শ্রাবণ মেঘের ভেলা ৫ম পর্ব

0
1637

#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#৫ম_পর্ব

লোকটাকে দেখে বেশ বিরক্ত লাগছে তার। অস্বস্থিও লাগছে, নিজের একাকিত্ব সময়ে কারোর আগমণ পিউ এর একদম ই পছন্দ নয়। এটা শুধু তার এবং আহাশের স্মৃতির ব্যাক্তিগত মূহুর্ত। নিঃশব্দে নিজের রুমের দিকে রওনা দিতে নিলে নীলাদ্রি পিউ এর হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। নীলাদ্রি এমন কাজ করবে স্বপ্নেও ভাবে নি পিউ। স্বভাবত পিউ এর চোখ বিস্ফোরিত রুপ নিয়ে তাকালে নীলাদ্রি পিউ এর হাত ছেড়ে দেয়। নিজের কাজে নিজেরই অস্বস্থি লাগছে নীলাদ্রির। আমতা আমতা করে পিউকে বলে,
– কিছু কথা ছিলো, তোমার ব্যাপারে
– বলুন শুনছি

পিউ এর কঠোর উত্তরে খানিকটা ভড়কে যায় নীলাদ্রি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হাত দুইটি বুকে বেঁধে শান্ত গলায় বলে,
– মোবাশশিরা, আমি জানি আমাকে তোমার তেমন পছন্দ নয় তবে এখন থেকে আমার সাথে তোমার বহুবার দেখা হবে। তোমার ইচ্ছে থাকুক কিংবা না থাকুক।
– মানে? একটু খোলসা করে বললে আমার জন্য ভালো হয় কিনা
– খালু আমাকে তোমার ব্যাপারে সব বলেছেন। তিনি চান আমি তোমার চিকিৎসা করি। যদিও তোমার মেইনলি একজন সাইকোথ্যারাপিস্টের প্রয়োজন, বাট আমার মনে হয় আগে কিছুদিন তোমাকে আমার অবসার্ভে রাখলে বেটার হবে। আমি শুধু তোমাকে কাউন্সিল করবো কিছুদিন।
– আপনাদের সমস্যা কি বলুন তো? কেনো আমার পেছনে লেগে আছেন? আমি তো পাগল নই।
– মোবাশশিরা কাম ডাউন। তোমাকে কেউ পাগল বলছে না। আমি জাস্ট তোমাকে অবসার্ভ করবো, আমার যদি মনে হয় যে তোমার কোনো প্রবলেম নেই, দেন খালুকে ক্লিয়ার করে বলে দিবো যে ইউ আর অলরাইট। সত্যি বলতে কি আহাশ মানে তোমার হাসবেন্ডের মৃত্যুর পর থেকে তোমার বিহেবিয়ার বেশ অ্যাবনর্মাল। যেকারণে….

এবার বেশ শক্ত কন্ঠে পিউ বলে উঠে,
– জানেন তো জীবনটা একটা স্টেজের মতো, জ্বলজ্যান্ত স্টেজ। যেখানে আপনাকে প্রতিনিয়ত অভিনয় করে যেতে হয়। প্রত্যেকটা মানুষের জন্য আলাদা আলাদা রোল, আলাদা আলাদা ক্যারেক্টর। এই দেখুন না, জীবনের সব থেকে সুখময় দিনটাই আমার জীবনের সব থেকে বিষাদময় হয়ে গেছে। তাই বলে কি আমার জীবন কি থেমে আছে! না আমার জীবন থামে নি। আমি অন্য কারোর বিয়েতে আনন্দ করতে চলে এসেছি। কারণ এখানে আমার ক্যারেক্টর কনের মামাতো বোনের। এবং আমি হাসিখুশি সেই ক্যারেক্টর পালন করবো। সুতরাং আমার জীবন সাজানোর অহেতুক চেষ্টা করবেন না। আমি খুশি আছি, আমি ভালো আছি। আমার আপনার সিম্প্যাথির কোনো প্রয়োজন নেই মি. নীলদ্রি

পিউ এর কথা শুনে মুচকি হেসে নীলাদ্রি বলে,
– সবাইকে মিথ্যে বললেও নিজেকে ঠকাতে পেরেছো কি? নিজের মনকে জিজ্ঞেস করে দেখো সে আদৌ খুশি আছে তো। নাকি মানুষের সাথে অভিনয় করতে করতে নিজের অন্তঃসত্ত্বার সাথেও ছলনা শুরু করেছো। যদি সত্যিই ভালো থাকো তাহলে রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটে কেনো তোমার? কেনো তোমার ফেসবুক সার্চে সবার প্রথম নামটি আহাশের? কেনো দিন শেষে তার মোবাইলে ম্যাজেস করো তুমি? মোবাশশিরা, তুমি ভালো নেই বরং আরো খারাপের দিকে যাচ্ছো। এতোটা খারাপ যে তুমি কল্পনাও করতে পারছো না। তোমার ডাক্তার বলে বলছি না। একজন বন্ধু হিসেবে বলছি। অতীত একটা কন্টকময় সত্যি, সেটাকে এড়ানো যায় না। এভাবে থাকলে একদিন নিজেই গুমরে গুমরে শেষ হয়ে যেতে হবে তোমায়।
– তো? কি করবো? আপনি আমার জায়গায় থাকলে কি করতেন? পৃথিবীর কেউ তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। এটা অসম্ভব। এভাবে আমাকে অভিনয় করে যেতে হবে। শেষ নিঃশ্বাস অবধি অভিনয় করে যেতে হবে।
– এটা তোমার ভুল ধারণা, আমরা তো মানুষ মোবাশশিরা। এক না এক সময় আমাদের মরতেই হবে। এটা বাস্তবতা। আহাশের মৃত্যুও একটা বাস্তবতা, এটা তোমাকে মানতেই হবে। তাই বলে কি তোমার জীবন থেমে থাকবে? তুমি নিজেকে থামিয়ে রেখেছো। এখনো সেই আড়াই বছর আগের সেই দিনে নিজেকে আটকে রেখেছো। প্লিজ মুভ অন মোবাশশিরা। অনেক সুন্দর পৃথিবী তোমার জন্য ওয়েট করছে।
– কাউকে কোনোদিন ভালোবেসেছেন?

হুট করে পিউ এর ভাবলেশহীন প্রশ্নে খানিকটা ভড়কে যায় নীলাদ্রি। কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছিলো না নীলাদ্রি। নীলাদ্রিকে চুপ থাকতে দেখে টিটকারির হাসি দিয়ে পিউ বলে,
– উত্তর নেই মানে ভালোবাসেন নি। আমি ভালোবেসেছি, আহাশ আমার প্রথম প্রেম, ভালোলাগা, ভালোবাসা। আমার জীবনের প্রথম পুরুষ। ভালোবাসা নামক অনুভুতিটাই অন্যরকম। যেদিন আপনি কাউকে ভালোবাসবেন সেদিন নাহয় আমাকে জ্ঞানগুলো দিবেন। সেদিনও যদি মনে হয় আমার কাজগুলো পাগলামি তবে আপনি যা বলবেন আমি তাই শুনবো। রাত হয়েছে আমি ঘুমোতে যাবো। আসছি

পিউ এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে রুমের দিকে হাটা দিলো। নীলাদ্রি পিউ এর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যতক্ষণ পিউকে দেখা যাচ্ছিলো পিউ এর নজর তাকেই দেখছিলো। যখন আর পিউ এর অবয়ব মিলিয়ে গেলো তখন পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে তা ধরিয়ে ছাদের কর্নিসে গিয়ে বসলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াতে লাগলো সে আর বাকা হেসে বলতে লাগলো,
– ভালোবাসা……ভালোবাসা…… আদৌ কি বাস্তব!

০৭.
বদরুল সাহেবের বাড়িতে আজ খুব তোড়জোড় চলছে। দিশার আজ গায়ে হলুদ। বিয়ের সব অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে হলুদ একমাত্র অনুষ্ঠান যেখানে মূলত আনন্দের রোলটা বেশি থাকে। বদরুল সাহেবের বাড়িতেও একই আমেজ। কোথাও কনের তত্ত্ব এসেছে, কি কি দিয়েছে তার তদারকি হচ্ছে তো কোথাও বরের তত্ত্ব সাজানো হচ্ছে, কেউ ছাদে হলুদের স্টেজ সাজাচ্ছে, কেউ দিশার গোসলের আয়োজন করছে, কেউ হলুদ বাটছে, কেউ মেহেদী দিচ্ছে দিশার হাতে। পিউ এর দায়িত্ব পড়েছে সুন্দর করে বরের বাড়ির তত্ত্ব সাজানো। সাথে বেশ কিছু পিচ্চি মেয়ে রয়েছে তাকে সাহায্য করার জন্য। ডালা সাজানোর মাঝেই পিউ নজর গেলো নীলাদ্রির দিকে, হাতে কিছু নিয়ে বারবার রুমে ঢুকছে আবার বের হচ্ছে; বোধ হয় কাউকে খুজছে। বেশ অস্থির লাগছে তাকে। এই নিয়ে মোট পাঁচ বার পিউ যেখানে বসে ডালা সাজাচ্ছে যেখানে ঘুরে গেছে।
– কিছু লাগবে আপনার? আধ ঘন্টায় এই নিয়ে ছ বার এই রুমে এসে ফিরে গেছেন।

এবার আবার রুমে ঢুকতেই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নীলাদ্রির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় পিউ। পিউ এর প্রশ্নে খানিকটা অস্থির ভাবেই জিজ্ঞেস করে নীলাদ্রি,
– ঐন্দ্রি বা খালাকে দেখেছো?
– দিশার গোসলের আয়োজন করছেন কেনো?
– ওহহ

চিন্তিত মুখে এমন ভাবে “ওহহ” বললো যে পিউ বাধ্য হলো তাকে জিজ্ঞেস করতে,
– আপনার কি কিছু লাগবে? ঐন্দ্রি নেই এখানে, কখন ফ্রি হবে জানা নেই। খুব প্রয়োজনীয় কিছু যদি হয় এবং আমার দ্বারা যদি সেটার সমাধান করা যায় তবে আমাকে বলতে পারেন।

নীলাদ্রি বেশ ইতস্তত বোধ করছে, কিন্তু উপায়ন্তর না পেয়ে পেছন থেকে ধলামচা করা একটা কাপড় বের করে পিউ এর সামনে এনে বললো,
– না মানে, আসলে এই পাঞ্জাবীটা একটু ইস্ত্রি করা লাগতো। আমি আয়রন খুজে পাচ্ছি না তাই ঐন্দ্রিকে খুজছিলাম। তুমি যদি একটু সাহায্য করতে ভালো হতো

নীলাদ্রির অবস্থা থেকে বেশ মজা লাগছে পিউ এর, কোনো মতে ঠোঁট চেপে হাসি আটকে বললো,
– আজিব পাবলিক আপনি মশাই, বিয়েতে এসেছে এমন দুমরানো মুচরানো পাঞ্জাবী নিয়ে! দেখে মনে হচ্ছে ওর উপর ঝড় বয়ে গেছে।
– শুনো, প্রথমত আমার পাঞ্জাবী পরার কোনো প্লান ছিলো না তাই কোনো পাঞ্জাবী আমি আনি নি। দ্বিতীয়ত এটা আমার পাঞ্জাবী না। হুট করে সবাই জোর করায় মেজো মামার কাছ থেকে ধার করেছি। তোমার যদি আমাকে নিয়ে খিল্লি উড়ানোর ইচ্ছে থাকে তবে লাগবে না সাহায্যের।
– থাক থাক, ঘাট হয়েছে আমার। বাবুর গোসা আছে বলতে গেলে। রেখে যান ওখানে, হাতের কাজ শেষ হলে সাফাকে নিয়ে পাঠিয়ে দেবো।

পিউ এর কথায় আর কথা না বাড়িয়ে পাঞ্জাবীটা সেখানে রেখেই হাটা দিলো নীলাদ্রি। ওখানে নীলাদ্রির টমেটোর মতো লাল হয়ে যাওয়া মুখের কথা ভেবে খিলখিল করে হেসে উঠে পিউ। অবশ্য পিউ এর মুক্তোদানার হাসি নীলাদ্রির চোখ এড়ালো না। মেয়েটাকে এই পাঁচদিন যাবৎ পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে নীলাদ্রি, বড্ড বেশি রহস্যময়ী লাগছে তার কাছে। মাঝে মাঝে দেখলে বুঝাই যায় না দুখের পাহাড় বুকে চেপে রেখেছে সে।

সন্ধ্যা ৭টা,
হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। স্টেজে দিশাকে এনে বসানো হয়েছে, সব মেয়েরা আটপৌড়ে করে শাড়ি পড়েছে। পিউ ও সবার মতো করে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছে। সাধারণত অফহোয়াইট কিংবা ধূসর কিংবা কালো রঙগুলো তাকে বেশি পড়তে দেখা যায়। কিন্তু দিশার একান্ত অনুরোধে সবার মতো রঙ্গীন শাড়ি পড়তে বাধ্য হলো সে। আর সে সুযোগে ঐন্দ্রিও তাকে মনের মতো সাজিয়ে দিয়েছে। ঝাকড়া ঢেউ খেলানো চুল গুলো হাফ পাঞ্চ করে সুন্দর করে বেধে দিয়েছে, সাথে জার্বেরা আর রজনীগন্ধ্যার হালকা ফুলের গহনাও তাকে পরিয়ে দিয়েছে ঐন্দ্রি। চোখে মোটা করে কাজল দিয়ে দিয়েছে, আর লাল রঙের লিপস্টিক নিয়ে ঠোঁটজোড়াকেও রাঙ্গিয়ে দিয়েছে পিউ এর। আড়াই বছর পর এভাবে সেজেছে পিউ। দিশা তো বেশ খুশি, এতোদিন জীবন্ত লাশটিকে আজ সত্যি জীবন্ত লাগছে। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারছিলো না পিউ। এই মেয়েটা কি সত্যি সে। বদরুল সাহেবের পিউকে দেখে আজ অনেক শান্তি লাগছে। মেয়েটা যদি জীবনটাকেও এভাবে সাজাতো তাহলে হয়তো তার বোনের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হতো না তার।

শওকত সাহেবের পুরো পরিবার এসেছে হলুদের অনুষ্ঠানে, অভ্র যদিও আসতে চাচ্ছিলো না কিন্তু বাবার কথায় খানিকটা বাধ্য হয়ে এসেছে। পিউ তাদের অতিথি আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখে নি। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। সাউন্ড বক্সের এক পাশে শরবতের গ্লাস হাতেই দাঁড়িয়ে ছিলো অভ্র। কিন্তু হঠাৎ স্টেজের দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেলো তার। যার জন্য পাঁচদিন নিশাচরের মতো কাটিয়েছে আজ সে নিজে তার জগতে ধরা দিয়েছে। বাসন্তী কালারের শাড়িতে বেশ লাগছে ঐন্দ্রিলাকে, কোনো ভারী গহনা নেই; শুধু খোপায় বেলী ফুলের মালা পরা। একটা অন্যরকম স্নিগ্ধতা তার মাঝে আছে। অভ্র খুব খুতিয়ে পা থেকে মাথা অবধি ঐন্দ্রিলাকে দেখে নিলো। বাঁকা হাসি দিয়ে স্টেজে কাছে গেলো সে। পিউ অভ্রকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
– ভাইয়া কিছু লাগবে?
– না, আচ্ছা এই মেয়েটা কে?
– কোন মেয়ে বলুন তো।
– বেলীফুলের খোঁপা ওয়ালি
– ওহ, ও ঐন্দ্রিলা, আমার দূর সম্পর্কের খালাতো বোন।

পিউ এর কথায় চাপাস্বরে অভ্র বলে উঠলো,
– বেয়াইন বলে কথা, ঠাট্টা তামাশা তো করাই যায়
– কিছু বললেন ভাইয়া?
– উহু থাকো।

বলে অভ্র চলে গেলো সেখান থেকে, মাথায় এখন ছক কষছে মেয়েটাকে কিভাবে শায়েস্তা করা যায়। স্টেজ থেকে নেমে ভেতরের দিকে রওনা হলো ঐন্দ্রি। হলুদের দ্বিতীয় বাটিটা নিয়ে যেতে হবে স্টেজে তাকে। টেবিলের থেকে বাটিটা নিতে গেলে অনুভব করতে পারলো কারোর নিঃশ্বাস ঘাড়ের উপর পড়ছে। সবাই ছাদে বিধায় খানিকটা থমকে যায় ঐন্দ্রি। তাড়াতাড়ি পেছনে ফিরলে…………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে