#সংসার
#পর্ব_০৬
#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি।
আমি আর কিছু না বলে বাবুর জন্য ফিটার বানাতে চলে গেলাম। স্বপ্ন দিয়ে আমি কাটিয়ে দিতে পারলেও বাবুর জন্য খাবার লাগবে।
খাবার বানাচ্ছিলাম তখন রান্নাঘরে রাইমা আপু এসে আমার পাশে দাড়ালো। আপু পাশে দাড়িয়ে উসখুস করতে দেখে বুঝলাম আপু আমাকে কিছু বলবে।
বাবুর ফিটার গুলতে গুলতে আপুকে বললাম-
“কিছু বলতে আপু”
আপু মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে লাজুক হেসে বললো-
“হ্যাঁ, আস আসলে মেঘ জানতে চাইছিলাম,,,,”
“এমন করছো কেনো? কি বলতে চাও বলো তো।”
আপু লাজুক হেসে মাথা চুলকে বলে-
“মেঘ আমি ওই যে তোমার একটা ভাই আছে না
তার সম্পর্কে জানতে চাইছিলাম।”
“ওহ রাকব ভাইয়া? হ্যাঁ কি জানতে চাও বলো?”
১১.
“এই তো ওনি কেমন, বিয়ে করেছেন নাকি? আসলে মেঘ তোমার থেকে আমি কিছু লুকাতে চাই না। প্রথম দেখায় তাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। তোমাদের বাসায় গিয়ে তার সব কিছুতে দায়িত্ব পালন আমার বেশ লেগেছে। আমার এই বয়স পর্যন্ত কখনো এমন ফিলিংস হয়নি যতটা তাকে দেখার পর থেকে আমার হচ্ছে।”
আমি আপুর কথা শুনে কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। আমি জানতাম আপু রাকিব ভাইয়াকে পছন্দ করে তবে সিওর ছিলাম না। তার মুখ থেকে শুনার জন্য এতোক্ষণ কথা প্যাঁচালাম। বৃষ্টির বিয়ের দিন রাইমা আপু সাড়িতে বেঝে সিড়ি থেকে পরে যাওয়ার সময় রাকিব ভাইয়া ধরেছিলো। তখন থেকে আপুকে রাকিব ভাইয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখতাম। যখন বৃষ্টির বিয়েতে সবাই সবার সাথে নাচছিলো তখন রাকিব ভাইয়ার সাথে রাইমা আপু নাচছিলো।তারপর থেকে রাইমা আপু রাকিব ভাইয়ের পিছু পিছু ঘুরতো, সে যেখানে যেত তার পিছুপিছু যেত। তখন রাকিব ভাই সে যেখানে যেত তার পিছে রাইমা আপুকে দেখলেও ব্যপারটা কাকতলীয় ভাবেই নিছিলো। কিন্তু আমি সবটা দেখার পর সন্দেহ হয়েছিলো তবে সিওর ছিলাম না।
রাইমা আপু খুব ভালো রাকিব ভাইয়ের সাথে খুব মানাবে। কিন্তু রাকিব ভাই কী মানবে? না মানলেও আমার কথা কখনো ফেলতে পারবে না অনুরোধ করে বললে অবশ্যই আমার কথা রাখবে। আজ হোক আর কাল রাইমা ম্যামকে যদি জীবনে পায় তবে একদিন রাকিব ভাই আমাকে কৃতজ্ঞতা জানাবে।
আমি আপুর দিকে তাকিয়ে তার ফিলিংস সত্য না মিথ্যে জানার জন্য রসিকতা করে একটু হেসে বললাম-
“আপু এটা তোমার আবেগ, ভালো লাগা হতে পারে তবে ভালোবাসা না। কিছুদিন পর চলে যাবে চিন্তা করো না। তাছাড়া রুদ্র স্যার বা বড় ম্যামও এটা মানবে না। এসব হয় না আপু তুমি ভুলে যাও।”
আমি চলে যেতে নিতেই আপু আমার হাত ধরে জ্বলজ্বল চোখে বলল-
“আমার এটা আবেগ না মেঘ, আমি সত্যিই খুব ভালোবাসি তাকে। এই কয় মাসে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। তাকে ভুলার জন্য খুব চেষ্টা করেছি কিন্তু পারেনি। বিশ্বাস করো আমি তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। আর আমি জানি তুমি ভাইয়া আর মাকে মানিয়ে নিতে পারবে।”
আপুর চোখ এতোখন জ্বল জ্বল করলেও কথার বলার সাথে সাথে চোখ থেকে এই ফোটা টুপ করে জল পরলো। আমি আহম্মকের মতো তাকিয়ে ছিলাম। একজন এতোবড় ডাক্তার, সে কিনা ভালোবাসার জন্য কাঁদছে। আপুকে বুঝিয়ে শান্ত করলাম যে আমি সব ঠিক করে দিবো।
রাইমা আপুর থেকে রুদ্র স্যারের রুম কেন এলোমেলো জানতে চাইলে বলে-
যেদিন বৃষ্টির সাথে বিয়ে হইছে তারপর পর থেকে কারনে অকারনে সব রাগ রুমের জিনিস পএের উপর ঝাড়ত। আর ওই যে ওই ঘড়িটা ওটা ভেঙ্গেছিলো যেদিন আমার বিয়ে প্রস্তাব নিয়ে বড় ম্যাম আর রাইমা আপু গেছিলো। সেদিন যখন শুনে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে তখন খুব রাগ করে সেই সাথে কান্নাকাটিও করে। আর রুদ্র স্যার যখন কাঁদছিলো তার কান্না দেখে বাবুও চিৎকার করে কান্না করে আর খুব কষ্টে স্যার তখন ফিটার খাইয়ে বাবুকে ঘুম পড়ায় কিন্তু রাত ১ টা বাঝতেই ঘড়ির বেল বেঝে ওঠে তখন বাবুর ঘুম ভেঙ্গে যায় আবার কান্না শুরু করে। তখন রাগে জেদে ঘড়ির হাতের পাশে ফোন ছিলো ওটা ঘড়ির উপর ছুড়ে মারে সেই সাথে ঘড়িও যায় আর ফোনও। স্যারে রুমে পার্সোনাল ভাবে কাউকেই এলাউ করে না। যখন বৃষ্টির সাথে বিয়ে হয়েছিলো তখন তারা অন্য একটা রুমে থাকত তবে এই রুমে রুদ্র স্যার কাউকে ডুকতে দিতো না, নিজে একা একা সারাদিন থাকতো। রাইমা আপু আরো বলে যে তাকে প্রায় দিনই আমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে স্যারই পাঠাই তো।
আমি রাইমা আপুর মুখে কথা গুলো শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমি যে তার রুমে এই দুইদিন থেকে আছি কই সে তো কখনো আমাকে রুম থেকে চলে যেতে বলেনি।
তবে কি আগের পিছুটান এখনো আছে? কথাটা মনের ভিতর কয়েক বার ভাবতেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে। খুশীতে চোখ জ্বল জ্বল করে ওঠে।
বাবুকে খাইয়ে ঘুম পরিয়ে দেয়। তারপর রাইমা আপুর সাহায্য কিছু কাজের লোক নিয়ে রুমটাকে পরিষ্কার করি। যতোগুলো জিনিস ভাঙ্গা ছিলো সেগুলো পরিষ্কার করে লোক দিয়ে দোকান থেকে ওই জিনিস গুলো কিনে নিয়ে আসি। সব কিছু রাইমা আপু দেখিয়ে দেয় কোনটা আগে কোথায় ছিলো,আমি আবার আগের মতো সব সাজাই। সাজানো প্রায় শেষ আমি ক্লান্ত হয়ে বেডের উপর বসে দেখতে থাকি সব কিছু কেমন লাগছে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি এই রকম একটা রুমের আমার খুব ইচ্ছে ছিলো যেখানে প্রাকৃতিরও আভা পাওয়া যাবে। এগুলোর কথা আমি ফোনে একদিন মাহমুদ কে বলেছিলাম।
ঞ
১২.
“জানো আমার খুব ইচ্ছে এমন একটা জায়গায় আমারা দুজনে থাকবো যেখানে বেড থাকবে কিন্তু পাশেই দোলনা থাকবে তার চারপাশে গাছ থাকবে। খোলা বাতাস থাকে। পাখি পাশে বসে কিচিরমিচির করে গান গাইবে আর আমি সেই গানের সুরে দোলনায় ঘুমিয়ে পরলে তুমি সুরসুরি দিয়ে ওঠিয়ে দিবে। আর আমি বিরক্ত মাখা ভঙ্গিতে ওঠে যেতে চাইলে তুমি পেছন দিক থেকে ওই সে সিনেমার ভিতর হিরোইন যখন রাগ করে চলে যায় তখন হিরো পিছন দিক থেকে টেনে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে ঠিক সেভাবে পিছন দিক থেকে টান দিবে তবে জড়িয়ে না ধরে আমাকে দোলনায় বসিয়ে তুমি আমার কোলে শুবে। তখন আমি তোমার মাথায় বিলি কেটে দিবো আর তুমি কোমর জড়িয়ে শুয়ে থাকবে।”
এইটুকু বলেই খিলখিলিয়ে হেসে আবার গম্ভীর মুখে বলতাম, “এসব কি আর সত্যিই হবে? স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। এসব কি বাস্তব হয়, বেডের পাশে দোলনা তা আবার বাগানের ভিতর। রুমের ভিতর কি আর খোলা বাতাস পাওয়া যায়?”
“কেনো পাওয়া যাবে না সানু? সব হবে, আসল না হোক তবে এভাবে সাজিয়ে নেওয়া যাবে। দোলনার পাশে ইয়া বড় একটা জানালা থাকবে যেখান থেকে খোলা বাতাস আসবে। তুমি চাইলেই সব হবে?”
আমি তখন বেশ উৎসাহ হয়ে বলতাম-” সত্যিই হবে? কিন্তু কিভাবে হবে?”
আমার প্রশ্নের জবাবে মাহমুদ শুধুই হাসতো।
পুরোনো কথা মনে পরতেই আনমনে হেসে ওঠলাম।রুমের কর্নারের দিকে চোখ গেলো। দোলনার একটু পাশে বড় একটা কাচের জালনা। জানলা খুলতেই ফুরফুরিয়ে রুমের ভিতর হাওয়া ডুকতে শুরু করলো। আমি দুহাত মেলে গভীর নিশ্বাস নিলাম। একেবারে আমার স্বপ্নের রুমের মতো। কিন্তু কি যেন নেই। ভাবতেই মনে পরলো পাখি নেই। আর নাতো পাখির কিচিরমিচির সুর। ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলে এতো সুন্দর পরিবেশ কিন্তু পাখি শব্দ নেই। আসেপাশে কোথাও পাখির দোকানও নেই যে কাউকে নিয়ে আসতে বলবো। রুমের একপাশে চোখ যেতে দেখি একটা পাখির খাচা পরে আছে কিন্তু পাখি নেই।তবে কি পাখি গুলোকে রুদ্র স্যার ছেড়ে দিছে?
,
,
বিকেলের দিকে রুদ্র স্যার রুমে আসে। ভাবছিলাম সব কিছু সুন্দর করে সাজানো দেখে চমকে যাবে। কিন্তু না ওল্টো সে এমন ভাব নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো মনে হচ্ছে যে আগে থেকেই জানত রুম সাজানো থাকবে। কিছুটা মন খারাপ করে রুমের বাহিরে চলে আসলাম আজ বড় ম্যাম বাড়িতে নেই। এই বয়সে কতো ইয়াং সে। নিজেও ছোট একটা ব্যবসা সামলান। শহরের গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের মাঝে সে একজন।
আজ কেমন জানি রুদ্র স্যারকে ভয় লাগছেনা। এতদিন ভয়ে গুটিয়ে নিলেও আজ কেনো যেনো মনে হচ্ছে ভয়টা সত্যিই হোক সমস্যা কি সে তো আমার স্বামী আমার ভালোবাসা। রুদ্র স্যার খুব চেনা আপন আপন মনে হচ্ছে।
ইচ্ছে করেই রাতে কিছু না খেয়ে দোলনায় শুয়ে দুলতে দুলতে সেখানেই ঘুমিয়ে পরলাম। শরীর টা ক্লান্ত লাগছে কালকে ফুপি নিতে আসবে তাই সব গোছাতে গোছাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছি।
রাত দেড়টা, কেউ একজন পাশের রুমের বারান্দা থেকে চুপচাপ আমার রুমে পা টিপে টিপে ডুকছে। ঘুমের ঘোরে মনে মনে চোর ভেবে লাঠি খুজতে লাগলাম। লাঠি না পেয়ে পাখির খাচাটা হাতে নিলাম। ঘুমের ঘোরে ভাবছি চোর টা কাছে আসলেই খাচায় বন্দি করে নিব। আস্তে আস্তে চোরটা সামনে আসলো অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছেনা। আমার হাত থেকে খাচা চুরি করবে বলে খাচা নিয়ে টানাটানি শুরু করলো।কিন্তু আমি দিবো না তাকে অনুরোধ করে বলছি-
“আমার রুমে কোনো পাখি নেই, আর কোনো পাখির সুরও নেই। তুমি কি আমার পাখি হয় গান শুনাতে পারবে? প্লিজ খাচার ভিতর ডুকে যাও।”
চোরটা আমার কথা শুনে আবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিরবির করে বলে- “পাখি নেই বলে, নিজের জামাইকে পাখি বানিয়ে বসিয়ে রাখতে চায়। না জানি কখন বলে গাছে বাদর নেই তুমি কি আমার বাদর হবে? প্লিজ গাছে ওঠে বসে থাকো, ইডিয়েট।”
আমার হাত থেকে পাখির খাচা নিয়ে দুটি পাখি রাখলো। অন্ধকারে দেখতে পারছিনা কি পাখি তবে মনে হচ্ছে পাখি দুটো আমার মতো খুব ক্লান্ত খাচায় রাখতেই এক কোনায় গিয়ে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে।
আমাকে সেই চোর নিজ হাতে খাবার খাইয়ে খাটের উপর শুইয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় আমি তার গলা আকরে ধরে টুপ করে ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললাম- “ধন্যবাদ চোর ভাইয়া, আবার কিছু লাগলে জানাব।”
চোরটা বারান্দার দরজা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় অসহায় গলায় বিরবির করে কি জানি বলছিলো তবে বিরবির করে বললেও আমি স্পষ্ট শুনতে পারছি সে নিজেকে নিজে বলছে-
“যাহ রুদ্র এবার হইছে তো মন মতো? নিজের বউ ডাকে ভাইয়া তাও আবার যেই সেই ভাইয়া না চোর ভাইয়া। জীবনে আর কোন কথা শুনার স্বপ্ন বাকি আছে? তাও তোর বউয়ের থেকে শুনে নিস।
মানুস ফান্দে পড়ে কান্দে আর তুই তো নিজেই নিজে ফান্দে এসে ডুব দিছিস।”
পাখির কিচিরমিচির শব্দ ঘুম ভাঙ্গে। নাহ শুধু পাখির শব্দে না কেউ দরজায় নকও দিচ্ছে। ওঠে গিয়ে দেখি ফুপি এসেছে। আমি দৌড়ে গিয়ে ফুপিকে জড়িয়ে ধরি। ফুপি তাড়াতাড়ি তৈরি হতে বলে রুদ্র স্যারকেও নাকি বলেছিলো কিন্তু সে যাবে না অফিসে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে, যাই পরে যাবে।
আমি দোলনা উপর থেকে ব্যাগ নিতেই চোখ পরে খাচায় ঝুলে থাকা দুটো লাভ বার্ডের উপর। তবে কি এটা রুদ্র স্যার রেখে গেছে? তাহলে কী রাতে যা দেখেছি ওসব স্বপ্ন ছিলো না? আমার রাতের কথা মনে পরতেই শব্দ করে হেসে ওঠি। রুদ্র স্যার কে জড়িয়ে ধরে চুমু দেওয়ার কথা মনে পরতেই লজ্জায় দুহাতে মুখ ডেকে নেই।
ফুপি বার তাড়া দিচ্ছি তাড়াতাড়ি বের হওয়ার জন্য। আমি এতো তাড়াতাড়ি কেন কারন জিঙ্গেস করলে বলে- “কাল রাকিবের বিয়ের পাকা কথা হইছে। আজ আমরা গেলে আমাদের পছন্দ হলে তবে কালই বিয়ে হবে। মেয়ে শুনছি সুন্দরী, তিন ভাইয়ের আদরের বোন। অনেক তো বয়স হইছে ছেলেটার এবার যেহেতু বিয়েতে রাজি হইছে তবে আমরা গিয়েই বায়ে পরিয়ে দিবো। এর আগে তো বিয়ের নামও শুনতে পারতো না। কিন্তু এখন আর নাও বলে না আর হ্যাঁও বলে না।”
আমি ফুপির কথায় ধমকে দাড়ায়। যেভাবে হোক এই বিয়ে ভাঙ্গতেই হবে। রাইমা আপুকে দেওয়া কথা রাখতেই হবে।
#চলবে,,,,,