#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#২১তম_পর্ব
সবার কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসলো ঐন্দ্রিলা। বরের গাড়িতে শুধু ঐন্দ্রিলা এবং অভ্র। ঐন্দ্রিলা এখনো কাঁদছে, অনেকটা হিচকি তোলা অবস্থা। এবার অভ্রের চরম বিরক্ত লাগা শুরু হলো, এতো কাঁদার কি আছে, বৌভাতের পর দিন ই তো বাড়ি যাবে ওইন্দ্রিলা। ভাবটা অনেকটা এমন যেনো কোনো কসাই এর সাথে তার বিয়ে হয়েছে। অনেকটা ধমকের সুরেই বলে উঠলো অভ্র,
– এতো কাঁদার কি আছে? কেউ কি মারা গেছে নাকি?
অভ্রের এমন আচারণে বেশ হতচকিয়ে যায়। এতোক্ষণ অভ্রের মায়াভরা রুপ দেখার পর এখন এমন রুপ যেনো কিছুতেই হজম হচ্ছিলো না ঐন্দ্রিলার। অবাক নয়নে শুধু অভ্রকেই দেখে যাচ্ছিলো যে। একেই নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে, তার বাবাকে ছেড়ে এসেছে সে। তাই মন এমনিতেই খারাপ। উপরে অভ্রের ধমকে মন আরো ও খারাপ হয়ে গেছে। অভ্রকে খুব ইচ্ছে করছিলো দু কথা শুনিয়ে দিবে কিন্তু কিছু বলার ইচ্ছেটুকু নেই তার। চুপচাপ বসে রইলো সে, নজর বাহিরের দিকে; চোখ থেকে পানি পড়েই যাচ্ছে কিন্তু মুখে শব্দ নেই। অভ্র মিনিট পাঁচেক পর খেয়াল করলো ঐন্দ্রিলা চুপ হয়ে গেছে, হয়তো অভিমান করেছে। এখন নিজেরই খারাপ লাগছে। না বকলেই ভালো হতো হয়তো, কিন্তু কি করবে এসব শান্তনা দেয়া যে তার কোনো কালে অভ্যাস নেই আর কান্না কাটি খুব ই বিরক্ত লাগে তার। ঐন্দ্রিলাকে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। একবার চেয়েও আবার থেমে গেলো। পাশাপাশি দুটা মানুষ বসা অথচ একে অপরের সাথে কোনো কথাই বলছে না। একজন অভিমানের বসে তো আরেকজন নিজের ইতস্ততার কারণে। এখনো যে অনেক পথ পেরোনো বাকি, কেবল তো একসাথে চলা শুরু।।
রাত ১১টা,
এক ঘন্টা যাবৎ অভ্রের রুমে ঘোমটা দিয়ে বসে রয়েছে ঐন্দ্রিলা। সেই যে বরণের পর আহানা এবং পিউ তাকে এখানে বসিয়ে গেছে এখনো একাই এইরুমে বসে রয়েছে। রুমটা খুব সিম্পল, পুরো রুমে সাদার ছড়াছড়ি। সাদা দেয়াল, সাদা পর্দা, সাদা বিছানার চাদর তাতে সাদা গোলাপের সাজসজ্জা। ফার্নিচার যে খুব বেশি আছে তাও নয়, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, ওয়ার্কিং টেবিল এবং একটা বুকসেলফ যাতে বই পত্র নয় কাজের ফাইল ভর্তি। মানুষটা যে বড্ড বেশি কাজপ্রেমিক। ঐন্দ্রিলার ভেতর অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করেছে, অভ্রের বিভিন্ন রুপে ধাতস্ত হতে তার বেশ অসুবিধা হচ্ছে। এখন অভ্রকে জব্দ করার ফন্দি তো আসছেই না উলটো একরকম ভয় কাজ করছে। জিদের বসে বিয়ের ডিসেশনটা ভুল নয় তো। এবার অধৈর্য হয়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। একা একা কতোক্ষণ বসে থাকা যায়! আজ পূর্ণিমা, আকাশে থালার মতো মস্তবড় চাঁদ উঠেছে। ঐন্দ্রিলা জ্যোৎস্না বেশ ভালোবাসে। হুমায়ুন আহমেদ এর উপন্যাসে জ্যোৎস্না বিলাস পড়তে পড়তে ঐন্দ্রিলার মনে একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো, তার স্বামীর সাথে কোনো এক পুর্ণিমায় ছাঁদে জ্যোৎস্না বিলাস করবে। কিন্তু সে গুড়েবালি, অভ্র নামক লোকটার সাথে এমন কিছু ভাবাও দুষ্কর। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে একথাগুলোই ভেবে যাচ্ছিলো ঐন্দ্রিলা। রাতের নীরবতায় হঠাৎ কারোর পায়ের শব্দ পেতেই পেছনে ফিরে ঐন্দ্রিলা। এতক্ষণে মশাইয়ের রুমে আসার সময় হলো। অভ্রকে দেখে গাড়ির কথাটা মনে পড়ে গেলো। সাথে সাথেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো ঐন্দ্রিলা। খানিকটা অভিমান হয়েছে তার। অভ্র সেভাবে না বললেও তো পারতো, সে কি বুঝে নিজের ঘর, নিজের আপনজন ছেড়ে আসার কষ্ট। ঐন্দ্রিলাকে উদাস মনে বাহিরে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুঝতে বাকি নেই অভ্রের ম্যাডামের রাগ হয়েছে। আসলে এখানে অভ্রের ও দোষ যে আছে সেটাও না, সে তো সম্পর্কের এই পর্যায়ে নতুন, প্রিয়তমাকে শান্তনা দেবার ট্রেনিং যে কেউ তাকে দেয় নি। এতোদিন তো শুধু চেক দ্বারাই প্রেমিকার রাগ ভাঙ্গাতো সে, আর যখন বিরক্ত লাগতো সুন্দর ব্রেক-আপ। এখন তো তা করলে চলবে না, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিশার্ট আর শর্টস নিয়ে বাথরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলো অভ্র। ঐন্দ্রিলা এবার অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে। একটা সরি বললে কি যায় লোকটার! সুন্দর ফ্রেশ হতে চলে গেলো!
মিনিট দশেক পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসলো অভ্র। ঐন্দ্রিলা এখনো ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে এভাবে দেখে খানিকটা নরম স্বরে বললো অভ্র,
– ফ্রেশ হয়ে আসো, সারাদিন তো কম ধকল যায় নি।
– সেটা নিয়ে আপনার না ভাবলেও হবে!
ঐন্দ্রিলার এরুপ কাট কথায় অনেকটা চমকে গেলো অভ্র। না এভাবে হবে না, তাই বেশ কঠিন কন্ঠে অভ্র বললো,
– পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি চেঞ্জ করে আসো, একবার ই বলবো। না শুনলে কিভাবে শুনাতে হয় আমার জানা আছে।
– জোর দেখাচ্ছেন?
– না, অধিকার। তোমার লাগেজ ওখানে রাখা। চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও, ভালো লাগবে
ঐন্দ্রিলা আর কথা বাড়ালো না। একটা নীল শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। লোকটার মাথা খারাপ, কখন কি করে তার কোনো ঠিক নেই। মিনিট পনেরো পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো অভ্র ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আপন মনে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। সিগারেটের ধোয়া ঐন্দ্রিলার সহ্য হয় না। নাক মুখ কুচকে বিছানায় বসে পড়লো সে। অভ্র তখন আপনমনে সিগারেটে টান দিতে ব্যাস্ত। পেছনে আওয়াজ পেতেই বুঝলো ঐন্দ্রিলা বেড়িয়ে গেছে। মুচকি হেসে সিগারেটের শেষ টান দিয়ে সেও ভেতরে গেলো। ধীর পায়ে ঐন্দ্রিলার কাছে যেতেই ঐন্দ্রিলা খানিকটা উপসে গেলো, ঐন্দ্রিলার অস্বস্তির ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ধীর কন্ঠে অভ্র বললো,
– তোমাকে কিছু বলার ছিলো ঐন্দ্রিলা, আমার মনে হয় তোমার কাছে কিছু লুকানোটা ঠিক হবে না
– জ্বী বলুন
– আমি জানি, আমি যেভাবে তোমাকে বিয়ে করেছি তুমি আমাকে ভালো মানুষের কাতারে ফেলতে পারছো না। আসলে তুমি আমার জীবনে আসার আগে আমার কাছে নারীর সংজ্ঞাটাই অন্যরুম ছিলো। আমার কাছে মনে হতো নারীরা টাকার গোলাম। বিয়ে ব্যাপারটা আমার সিলেবাসে ছিলোই না। সম্পর্কে কমিটমেন্টের ব্যাপারে আমার ভয় লাগতো।
-………
– আসলে আমার অতীতটা অনেক তেতো, আমার নিজের মা আমাকে টকার জন্য ইউজ করেছে। প্রথমে সে আমাকে ছোট থাকতে ছেড়ে চলে যায়, তারপর যখন তার টকার প্রয়োজন হয় সে বাবাকে ব্লাক মেইল করে আমার কাস্টেডি নিয়ে। বাবা তাকে টাকা দিয়ে দিলে সে আমাকে আবার ছেড়ে যায়। ঘটনা গুলো আমার উপর খুব বাজে প্রভাব ফেলে, তাই আমার চিন্তাধারা গুলো এমন হয়ে ছিলো। সত্যি বলতে আমার অনেক গার্লফ্রেন্ড অনেক ছিলো, কারো কারো সাথে আমার শারীরিক সম্পর্ক ও হয়েছিলো কিন্তু ব্যাপারগুলো সিরিয়াস ছিলো না। কারণ কমিটমেন্ট করার মতো সাহসটুকু আমার ছিলো না। হয়তো বিয়ের প্রথম রাতে কথাগুলো তোমার জন্য মেনে নেওয়াটা অনেক কঠিন। কিন্তু আমি চাই না কোনো মিথ্যের উপর আমাদের সম্পর্ক হোক।
ঐন্দ্রিলা চুপ করে অভ্রের কথাগুলো শুনছিলো, পিউ এর কাছে এগুলো অনেক আগেই তার শোনা হয়ে গেছিলো, এগুলো নতুন কিছু না। অভ্রের যে আগের গার্লফ্রেন্ডগুলোর কিচ্ছাও তার জানা, কিন্তু অভ্র তাকে এসব বলবে এটা ভাবতে পারে নি। অনেক ঠান্ডা গলায় ওইন্দ্রিলা তাকে বলে,
– আপনি আমাকে এগুলো কেনো বলছেন? আমাকে তো প্রতিশোধের নেশায় বিয়ে করেছেন, তাই না?
– প্রথমে তাই ভেবেছিলাম, কিন্তু শুধু প্রতিশোধের নেশায় তোমাকে আমি বিয়ে করি নি।
– তাহলে?
– আমি যে কমিটমেন্টে যেতে চাই, এই প্রথম আমি একটা সম্পর্কে যেতে চাই। আমি ভালোবাসতে চাই কাউকে, আমার আধারে ঘেরা জীবনে কাউকে আকড়ে ধরতে চাই। আমি ক্লান্ত ঐন্দ্রিলা, এবার কারো উপর ভরসা করতে চাই। আর তাই তোমাকে আমার বিয়ে করা
অভ্রের কথায় কি বলা উচিত জানা নেই ঐন্দ্রিলার। অভ্র চৌধুরীর মতো মানুষ তাকে প্রেম নিবেদন করছে, ব্যাপারটা যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না। ঐন্দ্রিলা অবাক নয়নে অভ্রের মুখপানে চেয়ে আছে। হৃদস্পন্দনের বেগটা বেড়েই চলেছে। মুখ ফসকেই বলে ফেললো,
– আমি কেনো?
– জানি না, কিন্তু তোমার সাথে প্রথম দেখা থেকেই আমি যেনো নিজের মাঝেই ছিলাম না। কিসের টানে, জানি না তোমাকে খুজতাম। তারপর তোমাকে দিশার বিয়েতে দেখলাম, পায়ে পা বাধিয়ে জগড়া করলাম। তারপর বিয়েতে খুনসুটি। কখন তোমার প্রতি দূর্বল হয়ে গেছি জানা নেই। এই ভালোবাসা, ভালোলাগা এই ব্যাপার গুলো আমার কাছে যেনো নতুন কোনো অধ্যায়। আমার রাগ অনেক ঐন্দ্রিলা, প্রচুর জিদ। জিদের বসেই তোমাকে বিয়ে করা। কিন্তু কোথাও না কোথাও তোমার প্রতি দূর্বলতা ছিলো। তুমি যখন বললে তুমি ডিভোর্স চাও না, আমার সাথে তুমি সংসার করবে; একটা অন্যরকম খুশি হয়েছিলাম। আমি তোমাকে বুঝাতে পারবো না, ঐন্দ্রিলা। যদি বলো এটা ভালোবাসা তবে তাই, কিন্তু আমার যে তোমাকে চাই। সারাজীবনের জন্য। তবে চিন্তা নেই, আমি তোমাকে কখনোই জোর করবো না, যথেষ্ট সময় তুমি পাবে। তোমার সম্মতি ব্যাতীত আমি তোমার কাছেও আসবো না। আমি বেড পার্টনার না, একজন বউ চাই। যে আমার রাগ, আমার জিদ সব সামলে আমাকে ভালোবাসবে। তবে হ্যা, সারাজীবন সময় দেবার মতো আমার ধৈর্য নেই, আর এই আপনি আজ্ঞা আমাকে করা দরকার নেই। একসাথে চলতে যখন হবেই তাহলে এসবের কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
বলে উঠে যেতে নিলে…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি