#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#৬ষ্ঠ_পর্ব
টেবিলের থেকে বাটিটা নিতে গেলে অনুভব করতে পারলো কারোর নিঃশ্বাস ঘাড়ের উপর পড়ছে। সবাই ছাদে বিধায় খানিকটা থমকে যায় ঐন্দ্রি। তাড়াতাড়ি পেছনে ফিরলে খানিকটা চমকে উঠে সে। তার ঠিক পেছনে সাদা পাঞ্জাবী এবং হলুদ কটি পরিহিত একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে, বেশ লম্বা লোকটি নীলাদ্রির কাছাকাছি তো হবে, ফর্সা মুখে খোচা খোচা দাঁড়ি, চুলগুলো জেল দিয়ে কায়দা করে স্টাইল করা। প্রথমে চিনতে না পারলেও পরে ঠিক চিনতে পারে লোকটি সেই ব্যক্তি যার সাথে রেস্টুরেন্টে তর্কাতর্কি হয়েছিলো। লোকটি তার দিকে বেশ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে, ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসির রেখা। এই লোক এখানে এসে টপকাবে এটা কল্পনাতেও চিন্তা করে নি ঐন্দ্রি। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে সে,
– আ…আপনি এখানে?
– নারী কল্যান সমিতির ম্যাডাম তোতলাতেও পারে জানা ছিলো না
– আগে বলুন আপনি এখানে কি করছেন? দাঁরোয়ান চাচা আপনাকে ঢুকতে কিভাবে দিলো?
– বদরুল আংকেল এতো ভালোবেসে দাওয়াত করেছেন যে না এসে পারলাম না। দাঁরোয়ান চাচা সালাম দিয়ে ঢুকতে দিয়েছেন।
স্বাভাবিক ভঙ্গিমাতে কথাগুলো বলে নিজের দুটো হাত ঐন্দ্রিলার দুপাশে নিয়ে টেবিলে ভর দিয়ে দাঁড়ায় অভ্র, যাতে করে ঐন্দ্রিলার দিকে আরো ঝুকে পড়ে সে। অভ্রের গরম নিঃশ্বাস ঐন্দ্রিলার মুখে আছড়ে পরছে। বেশ অস্বস্থিকর একটা পরিবেশ, ঐন্দ্রিলা শুধু এখান থেকে কিভাবে বের হবে সে কথাটাই ভাবছে। রাগ লাগছে আবার দম বন্ধ বন্ধ লাগছে, বুকের হৃদস্পন বেশ বেড়ে যাচ্ছে। অভ্রের চোখ তখন স্থির ঐন্দ্রিলার দিকে। মেয়েটা এতো সাধারণের মাঝে অসাধারণ কিভাবে হতে পারে, কোন সাজসজ্জা নেই; শুধু চোখের নিচে হালকা কাজল আর ঠোটে লিপবাম। এভাবেও কোনো নারীকে নজরকাড়া সুন্দর লাগতে পারে? বেলীফুলের মিষ্টি মাতালকরা নাকে আসছে। এ নারীর সঙ্গ তাকে বিরক্ত করছে না, বরং মন চাইছে সময়টা থেমে যাক। অভ্রের নিপুন নজর ঐন্দ্রিলাকে আরো অস্বস্থিতে ফেলে দিচ্ছে। হলুদের বাটিটা নিয়ে চলে যেতে নিলে অভ্রের দু হাত তাকে বেড়িবাধের মতো আটকে রেখেছে, যদিও তার শরীরে একবারও স্পর্শ করে নি। বেশ ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে ঐন্দ্রি,
– কি অসভ্যতা হচ্ছে, যেতে দিন আমাকে
– পালিয়ে যেতে চাচ্ছো? সেদিন তো বেশ বড় বড় কথা বলেছিলে আজ পালাতে চাচ্ছো? আমি কিন্তু একটা কথাও ভুলি নি।
– সমস্যাটা কি বলুন তো কেনো পায়ে পা বিধিয়ে ঝগড়া করতে চাচ্ছেন?
– শুরুটা টা তুমি করেছিলে, আমি তো শেষটা টানছি।
– দেখুন
– দেখছি বলো
– পথটা ছাড়ুন আমি যেতে চাই, নয়তো
– যদি না ছাড়ি? কি করবে?
– আমি চিৎকার করবো, মানুষ জড়ো করবো
– করো, ডূ হোয়াটএবার ইউ ওয়ান্ট টু ডু। বাট কেউ আসবে না, ছাদে লাউডস্পিকারে গান চলছে। তোমার চিৎকার কাক পক্ষীর ও কানে যাবে না। তোমার সাথে কিছু হয়ে গেলেও কেউ টের পাবে না।
এবার বেশ চুপসে গেলো ঐন্দ্রিলা, অভ্রের চোখের ভাষাটা বেশ ভয়ংকর। অভ্র খেয়াল করলো ঐন্দ্রিলার চোখগুলো লাল হয়ে গেছে এবং তাতে পানি জমে গেছে। তাই ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীর এবং কড়া কন্ঠে বলে,
– তাহলে ঐন্দ্রিলা ও ভয় পায়। এবারের জন্য ছেড়ে দিচ্ছি তবে অভ্র চৌধুরীর সাথে পাঙ্গা নিতে গেলে এমন পরিণতি ই হয়। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখো। আর একটা কথা, খয়েরি ব্লাউসের নিচে সাদা ব্রা টা ঠিক মানায় না।
বলে বা চোখ টিপ্পনী কেটে পকেটে হাত গুজে হাটা দিলো অভ্র। পেছনে একবার ফিরেও তাকায় নি সে, তাকালে হয়তো দেখতে পেতো, রাগ সামলাতে না পেরে গাল বেয়ে নোনা জলরাশি গড়িয়ে পড়ছে ঐন্দ্রিলার। এই একটা স্বভাব মেয়েটার খুব রাগ হলে কেঁদে দেয়। অভ্রের বেশ শান্তি লাগছে, অপমানের বদলাটা নেওয়া হয়ে গেছে সাথে আহত বাঘিনীর মতো ঐন্দ্রিলার চেহারাটাও দেখা হয়ে গেলো। মেয়েটাকে যদি সারাক্ষণ চোখের সামনে রাখা যেতো বেশ হতো।
ঐন্দ্রিলা সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, রাগে গা রি রি করছে। লোকটা অসহ্যকর, খারাপ, অহংকারী তা ঐন্দ্রিলার জানা ছিলো তবে এতোটা নিচু মনের সেটা কল্পনাও করে নি যে। অভ্র নামের লোকটিকে তার প্রথম দেখায় অপছন্দ হয়েছিলো ঠিকই কিন্তু এখন অভ্র নামক লোকটির প্রতি মনে ঘৃণার জাল বাসা বেধেছে। বেশ খানিক সময় হয়ে গেছে অথচ হলুদের বাটি না আসায় আসমা বেগম পিউকে নিচে পাঠান। পিউ ডাইনিং রুমে এসেই দেখে হলুদ হাতে টেবিলের কাছে ঐন্দ্রিলা দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখ বেশ সুবিধার মনে হচ্ছে না, চোখ জোড়া, নাক বেশ লাল হয়ে আছে তার। পিউ ঐন্দ্রির কাধে হাত রেখে বলে,
– কি হয়েছে তোকে এরকম লাগছে কেনো?
পিউ এর কন্ঠস্বরে স্বম্বিত ফিরে ঐন্দ্রিলার। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
– তুই হলুদ নিয়ে উপরে যা, আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।
– শরীর কি খুব খারাপ? আমি কি থাকবো তোর সাথে?
– লাগবে না তুই উপরে যা, কত কাজ আছে বল। আমার একটু ভালো লাগলেই আমি উপরে যাবো।
– ঠিক আছে, নিজের খেয়াল রাখিস, দরজা লাগিয়ে দিস। সবাই আমরা উপরে তো।
– হুম
পিউ আর কথা বাড়ালো না হলুদের বাটি নিয়ে উপরে ছুটলো। ঐন্দ্রিলা দিশার রুমে যেয়ে শাড়ি ছেড়ে নিলো। খুব রাগ লাগছে, কেনো যেনো মনে হচ্ছে এখনো লোকটার অস্তিত্ব তার গায়ে লেগে আছে। দেরি না করে ওয়াশরুমে সাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে পড়লো সে।
০৮.
দিশার হলুদের অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে, সব বড়দের হলুদ লাগানো শেষ। পিউ দিশার পাশেই ছিলো। তখনই আহানা এসে তার কাছে দাঁড়ালো। পিউকে একটু টেনে নিয়ে বললো,
– ভাবী শুনো না, আমি না ক্রাস ছেয়েছি
– কিহহ!
– হুম, বড়সড় ক্রাস খেয়েছি।
– কার উপর?
– ঐ যে নীল রঙের পাঞ্জাবী পরা ছেলেটা।
পিউ কৌতুহলী চোখে তাকাতেই খেয়াল করলো আহানা কার কাউকে নয় নীলাদ্রিকে দেখাচ্ছে। হলুদ পাঞ্জাবীটায় খারাপ লাগছে না লোকটাকে। হাতাগুলো ফোল্ড করে কনুই অবধি উঠানো, হাতের কালো ঘড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সিল্কি চুলগুলো কপালে পড়ে রয়েছে। হলুদ উপলক্ষ্যে দাড়ি কেটে ক্লিন সেভ করা মুখটা দেখে কেউ বলবে লোকটা শুধু আহানা তার থেকেও ছ সাত বছর বড়। উফফফ, লোকটা পারেও কি দরকার এতো মাঞ্জা মেরে আসার। পিউ এর খানিকটা বিরক্ত ও লাগলো। কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ না করেই আহানাকে বললো,
– তুমি শিওর তুমি এর উপর ক্রাস খেয়েছো?
– হ্যা, ভাবি। তুমি চিনো তাকে?
– না চিনি না, তবে আমার তো মনে হয় লোক ভালো না। ক্রাস ই খাও এর বেশি কিছুর দরকার নেই।
– কি বলছো, খুব ভালো মানুষ
– হ্যা?
– হ্যা, আমি তো শাড়িতে পা বেধে পড়ে যাচ্ছিলাম। উনি পুরো হিরোর মতো এসে আমাকে ধরলেন। কি মিষ্টি করে কথা বলে। এমন একটা লোককে বিয়ে করলে মন্দ হয় না। আমার তো মনে হয় আমার থেকে দু তিন বছর বড় হবে।
– এই মেয়ে, কমপক্ষে তোমার থেকে দশ বছর বড় হবে এই লোক। অভ্র ভাইয়ের বয়সী।
– এতো বড়! কই চেহারাতে তো বুঝা যায় না। সমস্যা নেই চেহারাতে না বুঝা গেলেই চলবে। তবে তুমি কিভাবে জানো উনার বয়স এতো?
– কারণ আমার দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই হন উনি
– তাহলে যে বললে চেনো না?
– আমার তাকে পছন্দ নয় তাই বলেছিলাম
– যাক গে ভালোই হলো, একটু পরিচয় করিয়ে দাও না, কি নাম তার?
– মাকে বলি?
– ধুর, ভাবি। এমন করছো কেনো? আমি না তোমার একমাত্র ননদ
– উনার নাম নীলাদ্রি, শান্তি? শোনো ক্রাস যেনো ক্রাসের মতোই থাকে।
– ঠিক আছে, ঠিক আছে
আহানার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে। এবার ফেসবুকই শেষ ভরসা তার। পিউ আর কথা বাড়ালো না। বাচ্চা মেয়ে, মন শুধু উড়ো উড়ো ভাব; শুধু শুধু কিছু বলে লাভ হবে না
রাত ৯টা
ছাদ বিশাল বড় হওয়ার স্টেজের অপজিটে খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। ছামিয়ানা খাটানো জায়গায় সব গেস্টদের বসানো হয়েছে। অভ্রের চোখ শুধু ঐন্দ্রিলাকেই খুজে বেড়াচ্ছে। তখনের ঘটনার পর থেকে এখন অবধি একবারের জন্য মেয়েটার দেখা মেলে নি। কোথাও জানে একটা অস্থিরতা কাজ করছে অভ্রের। আচ্ছা তখন কি মজা করতে গিয়ে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছিলো! একটু বেশি কি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে! মনটা বড্ড বেশি খচখচ করছে। কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস ও করতে পারছে না মেয়েটা এখন কোথায়। পিউকে ও দেখছে না, যে ওকে ছলেবলে কৌশলে জিজ্ঞেস করবে ঐন্দ্রিলা কোথায়! মেয়েটাকে শায়েস্তা করেও শান্তি পাচ্ছে না অভ্র।
বাড়ির সবাই গেস্টদের খাওয়াতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। দিশার সব কাজিনরাই সার্ভ করছে। পিউ ও তাই পিছপা হয় নি। পোলাও শর্ট পরায় সেই রান্নার জায়গা থেকে পোলাও এর গামলাটা বহন করে ছাদে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। একে তুলোর মত ওজন উপরে এত ভারী গামলা, একটা সময় নিজেকে ব্যালেন্স করাই দায় হয়ে যাচ্ছিলো। ঠিক তখনই …………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি