#সংসার
#পর্ব_০৭
#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি
আমি ফুপির কথায় ধমকে দাড়াই। যেভাবেই হোক এই বিয়ে ভাঙতেই হবে। রাইমা আপুকে দেয়া কথা রাখতে হবে।
পাশে তাকিয়ে দেখি রাইমা আপু দাড়িয়ে আছে চোখে পানি টলমল করছে। আমি তাকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করলাম যে কিছু হবে না। আমি সব ঠিক করে দিব।
আমরা সবাই রাকিব ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে গেলাম। আমি, রাকিব ভাই, ফুপি, রাকিব ভাইয়ার একটা ফুপি, ফুপাতো বোন আর রাকিব ভাইয়ার মেজো কাকাও এসেছে। সবাই মেয়ে দেখার জন্য বসে আছি। এর মাঝে আমি বেশ কয়েক বার রাকিব ভাইয়ার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি তবে প্রতিবারই রাকিব ভাইয়ের ফুপাতো বোন ‘অনু’ আমাদের কথার মাঝে ডুকে যেত। তাই আর সময় করে বলা হয়নি।
অনুকে প্রথম দেখাই বুঝেছিলাম গায়ে পড়া মেয়ে বিশেষ করে ছেলে দেখলে তো কথায় নেই।
১৩.
মেয়ে দেখতে এসেও এখানে একটা ছেলেকে সে পটিয়ে নিয়েছে চোখের ইশারায়। আমি সামনে বসে থাকা পাএী না দেখে তাদের চোখের ইশারা দেখছি। আর মাঝে মাঝে আমি মুচকি হেসে উঠছি।
একটা ছেলে বেশ অনেকক্ষণ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি ব্যপারটা সেভাবে না নিলেও এখন বেশ অস্বস্তি লাগছে। ছেলেটা এক ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ পূর্নতা কেঁদে ওঠে, এত মানুষের আনাগোনা পূর্ণতা অভ্যস্ত না তাই হয়তো বেশ ভয় পেয়েছে। আমি পূর্ণতার কান্না ধামানোর জন্য কোলে করে বাসার বাহিরে বের হলাম। বাসার এক পাশে সুন্দর একটা বাগান পূর্নতাকে কোলে নিয়ে বাগানে ঘুরছি তখনই সেই ছেলেটা এসে আমার পাশে দাড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলল-
“হাই, আম রাহুল এন্ড ইউ”
আমি হাত না বাড়িয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলাম-
“মেঘ”
বেশ বিরক্ত নিয়ে আমি ছেলেটার পাশ কাটিয়ে অন্য পাশে দাড়াই। তখন ছেলেটি এসে আবার বলতে শুরু করে-
“হাউ আর ইউ?”আচ্ছা আপনি ছেলের কী হন? আমি মেয়ের একমাত্র কাজিন।
“জ্বী ভালো, আমিও ছেলের কাজিন।”
“আপনি খুব সুন্দর, দেখতে অস্পরীর মতো। বেবী টাও খুব সুন্দর। ঠিক আপনার মতো।
আমি ছেলেটা কথায় মুচকি হাসি দিয়ে চলে আসি। ছেলেটা আমার পিছন পিছন হাঁটতে হাঁটতে বলে-
“বেবী কাঁদছিল কেন, আমার কাছে দেন আমি বাহির থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। আপনার বোন কিন্তু আপনার মতোই সুইট। নাম কী বেবীর?”
আমি ছেলেটার কথায় তার দিকে তাকায়, ছেলেটা আমকে পূর্নতার বোন ভাবছে।
“জ্বী এটা আমার মেয়ে।”
ছেলেটা আমার কথায় আহম্মকের মতো হয়ে যাই, মুচকি হেসে সরি বলে চলে যায়। আমরা বাকী যতক্ষণ ছিলাম ছেলেটাকে আর দেখিনি। আমার এই মুহূর্তে ছেলেটার মুখটা দেখে খুব হাসি পেলেও, হাসি চেপে বিতরে এসে রাকিব ভাইয়ের পাশে বসি।
রাকিব ভাইয়ের পাশে বসতেই , ভাইয়া আমার কাছাকাছি এসে ফিসফিস আওয়াজে জিঙ্গেস করে-
“মেঘ কই গিয়েছিলে? তুমি কিছু তো বল, তোমার মেয়ে কেমন লেগেছে?”
রাকিব ভাইয়ের কথায় আমি সামনে বসা মেয়ের দিকে তাকাই মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর। ফুপি আজই আংটি পরিয়ে যেতে চাই। তখন আমি মেয়ের পাশে দাড়ানো খালাকে উদ্দেশ্য করে বললাম-
“আন্টি আমার মনে হয় ছেলে মেয়ে দুজন দুজনের সম্পর্কে জেনে নিয়ে সামনে কথা বাড়ানো উচিত। দুজন দুজনের সম্পর্কে জেনে নিলে ভালো হয়।”
আমার কথায় সবাই রাজি হয়। কিন্তু রাকিব ভাই আমাকে তার সাথে করে নিয়ে যায়। আমিও যেন এটারই সুযোগ খুজছিলাম। ছাদের একপাশে রাকিব ভাই আর মেয়েটি দাড়িয়ে আছে। রাকিব ভাই বার বার তাদের মাঝে আমাকে ডাকছে।
আমি পূর্নতাকে কোলে নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমি কাছে যেতেই রাকিব ভাই মেয়েটিকে বলতে শুরু করলো।
“দেখুন আমার একজন অতিত আছে। আর আমি কখনো আপনাকে তাঁর জায়গাটা দিতে পারব না। আপনার সব কিছু পূরন করব দিনশেষে আমার অতিতকেও ভালোবাসবো তার মানে এই নয় যে আপনাকে ভালোবাসবো না। আপনিই যতোটা আমার থেকে চাইবেন ততটাই পাবেন। এটা আপনি যদি মানতে পারেন তাহলে সবাইকে বলে দিবেন আমারা রাজি।”
মেয়েটা নম্র হেসে বলল-
“অতিত সবারই থাকে রাকিব সাহেব। কেউ লুকায় কেউ লুকায় না। আপনার কথা গুলো আমার ভাল লাগছে, তবে আমার কিছুদিন সময় লাগবে তারপর ভেবে জানাব।”
আমরা সবাই ওই বাসা থেকে চলে আসলাম, দুইদিন পর তারা ভেবে জানাবে এ বিয়েতে তারা রাজি কি না। তাছাড়া সবদিক থেকে দু পরিবারের পছন্দ হয়েছে। আমি রাকিব ভাইদের বাসায় এসে বেশ কয়েক বার কথা বলার চেষ্টা করেছি। তবে যতবার কথাগুলো বলতে চাইতাম ততবার রাকিব ভাইয়ের ফুপাতো বোন অনু আমাদের কথার মাঝে নানা বাহানায় আসত। বেশ বিরক্ত হয়ে রাকিব ভাইকে বাবার বাসায় নিয়ে আসি। এখানে বসে নিশ্চিতে সবটা বলা যাবে। রাতে খেয়ে পূর্নতাকে ঘুম পাড়িয়ে রাকিব ভাইকে মেসেজ দিয়ে ছাদে আসতে বললাম।
আমি ছাদের এক পাশে অনেকক্ষণ থেকে দাড়িয়ে আছি। আকাশ আজ পরিষ্কার কোথাও মেঘ নেই। ঝকঝকে চাঁদ মনে হচ্ছে রাতের প্রকৃতি চাঁদের সাথে হাসছে। ফুরফুরে বাসাত গায়ের উপর আচড়ে পড়ছে।
রাকিব ভাই পেছনে এসে ছোট একটা কাশি দিতেই আমি তার দিকে ফিরে তাকালাম। আমি তার দিকে তাকাতেই সে বলল-
“আসলে দুঃখিত, বড় মা জেগে ছিল, আমাকে দেখে তার রুমে ডেকে নিয়ে কথা বলছিল তাই একটু দেরি হলো।”
“আরে ঠিক আছে সমস্যা নেই, আপনি দেরীতে আসলেন বলে রাতের পরিবেশটা একটু উপভোগ করতে লাগলাম। আজকে আকাশ টা খুব সুন্দর তাই না?”
রাকিব ভাই আমার কথা শুনে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল-
“রাতের আকাশ বরাবরই সুন্দর হয়। তুমি আজ অনেকদিন পর দেখছ তাই তোমার আজকের আকাশ সুন্দর মনে হচ্ছে? বাই দ্যা ওয়ে কি জানি বলবে বলছিলে? বলো এবার।”
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলাম-
“জানেন তো রাকিব ভাই উপরে যিনি আছেন সে কাউকে নিরাশ করেন না। ভালো কাজের ফল ভালো কাজই দেন। আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?”
রাকিব ভাই আমার দিকে ভ্রু কুচকে কী জিঙ্গেস করতে আমি বললাম-
“আপনি এই বিয়ে ভেঙ্গে দেন। আপনাকে রাইমা আপু খুব ভালোবাসে। তাছাড়া আমি রাইমা আপুকে কথা দিয়েছি আপনাকে তার কাছে নিয়ে আসব। প্লিজ আপনি এই বিয়ে ভেঙ্গে দেন।”
রাকিব ভাই আমার কথা শুনে একটু দম নিয়ে বলল-
“মেঘ আমার জীবনের প্রথম সত্য আমি তোমায় ভালোবাসি, দ্বিতীয় সত্য আমি তোমার কোনো কথা ফেলতে পারি না। তবে আজকের জন্য আমাকে মাফ করে দেও আমি তোমার এই কথাটা রাখতে পারবো না।”
১৪.
“রাকিব ভাই এভাবে কেন বলছেন? রাইমা আপু খুব ভালো একটা মেয়ে আপনাকে খুব ভালোবাসে। দেখবেন আপনারা খুব সুখী হবেন।”
“মেঘ তুমি বুঝতেছো না, আমি জানি রাইমা খুব সুইট একটা মেয়ে। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি আর আমি জানি তুমি রুদ্র সাহেব কে ভালোবাসো। আমি তোমার উপরও রেগে নেই। আমার ভালোবাসা এক তরফা যেই দিন তোমার ওই কাজল কালো চোখের প্রেমে পরেছিলাম সেই দিন থেকেই জানতাম তুমি কখনো আমার হবে না। কিন্তু তাই বলে এটা ভেবো না তোমাকে পাওয়ার স্বপ্ন কখনো দেখিনি। আমার তোমাকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্ন প্রতিনিয়ত দেখতাম যার জন্য আজ আমি এত ভালো পজিশনে। কিন্তু লাভ কি তোমাকে পাওয়া আর হলো না। তাই বলে আমি সব সময় তোমার সামনে থাকতে পারবো না ক্ষমা করে দিও। রাইমাকে বিয়ে করলে আমি ওখানে গেলেই তোমাকে রুদ্র সাহেবের কাছে দেখতে হবে, যা আমি পারব না। আমি তোমার কথা রাখতে পারলাম না।”
রাকিব ভাইয়ার কথা শুনে আমার মনের শেষ আসা টুকুও ভেঙ্গে গেলো। আমি রাকিব ভাইএর দুহাত ধরে কান্না করে অনুরোধ করে বলতাম-
“রাকিব ভাই এমনটা করতে পারেন না। এই শেষ বার আমার শেষ অনুরোধ রাখেন। আপনি না চাইলে আমি কখনো আপনার সামনে আসবো না। আপনাকে রাইমা আপু খুব ভালোবাসে যতটা আপনি আমাকে বাসেন। আমি যে তাকে কথা দিয়েছে প্লিজ ফিরিয়ে দিয়েন না।”
আমি রাইমা আপুকে দেওয়া কথা রাখতে পারবো না ভেবে নিজের ভিতরে অপরাধরোধ জেগে ওঠে। আজ আমি ওই বাড়িতে না গেলে রাকিব ভাইয়ের রাইমা আপুকে মেনে নিতে কোনো অসুবিধা ছিল না। শুধু আজ আমার জন্য রাইমা আপু তার ভালোবাসা হারালো ভেবেই চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে।
আমাকে কান্না করতে দেখে রাকিব ভাই আমার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল-
“মেঘ কেঁদোনা প্লিজ, আমি তোমার চোখের পানি সহ্য করতে পারি না। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। কেঁদোনা আমি তোমার কথা পূরন করতে সাহায্য করবো।”
রাকিব ভাই কথাটা বলেই সিড়ি বেয়ে নিচে চলে গেলো। আমি রাকিব ভাইয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিতেই দেখি রুদ্র স্যার উপরের সিড়িতে দাড়িয়ে আছে। রুদ্র স্যারকে দেখে আমার আত্মা কেঁপে উঠলো। স্যার কী রাইমা ম্যাম আর রাকিব ভাইয়ের সব কথা শুনেছেন? নাহ এতোদূর থেকে কিছু শুনতে পাবে না তবে আমার রাকিব ভাইয়ের হাত ধরা, তাকে আমার চোখের জল মুছিয়ে দেওয়া সবই দেখেছেন নিশ্চয়ই। কখন এখানে এসেছেন তিনি? আবার কি ভুল বুঝবেন, এক ভুল ভাঙতে না ভাঙতেই আবার কি ভুল বুঝবেন?
এসব ভাবতেই আমার গলা শুকিয়ে যাই। আমি কাঁপা কাঁপা পায়ে রুদ্র স্যারের দিক পা বাড়াই। আমি স্যারকে কিছু বলতে নিবো, কিন্তু আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমার বাম হাত ধরে সিড়ি থেকে টানতে টানতে নিচে নামায়। আমি পা মচকে পড়ে গেলেও সে সেদিকে খেয়াল না করে জোরে জোরে টানতে টানতে রুমের ভিতর নিয়ে এসে বেডের উপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।
#চলবে,,,,,,