#সংসার
#পর্ব_০৩
#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি
আর গল্পটায় মেইন চরিত্র মেঘ। তাই মেঘের সবদিকটা তুলে ধরেছি। অনেকেরই প্রশ্ন এটা মেঘের এতো কষ্ট কেনো?
শেষ পর্যন্ত পরলে সবটা বুঝতে পারবেন। আর এটা কোনো বাস্তব জীবন কাহিনী না, এটা গল্প শুধু বিনোদনের জন্য। আসা করি গল্পকে কেউ বাস্তব জীবনের সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না। ভালোবাসা নিবেন।💚)
,,,,,,,
আমি রাকিব ভাইয়ের কথার জবাব না দিয়ে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসি নয়তো রাকিব ভাইয়ার কথা আজ আর শেষ হবে না। লোকটা এমনই অদ্ভুত টাইপের। সবার সামনে গেলে গুলি মারলেও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলবে না। কিন্তু আমাকে দেখলেই তার সব কথা পেট থেকে একসাথে বের হয়ে আসে।
আমি ফুপিকে সব কিছু গুছাতে সাহায্য করছি। বাবা আজও খুশি তবে মুখের সেই দীর্ঘ হাসিটা নেই। খারাপ হোক বা ভালো হোক দুটোই তার মেয়ে। একজনের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে মনের ভিতর কষ্ট থাকলেও অন্য মেয়েটার ভালো জায়গায় বিয়ে হচ্ছে ভেবে বাবা খুশি।
বৃষ্টিকে আজ পরির মতো লাগছে। গা ভর্তি জিনিস দিয়ে সাজানো। আমি বৃষ্টির কাছে যেতে নিলে ফুপি পেছন থেকে হাত মুচড়ে আমাকে টেনে নিয়ে আসে আর কড়া গলায় বৃষ্টির কাছে যেতে নিষেধ করলো, অপয়া মেয়েদের নাকি সুন্দর জিনিসের কাছে যেতে নেই তাহলে সেখানেও খারাপের ছোঁয়া লাগে।
০৫.
সত্যিই কি অদ্ভুত সময়, আজ বৃষ্টির জায়গায় আমার থাকা উচিত ছিলো। কিন্তু আমি আজ বৃষ্টির কাছে যেতেও পারছি না। ফুপি ঠিকই বলে আসলেই আমি অপয়া।
আজ মা কে খুব মনে পরছে। মায়ের কাছে গিয়ে জানতে ইচ্ছে করছে সেও কি তার দুটি মেয়েকে আলাদা চোখে দেখতে পারতো? একজনকে লক্ষী আর অন্যজনকে অপয়া বলতে পারতো?
কিছুক্ষণ আগে রুদ্র স্যার বৃষ্টির হাতে আংটি পরিয়ে দিলো। ফুপি এতক্ষণ আমাকে সবার সামনে আসতে দেয়নি যদি কোনো অমঙ্গল হয় এটা ভেবে। কিন্তু এঙ্গেজমেন্ট শেষ হওয়ার পর রুমের দরজা খুলে দিছে। আমি দৌড়ে রুম থেকে নিচে নামি বৃষ্টিকে দূর থেকে দেখি। মেয়েটাকে রুদ্র স্যারের পাশে খুব সুন্দর লাগছে । দূর থেকেই ওকে মনে মনে দোয়া দিলাম যতোই হোক আমি ওর বড় বোন মায়ের মতো। আমার আপনজন বলতে তো বৃষ্টিই আছে।
আমাকে রাইমা ম্যাম দেখতেই কাছে এসে জিঙ্গেস করে-
“কিরে মেঘ এতখণ কোথায় ছিলে, সারা বাড়িতে তোমাকে খুজেছি কোথাও পাইনি। আসলে তোমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ছিলো। আজ যদি তুমি আমাকে ফোন না দিয়ে দেশে না নিয়ে আসতে, তবে আমি এতো আনন্দ কোথায় পেতাম বলো? তুমি আমার সব ভুল ধারনা দূর করে দিলে ধন্যবাদ তোমাকে। দেখো ওদের দুজন কে কতো সুন্দর লাগছে। বৃষ্টিও তোমারই মতো মিষ্টি একটা মেয়ে।
আরে মন খারাপ নাকি তোমার, এভাবে মুখ করে আছো কেনো? বলছিলাম না কখনো মন খারাপ করবেনা। তাহলে এর জন্য আমি নিজেকে দায়ী মনে করব।”
রাইমা ম্যামের কথা শুনে আমি হেসে দেয়। ইদানীং সব কথাতেই হাসিটা যেনো বাঝে অভ্যাস হয়ে গেছে। এই বাঝে অভ্যাসও বড্ড উপকার করে এর থেকে অনেক প্রশ্নের জবাব সহজেই ইগনোর করা যায়।
চারদিকে তাকিয়ে দেখছি কেউ কেউ খাবার খাচ্ছে আবার কেউ নাচছে এমন সময় রাকিব ভাই মাইকে আমাকে খান গাওয়ার জন্য ডাক দেয়। ছোট থেকেই গানের গলা ভালো হওয়ায় সব অনুষ্ঠানেই গান গাইতাম। আজ তারই সূএ ধরে রাকিব ভাই গান গাইতে সবার সামনে অনুরোধ করছে। চারপাশের লোকজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করছে। আমার হাত পা কাঁপছে এখান থেকে দৌড়ে রুমের ভিতর চলে যেতে ইচ্ছে করছে। মাহমুদের সাথে যেদিন থেকে কথা হয়নি তারপর আর গান গাওয়া হয়নি আজ এতোবছর পর গান প্রায় ভুলেই গেছি।
মাইক হাতে নিয়ে লম্বা করে একটা নিঃশ্বাস নিলাম, বাবা বলত এভাবে নিঃশ্বাস নিলে নিজেকে হালকা লাগে। চোখ বুঝে পরিচিত গানটি খাইতে শুরু করলাম। এই গানটা মাহমুদের খুব পছন্দের ছিলো। আগে মাঝে মাঝেই গাইতাম-
তুমি না ডাকলে আসবো না
কাছে না এসে ভালোবাসবো না
দূরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়
নাকি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়
দূরের আকাশ নীল থেকে লাল গল্পটা পুরোনো
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি।
………………………………
গানের পুরোটা সময় চোখ বন্ধ করে ছিলাম। গান শেষ করে সবার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালাম। আজ অনেক বছর পর গান গাইলাম কেমন হইছে জানার জন্য সবার দিকে তাকালাম। তখনই সবাই হাত তালি দিয়ে উঠলো। এতো এতো লোকের প্রশংসা পেয়ে আজ খারাপ লাগার ভিতরেও একটু খানি ভালো লাগা কাজ করছে।
এতক্ষণে আমার বৃষ্টির আর রুদ্র স্যারের দিকে চোখ গেলো। রুদ্র স্যার আমার দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হনহন করে বাহিরে চলে গেলো। সবাই হতবাকের মতো তাকিয়ে আছে হঠাৎ রুদ্র স্যারের চলে যাওয়ার কারন বুঝতে চেষ্টা করছে। স্যার খুবই রাগী তবে হঠাৎ হঠাৎ রাগের বদ স্বভাব তার নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে রুদ্র স্যারের মা সব মেহমানদের বুঝলো ‘রুদ্র স্যারের আগে থেকেই মাথা ব্যাথা ছিলো। হঠাৎ মাইকে এই রকম বেসুরো গলায় গান শুনে আরো মাথা ব্যাথা হওয়ায় রাগ করে চলে গেছে।’
সব মেহমান চলে গেছে, আর ১৫ দিন পরে বৃষ্টি আর রুদ্র স্যারের বিয়ে। ফুপি একের পর এক বকে যাচ্ছে কেনো আমি গান গাইলাম তাই। সারাদিনে কিছু খাইনি তাই আমি চুপচাপ বসে বসে খাচ্ছি। এখন আর ফুপির বকা গায়ে লাগে না ছোট বেলা থেকে বকা শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গেছে।
“বলি মেঘ তোর ভিতরে আল্লাহ লজ্জা দিতে কী ভুলে গেছিলো? নিজে তো অপয়া তার উপর নিজের বোনেরও ভালো চাস না তুই? এতো বড় বড় মানুষদের সামনে গান গেয়ে গাইকা হতে চেয়েছিলো। তোর ওই বেসুরো গান শুনে ভ্যাগিস তারা আমাদের কিছু বলেনি। আমারই ভুল হইছে তোকে রুম থেকে যেতে দেওয়া উচিত হয়নি।”
“আহ বড় মা, তুমি মেঘকে কেনো বকছো বলো তো? মেঘ কি ইচ্ছে করে গান গাইছে? বকলে আমাকে বকবে আমিই তো মেঘকে গান গাইতে জোর করলাম। আর কে বলছে মেঘ গান খারাপ গায়? গিয়ে দেখো তোমাদেরর আদুরে হবু জামাইয়ের হঠাৎ হঠাৎ মাথা ব্যাথার অসুখ আছে আর সেটা তার মা মেঘের গানের গলা খারাপ বলে কাটিয়ে নিছে। নয়তো মেঘের যা সুরলো গলা ওতে তো মাথা ব্যাথা ভয়ে পালানোর কথা।”
চুপচাপ একবার ফুপির দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছি আবার মুখের খাবার দিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে রাকিব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছি।
খাওয়া শেষ করে বাবার রুমে ওষুধ নিয়ে গেলাম। বাবা বিয়ের জন্য দেশের বাড়ির জমি বিক্রি করবে লোকও ঠিক হয়েছে। দুই দিনের ভিতরে জমি বিক্রি হয়ে যাবে। বিয়ের সব দায়িত্ব বাবা আমাকে আর রাকিব ভাইকে দিয়েছে। রাকিব ভাই এই ১৫ দিন বাড়িতে যাবে না এখানেই থাকবে। আমার এই বিষয়ে খুব বিরক্ত লাগছে রাকিব ভাইয়ের সাথে ১৫ দিন থাকলে নির্ঘাত তার কথা শুনতে শুনতে জ্ঞান হারাবো।
০৬.
আজ দুইদিন পর আবার অফিসে এসেছি। তবে এইবার আর বৃষ্টি আসেনি কেউ কী আর নিজের হবু স্বামীর অফিসে কাজ করে?
অফিসে ডুকতে নিবো তখনই কোথা থেকে রুদ্র স্যার এসে আমাকে টানতে টানতে তার গাড়িতে বাসায়। সবকিছু এতো দ্রুত হয় আমি আহাম্মকের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
প্রায় দুইঘন্টা পর গাড়ি এসে নির্জন একটা জায়গা নদীর পাশে থামে। এই জায়গাটা আমার খুব পছন্দের আগে মাহমুদকে বার বার বলতাম তার সাথে দেখা করলে এই জায়গাতেই করবো।
কিন্তু রুদ্র স্যার কেন এখানে নিয়ে আসলো? মেরে গুম করে ফেলবে নাতো? আর এখানেই বা কেনো আসলো। নানা রকম প্রশ্ন মনের মাঝে উকি দিলেও আমি সব ভুলে প্রকৃতিকে অনুভব করি। এই জায়গা আমার আর বাবার খুব পছন্দের জায়গা। বাবা বলতো এই জায়গায় নাকি মায়ের সাথে প্রথম বাবার দেখা হয়েছিলো। ছোট বেলায় মাঝে মাঝে আমি আর বাবা দুজনে এখানে আসতাম কয়েক বছর থেকে পড়ালেখা আর কাজের ব্যস্ততায় এখানে আর আসা হয়নি। কিন্তু বৃষ্টি ছিলো এসবের ওল্টো আমি আর বাবা এখানে আসলে বৃষ্টি আর ফুপি যেতো শপিংমলে নয়তো কোনো মেলায়।
দুহাত মেলে পুরোনো শৃত্মি গুলো মনে করছিলাম। আমিই ভুলেই গেছি আজ আমার সাথে বাবা নয় রুদ্র স্যার এসেছেন।
হঠাৎ পিছন থেকে আমার গাওয়া সেই পুরোনো কন্ঠের কল রেকর্ড বেঝে ওঠে। এই গান গুলো আমি মাহমুদকে বলেছিলাম। তবে এগুলো রুদ্র স্যার কিভাবে পেলো।
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় রুদ্র স্যার কে বললাম-
“এ এ এগুলো আপ আপনার কাছে কিভাবে আসলো, এসব তো আমার মাহমুদের_”
আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে, আমার কথার মাঝে রুদ্র স্যার বলতে শুরু করলো-
” আমায় চিনতে পারছো না সানু? আমিই তোমার মাহমুদ। এই শুনো আগের সেই ভয়েজ চিনতে পারছোনা তুমি?”
আমি সেই অাগের ভয়েজ, কথা বলার ভঙ্গি শুনে চিনতে পেরে কাঁদতে কাঁদতে ঘাসের উপর বসে অস্পষ্ট কন্ঠে বলি-
“আপনি আমার মাহমুদ? নাহ আপনি কী করে আমার মাহমুদ হবেন? আপনি তো রুদ্র স্যার। আপনি হতেই পারেন না আমার মাহমুদ।”
স্যার আমার সামনে হাটু গেড়ে বসে দু হাত দিয়ে গাল ধরে অভিমান ভরা কন্ঠে বলেন-
“কোথায় চলে গেছিলে সানু? জানো কত কত জায়গায় খুজেছি তোমায়। তোমার নাম্বার, ফেসবুক একাউন্ট সব বন্ধ পেয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছিলাম। এই দেখো আজ সেই হাসিখুশি শান্ত ছেলেটা কতো কঠিন মনের হয়ে গেছে। সেদিন তোমাদের বাড়িতে এঙ্গেজমেন্টের সময় তোমার গানের প্রত্যেকটি সুর আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছিলো, হৃদয়ে সেই পুরোনো ঝড় তুলেছিলো। তোমার এতোটা কাছে থেকেও আমি তোমাকে চিনতে পারেনি কতোটা হতভাগা আমি।”
আমি শব্দহীন ভাবে স্যারে দিক তাকিয়ে আছি। আজ বড্ড অপরিচিত লাগছে তাকে। স্যার পাগলের মতো করছে। পকেট থেকে ফোন বের করে আমার দিকে ফিরিয়ে বলে-
“এই দেখো আজো পাগলের মতো মেসেজ দেয় তোমাকে তুমি এসে মেসেজ দেখবে, উওর দিবে এই আশায়। তুমি জানো অফিসে যেদিন ইন্টারভিউ দিতে প্রথম এসেছিলে তখন তোমার নাম মেঘ দেখেই রাইমাকে চাকরি দিয়ে দিতে বলি। “সানজিদা সানজি মেঘ” এই নামটা যে আমার কলিজার সাথে মিশে আছে। যেখানেই এই নামের কাউকে দেখতাম সেখানেই তার ব্যাপারে সব জানতে চাইতাম। মনে আছে তোমার এই নামটা কেটে আমি ছোট করে তোমায় সানু নামে ডাকতাম? কেনো এমন করলে বলো তো কেনো না বলে চলে গেলে? কী ভুল ছিলো আমার,কী ভুল ছিলো?”
স্যার ওখানেই ঘাসের উপর বসে হাটু মুড়ে নিঃশব্দে কেঁদে ওঠে।
#চলবে…….