এক দৃষ্টিতে রুদ্র স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। স্যার আমাকে আঙুলের ইশারায় নদীর দিকে তাকাতে বললে সেদিকে তাকিয়ে দেখি নদীর মাঝখানে শত শত ছোট ছোট ক্যান্ডেল জ্বলছে। নদীর ওই কূল থেকে কয়েক জন মানুষ ক্যান্ডেল গুলো ছাড়ছে। ক্যান্ডেল গুলোর মধ্যে হৃদয় আকৃতির ক্যান্ডেল ভাসছে। তার মাঝখানে আলো দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে ‘ভালোবাসি’ লেখা।

আমি খুশিতে স্যারের এইটা বাহু শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। স্যার আমার এক হাত ধরে নদীর বুকে ভেসে থাকা ফুল দিয়ে সাজানো একটা নৌকায় নিয়ে বসায়।
রুদ্র স্যার আর আমি পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আসি। নৌকার মাঝি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমার অজানা। পাশে থাকা এই মানুষটার সাথে আমি চোখ বুঝে পৃথিবীর যে কোন জায়গায় চোখ বুঝে যেতেও রাজী আছি।

নৌকা এসে থাকে ছোট্ট একটি দ্বীপে। দ্বীপে ছোট ছোট অনেক গুলো জেলেদের বাড়ি। যারা দু বেলা দু মুঠো খাওয়ার জন্য প্রাণপণ লড়াই করে যায়।
এখানে এসে বুঝতে পারি, রুদ্র স্যারকে এরা আগে থেকেই চেনে। আর আজ আমরা আসবো তারা আগে থেকেই জানতো। খোলা মাঠে ঘাসের উপর আমাদের জন্য যে যেভাবে পারছে সে সেভাবে আয়োজন করছে। কিছু কিছু ছোট ছেলে মেয়ে দূর থেকে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমাদের দেখেছে। আমি ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের কাছে ডেকে গল্পের আসর জুড়ে দেয়। তখন রুদ্র স্যার দৌড়ে নৌকায় গিয়ে ছেলেমেয়েদের জন্য চকলেট নিয়ে আসে আর সবার মাঝে ভাগ করে দেয়।

আমি অপরূপ চোখে রুদ্র স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি তখন বৃদ্ধ মহিলা আমার দিকে পায়েসের বাটি এগিয়ে দিতে দিতে বলল-
“আম্মাজান আপনি মেঘা মা না?”

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ি।

“আপনার কথা রুদ্র বাবার থেকে অনেক শুনেছি। আপনি খুব ভাগ্যবাতী রুদ্র বাবার মতো জীবন সঙ্গী পেয়েছেন। রুদ্র বাবা খুব ভালা মানুষ আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমরা এখানে টিকে আছি খালি রুদ্র বাবার জন্য। আমাদের জন্য তো রুদ্র বাবা আল্লাহর তরফ থেকে পাঠানো ফেরেশতা।”

আমি তার কথা গুলো শুনে রুদ্র স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকি। একটা মানুষের ভিতরে আর কত রূপ আছে?কখনো জেদী, কখনো রাগী,কখনো ভালোবাসার কাতর।
রুদ্র স্যার বাচ্চাদের সাথে দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে আমার পাশে এসে ঘাসের উপর বসে পরল।
আমাকে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ব্রু কুঁচকে ইশারায় কি হইছে জিঙ্গেস করলে আমি নিচে তাকিয়ে মাথা নেড়ে না বলে মুচকি হাসি দেয়।

ওখান থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে মাঝ রাত হয়ে যায়। বাসায় ফিরে দেখি বাসার মেইন দরজা আটকানো। রাইমা আপুকে খুলে রাখতে বলেছিলো কিন্তু সে হয়তো ভুলে গেছে। তখন রুদ্র স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
” আগে যখন বাসায় ফিরতে লেইট হতো তখন ইচ্ছে করেই দেয়াল টপকে ভিতরে যেতাম যদিও আম্মু বা রাইমাকে কল দিলে খুলে দিত। কিন্তু খুব শখ করেই আমি গেট টপকাতাম। আজ টপকাবে আমি তোমাকে তুলে দিব তুমি পারবে, নাকি রাইমাকে কল দিবো?”

আমি হেসে বলি-
“না আজ বরং দেয়াল টপকে জামাইয়ের বাড়িতে চোরের মতো ডুকি।”

স্যার মুচকি হেসে এক লাফে দেয়ালের উপরে ওঠে আমার দিকে হাত বাড়ায় আমি লেহেঙ্গা এক হাতে ধরে অন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।

রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরি। স্যার আমার পাশে এসে শুয়ে পরলে আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বলি-
“আমার জীবনের স্মরণীয় দিন গুলো ভিতর আজকে দিনটি দেওয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভালোবাসি খুব বেশি ভালোবাসি।”

রুদ্র স্যার তার বুকের মাঝে টেনে নিয়ে কপালে ছোট্ট করে চুমু দিয়ে বালিসে মাথা রাখল।
আমিও রুদ্র স্যারের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরলাম।

#চলবে,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে