সংসার পর্ব-০৮

0
1770

#সংসার
#পর্ব_০৮ (#সারপ্রাইজ_পর্ব)

#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি

এসব ভাবতেই আমার গলা শুকিয়ে যাই। আমি কাঁপা কাঁপা পায়ে রুদ্র স্যারের দিক পা বাড়াই। আমি স্যারকে কিছু বলতে যাবো, কিন্তু আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমার বাম হাত ধরে সিড়ি থেকে টানতে টানতে নিচে নামায়। আমি পা মচকে পড়ে গেলেও সে সেদিকে খেয়াল না করে জোরে জোরে টানতে টানতে রুমের ভিতর নিয়ে এসে বেডের উপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।

১৬.
রুদ্র স্যার রুমের জানালার পাশে দাড়িয়ে একের পর এক সিগারেট টানছে, আমি পা খুড়িয়ে খুড়িয়ে তার পাশে গিয়ে দাড়িয়ে বললাম-
“কখনো কখনো চোখের দেখা আর কানের শুনাও ভুল হয়। আপনি আজ যা দেখছেন তা সত্যিনা প্লিজ বিশ্বাস করেন।”

রুদ্র স্যার আমার কথা না শুনে এক দৃষ্টিতে জানালার বাহিরে তাকিয়ে সিগারেট ফুকছে। আমি কাধে হাত রেখে একটু নাড়া দিতেই স্যার আমার দিকে ঘুরে তাকায়।
“বিশ্বাস করুন যা দেখছেন ওসব কিছুই সত্যিই না, আপনি ভুলল বুঝছেন। দয়ে একটু কথা বলেন আপনার পায়ে পড়ি। ওভাবে চুপ করে থাকবেন না, প্লিজজজজজ।”

“কিসের বিশ্বাস, হ্যাঁ? আজ যা দেখছি এটা মিথ্যে নাকি আগেরবার বিয়ের আগে যেটা বলছো সে টা মিথ্যে?
তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো তাও মেনে নিয়েছি কিন্তু বিয়ের পর এটা আমি মেনে কি করে নিব? আর তুমি বলছো বিশ্বাস করতে? ছিহ, কি মুখ নিয়ে এটা বলছো লজ্জা করে না একজনের বউ হয়ে অন্য একজনকে জড়িয়ে ধরতে?”

রুদ্র স্যার যা বলছে তা একটুও ভুল না। আজ এখানে অন্যকেউ থাকলে হয়তো আরো বেশি বলতো। কিন্তু আমি যা করেছি তাও তো ভুল না। চোখের দেখা তো সব সময় সঠিক হয় না।
রুদ্র স্যার আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে রুম থেকে বের হবার জন্য পা বাড়ায়।

আজ রাগের মাথায় কী না কী করে ভাবতেই শরীরে কাটা দেয়। না জানি আজ নিজের কী ক্ষতি করে বসে।
আমি দৌড়ে গিয়ে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরি। পা থেকে রক্ত পরছে সোজা হয়ে দাড়াতে পারছি না কিন্তু এই মুহূর্তে আমার পায়ের ব্যাথার কথা ভুলে গেছি।
আমি পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে গেলে স্যার আমাকে ঝাটকা মেরে সরিয়ে দেয়। আমি টাল সামলাতে না পেরে পাশের টেবিলের উপর পরে জোরে চিৎকার করে ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
,
,

রাকিব ছাদ থেকে নিচে যাওয়ার সময় রুদ্র কে দেখে তখন কি না মনে করলেও এখন খুব ভয় লাগছে না জানি ভুল বুঝে আবার কি করে ফেলে।
রুমে এসে একটু চোখ বুঝলেও মেঘের কথা মনে পরতে আর রুমে শুয়ে থাকতে পারে না। অন্তত রুদ্র সাহেব কে সব বলে ভুলটা ভাঙ্গিয়ে দেওয়া উচিত।

রাকিব দ্রুত গতিতে ছাদে ওঠে দেখে কোথাও মেঘ বা রুদ্র নেই। ফিরে আসার সময় কোন রিংটোনের শব্দ পেয়ে সেদিকে পা বাড়ায়। মেঘের ফোন পড়ে আছে আর কে যেন বার বার কল দিচ্ছে।

রাকিব ফোনটা তুলে নিলেও রিছিব করে না, কল টা কেটে যেতে দেখে ১৩ বার কল দিছে হয়তো জরুরী কথা ভাবতে ভাবতেই আবার কল দেয়। রাকিব আর কিছু না ভেবে কলটা রিছিভ করে।

“মেঘ তোমার কি কমনসেন্স বলতে কিছু নেই বলো তো? আমি এদিকে বসে যে চিন্তায় মরে যাচ্ছি সে টা কি ভাবছো একবার ও? আমি বুঝতে পারছি তুমি ব্যস্ত তাই বলে একটা বারও জানাতে পারলে না ওখানে কি হলো? রাকিব সাহেব কি বললো, বিয়ে কি ঠিক হয়েছে?
বলতে বলতে ফোনের ওপাশে রাইমা ডুকরে কেঁদে ওঠে। আবার বলে-
“ও মেঘ আমি জানি তুমি একজন দায়িত্বজ্ঞান মেয়ে। ভালো কিছু হলে অন্তত একবার হলেও কল দিতে। খারাপ খবর দেখেই কল দিচ্ছে বলছো না আর কল ধরছো না, তাই না?
জানো মেঘ আমার ভাগ্য টাই এমন যাকে মন থেকে চাই কখনো পাইনি। খুব ভালোবাসি যে রাকিব সাহেব কে। তাকে ছাড়া টিনেজারদের মতো আত্মহত্যা করতে পারবো না ঠিকই কিন্তু জীবন্ত লাস হয়ে থাকবো। কি হলো, কথা বলছো না কেন মেঘ। যা হইছে বলো আমি মানিয়ে নিবো তবুও চুপ করে থেকে আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নিও না দয়া করে।”

কথাগুলো বলতে বলতে রাইমা আবার ডুকরে কেঁদে ওঠৈ। রাকিব চোখ থেকে এতক্ষণে কয়েক ফোটা পানি পড়ল, একটা মেয়ে তাকে এতটা ভালোবাসতে পারে সে কল্পনাই করতে পারেনি। কথা ঘুরানোর জন্য রাকিব বলল-
“হ্যালো, হ্যাঁ কে বলছেন?”

“আপনি কে? আর মেঘের ফোন আপনার কাছে কেন? কে বলছেন আপনি। নাম কি আপনার?

“জ্বী রাকিব আহমেদ। আপনি রাইমা তাই নাহ?”

রাইমা রাকিব প্রশ্নের উওর না দিয়ে কিছু না ভেবেই মনের আবেগে বলে-
“আচ্ছা আপনার কি বিয়ে ঠিক হইছে, আপনি কি বিয়ে করছেন? খুব সুখে রাখবেন আপনার বউ কে তাই না?”

“চোখের সামনে এমন একটা সুন্দরী মেয়েকে কাঁদতে দেখে কে পারে অন্য কোথাও গিয়ে বিয়ে করতে? বাই দ্যা ওয়ে আমি সুন্দরীদের জন্য সারা জীবন নিজেকে সিঙ্গেল নামে উৎসর্গ করতে রাজি আছি।”

কথা টা বলতেই রাকিব উচ্চস্বরে হেসে দেয়। মূলত রাইমাকে শান্ত করতে ফাজলামি করে এটা বলল।

১৭.
কিছুক্ষণ আগে রাইমা কি রকম একটা প্রশ্ন করলো তার আগে মেঘকে বুঝে আবেগে কত কিছুই না বলল ভাবতেই লজ্জায় ফোন কেটে দেয় রাইমা। কি করে তার সামনে যাবে ভাবতেই গায়ে কাটা দিচ্ছে। রাকিব সাহেব যে তার এক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আরো লজ্জা পাইয়ে দিল এবার কি করে তার সামনে গিয়ে বলবে “ভালোবাসি আপনাকে খুব ভালোবাসি।”

রাকিব আরো একবার রাইমার ফোনে কল দিলে,কল যাওয়ার সাথে সাথে কেটে দেয় রাইমা। রাকিব মুচকি হেসে ফোনে মেসেজ একটা পার্কের লোকেশন পাঠিয়ে দুইদিন পর দেখা করতে বলে।
,
,

আমার চোখের উপর কয়েক ফোটা পানি পরলে চোখ পিটপিট করে আস্তে আস্তে তাকাই। কোথা থেকে চোখে পানি পরছে দেখতে উপরে তাকিয়ে দেখে রুদ্র স্যার আমার দিকে ঘোড় লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ থেকে টুপ টুপ করে জল পরছে। আমি বিছানা থেকে ওঠে বসতে নিলে রুদ্র স্যার বলে ওঠে

“এখন কেমন লাগছে মেঘ?”

“হুমমম এখন ভালো লাগছে।”

আমি উঠে বসতে গেলে ব্যাথায় ‘আহহহ’ বলে কেঁকিয়ে ওঠি। রুদ্র স্যার তড়িঘড়ি করে আমাকে নিজে ওঠিয়ে বসিয়ে দেয়। আমি মাথায় হাত দিয়ে দেখি মাথায় আর পায়ে ব্যান্ডেজ করা।
সিড়ি দিয়ে পরে যাওয়ার পর টান দিয়ে নামানোর সময় কাপড় ছিড়ে হাঁটু ছিলে গেছে।

রুদ্র স্যার করুণ গলায় বলে-
“আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজজজ, আমি বুঝতে পারেনি আমার রাগের কারনে তুমি কষ্ট পাবে।”

আমি রুদ্র স্যারের জবার না দিয়ে ওল্টো বলি-
“বিশ্বাস করেন আমি ওসব করেনি। আপনি যেগুলো ভাবছেন ভুল ভাবছেন। রাকিব ভাইয়ের সাথে আমার অন্য কোন সম্পর্ক নেই।”

রুদ্র স্যার আমাকে টান দিয়ে তার বুকের উপরে মাথা রেখে কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বলে-
“ভুল হোক বা যাই হোক, আমি তোমাকে ভালোবাসি এটাই প্রথম সত্য। প্রথম বার নিজের ভালোবাসাকে হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছিলাম। এটা ভেবে প্রথম বার ছেড়ে দিছিলাম যে তুমি সুখে থাকো। কিন্তু তুমি ছিলে কই আর ওল্টো আমিও কষ্ট পেলাম।
দ্বিতীয় বার এই ভুল আর করব না। আমি কখনো তোমাকে আমার থেকে দূরে যেতে দিবো না। আর যদি না যাও তাই সম্পর্কের প্রথম দিনই কলমে আর শারীরিক ভাবে দুদিকেই তোমাকে নিজের করে নিয়েছে। আমি জানি সেই দিনের কথা, কতটা জানোয়ারের মতো আচারন করেছি তোমার সাথে কিন্তু বিশ্বাস করো সেই দিন যতটা না রাগ ছিল তার থেকেও বেশি ছিল ভালোবাসা।

লজ্জা আর অপরাধবোধে দুইদিন তোমার সামনে যাইনি তোমার চোখের দিকে তাকানোর ও সাহস হয়নি। তাই প্রতিদিন তুমি ঘুমালে পিছনের বারান্দার দরজা দিয়ে আসতাম তোমার সাথে কথা বলতাম। যা তুমি স্বপ্ন ভাবতে। প্রথম প্রথম যখন দেখতাম তুমি আমাকে দেখলে গুটিয়ে যাও, কথা বলতে ভয় পাও তখন নিজের ভিতর অপরাধ জেগে ওঠতো আর গিয়ে কন্টোল করতে না পেরে নিজের ক্ষতি করতাম। খুব ভালোবাসি মেঘ তোমাকে। যতটা সেই সময় তোমার কন্ঠ শুনে, না দেখে ভালোবাসতাম ততটা।

আর আমি অত ভালো না মেঘ এবার কোন ভুল করলে পা ভেঙ্গে ঘরে বসিয়ে রাখবো, সুখ হোক দুঃখ দুটোই তোমার সাথে ভাগ করে নিব। আর রইলো বিশ্বাস, তুমি শুধু আমার বিশ্বাস টা কখনো ভেঙ্গো না আমি তোমার জন্য সব উৎসর্গ করবো। যতই ভুল করো অন্তত আমাকে সত্যিই টা জানিও। ”

আমি চুপচাপ রুদ্র স্যারের কথা শুনছি। একটা মানুষ কতটা ভাগ্যবতী হলে আমার একজনকে পায়। আমি সত্যিই দুনিয়ার সেরা ভাগ্যবতী।
আমি স্যারের দু হাত আমার হাতের মাঝে আনতেই স্যার ব্যাথা কেঁকিয়ে ওঠে। আমি স্যারের দিকে তাকাতে মুখে হাসি কিন্তু তার ভিতরেও কষ্টের ছাপ।
আমার হাতের দিকে চোখ পরতেই দেখি হাত রক্তে মেখে আছে। আমার তো ক্লিন করে ব্যান্ডেজ করে দিছে তাহলে এই তাজা রক্ত কী করে আসলো?

তখনই আমার রুদ্র স্যারের বাম হাতে চোখ পরে। বাম হাত ফেটে রক্ত পরছে। বেডের পাশে তাকাতেই দেখি পাশের কাচের টেবিলটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে আছে। হয়তো হাত দিয়ে আঘাত করেই ভেঙ্গেছে। আমি চুপচাপ হাত ক্লিন করে মেডিসিন লাগাতে থাকি।
অভিমানে কথা মুখ থেকে বের হচ্ছেনা চুপচাপ কাঁদছি আর ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।
স্যার আমার অভিমান বুঝতে পেরে বলে-

“এই মেঘ প্লিজজ কেঁদোনা তখন তোমাকে ওই ভাবে কষ্ট পেতে দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। কিন্তু তুমি এখন যেভাবে কাঁদছো সেটা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। এখন হাতে যা ব্যাথা পাচ্ছি এটা হাতেই থাকছে কিন্তু তোমার এইভাবে কান্নাটা আমার বুকে গিয়ে লাগছে। প্লিজজজ কেঁদোনা।”

আমি কিছু না বলে চুপচাপ ব্যান্ডেজ করে, আবার রুদ্র স্যারের বুকে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে ঘুম ভাঙলে ওঠে দেখি রুদ্র স্যার রুমে নেই। সারা রুম অন্ধকার। আমি আর কিছু না ভেবেই দৌড়ে বাহিরে চলে যাই। ফুপিকে দেখে রুদ্র কই জিঙ্গেস করতেই বলে যে রুদ্র রাতে এসেই চলে গেছে।

আমি দৌড়ে রুমে আসি। এতক্ষণ পায়ে ব্যাথার কথা মনে না থাকলেও দৌড় দেওয়ার কারণে পায়ে ব্যাথা লাগছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে রুমে লাইট অন করে আসে পাশে তাকাতেই দেখি বেডের পাশে বালিশের উপর একটা চিরকুট
“এই টুকু ব্যাথাতেই অজ্ঞান? আমার বউ এতো দুর্বল হলে চলবে না। সারাদিন দিন মার খাওয়ার মতো অভ্যাস থাকতে হবে। যতসব ন্যাকামি।”

আমি চুপচাপ চিরকুট পড়ে মুচকি হাসি দেয়। মনে মনে কিছু একটা ভেবে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠি।

“বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান,
এইবার বুঝবে তুমি কত ধানে কত চাল।”

#চলবে,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে