#সংসার
#পর্ব_০২
#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি
যখন জ্ঞান ফিরে তখন শুনি ডাক্তার বাবা আর ফুপিকে বলছে- “রোগী এখন সুস্থ তবে এক্সিডেন্ট কারনে পেটে ব্যাথা পাওয়ায় অপারেশন করতে হয়েছে। আমরা দুঃখিত আমাদের অপারেশনে একটু ভুলের জন্য রোগীর সন্তান হওয়ার ক্ষমতা একেবারে কমে গেছে। এই রকম রুগীর যদি বাচ্চা নেয় তবে কেউ একজন বেঁচে থাকবে। তাই আগেই সাবধান থাকবেন ভবিষ্যতে যেন এমন খারাপ কিছু না হয়।
ডাক্তারের কথাশুনে বাবা সেখানেই থম মেরে নিচের চেয়ারে বসে থাকে, ফুপি বাবাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য কাধে হাত রাখতেই বাবা শব্দ করে কেঁদে ওঠে।
“বল তো রেনু (ফুপির নাম) কেন আমার মেয়েটার সাথেই বারবার এমন হয়। কি পাপ করছিলো মেঘ, ছোটবেলা থেকে একের পর এক কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। বলতে পারিস রেনু?”
“দাদা তুমি এমন করো না,শান্ত হও। হার্টের রুগী তুমি অসুস্থ হয়ে গেলে তোমার মেয়েদের কে দেখবে। আর তাছাড়া বৃষ্টির কি হবে। তোমার কিছু হলে মেয়েটা সামলাতে পারবেনা।”
“কি করে শান্ত হবো বল? রেনু তুই মেঘকে এসব ব্যাপারে কিছু জানতে দিস না আর বাহিরে কাউকে বলিস না এসব শুনলে কে নিবে আমার মা মরা মেয়েটাকে।”
বাবার চোখে জল দেখে আমার চোখ থেকে অজান্তেই জল গড়িয়ে পরতে থাকলো। অন্যের ভালো চাইতে গিয়ে নিজের এতো বড় ক্ষতি করে বাবাকে কষ্ট দিলাম। আজ বৃষ্টির পাপের শাস্তি আমি পাচ্ছি যা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
০৩.
আজ রাইমা ম্যাম আর আমাদের কোম্পানির মালিক নিজে এসেছেন আমাকে দেখতে। আগে কখনো দেখিনি এই ভদ্রলোক রুদ্র সাহেবকে।
ম্যাম অনেকক্ষণ থেকে আমার পাশে বসে আছেন।বড় স্যার কিছুক্ষণ থেকে চলে গেছে। তার বোনের প্রান বাঁচালাম তার পরিবর্তে একবারও জানতে চাইলোনা আমি কেমন আছি বা ঠিক আছি কিনা? বড়লোক বলে কথা এখানে সময় নষ্ট করে এসেছে এটাই তো অনেক। ভদ্রলোক অনেকগুলো ফলমূল আমার বেডের পাশে রেখে বাবার হাতে কতগুলো টাকা দিয়ে চলে গেলো কিন্তু রাইমা ম্যাম মাথা নিচু করে অপরাধি ভঙ্গিতে বসে আছে।
বাবার থেকে জানতে পারি রাইমা ম্যাম এই হাসপাতালের ডাক্তার। আজ সে যদি না থাকতো তাহলে যেভাবে আঘাত লাগছে তাতে আরো খারাপ কিছু হতে পারতো।
বাবা রাইমা ম্যামের কাছে গিয়ে অনুরোধ করে বলে কাউকে যেনো না বলে আমি কখনো সন্তান জন্ম দিতে পারবো না। ম্যাম তখন বাবার কান্না জড়িত অনুরোধ দেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে-
“মেঘ তোমার কাছে কিছু চাইলে আমাকে দিবে প্রমিজ করো?”
“ম্যাম এভাবে বলছেন কেনো? আপনি চাইলে দিতে পারলে অবশ্যই দিবো।”
“আমি তোমাকে চাই, আমার ভাইয়ের বউ করে নিতে চাই। যাতে আজীবন আমার জন্য কষ্ট পেতে না হয়।”
“কি বলছেন ম্যাম! কোথায় আমি আর কোথায় আপনারা। এসব হয় না, আমরা সাধারণ মানুষ আপনাদের মতো না তাছাড়া স্যার আমাকে মানবে না। না আছে রূপ আর না আছে সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা। আপনার পরিবারের তারা কেউ এটা মানবে না ম্যাম।”
“মেঘ মানবেনা বা মানবে সেটা আমি বুঝবো। তুমি আমার অনুরোধটা রাখো প্লিজ নয়তো কখনো আমি নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারবো না। ভাইয়া প্রথমে না মানলেও আমি জানি তুমি তোমার ধৈর্য দিয়ে মানিয়ে নিতে পারবে। তোমার মতো একজনই আমার ভাইয়ের যোগ্য। আর কি গ্যারান্টি আছে ভাইয়াকে অন্য কোথাও বিয়ে দিলে বাচ্চা হবে।”
সেদিন রাইমা ম্যামের কথা ফেলতে পারিনি। বাবাও এই বিয়েতে খুব খুশি ছিলো। কিছুদিনের ভীতর হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসি। তার দুইদিন পরে রাইমা ম্যামের পরিবার আমাকে দেখতে আসে। এক প্রকার জোর করেই রাইমা ম্যাম তাদের নিয়ে আসে । তাদের কথা শুনে বুঝতে পারি আমি যে বাচ্চা জন্ম দিতে পারবো না এটা তারা জানেনা। তখন রাইমা ম্যামকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে জিঙ্গেস করলে বলে-
“মেঘ এটা নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। আমার ভাইয়ের সাথে একবার মানিয়ে নিতে পারলে বাচ্চা না হওয়াটা ব্যাপার না। দরকার হলে দওক নিবে। তবে এখন কাউকে বলবেনা।”
খুব বড় করে এগেন্জমেন্টের ব্যবস্থা করে। শহরের বড় বড় মানুষরা আসবে সেদিন যেখানে আমরা সামান্য একজন মানুষ। আমিও সব ভুলে নতুন করে আবার স্বপ্ন বুনতে শুরু করি। আজ কাল বাবার মুখের হাসি দীর্ঘ হয়েছে, এই হাসিটা দেখলে পুরোনো সব কষ্ট এমনিতেই ভুলে যাই।
০৪.
হঠাৎ একদিন কে জানি রাইমা ম্যামের মাকে আমার সব সত্যিটা বলে দেয়। তখন বড় ম্যাডাম আমাদের বাড়িতে এসে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়। কিন্তু এতে তাদের সম্মানে আঘাত হানবে তাই আবার বিয়ে ঠিক করে তবে আমার সাথে না আমার ছোট বোন বৃষ্টির সাথে।
এবার রাইমা ম্যাম হাজার চেষ্টা করেও বিয়ে ভাঙ্গতে পারিনি। সেই রাগে সে বাড়ি থেকে বিদেশে চলে যায়। স্যারের একমাত্র ছোট বোন আমার কারনে বিদেশ চলে গেছে তাই সে আমার উপর আরো ক্ষেপে গেছে।
“নিজেকে খুব সুন্দরী মনে হয়? আপনার জন্য আমার বোন আজ আমার বিয়েতে থাকছে না। আপনি আমার সরল বোনটাকে ভুল বুঝিয়ে মন কেড়েছেন। আপনার থেকে বৃষ্টি অনেক ভালো। একই ফেমেলীতে দুটো বোন কিভাবে এতো পরিবর্তন হয়?
আজ যদি বৃষ্টি না থাকতো তবে আপনার ভালো মুখের আড়ালে লোভী চেহারাটা দেখতেই পারতাম না। বৃষ্টি অনেক ভালো মেয়ে ওকে বিয়ে করতে আমার আপত্তি নেই, তবে যদি আমার বোন আমার বিয়েতে না থাকে তাহলে আমিও এই বিয়ে করবোনা।”
তখন আমি রাইমা ম্যামকে ফোন করে দেশে নিয়ে আসি এটা বলে যে আপনার সেইদিন হাসপাতালে বসে অনুরোধ রেখেছিলাম আর আজ আপনি আমার অনুরোধ রাখতে দেশে আসবেন। আমি আজ আরো বেশি খুশি আমার বোন আপনাদের বাড়িতে যাচ্ছে। এখন আপনি না আসলে বড় স্যার বিয়ে করবেনা আর এবারও বিয়ে না হলে বাবা অসুস্থ হয়ে পরবে।
জানিনা ম্যাম সেদিন আমার হাসিমুখের আড়ালে চেহারাটা দেখতে পেয়েছিলো কিনা। সেদিন ম্যাম বলেছিলো “দেখো মেঘ তোমার জীবনে আরো ভালো কেউ আসবে, তুমি আসলেই খুব ভালো মেয়ে তবে ওয়াদা দাও তুমি সব সময় হাসিখুশি থাকবে। কখনো মন খারাপ করে থাকবে না তাহলে আমার মনে হবে এর জন্য আমি দায়ি।”
আস্তে আস্তে সময় এগিয়ে যায়। মনের ভিতর থাকা আবেগ আর ভালোবাসা দুটোই চাপা দিয়ে রাখি। আজ সন্ধ্যায় বৃষ্টি আর রুদ্র স্যারের এঙ্গেজমেন্ট বাড়িতে মেহমান ভরপুর। হঠাৎ মেহমানদের ভিতরে একজন দেখে চমকে ওঠি। রাকিব ভাই ফুপির দেবরের ছেলে। ফুপি কোনো ছেলে ছিলো না তাই রাকিব ভাইকে নিজের ছেলের মতোই দেখে। আমাদের কোনো সমস্যা হলে আগে রাকিব ভাইকেই বলতো ফুপি।
এই ছেলেটা আমাকে ছোট বেলা থেকে পাগলের মতো ভালোবাসে। মোটামুটি ভালো চাকরি করছে তবে তার এই ভালোবাসা আমার কেন জানি বিরক্ত লাগে। মাঝে মাঝে তার জন্য মায়া লাগলেও ভালোবাসা হয়ে ওঠিনি। মনের ভীতরে একজনকে যত্ন করে রাখলে বাকি সবাইকে তার জায়গায় বসাতে বিরক্ত লাগে।
“কেমন আছো ময়না, আজ কি বিরক্ত লাগছে না আমাকে? জানো তোমার মুখে ‘আপনাকে খুব বিরক্ত লাগছে’ শুনতেও খুব ভালো লাগে।”
“হ্যা ভাই আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি। আপনি তো দেখি এই পাঁচ বছরে একটুও বদলে যান নি। দেখতে চেহারায় পরিবর্তন আসলেও মুখের ভাষা বদলেনি। এখনো একবারেই সব কথা বলে শেষ করার প্রতিযোগিতা করতে চান?”
রাকিব ভাই শব্দ করে হেসে ওঠলো-
“মেঘ তোমার মুখের সব কথাই বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়। তোমার বলা একটা শব্দ যদি শুনতে না পাই বা বাসাতে হারিয়ে যায় তবে মনে হয় বড় কোনো কিছু মিস করে ফেলেছি শুনতেই হবে।
আর তুমি না বলেছিলে তোমার সামনে না আসতে তাই তোমার কথা রাখতে এই পাঁচ বছর আসিনি। জানো এটাও বেশ মজার ব্যাপার। প্রত্যেকটি দিন কেটে যাওয়ার পর ভাবতাম তোমার কথা আমি আরো একদিন রাখতে পেরেছি।
চেহারায় পরিবর্তন তো উপর আল্লাহ দিয়েছে কিন্তু কথার পরিবর্তনটা আমার নিজের ভিতর যা কখনো করতে পারবো যতোদিন তুমি আছো। তোমাকে দেখলেই আমার সব কথা একসঙ্গে বলতে ইচ্ছে হয়।”
রাকিব ভাই চারদিকে তাকিয়ে এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো-
“দেখো মেঘ কতো লাল নীল ফুলে ঘর সাজানো আচ্ছা তোমার ইচ্ছে হয়না তোমাকে কেন্দ্র করেও এমন করে সাজানো হোক? আমি তোমাকে বৃষ্টির হবু জামাইয়ের মতো এতোকিছু দিয়ে সাজাতে না পারলেও তার থেকেও বেশি ভালোবাসা দিয়ে সাজাতে পারবো?”
আমি রাকিব ভাইয়ের কথার জবাব না দিয়ে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসি নয়তো রাকিব ভাইয়ার কথা আজ আর শেষ হবে না। লোকটা এমনই অদ্ভুত টাইপের। সবার সামনে গেলে গুলি মারলেও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলবেনা। কিন্তু আমাকে দেখলেই তার সব কথা পেট থেকে একসাথে বের হয়ে আসে।
#চলবে,,,,,,,,,,