সংসার পর্ব-০১

0
1783

#সংসার
#পর্ব_০১
#তাহরীমা

“তোর তো বিয়ে ভেঙ্গে গেছে রে,ওদের নাকি আরো ভালো পরিবার লাগবে।

–এটা আগে কেন বলে নি?

–জানিনা,ওরা নাকি অনেক বড়লোক,বাবার তো অত টাকা নেই।ভেবেছে হয়তো কিছুই দিবেনা বিয়েতে,তাই ভেঙ্গে দিয়েছে।

“তনু কান্নারত চোখে কিছুক্ষণ আকাশের পানে থাকালো।মন খারাপের সময় নাকি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে ভাল ই লাগে।

“তনু মা বাবার ছয় নাম্বার সন্তান।তনুর বাবা পেশায় কৃষিকাজ করেন।মা গৃহিনী।তনুরা নয়বোন দুইভাই।বাবা কৃষক হওয়ায় ঘরের খাবারের অভাব নেই।পরিশ্রম ও করেন সুখে ও থাকেন,তনুর বাবা কারো কাছে হাত ও পাতেন না।কিন্তু মেয়ে বড় হলে বাবা মায়ের যে চিন্তার শেষ থাকেনা।তাও আবার এতগুলো মেয়ে হলে তো কথায় নেই,তনুর ইচ্ছা ছিল অনেক পড়বে একজন নার্স হবে।কিন্তু বোনেদের দিকে তাকিয়ে তার বিয়ের পিড়িতে বসতে হলো।তনুর ছোট আরো বোন আছে তারা ও যে তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছে,ঘরে এত মেয়ে থাকলে লোকের কথার শেষ থাকে না যে।

“তনু দেখতে যেমন সুন্দরি,তেমন গুণি।তনুর বাবা লাল মিয়া তনু কে বেশি পছন্দ করেন।কারণ তিনি যেমন কাজ পছন্দ করেন তনু ও তাই করেন।তনু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে।

লাল মিয়া মেয়েদেরকে স্কুলে ও পড়াচ্ছেন।লোকে অনেক কিছু বলে মেয়ে পড়ে কি হবে?কিন্তু তাঁর একটায় কথা মেয়েদের ও শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন।একজন শিক্ষিত মা একটা শিক্ষিত জাতি উপহার দেয়।তনু ভোরে উঠে মাকে কাজে সাহায্য করে,পাশাপাশি ক্ষেতে যায় বাবার সাথে,গরু আছে দুইটা সেগুলো কে খাবার দিয়ে স্কুলে যায়।এভাবে দেখতে দেখতে তনু বড় হয় এসএসসি পাশ করে।আরো পড়ার ইচ্ছে থাকলে ও টাকার অভাবে তা আর হয়ে উঠে না।তাই বিয়ে করতে রাজি হয়।তনু সুন্দরী হওয়ায় তারা তনুকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে।পরে কি ভেবে তারা বিয়ে ভেঙ্গে দিলো বুঝা আসলো না।

“বিয়েটা না হওয়ার কারণে তনুর মা বাবা একদমি ভেঙ্গে পরেন।লোকের কথার যে শেষ থাকবে না।তনুর এক ভাই বড় আরেকভাই ছোট।বড় ভাই মাস্টার্স করছে তখন।সে ও টিউশনি করিয়ে কোনোমতে পড়ালেখা টা চালিয়ে নিচ্ছে।

“বিয়ে হবে ভেবে তনুর কান্নার শেষ ছিলো না।কত ভাল ছিল মা বাবার সাথে।তনু রা ভাইবোন বেশি হলেও ঝগড়া শব্দ টা একদমি নেই।সবাই একসাথে হাসিখুশি তে থাকে।যে যার যার মতো কাজ ভাগ করে সেটা করে ফেলে।যেহেতু তনুর বাবা ধান,টমেটো,মরিচ,শসা আরো অনেক কিছুই চাষ করতো,এসব আনে আবার তনুর বাবা হাটে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে।আম গাছে আম,জাম গাছে জাম,পেয়ারা,খেজুর,তেতুল প্রায় সব গাছ তনুদের আছে।খাবারের অভাব সে কখনো দেখেনি বাবা কৃষক হওয়া সত্ত্বেও।কিন্তু বিয়ের পর অন্য পরিবেশে যাবে এটা মানতে ই পারছিলো না।

————-

কিছুদিন পর তনুর আবার বিয়ে ঠিক হয়।তনুর বোনেরা সবাই সুন্দরী হওয়ায় সবার এক দেখায় বিয়ে হয়ে যায়।শুধু তনুর বেলায় এমন হলো।তাও নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে।তনু ভীষণ রাগি হলেও মন টা একদমি নরম।তনুর চাচা ই এ বিয়ে ঠিক করে।বিয়ের আগে তনুকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসে।কিন্তু শাশুড়ি কে তনুর পছন্দ হয়নি।অতিরিক্ত কথা বলে।বেশি কথা বলা মানুষ ও তনুর পছন্দ না।এভাবে বিয়ের ডেট চলে আসে,বিয়ের আগে জামাই কে তনু দেখে নি।তখন এরকম দেখা করা,কথা বলার তেমন নিয়ম ছিল না।জামাইকে শুধু তনুর চাচা দেখেছিল।ছেলে প্রবাসী,জমি আছে অনেক। মেয়ে সুখে ই থাকবে,ভাল শাড়ী গহনা পরবে আর কি চাই??

“এভাবে বিয়ে হয়ে যায়।বিয়ের পর জামাইকে তনুর বড় বোনেরা উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে।সাথে সাথে ততনু মেঝ বোন কান্নায় ভেঙ্গে পরে।তনুর কাছে গিয়ে তনুকে ঝাপটে ধরে কাঁদতে থাকে,আর বলতে থাকে-

–বিয়ের আগে জামাই দেখলে আমি কখনো বিয়ে হতে দিতাম না তনু,তোর পুরা ই বিপরীত।তুই আদৌ সংসার করতে পারবি??ছেলে যেমন কালো তেমন দাঁত বের হওয়া,তেমনি চিকন।

“একে একে সবাই বোন কে জড়িয়ে ধরে।তনুর বাবা ও বিয়ের দিন জামাই কে দেখে।তনুর বাবার পছন্দ না হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে দেন কারণ মেয়ে বেশি,বিয়ে যে দিয়ে দিতে ই হবে।তিনি তনুর চাচা মানে নিজের ভাইয়ের উপর কথা বলেন না যে,তিনি ও কাঁদতে থাকেন,সবাই কাদেঁ।

“তনু নিজের ভাগ্যেকে মেনে নিয়ে,চলে যেতে হচ্ছে অন্য পরিবেশে,সংসার নামক পরিবেশে। গ্রামের মেয়েদের মা বাবা যায় বলতো তাই যে মেনে নিতে হতো।তনুর জন্য সিএনজি নিয়ে আসলো তারা।তনুকে একটা বোরকা পরিয়ে দিলো।তনুর বড় বোনেরা,আর চাচা এসে গাড়িতে তুলে দিলো।মনে মনে ভয় হতে লাগলো মা বাবাকে ছেড়ে কিভাবে থাকবে কি করবে।সব সামলাতে পারবে তো।

“শশুড় বাড়িতে গিয়ে সবার এক কথা,সুন্দর বউ নিয়ে এসেছে,সুন্দর বউ।সবাই ঝাকেঝাকে দেখতে আসলো তনুকে,দেখে সবাই হা হয়ে গেলো।যেই দেখছে সে ই বলছে এত কালো ছেলের বউ এত সুন্দর হয় কিভাবে।তনুর বয়স আঠারো আর জামাইর বয়স একুশ।তনুর শাশুড়ি বলল-আমার ছেলেকে অল্প বয়সে বিয়ে করিয়েছি,কারণ আমার কাজ করার আর বয়স নেই।তনু ও মেনে নিলো সংসার মানে খালি কাজ করা।

তনুর দুই ননদ এক ননাস।এক ননদ কালো আর পাগলাটে,সাথে প্রতিবন্ধী ও,উলটাপালটা কথা বলে,আরেকজন ছোট ৫/৬ বছরের হবে।দুই দেবর,আর শশুড় আছে।পুরা ঘরে এত্ত এত্ত ময়লা,তনু এদের ব্যবহার আর কথার ধরণ দেখে সত্যি ই মনে মনে বলতে লাগলো এরা যে তার বিপরীত,কিভাবে সংসার করবে?

“তনুর সাথে তনুর ভাই ও আসে যে,বোনকে শশুড় বাড়ি দিয়ে যাওয়ার জন্য।তনুর ভাই কে দেখে পাড়া-প্রতিবেশী কয়েকজন বলতে শুরু করলো-

–ভাইয়ের তো অনেক বয়স হয়েছে,ভাই বলে ছোট না জানি বউয়ের কত বয়স হবে?

তনুর শাশুড়ি কে দেখিয়ে বলল-“দেখো গা বউ তোমাদের ছেলের বড় হবে,বুড়ি বউ আনছো।এ কথা শুনে তনুর শাশুড়ি তাল মিলায়।এতে তনু প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে যায় নতুন বউ কে কি ভাববে।এটা বাপের বাড়ি হলে কখনো এসব কথা সহ্য করতো না।

একবার এক মহিলা তনুর বাবা কে নিয়ে খারাপ কথা বলছিল বলে প্রতিবাদ করেছিলো,মহিলা টি বলেছিল শুধু-” তোর বাপ কৃষক।নামিদামি তো কেউ আর না।

তখন তনু বলেছিলো-

–হ্যা আমার বাবা কৃষক হলেও কারো থেকে হাত পাতে নি,একাই এতগুলা ছেলে মেয়ে মানুষ করছে সৎভাবে,আমি গর্বিত এমন বাবা পেয়ে।

তখন মহিলাটি চুপ হয়ে গেছিলো।কিন্তু আজ শশুড় বাড়িতে তাকে বুড়ি বলল,তাও সে প্রতিবাদ করতে পারলো না।তবে কি এভাবে চুপ থাকতে হবে?তার খুব কষ্ট হতে লাগলো।শশুড় বাড়ি এত কষ্টের কেন?

“তনুর ভাই তনুকে শশুড় বাড়ি দিয়ে চলে গেলো।তনুকে তারা কিছু নতুন বউয়ের নিয়মকানুন শেষ করে আরেকটা শাড়ি পরিয়ে একটা রুমে নিয়ে গেলো।এতক্ষণ এ একবারো তনু তার জামাইকে ভালো ভাবে খেয়াল করেনি।রুমে আসার পর যখন জামাই ও আসলো তারপর খেয়াল করলো।মুহুর্তেই মন খারাপ হয়ে আসলো।সে কোনো কথা না বলে ঘুমিয়ে পরলো।

“ভোরে তনু নামাজ পড়তে উঠলো।খুঁজে খুঁজে বাথরুম এ গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিলো।শশুড় বাড়ির সবাই তখন ঘুম।তনু এদের কে দেখে আরেক দফা অবাক হলো।আদৌ কি এরা মুসলিম?তনুর বাবা মা বোন সবাই একসাথে নামাজ পড়তে উঠতো।অথচ শশুড় বাড়ির কেউ ভাল করে নামাজ টা ও পড়ে না?এ আবার কেমন পরিবার…??

“তনু রুমে বিছানায় বসে থাকলো,ক্ষুধায় পেট ছো ছো করছে,নতুন বউয়ের কথা কারো খেয়াল নেই,এমন কি জামাই এর ও না।অনেক বেলা করে শাশুড়ি ঘুম থেকে উঠলো।তারপর চা বানালো।

তারপর তনুকে ডেকে বলল-

–আজ থেকে এ সংসার তোমার,সব কাজ ও তাই তোমার,আশা করি সব করে ফেলবে,কাল থেকে চা বানানো থেকে শুরু করে সব কাজ তুমি ই করবে।ঘরে বউ এনেছি একটু সুখ করার জন্য।বুঝলে?

তনু অবাক হয় নতুন বউয়ের সাথে এমন ব্যবহারে।সে মেনে নিতো এমন ব্যবহার যদি সে প্রেম করে আসতো।প্রেম করলে সমাজের মানুষ নানান কথা বলে সেসব শুনতে ও হয়।কিন্তু এরা তো দেখেশুনে বিয়ে করিয়েছে,তার কি একটু ও সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা নেই?

“বিয়ের পরের দিন তনুর বাবা মা বোনেরা দেখতে আসলো।সবাইকে দেখে তনুর শশুড় বাড়ির লোকেরা ইচ্ছেমত বলতে লাগলো-“এত মেয়ে?এরা খাবার পেয়েছে?না জানি মুড়ি দিয়ে বসিয়ে রেখেছে বাপ”

আরো কত কথা।তারা নতুন আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও কোনো আয়োজন করলো না।তনুর বাবা নিজের সাধ্যমত মেয়েকে সব দিয়েছে,যা যা দাবি ছিল পাত্রের।গরীব হলেও তিনি সব মেয়েকে ভাল ভাল জিনিস পাঠিয়েছেন যাতে শশুড় বাড়িতে সুখে থাকে।

তাও ওদের কথা থেকে রেহায় পায়নি তারা।একেক জিনিসের দিকে চেয়ে একেক মন্তব্য করতেছিলো।তনু নিরবে সব সহ্য করলো।কারণ মায়ের উপদেশ-

“ধর্য্য ধর,সব ঠিক হয়ে যাবে,উল্টাপাল্টা কিছুই বলিস না।একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে”

——–

“তনুর বাবা মা সবাই চলে গেলো।তনুর ভীষণ মন খারাপ।আজ তাদের বাসর রাত,শুনেছে বাসর রাতে নাকি বিছানায় অনেক ফুল থাকে,অনেক ফুল দিয়ে রুম কে সাজানো হয় না জানি আজ কেমন হবে?এসব ভাবতে ভাবতে তার আরো ভয় হতে লাগলো।যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে তাই সব মানিয়ে নেয়ায় ভাল।

“তনুর বর তনুর ননাসের জামাইকে অনেক টাকা দিলো ফুল কিনে আনার জন্য,যাতে রুম সাজাতে পারে,ননাসের জামাইয়ের এটা পছন্দ হলো না,তাই সে হিংসার বশে ফুল তো কিনে আনলো ই না উলটা বুঝিয়ে দিলো অল্প বয়সে বিয়ে করে এসব বাসর করা ঠিক না।লোকে হাসবে।তনুর বর ও লজ্জায় কিছুই বলতে পারলো না।

“রাত যখন হলো তনু দেখলো রুম এ কিছু নেই।তার খুব অভিমান হলো।বর আসতে ই তনু অন্যদিকে ফিরে ঘুমিয়ে গেলো।

“ভোরে ঘুম থেকে উঠে তনু নামাজ পড়লো।তারপর রাতের খাওয়া সব বাসনকোসন পরিষ্কার করতে বসে গেলো..এগুলো পরিষ্কার করতে করতে সকাল ৭ টা বেজে গেলো,আর শাশুড়ি ঘুম থেকে উঠে বলে উঠলো-

“কই চা টা কি বানাবে না?”

চলবে….??

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে