সংসার পর্ব-০৪

0
1778

#সংসার
#পর্ব_০৪

#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি।

স্যার ওখানেই ঘাসের উপর বসে হাটু মুড়ে নিঃশব্দে কেঁদে ওঠে।

আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে বলি-
“আমাদের চিনতে খুব দেরী হয়ে গেছে স্যার। এখন আপনি অন্যকারো হবু স্বামী। আমাদের পুরোনো আবেগ মাখানো সম্পর্কের এখন আর দাম নেই। আমার বাসায় ফিরতে হবে।”

রুদ্র স্যার আচমকা তার দুহাতে আমার হাত ঝাপটে ধরে। মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই আমি উড়ে যাব।
“না সানু এভাবে বলো না, দেখো আমি সব আগের মতো ঠিক করে নিব। তোমাকে অনেক কষ্টে খুজে পেয়েছি আর হারাতে দিবো না।”

আমি রুদ্র স্যারের বুকের মাঝে চোখ খিচে বন্ধ করে দু হাত মুঠোবন্দী করে আছি। স্যার খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। আমাকে কিছু বলতে না দেখে তার বাম হাত সামনে এনে আংটি দেখিয়ে বলে-

“হ্যাঁ তোমার এইটায় তো সমস্যা এই নেও খুলে ফেললাম। আরো সমস্যা হলে আমরা পালিয়ে কোথাও দূরে চলে যাবো। কারো সামনে আসবো না। কারো মুখোমুখি হবো না আর নাতো কাউকে কিছু জানতে দিব, নাতো কারো জবাবদিহিতা দিতে হবে। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। চলো আমরা অনেক দূরে কোথাও পালিয়ে যাই।”

০৭.
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে আংটির দিকে তাকিয়ে কথা গুলো শুনছি। একটু দূরেই ঘাসের ভিতর থেকে রোদের আলো পরে আংটিটা চিকচিক করছে। আমি স্যারের কথায় জবাব না দিয়ে ঘাস থেকে আংটি টা কুড়িয়ে নিয়ে সামনের দিকে হাটা শুরু করলাম। আজ এই সুন্দর প্রকৃতিকেও বিষাদময় লাগছে। ইচ্ছে করছিল পিছন ফিরে একবার দেখি স্যার কি করছে। ইচ্ছাটা চাপা দিয়ে দ্রুত গতিতে সামনের দিকে পা বাড়াই।। এখনো হয়তো জ্বলজ্বল চোখে আমার যাওয়ার পথের দিক তাকিয়ে আছে। যে চোখের দিকে তাকালে আমি আর সামনে যেতে পারবো না, এখানেই থেমে দৌড়ে তার কাছে ফিরে যেতে হবে।

রাস্তায় হাঁটছি আর মনে মনে ভাবছি, আর একবার সুযোগ দিবো নিজেকে সাজাতে। জীবনটা ছেলেখেলা না নিজেকে নিজেরই সাজিয়ে নিতে হবে।
,
,

আজ দুইদিন পর আবার রুদ্র স্যারের সামনে বসে আছি আমার পাশের চেয়ারে গা ঘেঁষে বসে আছে রাকিব ভাই। টেবিলের উপর টুং টাং শব্দ।। আমি আনমনে সেদিনের ঘাসের ভিতর থেকে কুড়িয়ে নেওয়া আংটি টা টেবিলে ফেলছি আবার তুলে একটু উপর থেকে কাচের টেবিলের উপর ফেলছি।
সবকিছু থমথমে নিরবতা। রুদ্র স্যার মুখে একগাল হাসি নিয়ে রেস্টুরেন্টের ভিতর আসলেও রাকিব ভাইকে আমার পাশে দেখে হাসিখুশি মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে চুপসে যায়। নিরবতা ভেঙ্গে রাকিব ভাই বলে ওঠলো-

“রুদ্র সাহেব আপনাদের সম্পর্কে মেঘ আমাকে সব বলেছে। আসলে আমার বলতে একটু খারাপ লাগলেও বাস্তবতা তো অনেক ভিন্ন। আমরা অল্প বয়সে যেটা করি সেটা শুধুই কিছু দিনের আবেগ মাএ। আবেগ কেটে গেলে আমরা দ্রুত সেখান থেকে পালাই।
আরে ওই রুদ্র সাহেব কি ভাবছেন? আমি কি বলছি বুঝতে পালছেন?”

“হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি।”

“আসলে আমি আর মেঘ চার বছর ধরে রিলেশনে আছি। ভালো চাকরি করছি না বলে এখনো পরিবারকে জানাতে পারেনি। আপনার সম্পর্কে মেঘ আমাকে কালই প্রথম বলল আসা করি আপনি সব বুঝতে পেরেছেন।”

রুদ্র স্যার রাকির ভাইয়ের কথার জবাব না দিয় আমার দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। আমি তার দিকে তাকাতে তার চোখে আমার চোখ পরে। সেই গভীর চোখ বলে দিচ্চি এসব মিথ্যা আমি এসব বিশ্বাস করিনা। প্লিজ সানু তুমি একবার বলো এসব সত্যি না।
আমি স্যারের চোখের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে তার সামনে আংটি রেখে ভাঙ্গা গলায় বলি।

“এসব কিছু মিথ্যে না রুদ্র সাহেব। প্রথম জীবনে আবেগের বসে ভুলটা আপনি আকরে ধরে থাকবেন বুঝেনি। তবে এটা আমার ভুল না আপনার ভুল। আপনার বুঝতে সমস্যা হয়েছিল হঠাৎ করে কেউ এমনি চলে যায় না, সব কিছু থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছেড়ে চলে গেছিলাম। তবে সেই পিছু ছুটতে ছুটতে আপনি এখানে। ক্ষমা করবেন আমাকে।
এই নেন আংটি, আমার বোনকে কখনো এসব ব্যাপারে জানতে দিবেন না। আমার আবেগ গুলো মিথ্যে হলেও আপনার আবেগ গুলো সত্যিই আর সেই আবেগ আজ আপনার কাছে অনুরোধ করে বলছি কখনো আমার বোনকে কষ্ট দিবেন না। খুব সুখে রাখবেন যতোটা আমাকে রাখতে চেয়েছেন।”

চোখের পাশের জলগুলো লুকাতে দ্রুত পায়ে রাকিব ভাইয়ের হাত ধরে সেখান থেকে বেড়িয়ে আসলাম। রাস্তায় নামতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। আমার সাথেই কেনো এসব হচ্ছে? সব ভালোবাসা পেয়েও কেনো হারিয়ে ফেলি, আর যে ভালোবাসা হারাবেনা বলে কথা দেয়, তার থেকে পালিয়ে আসতে হয়।
বুক ফেঁটে কান্না আসছে, আজ সারাজীবনের জন্য মাহমুদকে হারালাম, প্রতিদিন একটা আসা নিয়ে বেঁচে থাকতাম হয়তো মাহমুদ একদিন আবার আমার জীবনে আসবে। কিন্তু আজ নিজের ইচ্ছায় সব কিছু হারালাম। হয়তোবা রুদ্র স্যার কখনো এর পিছনের গল্পটা জানতেও পারবেনা। ভুল বুঝে আজীবন ঘৃণা করে যাবে।
নিজের অজান্তেই পাশে থাকা রাকিব ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি। ভাইয়া আমাকে বার বার শান্ত হতে বলছে।

আমি পাবলিক প্লেসে আছি মনে হতেই সাথে সাথে রাকিব ভাইকে ছেড়ে দূরে দাড়ায়। হঠাৎ চোখ যায় রুদ্র স্যারের গাড়ির দিকে স্যার আমার দিকে একদৃষ্টিতে ঘৃণার চোখে তাকিয়ে আছে। আমার চোখে চোখ পরতেই স্যার তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে দিয়ে চলে যায়।

০৮.
ফ্লাস ব্যাক,,,

সেই দিন নদীর পাড় থেকে এসে সরাসরি বাবার রুমে চলে যায়। বাবার কাছে জীবনের শেষ আবদার হিসেবে আজ রুদ্র স্যারকে চাইবো।
কিন্তু বাবার রুমের সামনে যেতেই দেখি বৃষ্টি, বাবা আর ফুপি বসে কথা বলছে। কিছুক্ষণ আগেই ফুপি আর বৃষ্টি গিয়ে বিয়ের সাজ কিনে নিয়ে এসেছে। বৃষ্টি বাবার সামনে বসে বিয়ের লেহেঙ্গা পরে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখাচ্ছে কেমন লাগবে বিয়ের দিন।

বাবার গ্রামের প্রিয় জমি বিক্রি করা টাকা হাতে নিয়ে বসে আছে। একবিন্দু আপসোস হচ্ছেনা তার চোখে মুখে খুশির ঝলক।
“আরে মেঘ মা তুই, আজ অফিস এতো তাড়াতাড়ি শেষ? এই দেখ তোর জন্যও একটা লেহেঙ্গা কিনেছি, বৃষ্টির বিয়ের দিন এটা পরলে তোকে পুতুলের মতো লাগবে মা।”

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় নিচু স্বরে বাবার দিকে তাকিয়ে বলি- “বাবা এই বিয়ে যদি না হয়, তাহলে কি হবে? যদি ওতো বড়লোক বাড়ির ছেলে আমার বোনকে বিয়ে না করে? যদি ওই ছেলে কারো হাত ধরে পালিয়ে,,,,,”

আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ফুপি রাগে আমার দু গালে দুইটা চড় মেরে চিৎকার করে বলে ওঠলো- “দেখলে দাদা কি অলক্ষুণে কথা তোমার বড় মেয়ের মুখে, অপায়া মেয়েদের মুখে এসব কথা এখন না জানি কি হয়।”

আমি কান্না ভেজা চোখে বাবার দিকে তাকাতেই বাবা বলল- “মারে এমন কথা মুখেও আনিস না। আমার আব্বার স্বপ্নের জমিটা আজ বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি আল্লাহ না করুক এমন কিছু যদি হয় আমি বাঁচবো নারে মা।”

বাবা মুখে ‘আমি বাঁচবো নারে মা’ এই কথাটা কানে যেতেই মনে হলো কে যেনো বুকের ভিতরে খাঁমচে ধরলো।
দৌড়ে রাকিব ভাইয়ের রুমে গেলাম, এই বাসায় বাবা আর রাকিব ভাইকে মন খুলে ভরসা করতে পারি।
রাকিব ভাইকে গিয়ে সব খুলে বললাম। আর আমাকে এই বিষয়ে সাহায্য করতে বললাম। যদিও রাকিব ভাই প্রথমে রাজি ছিলোনা কিন্তু আমার বার বার অনুরোধ ফেলতে পারেনি।

কেন জানি না বৃষ্টিও সেদিন আমার কাছে এসে সন্দেহের চোখে বারবার অনুরোধ করেছিলো এমন কিছু যেনো না হয়।
পরে রাকিব ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারি রুদ্র স্যার এঙ্গেজমেন্ট আগেই বৃষ্টিকে তার প্রথম ভালোবাসার কথা বলেছে। সেদিন থেকে বৃষ্টি আমার উপর সন্দেহ করলেও এঙ্গেজমেন্টের দিন স্যারের ওই ভাবে চলে যাওয়া দেখে একে বারে সিওর হয় যে স্যারের প্রথম ভালোবাসা তার নিজের বড় বোনই।
এই কথা গুলো আগে থেকেই ফুপি জানতো তাই এঙ্গেজমেন্টের দিন রুমে আটকে রেখেছিলো।
যেদিন বৃষ্টি ফুপিকে এসব বলেছিলো সেদিনই রাকিব ভাই সব শুনেছিলো কিন্তু কথার অর্থ সেদিন না বুঝলেও আজ বুজতে পেরে আমাকে জানিয়েছে।

আস্তে আস্তে বিয়ের দিন চলে আসে। বিয়ের আগের দিন বাবাকে পুরোনো কলেজের কাজের বাহানা দিয়ে একটা বান্ধবীর বাসায় চলে আসি এটা বলে যে বিয়ের ঠিক সময় বাসায় এসে পৌছাবো। কিন্তু অসুস্থ কথা বলে আর বিয়ের দিন বাসায় ফিরেনি। এই ব্যাপারে ফুপি অনেক হেল্প করেছে। ফুপি কে এটা বুঝেয়েছি আমার এখানে থাকলে বৃষ্টির যদি কিছু হয় তাই বিয়ের পর চলে আসবো। বাবাকে যেনো আমাকে যেতে দিতে বলে।
সেদিন নিজের উপর বড্ড ঘৃর্না হচ্ছিলো এতো মিথ্যে বলে আজ নিজের ভালোবাসার থেকে পালাতে হচ্ছে। তবে কি করবো আমি যে পরিস্থিতির শিকার। আজ চাইলেও আমি ছুটে চলে যেতে পারি না আমার হাত পা যে বাধা। আজ আমি নিজের কথা ভাবলে সারাজীবনের জন্য ছাড়তে হবে বাবাকে। যে বাবা আমাদের জন্য সেই ছোট্ট বয়সে মা মরে যাওয়ার পরও বিয়ে করেনি তার মেয়েদের ভেবে। সেই বাবাকে কী করে এতো কষ্ট দিবো, কী করে তার বিশ্বাস ভাঙবো?
,

ওদের বিয়ের পর আমি রুদ্র স্যারের অফিসের কাজ ছেড়ে দেই। তার ছয় মাসের মাথায় শুনি বৃষ্টি অসুস্থ, বাচ্চা হবে। সেদিন ফুপি খুশিতে যাকে পেয়েছে তাকেই মিষ্টি খাইয়েছে। মনে মনে তাছিল্য হেসে ভেবেছিলাম এই ছিলো তার ভালোবাসা? এতোই যদি ভালোবাসতো তাহলে এত তাড়াতাড়ি বৃষ্টির রুপে গলে যেত না। আবার নিজেকেই ওল্টো প্রশ্ন করতাম, আমি বা আর কী ভালোবাসতাম, ভালোবাসলে কি তাকে ছেড়ে থাকা যায়?

#চলবে,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে