শ্রাবণ মেঘের ভেলা ২৫তম পর্ব

0
1255

#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#২৫তম_পর্ব

অভ্রের যাবার পর কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পরে ঐন্দ্রিলা। হঠাৎ ঘাড়ে কারো নিঃশ্বাস পড়তেই চমকে উঠে সে। তৎক্ষনাৎ উঠে বসতেই দেখে অভ্র তাকে জড়িয়ে শুয়ে ছিলো। ঐন্দ্রিলার এভাবে উঠে বসা দেখে অভ্র ও উঠে বসে। অভ্রকে এই মূহুর্তে সামনে দেখে দুপুরের ঘটনা গুলো মনে পড়ে যায় ঐন্দ্রিলার। মনের মাঝে অভিমানগুলো বিদ্রোহের রুপ নেয়। দুপুরের ব্যবহারগুলো মনের মাঝে ভোঁতা ছুরির আঘাতের মতো লাগছে তার। গায়ের ওড়নাটা টেনে উঠে যেতে নিলেই অভ্র হাতটা টেনে ধরে। হাতটা ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে গেলেই অভ্র আরো টেনে ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে তাকে। অভ্রের এরুপ আচরণে বেশ খেপে যেয়ে ঐন্দ্রিলা বলে,
– কি সমস্যা? হাত ছাড়ুন
– উঠে যাচ্ছো কেন?
– এখানে বসে আপনার অপমান সহ্য করার ইচ্ছে আমার নেই
– সরি, ভুল হয়ে গেছে আর হবে না
– ভালো হয়েছে, ছাড়ুন এবার
– বলছি তো, ভুল হয়ে গেছে আর হবে না এবারের মতো ক্ষমা করে দেও। আসলে হুট করে মাথাটা গরম হয়ে গেছিলো
– তো? আমি কি করবো? আমি কি আপনার রাগ ঝাড়ার টুল? রাগ হবে আপনি আমার উপর ঝাড়বেন? যখন আপনার ইচ্ছে হবে তখন আমার সাথে ভালো ব্যাবহার করবেন আর ইচ্ছে হলেই কুকুররের মতো ব্যবহার করবেন আমি কি হাতের পুতুল আপনার? তোমার যদি আমাকে পছন্দ না হয় বলে দিন, ভালোবাসার মিথ্যে নাটকগুলো আমার সাথে প্লিজ করবেন না।

ঐন্দ্রিলার কথা শুনে মাথা নিচু হয়ে যায় অভ্রের। ঐন্দ্রিলার গলা ধরে এসেছে, অভিমানগুলো চোখের কোনায় জমা হচ্ছে। সত্যি তো ঐন্দ্রিলার এখানে কোনো দোষ নেই। অভ্র তার ভেতরের ঝামেলাগুলো ও তাকে বলতে পারছে না। সব মিলিয়ে খুব অপরাধী লাগছে নিজেকে। ঐন্দ্রিলা উঠে যেতে নিলেই ঐন্দ্রিলাকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে অভ্র। ঘাড়ে মুখ গুজে বলতে থাকে,
– সরি বউ, আর হবে না। এবারের মতো আমায় ক্ষমা করে দেও
– তারপর আবার রাগ উঠবে আবার খারাপ ব্যবহার করবে তুমি, আমিও তো মানুষ। আমার ও খারাপ লাগে অভ্র। আমি বিয়েটাকে সুযোগ দিতে চাই অভ্র। আমিও সুখী হতে চাই অভ্র। ভালোবাসতে চাই তোমাকে। কিন্তু তুমি এমন কিছু একটা করো বা এমন একটা কাজ করো যে আমার মনে প্রশ্নেরা ভিড় করে আমি কি আদৌ সুখী হতে পারবো। এই সময়টা তো আমাদের দুজনে সম্পর্কের একটা সুখময় সময় হবার কথা। কিন্তু দেখো ঠিকই সব গণ্ডগোল করে দিলে তুমি। আমার দোষটা কি অভ্র? তোমাকে বিশ্বাস করা, তোমাকে ভরসা করা? নাকি তোমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করা? কোনটা?

ঐন্দ্রিলার কথায় অভ্রের নিজেকে আরো ছোট লাগছে। ঐন্দ্রিলাকে আরোও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শান্ত গলায় বলে,
– ঐন্দ্রিলা তোমাকে এই সপ্তাহ খানিক তোমাকে কিছু বলার চেষ্টা করছি। কিন্তু বলতে পারি নি। আমার কথাগুলো শুনো, তারপর তুমি যা ডিসিশন নিবে আমি সেটাই মেনে নিবো।
– কি কথা?
– দুপুরে যে ফোনটা এসেছিলো সেটা রং নাম্বার ছিলো না, নিশি ফোন করেছিলো।
– কে নিশি?
– আমার এক্সগার্লফ্রেন্ড। রেষ্টুরেন্টে সেদিন যে মেয়েটাকে আমার সাথে ব্রেকাপ করতে দেখছিলে তুমি। ও বিগত সপ্তাহখানিক ধরে আমাকে রীতিমতো ফোন করে ডিসটার্ব করে যাচ্ছে। শুধু তাই না সে ব্লাকমেইল ও করে যাচ্ছে
– ব্লাকমেইল করে যাচ্ছে মানে?
-……
– কি হলো বলো
– আসলে আমার একটি ছেলে আছে।
– কিহ

ঐন্দ্রিলা চমকে পেছনে তাকাতেই দেখে অভ্র মাথানিচু করে বসে আছে। ঐন্দ্রিলার মাথা যেনো কাজ করছে না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে, মনে হচ্ছে পৃথিবীটা অন্ধকার লাগছে। গলায় কথাগুলো আটকে যাচ্ছে তবুও অনেক কষ্টে বলে,
– মানে টা কি?
– আসলে ছেলেটা আমার আপন ছেলে নয়। আমি যখন বাইরে ছিলাম তখন ছেলেটাকে এডোপ্ট করি। এখন ছয় বছর হতে চলেছে ওর। আসলে ও আমার এক ফ্রেন্ডের ছেলে, আমার একটা ভুলের কারণে ছেলেটা অনাথ হয়ে যায়। আসলে একরাতে ফ্রেন্ডরা মিলে রেসিং করতে যেয়ে গাড়ি ব্যালেন্স না করতে পারায় ওর এক্সিডেন্ট হয়ে যায়। আমরা সবাই ড্রাংক ছিলাম, প্লাস রেসিং এর আইডিয়াটা আমার ছিলো। ছেলেটার বয়স তখন আটমাস, ওর মা ওকে ফেলে আমার ফ্রেন্ডের সব টাকা নিয়ে চলে যায়। ছেলেটার ফ্যামিলি বলতে কেউ নেই। তাই আমি ওকে এডোপ্ট করি। একটা সময় ভেবেছিলাম আমি কখনো বিয়ে করবো না। যতই হোক প্রতিটা মানুষেরই একজন সঙ্গী লাগে। ভেবেছিলাম ওর সাথেই আমার জীবন কাটিয়ে দিবো। বাসার কাউকে ওর কথা বলতে পারি নি, কারণ আমি চাই নি আমার রাইভালরা এটার সুযোগ নেক। তারপর আমার জীবনে তুমি আসলে। আমি পারতাম বিয়ের রাতে তোমায় কথাটা বলতে। কিন্তু তুমি আদৌ ওকে মেনে নিবে কিনা! ঐন্দ্রি বিশ্বাস করো তোমাকে কষ্ট দিলে আমারো কষ্ট হয়। কিন্তু রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকে না। আর তুমি যদি ওকে মানতে না চাও সেটাতেও আমার আপত্তি নেই। ও এখন যেভাবে আছে তেমনই থাকবে। আমি জানি না নিশি এটা কিভাবে জেনেছে, ও আমাকে রীতিমতো ব্লাকমেইল করে যাচ্ছে। তোমাকে সব বলে দিবে। আমি চাই নি এ ব্যাপারটা তুমি অন্য কারোর কাছ থেকে জানো। তুমি চাইলে আমি তোমাকে ডি.এন.এ টেস্ট দেখাতে পারবো। ও আমার বায়োলজিক্যাল চাইল্ড না। বাচ্চাটার কেউ নেই ঐন্দ্রি। কি করে ছেলেটাকে রাস্তায় ফেলে দেই বলো। দোষটা তো আমার ছিলো তাই না। তাই ওর বাবার পরিচয়টা আমার ই হবে।

ঐন্দ্রিলা চুপ করে অভ্রের কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলো। কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছে না। অভ্রের প্রতি সুপ্ত রাগগুলো মনে বাসা বেধে রয়েছে। কিন্তু কেনো জানে মানুষটার উপর রাগ করতে ইচ্ছে না। অভ্র এখনো মাথা নিচু করে আছে। অপরাধবোধটা অনেক বাযে জিনিস। ভেতর ভেতর নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়৷ যে লোক কখনো কারোর সামনে মাথা নত করে না সেই মানুষটা মাথানিচু করে রয়েছে। শান্ত গলায় ঐন্দ্রিলা বলে,
– কি নাম ওর?
– হ্যা?
– কি নাম ওর?
– দিশান
– স্কুলে ভর্তি হয়েছে?
– হুম, হয়েছে।
– ও কোথায় থাকে?
– গুলশানে আমার একটা ফ্লাটে ওকে রেখেছি। দুজন ন্যানি আছে। বিয়ের আগে ওকে অনেক সময় দিতাম। কিন্তু বিয়ের পর এই দু সপ্তাহে ওর কাছে যাওয়া হয় নি। দিশান অনেক ম্যাচুয়র। বুঝে আমার সমস্যা।
– আমরা কালকেই ঢাকা যাচ্ছি।
– হঠাৎ মাত্র তো আসলাম।
– আমার শখ মিটে গেছে এখানে থাকার।
– ঐন্দ্রি
– কি মনে করো তুমি আমাকে? আমি পাষাণ? তোমাকে আমি চয়েজ দিবো? ওই বাচ্চাটার সাথে কম্পিটিশন করবো? কি ভাবো তুমি আমাকে? এতোদিন যাবোৎ এই কথাগুলো কেনো বলো নি অভ্র? আমি তো তোমার সব কিছু মিলে তোমাকে ভালোবাসতে চেয়েছি। তাহলে কেনো? যা হয়েছে সেটায় তোমার দোষ ছিলো কিন্তু এজ ইউর ওয়াইফ আমার ও তোমার দায়িত্বগুলোকে ভাগ করে নেবার অধিকার রয়েছে। তুমি আমাকে এটুকু বিশ্বাস করতে পারলে না?
– কথাটা বিশ্বাসের নয় ঐন্দ্রি, আমার খারাপ লাগছিলো। তোমাকে আমি যেভাবে বিয়ে করেছি তার উপর এমন একটা কথা বলে অহেতুক তোমার উপর ওর দায়িত্ব অনেকটা চাপিয়ে দেবার মতো হয়ে যাচ্ছিলো।

অভ্র এখনো মাথা নিচু করে আছে। হুট করে ঐন্দ্রিলা তাকে জড়িয়ে ধরলো। অভ্র ও নিবিড়ভাবে ঐন্দ্রিলাকে জড়িয়ে ধরলো। খুব শান্ত ভাবে ঐন্দ্রিলা বললো,
– অভ্র স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা অনেকটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর উপর দাঁড়িয়ে থাকে। আমাদের মধ্যে ব্যাপারগুলো যত স্বচ্ছ থাকবে আমাদের সম্পর্কটা তত গভীর হবে। আজ যদি তুমি আমার সাথে তখন খারাপ ব্যবহার না করে একথাগুলো বলতে সেটা কি ভালো হতো না? আমি তোমার স্ত্রী, তোমার সব দায়িত্বে আমার ভাগ রয়েছে। এবং আমি সেটা পালন করবো। আমি তোমাকে ভালোবাসতে চাই অভ্র। সবটুকু মিলিয়ে ভালোবাসতে চাই। কিন্তু তোমার এই বদলে যাওয়াটা যে আমার ভালো লাগে না। আমি বুঝতে পারি না কোনটা আমার অভ্র? দুপুরের রাগী মানুষটা নাকি এখনের এই মানুষটা?
– আর হবে না বউ, এই কান ধরছি। প্লিজ আমাকে একা করে দিও না ঐন্দ্রি।

অভ্র কান ধরে কথাটা বললে ঐন্দ্রি হেসে দেয়। অভ্রের মুখটা দুহাত দিয়ে উচু করে কপালে উষ্ণ ঠোঁটের পরশ ছুইয়ে দেয় ঐন্দ্রিলা। অভ্র ও সেই সাথে নিবিড়ভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে। আজ তাদের মাঝের দূরুত্বগুলো যেনো নিমিষেই দূর হয়ে যায়। আজ রাত যেনো সাক্ষী হয়ে থাকবে তাদের ভালোবাসার, তাদের মিলনের।

২৬.
আসমা বেগমের ফোনে ঘুম ভেঙে যায় পিউ এর। রাত ১১টায় হুট করে সে কেনো ফোন দিয়েছেন বুঝে উঠতে পারছে না পিউ। ফোনটা ধরতেই……

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে