রবিকে সবাই কালু বলে ডাকত। কেউ আবার মোটা বলেও ক্ষ্যাপাত। দেখতে সে কাল ছিল সেই সাথে একটু মোটা ও।
কলেজের প্রথম দিন ও ফার্স্ট বেঞ্চে নিজের ব্যাগ রাখাতে ক্লাসের মেধাবী সালমান তার ব্যাগটা বারান্দায় ছুড়ে ফেলেছিল।কাল ও মটু বলে গালাগাল ও করেছিল। কয়েকদিন পরে ভর্তি হয়েছিল যে।
বন্ধু রাজুর ব্যাপারটা ভাল লাগেনি। সালমানকে ধমকে দিয়ে রবির ব্যাগটা উঠিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু রবিকে কোথাও দেখছিলাম না। খুজতে খুজতে শেষমেশ তাকে মাঠের মাথায় চামেলি ফুল গাছের গোড়ায় গোমড়ামুখে বসে থাকতে দেখা যায়। রাজু আমার কাছে ব্যাগটা দিয়ে বলল যা ছেলেটাকে দিয়ে আয়।
রবির কাছে গিয়ে ওর কাধে হাত রেখে বললাম আরে বোকা তুই কি বাচ্চা মানুষ রে! এভাবে এখানে বসে আছিস ক্যান? চল আমাদের সাথে তুই সামনের বেঞ্চেই ক্লাসে বসবি। ও দাড়িয়ে চোখ মুছে একগাল হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
সেদিন থেকে ও আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেল এর একজন হয়ে যায়৷ ও ছিল।ক্লাসের সবচেয়ে সহজ সরল একটি ছেলে। আমরা কয়েকজন ছাড়া ওর সাথে তেমন কেউ চলত না। কথা ও বলত না তেমন। আর ওর এই সরল চালচলন ই আমার খুব ভাল লাগত। আমাদের সাথে চলার কারণে এরপর থেকে কেউ আর ওর সাথে সামনে খারাপ ব্যবহার করতে পারেনি।
একদিন রবি ওর বাসায় আমাকে নিয়ে গেল। বাসায় ঢুকতেই আন্টি নুডলস আর চা নিয়ে হাজির। জিজ্ঞেস করলাম আন্টি আমার যে নুডলস আর চা খুব পছন্দের কিভাবে জানলেন? বললেন রবি বলেছে,তাই আগে থেকেই চা আর নুডলস তৈরি করে রেখেছেন। রবির দিকে তাকাতেই ও কেমন বোকা বোকা একটা হাসি দিল। আন্টি সেদিন খুশিতে কেদে ফেলেছিলেন। আর বলেছিলেন আমাকে “বাবা আমার এই বোকা ছেলেটা এই প্রথম ওর কোন বন্ধুকে বাসায় নিয়ে এসেছে। এর আগে ওর কোন বন্ধুই ছিল না। জীবনে চলার পথে ক্ষণে ক্ষণে বন্ধু-বান্ধব এর প্রয়োজন। তুমি ওকে একটু দেখে রেখো। সেদিন এক মাকে কথা দিয়ে এসেছিলাম তার ছেলেকে আজীবন বন্ধুর স্থানে রেখে একসাথে এগিয়ে যাব বহুদূর।
আমরা নিয়মিত ক্রিকেট খেলতাম কলেজের মাঠে। রবি খুব ভাল ব্যাটিং করতে পারত। আর আমাদের সাথে খেলত। আমরা ওকে এত কেয়ার করি দেখে সালমানের ব্যাপারটা সহ্য হলো না। আমি আর রাজু সেদিন মাঠে না থাকায় রবিকে একা বাগে পেয়ে যায় সালমান। কিন্তু অযথা তো আর কিছু করা যায় না! খেলার ছুতো ধরে কথা কাটাকাটি চলে রবি আর সালমানের। এক পর্যায়ে রবিকে মারধর করে সালমান আর তার সাঙ্গপাঙ্গ।
খবরটা শুনেই আমি আর রাজু ছুটে যাই ওর বাসায়। খাইরুল আর মনির ওকে বাসায় নিয়ে আসে৷ গিয়ে দেখি বিছানায় শুয়ে আছে ও।মাথায় পট্টি বাধা। রাজু রেগে বলল ” এই তোর কি গায়ে শক্তি নেই? তোর এই হাতির মত শরীরটা নিয়ে যদি ওদের সামনে দাড়াস ওরা তো ভয়েই প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলত। কেন নিজেকে এমন ছোট করে রাখিস? চিরচেনা সেই একগাল হাসি দিয়ে রবি বলল আরে ছাড় তো,ও তো আমাদেরই ক্লাসমেট তাইনা?
তুই ছেড়ে দিলেই কি আমরা কিন্তু ছাড়ছি না রাজু বলল। ওকে এবার শায়েস্তা করে তবেই ছাড়ছি।আন্টি রুমে ঢুকতে ঢুকতে রাজুর কথাটা শুনে ফেলে। আমাদের কিছু করতে নিষেধ করেন তিনি। বেশ কিছুক্ষণ বুঝিয়ে শুনিয়ে আমাদের ঠান্ডা করে বাসায় পাঠিয়ে দেন। নাহলে সেদিন হয়ত অন্য কিছু ঘটত।
এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুদিন। ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার নোটিশ চলে এসেছে। ক্লাসের সেরা সুন্দরী রুনার পাশে পরেছে রবির সীট। রুনা এতে ভীষণ বিরক্ত হয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষা শেষে রুনা পুরো বদলে গিয়েছিল। রবির সাহায্য না পেলে হয়ত রুনা সেবার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারত না।
এর কিছুদিন পর আকস্মিক ভয়ানক এক্সিডেন্টের সম্মুখীন হয় সালমান। বেশ জখম হয় সে। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জরুরী রক্ত লাগবে ওর। খবরটা শুনে সবার আগে সেই কালো ও মোটা রবি ছুটে গিয়েছিল রক্ত দানের জন্য। আর এই ঘটনাটা বেশ বদলে ফেলে সালমানকে। সুস্থ হয়ে কলেজে ফিরে এসেই প্রথম রবিকে খোজ করে সে।আর এভাবেই সেই কাল, মোটা রবি বন্ধু মহলের সবচেয়ে পরিচিত একজন হয়ে যায়।
ওর মনটা একদম বাচ্চাদের মত নরম ছিল। আমি মাঝে মাঝে বলেতাম ওকে “সাদা মনের কালো মানুষ”। রবির এই সুন্দর বন্ধুত্ব পরায়ণ ব্যবহার স্বাভাবিকভাবে যে কারো মন জয় করে নিতে পারত। তাছাড়া বন্ধুদের সহযোগিতার জন্য সে সদা প্রস্তুত থাকত। ওর চমৎকার কিছু কার্যকলাপ এখনো মনে পরে।
কলেজ লাইফ শেষ। ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই। এরমাঝেই রবি একদিন আমাকে ডেকে বলে ওর বাসায় আমাদের সবার দাওয়াত, আমি যেন যে করেই হোক সবাইকে নিয়ে হাজির থাকি। তার কথামত রুনা,সালমান আমাদের বন্ধু মহলের সবাইকে নিয়ে ওর বাসায় যাই।
সেদিন আন্টিকে দেখে মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী একজন মা।
খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই যে যার মত ফিরে গেলেও আমি আর সালমান বসে ছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পর আন্টিকে বলে উঠলাম ” আন্টি আপনার সেই বোকা ছেলেটি কিন্তু আর বোকা নেই। দেখেছেন তো এখন ওর কত বন্ধু। আপনার আর চিন্তা করতে হবে না। ও নিজের পৃথিবী এখন নিজেই গোছাতে পারবে। আমাকে বলেছিলেন না ওকে দেখতে রাখতে! ওকে দেখে রাখতে গিয়ে কি শিখেছি জানেন?
শিখেছি বন্ধুত্ব হল পবিত্র একটা সম্পর্ক। বন্ধুত্বের কোন সংজ্ঞা হয় না। টাকা পয়সা কিংবা ধন সম্পদ দিয়ে হয়না এই সম্পর্ক। শরীরের রঙে কি আসে যায়! রক্ত তো সবারই লাল হয়।
শিখেছি নিজের আত্মত্যাগ এর মাধ্যমে জয় করে নিতে বন্ধুদের মন। শিখেছি মাথা নত করে মেনে নিতে বন্ধুদের ইচ্ছে।
শিখেছি বন্ধুদের বিপদে সদা হাসিখুশি সাহায্য করার মানসিকতা।
আপনার এই বোকা ছেলেটাই আমাদের এগুলো শিখিয়েছে।
চিন্তা করবেন না। ও ভাল থাকবে।
কথাগুলো এক শ্বাসে বলেই বেড়িয়ে আসছিলাম আমি আর সালমান। রবি দৌড়ে এসে সালমানকে জড়িয়ে ধরে বলল মনে থাকবে তোকে অনেকদিন। আমার কাছে এসে কেদেই ফেলল একদম আর বলল তোকে ভুলব নারে কোনদিন। মৃদু হেসে বললাম বন্ধু কি বন্ধুকে ভোলে কখনো?
“সংজ্ঞাহীন বন্ধুত্ব”
আসিফ আল ওয়ালিদ
২৭.০১.২০২০