শ্রাবণ মেঘের ভেলা ২৩তম পর্ব

0
1247

#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#২৩তম_পর্ব

অনেকক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকতেই অভ্র স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ল্যাপটপের দিকে বলে উঠে,
– আমার চেহারায় কি কোনো হিরা মানিক জড়ানো আছে? এভাবে তাকিয়ে থাকলে তো আমারই লজ্জা লাগবে।

অভ্রের কথায় খানিকটা বিরক্তিস্বরে ঐন্দ্রিলা বলে উঠে,
– আমার বয়েই গেছে আপনাকে দেখতে।
– এই তোমাদের এক দোষ, এতোক্ষণ দেখছিলে তো। স্বীকার করলে কি আসবে যাবে?
– আপনি ক্লান্ত হন না তাই না?
– কিসের জন্য বলো তো!
– এই যে সারাদিন হয় ল্যাপটপে মুখ গুজে বসে থাকবেন নয় আমার সাথে ঝগড়া করবেন। ক্লান্ত হন না?

ঐন্দ্রিলার কথায় মুচকি হেসে ল্যাপটপটা নামিয়ে মাথা তুলে উত্তর এয়,
– যখন কাজ করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাই, তখন তোমার সাথে ঝগড়া করি। এটা একরকম রিফ্রেশমেন্ট ব্রেক আমার জন্য বলতে পারো।
– ইশশ, যতসসব
– তোমার রাগী মুখটা যে আমার খুব প্রিয় কি করবো বলো।
– ফ্লার্ট করছেন?
– আমার মতো ভদ্র মানুষ ফ্লার্ট করতে পারে না, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করছি।
– ওহ তাই বুঝি, নববিবাহিত বউ এর সাথে দু দন্ড কথাও বলা যায় না?
– বউ এর বুঝি রাগ হয়েছে?
– খুব খুব খুব

ঐন্দ্রিলার বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে রাখা দেখে অভ্র হেসে দেয়। চেয়ার থেকে উঠে ধীর পায়ে ঐন্দ্রিলার পাশে যেয়ে বসে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। কানের কাছে মুখ লাগিয়ে বলে,
– কি করলে মহারানীর ক্ষমা পাবো?
– আপনি আপনার কাজ নিয়েই থাকুন হাহ!
– আচ্ছা বাবা সরি, আর এমনটা হবে না। আসলে এক সপ্তাহের কাজ এক দিনে করতে হবে কিনা
– কেনো? হঠাৎ এতো চাপ?
– তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো যে, এজন্য। বাবা বলছিলেন, হানিমুনে যেতে। তাই
– কোথায় যাবো আমরা?

অনেকটা উচ্ছ্বল্যমনে জিজ্ঞেস করে ঐন্দ্রিলা। ঐন্দ্রিলাকে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে অভ্র বলে,
– যেখানে আমাদের কেউ ডিসটার্ব করবে না, যেখানে শুধু তুমি এবং আমি থাকবো। যেখানে আমাদের ভালোবাসার সূচনা হবে

অভ্রের কথা শুনে ঐন্দ্রিলার হৃদস্পন্দন যেনো বেড়েই যাচ্ছিলো। পালিয়ে যেতে পারলে যেনো বাঁচতো ঐন্দ্রিলা। গলা থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না তার। অনেক কষ্টে বললো,
– ছা……ছাড়ুন
– উহু, আমার বউকে ধরেছি, অধিকার আছে আমার। একটা শর্তে ছাড়বো
– ক…কি শর্ত?
– আগে আমাকে তুমি করে বলো
– পা…পারবো ন…না
-তাহলে আমিও ছাড়ছি না
– আমি ফ্রেশ হই নি
– তাতে কি? আমার ই তো
– ছাড়ো প্লিজ
– আর যেনো ভুল না হয়
– হবে না, এবার ছাড়ো

ঐন্দ্রিলার তুমি সম্মোধনটুকু যেনো অভ্রের হৃদস্পন্দন বাড়াতে যথেষ্ট। অভ্র তখন ঐন্দ্রিলার চুলগুলো ঘাড় থেকে সরিয়ে খুব গভীর ভাবে ঘাড়ে তার উত্তপ্ত ঠোঁট ছুইয়ে দেয়। মূহুর্তেই যেনো ঐন্দ্রিলার শিরদারা বেয়ে শীতলতা বয়ে গেলো। হৃদস্পন্দনের বেগ আরো বেড়ে গেলো যেনো তার, সম বন্ধ লাগছে, হৃদয় যেনো এখনই গলায় আটকে গেছে। এ যেনো অন্য অনুভূতি। এ ছোঁয়ায় নেই কোনো নোংরামী, নেই কোনো অশ্নীলতা। শুধু আছে এক মুঠো ভালোবাসা। যা ঐন্দ্রিলার হৃদয় অনুভব করতে পারছে। অভ্র তখন ঐন্দ্রিলাতে মগ্ন। একান্ত নিবিড়ভাবে তাকে চায় সে। নিজের করে; একান্ত নিজের করে। ঐন্দ্রিলা নামক নারীটি তার নেশার মতো। ধীরে ধীরে তাতে বিলীন হতে চায় অভ্র। এ নেশা যেনো কোনো হুইস্কি কিংবা উইডে নেই। এ যে ভালোবাসার নেশা। অভ্রের প্রতিটি ছোয়ায় কেঁপে উঠছে ঐন্দ্রিলা। তারা যেনো নিজের মধ্যে নেই। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলেই অভ্র এবং ঐন্দ্রিলার ঘোর কাটে। ফোনের স্ক্রিনে একটা নাম্বার দেখে অভ্রের চেহারা বদলে যায়। ফোন বেজে যাচ্ছে তবুও ধরছে না বলে কৌতুহলী কন্ঠে ঐন্দ্রিলা বলে,
– ধরছেন না যে? ফোনটা বেজে যাচ্ছে তো
– এতোটা জরুরি ফোন ও না। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও

বলেই ফোনটা সাইলেন্ট করে সিগারেট নিয়ে বারান্দায় চলে যায় অভ্র। অভ্রের মুড হুট করে অফ হয়ে যাওয়ায় বেশ অবাক হয়ে যায় ঐন্দ্রিলা। এতোক্ষণ যেনো অন্যরকম মানুষ ছিলো সে, হুট করে কি এমন হলো যেনো ভেবে পাচ্ছে না ঐন্দ্রিলা। লোকটার এতো রুপ, যেটায় এখনো নিজেকে ধাতস্থ করতে পারে নি ঐন্দ্রিলা এইতো তার মাঝে মগ্ন ছিলো; এই আবার রুদ্ররুপে সিগারেটের ধোয়া উড়াতে ব্যাস্ত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলো ঐন্দ্রিলা। একটু ধৈর্য যে তাকেও ধরতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা এমন, একটু ধৈর্য যে খুব প্রয়োজন তাতে_____

রাত ১১টা,
মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে বাহিরে, হয়তো ঝড় হবে। দমকা হাওয়া বইছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে পিউ, বৃষ্টির ঝাপটায় অনেকটাই ভিজে গেছে সে। এতোক্ষণ আহানা তার রুমে ছিলো, এখন নিজের রুমে গেছে। মেয়েটা পিউ কে আর ঝামেলার মাঝে ফেলে গেছে। মেয়েটা কথায় কথায় শুধু নীলাদ্রির কথা বলে। তাকে সে বুঝাতে পারছে না পিউ আজকাল মনকে সামাল দেওয়া বড্ড বেশি দুষ্কর হয়ে উঠেছে। মনটা শুধু নীলাদ্রির গলিতে যেতে যায়। আবার স্বপ্ন বুনতে চায়, আবার কারোর মাঝে নিজেকে খুজতে চায়, আবার ভালোবাসতে চায়। কিন্তু সব গবলেট হয়ে যায় যখন চিন্তা করে সে তো বিধবা। আচ্ছা একটা মানুষের জীবনে দুবার ভালোবাসা আসতে পারে না? দুবার বসন্ত আসতে পারে না? চোখ বারবার ভিজে আসছে, নীলাদ্রির মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। খুব কষ্ট হচ্ছে কেনো জানা নেই পিউ এর। জীবন্ন তাকে পাওয়া থেকে না পাওয়ার ভাগটাই বেশি দিয়েছে। প্রথমে তার বাবা নামক ছায়া কেড়ে নিয়েছে, তারপর মা। ভেবেছিলো বিয়ের পর সুখের মুখ দেখবে কিন্তু হলো কই? তাকেও কেড়ে নিয়েছে নির্মম ভাগ্যের লিখন। এখন আবার সুখ তাকে হাতছানি দিচ্ছে। আবার ও তাকে লোভ দেখাচ্ছে। কিন্তু ভয় হয় তার, যে পোড়া ভাগ্য তার। এই সুখ যে তার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। হঠাৎ দেখলো সামনের ল্যাম্পপোস্টের নিচে একটি অবয়ব দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির প্রকোপে ঠিক মত মানুষটার চেহারাটা দেখা যাচ্ছে না। তখন ফোনটা একনাগারে বাজতে লাগলো পিউ এর। ফোন রিসিভ করতেই চিরচেনা ভয়েসে অপজিটের মানুষটি বললো,
– বেহায়া মন যে বারণ শুনছে না মোবাশশিরা

পিউ এর বুঝতে বাকি নেই ল্যাম্পপোস্টের নিচের মানুষটি কে। মানুষটি যে নীলাদ্রি। লোকটা এই বৃষ্টির মধ্যে কোনো প্রটেকশন বাদেই চলে এসেছে। এমন পাগল কেনো এই লোক, পরে জ্বর বাধলে। খুব কড়া কন্ঠে পিউ বলে,
– কি উদ্ধার করতে এসেছেন এই রাতে? এসব ফাউ কাজ করলে কি আমি আপনাকে ভালোবাসবো ভেবেছেন?
– উহু শুধু তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিলো। তাই এসেছি। তোমার মনে আছে ও বাড়িতে থাকতে তুমি প্রায় বৃষ্টিতে ছাদে লাফালাফি করতে। তোমার তো বৃষ্টি খুব পছন্দ, তাই ভাবলাম তুমি বুঝি এখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে। না জানি কতো রাত পার করেছি এমন রাস্তায় এক ঝলক তোমাকে দেখার জন্য। এটা আমার জন্য নতুন কিছু না। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখি তখন তুমি মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ো। আমি তখন কলেজে, খুব অবাক লাগতো এই পিচ্ছিকে কিনা আমি ভালোবাসি। তোমার বয়সটা তখন এতই ছোট যে এগুলো কিছুই তোমাকে বলতে পারি নি। যখন তুমি কলেজে উঠলে ভাবলাম এখন হয়তো তোমাকে বলা যাবে আমার মনের কথা। চিঠি দিতাম প্রতিদিন, কিন্তু তুমি কোনোদিন সেটার উত্তর দিতে না। একটা সময় চিঠিগুলো পড়তেও না। ভাবলাম তুমি আরেকটু বড় হও তারপর নাহয় একেবারে বিয়ের জন্য প্রস্তাব দিবো। কিন্তু ভাগ্যের ফের দেখো বাধ্য হয়ে আমাকে বাইরে যেতে হতো। সেখানে থাকতেই শুনলাম তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। দেশে ফেরার ইচ্ছে টুকু ও শেষ হয়ে গেলো। আমাদের দুজনকেই জীবন দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছে অথচ সেটাকে গ্রহণ করতে পারছি না আমরা। কি নির্মম তাই না? যাক গে ভেতরে যাও। আসছি

বলেই ফোন রেখে দিলো নীলাদ্রি। পিউ চুপ করে কথাগুলো শুনছিলো। চোখ যেনো বাধ মানছে না। মন এবং মস্তিস্কের যুদ্ধে আজ সে পরাজিত সৈনিক। লোকটা কেনো তাকে এতো ভালোবেসেছে? এতোদিন তো ভালোই ছিল। এই গোপন কথা গুলো না জানাই তো ভালো ছিলো। কেনো পিউ এর এগুলো জানতে হলো! কেনো! কেনো!______

২৪.
কক্সবাজারে একটা হোটেলে উঠেছে ঐন্দ্রিলা এবং অভ্র। এই এক সপ্তাহ অভ্র ফোনে হাত দিবে না কথা দিয়েছে ঐন্দ্রিলাকে। রুমটা বেশ পছন্দ হয়েছে ঐন্দ্রিলার। একটা জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়। কক্সবাজারে এর আগে আসা হয় নি ঐন্দ্রিলার। অভ্র তাই কক্সবাজারে নিয়ে এসেছে। জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখায় যখন ব্যস্ত ঐন্দ্রিলা তখন

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে