#সংসার
#পর্ব_০৫
#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি।
ওদের বিয়ের পর আমি রুদ্র স্যারের অফিসের কাজ ছেড়ে দেই। তার ছয় মাসের মাথায় শুনি বৃষ্টি অসুস্থ, বাচ্চা হবে। সেদিন ফুপি খুশিতে যাকে পেয়েছে তাকেই মিষ্টি খাইয়েছে। মনে মনে তাছিল্য হেসে ভেবেছিলাম এই ছিল তার ভালোবাসা? এতোই যদি ভালোবাসতো তাহলে এত তাড়াতাড়ি বৃষ্টির রুপে গলে যেত না। আবার নিজেকেই ওল্টো প্রশ্ন করতাম, আমি বা আর কী ভালোবাসতাম, ভালোবাসলে কি তাকে ছেড়ে থাকা যায়?
কয়েক মাস কেটে গেছে। হঠাৎ একদিন সকাল বেলা কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে দেখি বৃষ্টি দাড়িয়ে আছে। চোখের নিচের গাড়ো কালো দাগ পড়ে গিয়েছে। সুন্দর চেহারাটা মলিন হয়ে গিয়েছে। গোলগাল মুখটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। আমাকে দেখতেই বৃষ্টি জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে থাকে।
এতোদিনের মনের ভিতরে পুষে রাখা কষ্ট রাগ অভিমান বৃষ্টির কান্না দেখে হারিয়ে গেল।
বৃষ্টির এমন অবস্থা কেনো জিঙ্গেস করলে কান্না ভরা চোখে একে একে সব বলতে শুরু করে –
“বিয়ের পর রুদ্র স্যার ভালো ব্যবহার করলেও কখনো স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে ওদের ভিতর গড়ে ওঠেনি। প্রথম প্রথম বৃষ্টি মেনে নিলেও পরে যখন রুদ্র স্যারকে এসব ব্যাপারে জোর করত তখন থেকে রুদ্র স্যার ওর সাথে ভালো ভাবে কথা বলেনি। একদিন রাগে বৃষ্টি রুদ্র স্যারকে বলেছিল-
“কেন করছেন এমন? আমি কোন পর নারী নই আপনার স্ত্রী তাহলে কেন ভালো করে কথাও বলছেন না? ওহ ওই মেঘের জন্য, ওই নষ্ট মেয়ের জন্য? ওর জন্য কখনো বাবার ভালোবাসা পায়নি এখন আপনাকেও কেড়ে নিতে চাচ্ছে। ওর মতো নষ্ট……”
০৯.
বৃষ্টিকে আর কিছু বলতে না দিয়ে রাগে বৃষ্টির দুই গাল শক্ত করে চেপে ধরে ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে বলে-
“হুসসহহহ, কোনো কথা বলবি না। আমার মেঘ নষ্ট হোক খারাপ সেটা শুধু আমিই বলবো আমিই শাস্তি দিবো অন্য কেউ সেখানে কথা বললে মেরে টুকরো টুকরো করে দিবো।”
এই টুকু বলতেই বৃষ্টি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো। আমার নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। বৃষ্টি চোখের পানি মুছে আবার বলতে শুরু করে-
তারপর একদিন বাহির থেকে ড্রিংস করে বাসায় এসে মাতাল হয়ে পড়ে যার সুযোগ নিয়ে বৃষ্টির রুদ্র স্যারের সাথে শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হয়। বৃষ্টিও সেদিন রুদ্র স্যারকে বাধা দেয়নি এটা ভেবে, রুদ্র জ্ঞানে থাকুক আর না থাকুক রুদ্রকে আপন করে পাচ্ছে এটাই অনেক। যার জন্য আজ বৃষ্টি প্রেগন্যান্ট।
কিন্তু ওর এই একটা ভুলের জন্য রুদ্র আর কখনো বৃষ্টির সাথে থাকেনি হয়ত ড্রিংস করে বাহিরে সারা রাত কাটিয়ে দিত। নয়তো অন্য রুমে এসে শুয়ে পড়ে থাকত।
বৃষ্টির প্রেগনেন্সির তিন মাসের সময় অফিসে হারিয়ে যাওয়া ফাইলে পুরোনো সিসি টিভি রেকর্ড খুজে পায় রাইমা ম্যাম। তখন সেটার একটা কপিতে রাইমার সেদিন এক্সিডেন্টের কারন বৃষ্টি এটার জানার পর থেকে ওই বাসার সবাই বৃষ্টির সাথে খারাপ ব্যবহার করত। তার জন্য আজ বৃষ্টি এখানে চলে এসেছে।
আগের বৃষ্টি আর এই বৃষ্টি সম্পূর্ণ আলাদা। বৃষ্টি আজ নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে ফুপিও বৃষ্টির কষ্ট দেখে ধুকে ধুকে মরছে। আমি বৃষ্টির কষ্ট দেখে রুদ্র স্যারের কাছে অনুরোধ করতে আসতে চাইলে বৃষ্টি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে-
“রুদ্র আর আগের মতো নেই মেঘ। এখন সাইকোর মতো ব্যবহার করে। ও তোকে যতটা না ভালোবাসতো তার থেকেও এখন বেশি ঘৃণা করে। তুই আমার জন্য ওর কাছে গিয়ে নিজের ক্ষতি করবি না”
বৃষ্টির ওর ভুলের জন্য তিলে তিলে মরছে। যখন ডেলিভারি হয় তখন রুদ্র স্যারের পরিবারের সবাই এসেছিল। ডেলিভারি পর মা আর বেবী দুজনে ঠিক থাকলেও। ৪৮ ঘন্টার ভিতরে বৃষ্টি ওর সব ভুলের সমাপ্তি টেনে চলে যায় আমাদের ছেড়ে। বৃষ্টি যা যা ভুল করেছিল তার থেকে ওর শাস্তি টা অনেক বড় ছিল।বৃষ্টি তো সব শুধরে নিতে চেয়েছিল তবে কেন ওরে আল্লাহ আমাদের মাঝে থেকে নিয়ে নিল? সেদিন রুদ্র স্যার সবার মাঝ থেকে বৃষ্টির বাচ্চাকে কোলে করে নিজের কাছে নিয়ে আসে।
এদিকে বাবা, ফুপি বৃষ্টিকে হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। আর এখন যদি বৃষ্টির মেয়েকে চোখের সামনে দেখতে পেত তাহলে একটু শান্ত হত। আমি কয়েক বার ওই বাসায় বাবু জন্য গেছিলাম কিন্তু রুদ্র স্যার এক কথায় বলে দিছে তার মেয়েকে সে কখনো দিবে না।
তার কিছুদিন পর রাইমা ম্যাম আর তার মা এসে বলে আমাকে রুদ্র স্যারের বউ করতে চায়। ফুপি এক কথায় না করে দেয়। যে ভুলে বৃষ্টিকে হারিয়েছে সেই ভুলে আমাকে হারাতে দিবে না। জেনে শুনে নরকে ঠেলে দিবে না।
ফুপি তাদের অপমান করে পাঠিয়ে দিলেও রাইমা ম্যাম পর পর কয়েক দিন এসে আমাদের বুঝায়।
“ফুপি আমি আপনাদের মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু ওই ছোট বাচ্চাটার কথা একবার ভাবুন। ভাইয়া এখন নিজেই ঠিক নেই তার উপর বাবুকেও কারো কাছে দেয় না এভাবে চলতে থাকলে না খেয়ে খেয়ে দুধের বাচ্চাটা মরে যাবে। মেঘ তুমি কি চাওনা বোনের শেষ স্মৃতি বাচিয়ে রাখতে?”
ফুপি আর রাইমা ম্যামের কথার উপর কথা না করতে পারে না, এক প্রকার বাধ্য হয়েই রুদ্র স্যারকে বিয়ে করতে হয়। ঘরোয়া ভাবেই বিয়েটা হয়েছিল। বিদায়ের সময় ফুপি আমার কপালে চুমু খেয়ে বলেছিল-
“তোর মাও এমন ছিল, অন্যের সাহায্য করতে নিজেকে বিলিয়ে দিত। আমি হিরে চিনতে ভুল করেছিরে মা। আজ আমার ভুলের জন্য বৃষ্টি চলে গেল। আমি ওকে সব কিছুতে লাই না দিলে এতো কিছু হতো না।”
‘অনুশোচনা’ বড় একটা অসুখের নাম। কেউ যদি তার কোনো কাজের জন্য অনুশোচনায় ভুগে এর থেকে তার জন্য বড় কোনো শাস্তি হতে পারে না। এই অনুশোচনা তাকে আজীবন তিলে তিলে শেষ করে দেয়। যে অসুখে আজ ফুপি ভুগছে।
বর্তমান,,,
পূর্ণতাকে কোলে নিয়ে বসে আছি। আজ বৃষ্টির কথা খুব মনে পড়ছে। এই জায়গায় আজ বৃষ্টি থাকত। ১০ মাস পেটে সন্তান রেখে কতই না স্বপ্ন বুনেছিল তবে সেই সন্তানকে কোলে নেওয়ার সৌভাগ্য তার হয়নি। বৃষ্টির জায়গা থেকে ও ভুল ছিলো না। জন্মের পর থেকে সবার মুখে শুনতো তার মা বাবা তাকে তার ফুপির দিয়ে গেছিল। মায়ের আদর ওর ভাগ্যে জুটেনি এই কথাগুলো ছোট বেলা থেকে ওর মাঝে জেদের মতো কাজ করত। সেখান থেকেই আমার জন্য হিংসা কাজ করতো। ফুপির ভালোবাসা আমি কখনো পাইনি বলে বাবা বৃষ্টির থেকে আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসতো এট বৃষ্টির সহ্য হতো না।
তাই আমার সবকিছুতে ওর ভাগ বসাতো একসময় ওর জেদ গুলো সম্ভাব হয়ে যায়। সব গল্পে হিরো আর ভিলেন থাকে তবে ভিলেন সবাইকে বলা যায় না, হিরোকে যেমন সব দিক থেকে পারফেক্ট তেমনই ভিলেনের সবদিক থেকে তার পরিস্থিতি দেখে তাকে ভিলেন বলতে হয়।
১০.
সারাদিনে একবারের জন্যও রুদ্র স্যার রুমে আসেনি। দুপুরে রাইমা ম্যাম খাবার দিয়ে গেছেন।
বাহিরে চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেজে। ঘড়িতে কয়টা বাঝে দেখার জন্য রুমের ওয়াল ঘড়িতে চোখ যায় ঘড়িটা ভাঙা। এই রুমের খুব সখের জিনিস দিয়ে ভরা থাকলেও সব কিছু এলোমেলো কিছু কিছু জিনিস ভাঙ্গা। রুদ্র স্যার খুব সখের মানুষ নয়তো এতো বড় বাড়ি থাকতে কেউ রুমের ভিতরে একুরিয়াম রাখে? বেশ বড় রুম, রুমের একপাশে একটা দোলনা। দোলনার চারপাশে পাস্টিকের গাছপালা দিয়ে সাজানো। নিচে ঘাসের মতো কার্পেট। মনে হচ্ছে এখানে একটা বাগান সাজানো। খুব সুন্দর করে সাজানো ছিল হয়তো, কিন্তু এখন সব কিছু এলোমেলো।
এই একদিনে এটা বেশ বুঝতে পেরেছে এইরুমে আসা সবার বারন। রাইমা ম্যামও তাই খাবার দিয়ে সাথে সাথে চলে যায়। নয়তো বাড়িতে এতোগুলো কাজের লোক থাকতেও রুম এলোমেলো থাকে?
ফোনটা হাতে নিলাম সময় দেখার জন্য, এই একদিনে ফোনটা একবারের জন্য ধরেনি বন্ধ হয়ে আছে। ফোনটা চার্জে লাগিয়ে রুমের ভিতর হাটাহাটি করতে লাগলাম।
একটা রুমের ভিতর কেউ সারাদিন কিভাবে থাকে? দম বন্ধ হয়ে আসছে।
পেটেও ইদুর দৌড়াচ্ছে। আজ রাইমা ম্যাম বাসায় নেই তাই রাতের খাবারও কেউ দিয়ে যায়নি। সবাই হয়তো ঘুমিয়ে পরেছে। রান্না ঘরের উদ্দিশ্যে বের হবো ভেবে রুমের দরজা খুলতেই রুমের ভিতর হুরমুর করে রুদ্র স্যার ডুকে। তাল সামলাতে না পেরে আমার গায়ের উপর পরে যায়। আমি নিজেকে সামলে রুদ্র স্যারকে তুলে দাড় করিয়ে সরে যাই। গা থেকে ড্রিংস এর বাজে গন্ধ আসছে। কেমন মাতাল মাতাল মনে হচ্ছে।
আমার কালকে রাতের কথা মনে পরতেই ভয়ে কুকড়ে যাই। ভয়ে ভয়ে সেখান থেকে ফিরে এসে ওয়াশরুমের পা বাড়ায়। মনেমনে ভেবে নিয়েছি যতখন না রুদ্র স্যার ঘুমাবে ততক্ষণে আমিও বের হবো না।
প্রায় দশ মিনিট পর কোনো শব্দ না পেয়ে আমি আস্তে করে দরজা খুলে পা টিপে টিপে বাহিরে আসি। স্যার পুরো খাটে উপর ওল্টো ভাবে শুয়ে আছে। পূর্ণতা তার পাশেই। রাতে যদি পড়ে যায় এই ভয়ে আমি পূর্নতাকে দোলনায় শুইয়ে দেয়। লাইট বন্ধ করে সোফার উপর শুয়ে থাকিট।
গভীর রাত, গালের উপর কেউ স্পর্শ করছে গভীর দৃষ্টি দিয়ে মায়াভরা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখ ঘুম থাকলেও অনুভব করছি তাকে। অচমকা ঘুম ভেঙ্গে যেত ওঠে বসে। দেখি রুদ্র স্যার নিচে হাটু গেড়ে আমার মাথার পাশে বসে আছে। হঠাৎ আমায় এভাবে ওঠতে দেখে স্যার চমকে যায়।
গভীর রাতে রুমে নিজের বউ। যার সাথে তার পবিত্র সম্পর্ক আছে। নিজেকে কন্টোল রাখতে পারেনি তাই কাছে এসেছেন। ভাবতেই আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে সোফার উপর পা দুটো ওঠিয়ে বসি। তবে কি আবার কালকের মতো ভালোবাসা হীন প্রতিশোধের আগুনে আমাকে আজো জ্বালাবেন?
রুদ্র স্যার আমাকে ভয় পেতে দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো, যে হাসির পিছনে অপরাধবোধ লুকিয়ে আছে। খাবার প্লেট সামনে তুলে দিয়ে বলল।
“রাতে কিছু খাও নি, এটা খেয়ে নাও। ভয় পেওনা আমি কিছু করবনা।”
আমি কিছু না বলে খাওয়া শুরু করলাম। দুপুরে খাওয়ার পর আর কিছু খাইনি। পেটে ক্ষুদার জন্য কিছু না বলেই খেতে শুরু করলাম।
খেয়ে ঘুমঘুম চোখে আবার গুটিসুটি মেরে সোফার উপর সুয়ে পরি। রুদ্র স্যার তার আলতো হাতের বাহুতে আমাকে নিয়ে খাটের উপর শুইয়ে দেয়। আমি ওঠে খাটের উপর বসতেই বলে।
“ভয় পেওনা, আমি কিছু করবোনা। যতদিন না তোমার ভয় দূর হচ্ছে ততদিনে আমি তোমার পাশেও যাবো না। প্রমিজ।”
আমি ঘুম ঘুম চোখে মুচকি হেসে বিছানার উপর শুয়ে পরি।
সকাল হয়েছে কিছুখন আগে। রাইমা ম্যার বার বার দরজায় নক করে যাচ্ছে। আমি ওঠে দরজা খুলতেই রাইমা ম্যাম বলতে শুরু করে।
“সরি মেঘ আমি কাল বাসায় ছিলাম না, কাউকে যে তোমাকে খাবার দিবে বলে যাবো মনে ছিল না। সারারাত খুদার জ্বালাই হয়তো ঘুমাতে পারোনি। বেবী ঠিক আছে তো?”
আমি মুচকি হেসে বলি-
‘না না সবঠিক আছে ম্যাম। রাতে রুদ্র স্যার খাবার এনেছিল আমি খেয়েছি আর বাবুকে স্যার খাওইয়ে দিছে।”
রাইমা ম্যাম অবাক দৃষ্টিতে ধমকের সুরে বলল-
“কি ম্যাম ম্যাম করছো আর কখনো ম্যাম বলবে না আপু ডাকবে। আর তুমি কি স্বপ্ন দেখছো? কাল রাতে তো ভাইয়া বাসাই ফিরেনি খাবার দিবে কি করে?এখন থেকে আর কারো খাবার দিতে হবে না নিজে গিয়ে খাবার নিয়ে খাবে এটা তো তোমারও বাড়ি।”
“আমি ঠুক গিলে চারপাশে তাকালাম, রুমের কোথাও রুদ্র স্যার নেই। আর রুম ও তো ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। তবে কি এটা স্বপ্ন ছিল? কিন্তু রাতে যেভাবে পেটে খুদা ছিল সেভাবে তো আর ক্ষুদা নেই।”
আমি আর কিছু না বলে বাবুর জন্য ফিটার বানাতে চলে গেলাম। স্বপ্ন দিয়ে আমি কাটিয়ে দিতে পারলেও বাবুর জন্য খাবার লাগবে।
#চলবে…..