#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#২২তম_পর্ব
বলে উঠে যেতে নিলে হাতটি ধরে ঐন্দ্রিলা। অবাক নয়নে পেছনে ফিরতেই দেখতে পায় সে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে। অভ্র তার দিকে গভীর নয়নে তাকিয়ে আছে। অবশেষে নিজের নীরবতা ভেঙ্গে ঐন্দ্রিলা শান্ত গলায় বলে উঠে,
– বিশ্বাস নামক তিন অক্ষরের শব্দটি খুব অদ্ভুত জানেন তো, একবার ভাঙ্গলে সেটা গড়তে অনেক সময় লাগে। সম্পর্ক ও ঠিক তেমন, একবার ভাঙ্গলে তা আবার জোড়াটা খুব দুষ্কর। আর জুড়লেও ফাটল থেকে যায়। আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে আপনাকে বিশ্বাস করছি। পুরোনো তিক্ত স্মৃতি ভুলে নিজেকে একটি দ্বিতীয় সুযোগ দিতে আমি রাজী। আপনার সাথে এই সম্পর্কের পথটা চলতে আমি রাজী। দেখবেন মাঝপথে হাতটা ছেড়ে দিবেন না যেনো।
– তাহলে বলছো আমাতে তোমার আপত্তি নেই।
– সুযোগ দিতে তো ক্ষতি নেই নাই না? তবে ঐ যে বললাম, মাঝপথে হাত ছেড়ে দিবেন না তো? আমি কিন্তু আপনার গার্লফ্রেন্ড নই, আপনার বিবাহিত স্ত্রী
– জানি, তুমি আমার স্ত্রী। আমার বেহায়া মনে যে তোমার বিস্তৃতি অনেক, হাতটা কিভাবে ছাড়বো বলো? আমার জন্য যে সেটা সম্ভব নয়। ঘুমিয়ে পড়ো, কাল আরেকদফা দকল যাবে।
মুচকি হেসে ঐন্দ্রিলাকে উত্তরটা দেয় অভ্র। অভ্রের এরুপ উত্তরে প্রশান্তির দোলা বয়ে যায় ঐন্দ্রিলার হৃদয়ে। এই জেদী, রাগী, অহংকারী লোকটা সহজ ভাষায় তার মনের অনুভূতিগুলো ঐন্দ্রিলার সামনে রেখেছে, সেটাকে পায়ে ঠেলে দেবার মতো ক্ষমতা যে ঐন্দ্রিলার নেই, তাকে যে গ্রহণ করতেই হতো। অনেকদিন পর শান্তির ঘুম ঐন্দ্রিলার চোখে এসেছে। এতোদিনের টেনশন, ভয়, উত্তেজনার আজ যেনো সমাপ্তি হলো। এই রাত তাদের তিক্ত সম্পর্কের সমাপ্তির সাক্ষী আর নতুন ভোর তাদের একসাথে পথচলার সাক্ষী হবে___
২২.
ঐন্দ্রিলার বাসার ড্রয়িং রুমে বসে রয়েছে পিউ এবং আহানা। উদ্দেশ্য অভ্র এবং ঐন্দ্রিলাকে ও বাড়ি দিয়ে যাবে। এমন কোনো প্লান ছিলো না তাদের, ননদ আর ভাবী বেরিয়ে ছিলো শপিং করবে। শপিং করার পর আহানা জিদ ধরলো ঐন্দ্রিলাদের বাড়ি যাবে। এমনেও আজ অভ্র এবং ঐন্দ্রিলা বিকেলের দিকে ঐন্দ্রিলাদের বাড়ি থেকে নিজেদের বাড়ি যাবে। আর যেহেতু তাদের বাসা কাছেই কেননা একই সাথে বাড়ি ফেরা যাক। ঐন্দ্রিলার বউভাতের পর প্রায় সকলেই ঐন্দ্রিলাদের বাড়ি থেকে চলে গেছে। বাড়িটা বড্ড ফাকা ফাকা হয়ে গেছে। থাকার মধ্যে দিশা, আসমা বেগম এবং বদরুল সাহেব আছেন। ঐন্দ্রিলারা চলে গেলে কালকে হয়তো তারাও চলে যাবে। মাঝে নীলাদ্রি আর শরীফুল সাহেব ই থেকে যাবেন এই বাড়িতে। দিশা আর আহানার বেশ ভাব হয়েছে প্রায় সমবয়সী তারা। ঐন্দ্রিলা সবার জন্য চা বানাতে ব্যস্ত। আর অভ্র সে রুমে বসে নেটে কনফারেন্স কলে ব্যস্ত। পিউ বসে বসে আহানা আর দিশার কথা শুনে যাচ্ছে, কিন্তু তার চোখ শুধু নীলাদ্রিকেই খুজে যাচ্ছে। মনটাও বেশ বেহায়া হয়ে গেছে, কিসের নেশায় শুধু নীলাদ্রির দেখা পেতে চায়। লোকটাকে বৌভাতের দিন অবশ্য দেখেছিলো, লোকটার মুখটা দেখে বুকে উথালপাথাল করছিলো। এক চাপা কষ্ট তার মুখোমন্ডলে স্পষ্ট ছিলো, তবুও নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখে সে। হঠাৎ ই কলিংবেল বাজে, কলিংবেলের আওয়াজে ধ্যান ভাঙে পিউ এর। দিশা খুলে দিতেই নীলাদ্রি ঘরে প্রবেশ করে। পিউ গভীর নয়নে নীলাদ্রিকে দেখে যাচ্ছে। যেনো বহুদিনের অতৃপ্ত হৃদয় তার পিপাসা নিবারণ করছে। নীলাদ্রিকে বেশ ক্লান্ত লাগছে। ঐন্দ্রিলা রান্নাঘর থেকেই বলে উঠে,
– দাদাভাই এসেছিস?
– হু, এক কাপ চা দিস তো।
বলেই নিজের রুমে হাটা দিলো সে, বাসায় ঢুকেই পিউকে দেখবে ভাবে নি। পিউ এর সামনে দাঁড়াতে চাচ্ছে না সে তাই পা চালিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। আয়শার সাথে কথা বলে সেখানেই চেম্বার দিয়েছে। সাথে একটা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে পার্টটাইম ক্লাস নিচ্ছে। ইচ্ছে করেই কাজের চাপ বাড়িয়ে দিইয়েছে যাতে পিউ এর চিন্তা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে। রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো নীলাদ্রি। পিউ এর মুখটা যে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করছে।
দিশা আর আহানা যেনো কথার ঝুড়ি নিয়ে বসেছে। এর মাঝেই পিউ উঠে ঐন্দ্রিলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
– কিরে, উঠে এলি যে,
– এদের কথায় মাথা ধরে এসেছে রে। কে বলবে দিশাটার বিয়ে হয়েছে? দিব্বি আহানার সাথে তাল মিলিয়ে গল্প করে যাচ্ছে।
– আচ্ছা, তোর আর দাদাভাই এর কি ঝগড়া বেধেছে আবার?
– হঠাৎ এটা মনে হবার কারণ?
– তেমন কিছু না, এমনি মনে হলো।
– আর ঝগড়া? আমাদের মধ্যে যে কি হয়েছে নিজেরাই বুঝছি না
– কিছু বললি?
ঐন্দ্রিলার প্রশ্নে নিজেকে সামলে নেয় পিউ। কথা কাটানোর জন্য বলে,
– না, কিছু বলি নি। চা দেতো ঐন্দ্রি, মাথা ধরেছে
– তোর ও? বাহবা তোর আর দাদাভাই এর কি মিল
– আচ্ছা বিয়ে দিয়ে না তোর দাদাভাইয়ের, বুড়ো হলে মেয়ে পাবে না।
– দাদাভাই দেবদাস হয়েছে রে, পারুল বাদে বিয়ে করবে না। খালা বলেছিলো, সাফ মানা করে দিয়েছে।
– যতসব ঢং, মামী কি সারাজীবন থাকবে এখানে? খালুর বয়স হয়েছে। একটা বিয়ে করে বউ আনতে বল।
– তোরে এতো শখ তুই ই বল না।
– ভাইটা তো তাই না?
– চিন্তাটা তো তোর, আর এমনেও দাদাভাইয়ের ঝামেলায় আমি পড়তে চাই না।
ঐন্দ্রিলা চা নিয়ে নীলাদ্রির রুমে যেতে নিলেই অভ্রের ডাক পরে। এই হয়েছে এক জ্বালা, এই লোকটা পনেরো মিনিট পর পর হাক দিবে, যেনো বারংকার চেক করছে বউটা তার আছে কিনা। পিউ সাথে সাথেই মুচকি হেসে বলে,
– এখন বুঝলাম, কেনো তুই দাদাভাইয়ের ঝামেলায় পড়তে চাস না। অভ্র ভাইয়া ছাড়লে তো। কি জাদু না করলি?
– তুই তো এতো ফাজিল ছিলি না, আহানা আর দিশার সাইড ইফেক্ট। চা টা একটু দাদাভাইয়ের রুমে দিয়ে আয় না। প্লিজ
বলেই পিউ এর হাতে দিয়েই অভ্রের কাছে চলে যায় সে। অগত্যা, এখন নীলাদ্রির মুখোমুখি হতে হবে। পিউ এর হাত যে বাধা, একজন বিধবা সে। শ্বশুরবাড়িতে থাকে, বলতে গেলে শওকত সাহেব তার গার্ডিয়ান। এর আগেও বদরুল সাহেব তার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো শওকত সাহেবকে। তিনি সাফ বাংলায় না করে দিয়েছেন। পিউকে সবকিছুই মেনে চলতে হবে। সত্যি বলতে, সমাজে বাধা নিয়ম পেরিয়ে নীলাদ্রির প্রস্তাবে রাজি হতে পারছে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলাদ্রির রুমের দিকে পা বাড়ায় পিউ।
নীলাদ্রির রুমের বাইরেই পা আটকে যায় তার। ভেতরে আহানা এবং দিশাও রয়েছে। নীলাদ্রির সাথে আহানার বেশ ভাল খাতির হয়েছে বলতে হবে। আহানা এবং দিশার এ রুমে আসার কারণ ও রয়েছে। কথায় কথায় দিশাকে আহানা বলে তার রোমান্টিক উপন্যাস পড়তে নাকি সেই লাগে। আর নীলাদ্রি বইয়ের কালেকশন অনেক। তাই সেই রুমে তাদের যাওয়া। নীলাদ্রিকে আহানা হঠাৎ বলে বসে,
– আপনার গার্লফ্রেন্ডটি খুব লাকি নীলাদ্রি ভাই
– হঠাৎ এমন কেনো মনে হলো?
– আপনি যে পরিমান কেয়ারিং। তা কবে বিয়েশাদী করছেন?
আহানার ছেলেমানুষী প্রশ্নে মলিন হাসি হেসে নীলাদ্রি বলে,
– আমার বিয়ে এজীবনে তোমার খাওয়া হবে না
– কেনো?
– আমাকে সে সোজা বাংলায় না করে দিয়েছে, অর্থাৎ ফিরিয়ে দিয়েছে।
– এমন মেয়েও আছে যে কিনা আপনাকে রিজেক্ট করে! আমি হলে জীবনেও এ কাজ করতাম না।
– আছে, সে যে আমার মনের খাঁচায় ধরা দিবে না।
– তাহলে বলবো, তাকে ভুলে যান।
– চেষ্টায় আছি।
– ওকে বলে লাভ নেই আহানা, মা একের পর এক মেয়ের ছবি দেখাচ্ছে কিন্তু বান্দা তার পারুলের অপেক্ষায় দেবদাস হয়েছে।
দিশার কথা শুনেই আচ্ছা করে কান মলে দেয় নীলাদ্রি ওর। নীলাদ্রির কথাগুলো ছুরির ন্যায় হৃদয়ে লাগছে পিউ এর। নিজেকে সামলে রুমের ভেতরে ঢুকে সে। পিউ এর প্রবেশে নীলাদ্রি দিশার কান ছেড়ে দেয়। পিউ যে তার রুমে আসবে ভাবে নি। আহানা তখন এক দৃষ্টিতে নীলাদ্রিকে দেখছে। পিউ দিশা আর আহানাকে বলে,
– মামী ডাকছে, নাস্তা টেবিলে দিয়েছেন। আর আহানা আমাদের যেতে হবে।
– আচ্ছা, নীলাদ্রি ভাই “অপেক্ষা” বইটা নিলাম। সময় করে ফিরিয়ে দিবো, সে সাথে আপনার থেকে ট্রিট ও নেয়া হবে
– ঠিক আছে।
আহানা এবং দিশা রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই পিউ চাপা স্বরে বলে উঠে,
– এবার বিয়েটা করেই নিন
– কি বললে?
– বললাম, বিয়েটা করে নিতে। খালুর বয়স হয়েছে
– আচ্ছা পিউ, একটা কথা বলি?
– …………
– আমাকে রিজেক্ট করেছো আমি কিছু বলবো না, কিন্তু আমার জীবনে অন্য কাউকে আনার কথা ভুলেও বলবে না। এইবার ই শেষ
– আপনি আপনার জিদের বসে
– এটা জিদ আমার জিদ নয় পিউ, জিদ হলে তোমার অমতেও তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব খালুকে দিতাম। খালুকে রাজী করাটা আমার জন্য খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। এটা আমার ভালোবাসা তাই তোমার মতের সম্মান করছি। আর একদিন তুমি বলেছিলে, ভালোবাসলে নাকি মানুষ ভুল সঠিক ভেদাভেদ করে না। আমার ক্ষেত্রেও তাই। তবে পার্থক্য একটাই, তুমি অপেক্ষা করেছিলে মৃত মানুষের, আর আমি জীবিত। আশা করি এসব বিয়ের আবদার তুমি আর আমার কাছে করবে না।
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় নীলাদ্রি। পিউ সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, নিজেকে আজ অপরাধী লাগছে। সব জেনেও নীলাদ্রির ভালোবাসাকে গ্রহণ করতে নাপারগ সে। নীলাদ্রির ভালোবাসায় তো কোনো নোংরামী নেই, কোনো বাধ নেই, তার ভালোবাসাটা অন্যায়ও নয়। তবুও পিউ ব্যর্থ তা গ্রহণে____
২৩.
রুমে এসেই গা এলিয়ে দিলো ঐন্দ্রিলা। খুব ক্লান্ত সে। এ কয়দিনের আচার-অনুষ্ঠান তাকে বড্ড বেশি ক্লান্ত করে দিয়েছে। অভ্রের কি অভ্র তো আছে তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তার কি খেয়াল আছে বউ এর প্রতি। ঐন্দ্রিলাদের বাসায় সবাই ভাবছে না জানি বর তার তাকে চোখে হারায়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এখনো ল্যাপটপ নিয়ে টেবিলে বসা। অনেকক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকতেই………..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি