#সংসার(০২)
#তাহরীমা
“তনু চা বানিয়ে সবাই কে পান করতে দিলো।বিয়ে বাড়ি অথচ কোনো নাস্তা ও বিদ্যমান ছিল না,সবাই বিস্কুট দিয়ে চা পান করলো।কিন্তু তনুকে একবার ও চা পান করতে ডাকলো না।তনু শুকনা কিছু মুড়ি খেয়ে নিলো কারণ ক্ষুধায় তার পেট তখন জ্বলে যাচ্ছিল।মা বাবার কথা খুব মনে পরাতে দুফোটা জল গড়িয়ে পরলো।কিন্তু ধর্য্য ধরা ছাড়া উপায় নাই যে।
“তনু সবার খাওয়া শেষে আবার জিনিস গুলা ধুতে নিয়ে গেলো।কাজ করতে করতে শাড়িতে ময়লা লেগে গেলো।এদিকে গ্রামে এরকম নতুন বউ নিয়ে আসলে,মানুষ খালি দেখতে আসতো তাই তনুকে ও দেখতে আসলো।তনুর শাশুড়ি তনুকে ডাক দিলো,তনু আসতেই এক মহিলা নাক সিটকে বলে উঠলো-
–এ কেমন বউ কাজে বেডির মতো,ছিঃ এ কি বউ নাকি?
“তনুর তখন কান্না পেয়ে গেলো।তারপর ও শাশুড়ি কিছুই বলল না।
“দুপুরের সব রান্নাবান্না ও তনুকে করতে হবে,তাই তনু তরকারি কুটে রেখে ভাত রান্না করলো,তারপর একটা বড় হাড়িতে তরকারি রাঁধল।রান্নাবান্না শেষে গোসল করতে গেলে শাড়ি খুঁজতে গেলো শাশুড়ি থেকে।কারণ বাপের বাড়ির সব জিনিস যে শাশুড়ির হাতে।শাড়ি যা নতুন সব ননাসে নিয়ে গেছে,আর যা সব শাশুড়ি নিয়ে নিয়েছে।
“শাশুড়ি তনুকে দুইটা শাড়ি ই দিলো তাও নরমাল,তনুর এসব নতুন শাড়ি মনে ই হচ্ছে না।তাও নতুন বউ মুখে মুখে তো প্রশ্ন করা যায় না।তনু আবার শাশুড়িকে খুব ভয় পায় কখন আবার তার মা বাবা কে নিয়ে নিন্দা করে ঠিক নেই,তাই সে শাড়িগুলা নিয়ে চলে গেলো।তারপর গোসল সেরে নামাজ পড়তে বসলো।এদিকে দুপুর হওয়াতে আবার শাশুড়ির চিৎকার-
–ও বউ তোমার শশুড় ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না,নামাজ পরে,আগে খেতে দাও সবাইকে।
“তনু কোনোমতে নামাজ পড়ে ননদ দেবর,বর,শশুড় শাশুড়ি সবাই কে খেতে দিলো।সবার কি লাগবে না লাগবে সেজন্য পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো সে,এদিকে একজন ও কেউ বলল না যে,” তুমি ও বসে যাও সকাল থেকে তো কিছুই খেলে না?
“সবার খাওয়াদাওয়া শেষে তনু বাসনকোসন নিয়ে গেলো পরিষ্কার করার জন্য।তারপর হাড়িতে চোখ দিলো দু এক মুঠ ভাত ছাড়া আর অবশিষ্ট নেই।তনু সেগুলো নিয়ে খেয়ে সব পরিষ্কার করে রেখে দিলো ততক্ষণ এ সবাই ঘুম।
“তনু রুমে গিয়ে দেখলো বর জেগে আছে,তনুকে জিজ্ঞেস করলো-
–খেয়েছ?
“তনু হাসিমুখে উত্তর দিলো-খেয়েছি।তখন দুজনে কিছুক্ষণ গল্প করলো।গল্প করতে করতে আসরের আজান দিয়ে দিলো।তনুর তখন মনে পরে গেলো শাশুড়ি যে বলল তখন,আগে খেতে দেয়ার কথা,আবার ও হয়ত বকা দিবে,তাই সে নামাজ না পড়ে চা বানাতে চলে গেলো।
“সবাইকে চা দিয়ে তারপর গেলো নামাজ পড়তে।নামাজ শেষ করে নিজে কিছু খেতে গেলে তার জন্য চা রাখলো না,আবার কিছু মুড়ি খেয়ে পানি খেয়ে নিলো।ঘরে বিস্কুট নেই তাই সে বরকে বললো কত দিক থেকে মেহমান আসতে পারে বিস্কুট নিয়ে আসো বাজার থেকে”
“বর বাজারে গিয়ে বিস্কুট মুড়ি প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই এনে মায়ের হাতে দিলো।সন্ধ্যার দিকে তাদের ক্ষুধা লাগলে বিস্কুট খুলে আধপ্রায় খেয়ে ফেললো।তনুর এসব অভিজ্ঞতা খুবই নতুন,সে এসব অবাক হয়ে চেয়ে থাকলো।কারণ তার বাপের বাড়িতে এত অভাব ছিল না।এত অভাবের সংসারে এসে সব সামলাতে পারবে তো এ নিয়ে বড্ড চিন্তা হয় তার,সারাদিন খুব ভয় করে শাশুড়িকে।
“এভাবে দিন কাটে প্রতিদিন।ঘরের একটা কাজ ও কেউ করেনা।ঘর ঝাড়ু থেকে শুরু করে মুছা,মাজা ঘষা,ধুয়া রান্নাবান্না,খাওয়ানো,গুছানো সব তনু একাই করতো।আর রাত হলে অল্পতে ই ঘুম চলে আসতো।
“কিছুদিন পর তনুকে বাপের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য তার ছোট দুইবোন নাস্তা নিয়ে আসলো।তনুর মা আবার ভাল পিঠা নাস্তা বানায়।এরকম মেয়ের শশুড় বাড়িতে নাস্তা বানিয়ে দেয়াও একটা রীতি।ছোট দুইবোন কে দেখে গ্রামের কিছু ছেলে মশকরা করে সুন্দরি ডাকতে লাগলে তারা এতে অপমান বোধ করে,এতে তারা আর কখনো বোনের বাড়িতে আসবে না বলেই দেয়।আর সমাজের মহিলারা তো আছেই নানান কথা বলার জন্য,
কেউ নাস্তাগুলা নিয়ে বলতে শুরু করলো-” এসব এত ছোট কেন?মেয়ে বেশি তাই যা পারছে দিছে এত অল্প কেউ এভাবে পাঠায়।
“তনুর শাশুড়ি মহিলা গুলা কে ইচ্ছে করে ডেকে আনে যাতে পচাতে পারে।তনু কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনা মায়ের কথা ভেবে।অনেক কিছু বলে তারা তনুকে বোনদের সাথে পাঠায়,সাথে করে আবার দুই ননদদের সহ,যেটা প্রতিবন্ধী ছিল সেটা সহ,যাতে তনুকে সেখানে ও জ্বালাতে পারে।তনুর বর মাকে খুব সম্মান করে তাই মায়ের উপর কথা বলতে পারেনা,মা যে সিদ্ধান্ত নিবেন সেটায় মেনে চলার চেষ্টা করে,তাই তনুর বর ও তনুর সাথে শশুড় বাড়ি যায়।
“শশুড় বাড়িতে নতুন জামাইয়ের কোনো কমতি নাই আদরের।সামর্থ্য অনুযায়ী সব করেছে।তনুকে দেখে সবাই খুব খুশি হয়।তনু বড় বোনদের জড়িয়ে ধরে কাদে,পড়ার কথা ভেবে কাদে,তখন তনুর সেজো বোন বলে-“নিজের বাচ্চাদের পড়িয়ে মানুষ করিস,আর কাঁদিস না।
“ঠিক হলো তনু কয়েকদিন এখানে থাকবে সাথে ননদ রা ও।তনুর খারাপ লাগলে ও কিছুই বলতে পারেনা।তনুর বর চলে যায়।
“তনুর প্রতিবন্ধী ননদের অচেনা জায়গায় এসে পাগলামি আরো বেড়ে গেলো।তনুদের বাড়ির পাশে খুব সুন্দর বিল আছে,সেখানে প্রচুর বাতাস থাকে।তনুর ননদ বাড়ি থেকে বের হয়ে এরকম বিল দেখে খিলখিল করে হেসে দৌড়াতে লাগলো।চুলগুলা আছড়ানো নেই,দেখে মনে হচ্ছে একটা পাগলি বিড়বিড় করছে,কেউ চিনে কেউ চিনে না তাই সবাই কানাঘুষা করতে লাগলো,তনুকে এ কেমন পরিবারে বিয়ে দিলো?
“দুইদিন তনু বাপের বাড়িতে থাকলে ও শান্তি পায়নি ননদ দের জন্য।তনুর মা বুঝলো মেয়ের কষ্ট কিন্তু বিয়ে দেয়ার পর মেয়েদের এভাবে মানিয়ে নিতে হয়,বিয়ের পর মেয়েরা সংসার ভাঙ্গলে লোকে নানান কথা বলে,বিশেষ করে গ্রামের মানুষ রা সমাজের মানুষের কথার খুব দাম দেয় তাই।শশুড় বাড়িতে তনুর বাবা ই দিয়ে আসে,যাওয়ার সময় তনু অনেক কান্না করেছে আরো কয়েকদিন থাকার জন্য,কিন্তু শাশুড়ি বলেছে দুইদিন থাকতে।
“শশুড় বাড়িতে তনুকে দিয়ে গিয়ে তার বাবা এক গ্লাস পানি ও পান না করে বেড়িয়ে যায়।তনু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
“শশুড় বাড়ি আসার পর শাশুড়ি মেয়েদের আড়ালে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে-“তনু কি কি করেছিলো আর তনুর বর শাশুড়ি কে মা বলে ডেকেছিল কিনা?
তখন তারা বলল ডেকেছিলো,তনুর শাশুড়ি তখন বলে উঠলো-
–হায় হায় বিয়ের পর ছেলে আমার পর হয়ে গেলো,অন্যর মাকে মা বলে ডাকছে?
“তনুর দুলাভাই রা অনেক ভাল,তনুকে ছোটবোনের মত ভালবাসে,তনু ও তাই বড় ভাইয়ের মতো দেখে তনু যখন যাবে বলছিল দুলাভাই রা ও এসেছিল তনুকে দেখতে,তনু যে কথা বলছে সেসব ননদ রা দেখেছিল সেটা ও মা কে বলে।এসব শুনে তনুর শাশুড়ি অনেক বকা দিলো।তনুর যেন কলিজা টা কেউ ছিঁড়ে নিচ্ছে মনে হলো,এদের মানসিকতা এত নিচ ছিঃ।
“তনু রুমে এসে দেখলো রুম পুরা তছনছ হয়ে আছে,হয়ত কিছু খুঁজেছে কেউ,তনু এটা বুঝলো না তাও সব গোজ করে নিলো।বরকে ও জিজ্ঞেস করার সাহস পায় না।সে তো মায়ের কথা ই মেনে চলে।তনু হঠাৎ শুনলো একজন মহিলা
চিৎকার করে উঠে বলে-
–কই তোমার বউ কই?
“শাশুড়ি তখন মহিলাটিকে বলে আস্তে কথা বল,বউ শুনবে।
–শুনলে কি?আমার গহনা ফেরত দাও?শুধু বিয়ের জন্য নিয়েছিলে এগুলো,এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
তনু এসব শুনতে পায়।তার মানে শাশুড়ি মিথ্যা বলিয়ে এসব দিয়েছে,তনুর বাবা কে বলেছিল যে-এসব তার গহনা,আর এখন কি শুনছে।তার মানে শাশুড়ি মিথ্যাবাদী।
“যে মিথ্যা তনু সহ্য করতেই পারে না আজ সে মিথ্যাবাদীর সঙ্গে থাকতে হচ্ছে,যে নামাজ কালামবিহীন মানুষকে তনু পছন্দ করতো আজ তেমন পরিবারে তনুকে থাকতে হচ্ছে,কি ভাগ্য তার..!!
“শাশুড়ি এসে তনু কে অন্যকিছু বুঝিয়ে গহনা সব খুলে নিলো।অথচ তনু সব শুনেছিল কিন্তু কিছুই বলেনি।ঝগড়া যে তনুর পছন্দ না।তনু ও চায়না অন্যর কিছু পরতে।তাই সে সব নিরবে দিয়ে দিলো।
তনুকে দেখেই বাড়ির বউ নয় বরং কাজের মেয়ে ই মনে হচ্ছে।তনু কাজে মনোযোগ দিলো।বাপের বাড়ি থেকে ফিরে দেখলো আবার চারদিকে ময়লা আর ময়লা।তনু সব পরিষ্কার করে নিলো।ভাতের হাড়িতে যখন চাল নিচ্ছিল রান্নার জন্য,তখন শাশুড়ি তনুকে শুনিয়ে শুনিয়ে পাশের ঘরের চাচি শাশুড়ি কে বলল-
–শুনো ভাবি আমার বউ ঘরে আসলে ভাত বেশি লাগে দেখছি।তাড়াতাড়ি চাল শেষ হয়ে যায়।কি রাধে কে জানে?সেদিন দেখলাম আমার ছেলে বিস্কুট আনলো তাও শেষ।
“একথা তনু শুনে ভাবতে লাগলো- বিস্কুট তো সে খায়নি,তাহলে?ওরা যেভাবে খায় একটা মেহমান আসলে কিছু দিয়ে আপ্যায়ন করা যাবে তার ও সুযোগ নেই তাই তনু কিছু বিস্কুট মেহমানদের জন্য লুকিয়ে রেখেছিল যাতে শশুড় বাড়ির মান সম্মান বাচে আর আজ শাশুড়ি তাকে এ অপবাদ দিলো।
“তনু ঠিক করলো সকালে একদম উপোস থাকবে মুড়ি ও খাবে না।তনু বাপের বাড়িতে যা ইচ্ছে খেয়েছে,এমনকি সবচেয়ে বেশি মজার আর ভাল খাবার টা তনুর মা তনুকে দিতো,এ নিয়ে ভাই বোনেরা কখনো ঝগড়া করতো না।টক খেতে পারেনা বলে গাছের সবচেয়ে মিষ্টি ফলটা তনু ই খেত।আহা সেসব দিন ভেবে দুফোটা জল গড়িয়ে পরলো…..
“সারাদিন উপোস থেকে ভাত টায় তো খায়,তাও এভাবে বলবে?একজন মানুষ বেড়েছে যেহেতু সেহেতু ভাতের চাল ও বাড়িয়ে ই দিতে হবে।তনু এসব ভেবে তনুর ভাগের টা একটু কম করে চাল দিয়ে ভাত রান্না করলো।যদি এক মুঠ থাকে সবাই খেয়েদেয়ে তাই না হয় খাবে…..
চলবে……..
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)