#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#২০তম_পর্ব
– তুমি চাইলে সারাজীবন এভাবেই খাওয়িয়ে দিতে রাজী
হঠাৎ নীলাদ্রির এরুপ কথায় অবাক নয়নে তার মুখের দিকে তাকায় পিউ। নীলাদ্রির চোখ তার দিকে স্থির, এ চোখে আজ যেনো অন্য কিছু দেখছে পিউ; অথৈ মায়া এক চোখ জোড়ায়। আর সেই মায়া কেবলমাত্র তার জন্য। কিছুক্ষণ আগের বাক্যটি যে নীলাদ্রি হুতাশে বলে নি তার প্রমাণ তার চোখ। মানুষের চোখ নাকি মিথ্যে বলে না। বুকের ভেতর অজান্তেই একটা মোচড় দিলো পিউ এর। নীলাদ্রির কথাটা কি তবে সে ভেবে বলেছে? এমন তো হবার কথা ছিলো না। সে তো নীলাদ্রির মাঝে একজন বন্ধুকে চেয়েছিলো। মুহুর্তেই পিউ এর মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো। মনের মাঝে হাজারো কালো মেঘ জড়ো হতে লাগলো। নিজেকে সামলে চাঁপা স্বরে পিউ নীলাদ্রির উদ্দেশ্যে বলে,
– আপনি ভেবে বলছেন তো?
– আমি যা বলি ভেবেই বলি। আর আমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে পারি না পিউ, এই রাতের নীরবতা, এই উত্তাল বাতাসকে সাক্ষী রেখে বলছি ভালোবাসি তোমায়। হ্যা তোমাকে ভালোবাসি আমি। তোমাকে জোর করার ক্ষমতা আমার নেই, তবে তুমি যদি আমার হাত ধরো পৃথিবীর সাথে লড়ে যাবো তোমায় কষ্ট দিবো না।
খুব স্বাভাবিক এবং জোরালো গলায় কথাগুলো বলে নীলাদ্রি। পিউ এর মাথা ভন ভন করছে, এটা কি আদৌ সম্ভব? যত হোক সে একজনের বিধবা। এসব ভালোবাসা কি তার জন্য! সব কিছু পিউ এর জন্য বেশ চাপের মতো লাগছে। নীলাদ্রিকে নিয়ে এরুপ চিন্তা কস্মিককালেও তার হয় নি। হ্যা নীলাদ্রি মানুষ হিসেবে অনেক ভালো কিন্তু তার মতো একজন অপূর্ণ হৃদয়ের কাউকে নীলাদ্রি মোটেই ডিজার্ভ করে না। আর সমাজ কি বলবে! নিজের বেড়িবাধ ভাঙার ইচ্ছে থাকলেও সেটা সম্ভব নয়। না নীলাদ্রির অনুভূতি তার প্রতি তৈরি হবার আগেই তার সমাপ্তি করা দরকার। বেশ ঠান্ডা কন্ঠে বলে পিউ,
– এটা কোনো রঙ্গমঞ্চের নাটক নয় নীলাদ্রি, যে আপনার বড় বড় ডায়ালগে আমার হৃদয় গলে যাবে। যত যাই হোক আমি একজন বিধবা। একজনের স্ত্রী, একটা পরিবার বধু। আমার কিছু দায়িত্ব আছে তা আমি এড়িয়ে যেতে পারি না।
– তোমার দায়িত্বতে আমি কখনো বাধা দিবো না পিউ, আমার তোমার অতীতে কোনো কিছুতেই কোনো সমস্যা নেই। একবার
– আমার আছে, আমার আছে নীলাদ্রি। একটা সময় আমি আমার সর্বোস্ব দিয়ে আহাশকে ভালোবেসেছি। সে নেই তাই বলে আমার ভালোবাসা শেষ হয়ে যাবে না।
– কে বলেছে মানুষ একবারই ভালোবাসে? তোমার আমাকে ভালোবাসতে হবে না। আমার ভালোবাসাই দুজনের জন্য যথেষ্ট।
– আপনাকে আমি বুদ্ধিমান ভাবতাম, কিন্তু এখন দেখছি তা নয়। সত্যি বলতে আমি চাই না আপনার মতো একটা মানুষ আমার সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিজের জীবনটা নষ্ট করুন।
– তুমিও তো সেটাই করছো তাই না পিউ? একটা মানুষের সাথে তোমার কাটানো মূহুর্ত মাত্র হাতে গোনা তার জন্য তুমি আড়াই বছর বসে আছো। তুমি তোমার জীবন নষ্ট করছো না? তুমি কিসের ভয় পাচ্ছো পিউ, আমি তো আছি।
– আপনি বুঝছেন না আপনার ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। আমাকে ক্ষমা করবেন আমি আপনার ভালোবাসার নিবেদনকে গ্রহণ করতে পারছি না।
বলেই ছাঁদ থেকে দৌড়ে নিচে চলে গেলো পিউ। চোখ থেকে পানি পড়ছে তার, কেনো বারবার না চাইতেও চোখ ভিজে আসছে জানা নেই তার। তবে কেনো যেনো খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। রুমে এসে দরজা লাগিয়ে সেখানেই বসে পড়ে পিউ। কেনো কাঁদছে নিজেও জানে না। আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নীলাদ্রি। বুকের বা পাশের চিনচিন ব্যাথাটা তীব্রতর হচ্ছে। এটা যে হারানোর ব্যাথা___
২১.
আজ ঐন্দ্রিলা এবং অভ্রের বিয়ে। অবশেষে অভ্রের বধুবেশে সাজতে হলো ঐন্দ্রিলাকে। আজ সেদিনের কথা বেশ মনে পড়ছে, যেদিন রেস্টুরেন্টে সবার সামনে অভ্রকে উচিত কথা শুনিয়ে দিয়েছিলো সে। তখন কি ভেবেছিলো এই লোকটাকেই অবশেষে নিজের স্বামী রুমে পাবে। সেদিন তো ভেবেছিলো এই লোকের সাথে আর কোনোদিন দেখাই হবে না তার অথচ আজ এই লোকটার সাথেই দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ে হচ্ছে তার। বৃষ্টির দিন রাগের বশে যদি ঐন্দ্রিলাকে বিয়ে না করতো অভ্র তাহলে বোধহয় আজ তাদের বিয়ে হতো না। ঐন্দ্রিলা তো কিছুতেই রাজী হতো না। ঘটনা গুলো মনে পড়তে এখনও রাগ লাগে তার। তবে রাগের সাথে একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে আজ। মনের মাঝে ভয়, চিন্তাগুলো একরকম ঝেকে বসেছে। অভ্র লোকটাকে কিছুতে তার বোধগম্য হয় না। লোকটা তাকে প্রতিশোধ তুলতে বিয়ে করল, বললো সে কখনো স্ত্রীর মর্যাদা তাকে দিবে না এবং কোনো দায়িত্ব ও পালন করবে না ঐন্দ্রিলার অথচ এই দু সপ্তাহ তার যেনো অন্য রুপ দেখতে ঐন্দ্রিলা। এইসব খুব ভাবাচ্ছে ঐন্দ্রিলাকে, বুকের মাঝে প্রশ্নরা যেনো ঝেকে বসে আসে, সামনে যেনো দূর্ঘম পথ তার জন্য অপেক্ষা করছে। কমিউটিনি সেন্টারের রুমে বসে এসব চিন্তাই তাকে আরো ঘাবড়ে দিচ্ছে।
এদিকে, বরপক্ষ চলে এসেছে। নীলাদ্রি কনের ভাই হিসেবে তার সকল দায়িত্ব যথারীতি পালন করার চেষ্টায় রয়েছে। বরপক্ষ চলে আসায় এক রকম দৌড়াদৌড়ি চলছে, আসমা বেগমের বরণ করার কথা কিন্তু তাকে খুজে পাচ্ছে না নীলাদ্রি। এরই মাঝে সে মুখোমুখি হয় পিউ এর সাথে। গোলাপি কাতানে কোনো পরীর থেকে কম কিছু লাগছে না পিউ কে। আজ দুদিন নীলাদ্রির এর সামনেও আসে নি সে। পিউ একই বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও তার সামনে আসে নি। এখন আসমা বেগমকে খুজার তাড়া না থাকলে হয়তো এখনো পিউ এর দেখা মিলতো না তার। পিউ তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে, অথচ এগারো বছরের প্রেমের ব্যার্থতা তো তার। পিউ চাচ্ছে না নীলাদ্রিবা সে অস্বস্তিকর পরিবেশে পরুক। পিউ পাশ কাটিয়ে চলেই যাচ্ছিলো তখন নীলাদ্রি ধীর কন্ঠে বলে উঠে,
– নিজেকে আমার থেকে লুকিয়ে রাখছো কেনো পিউ?
– কই না তো
আমতা আমতা করে উত্তর দেয় পিউ। পিউ এর উত্তরে মলিন হাসি ঠোঁটের কোনায় একে নীলাদ্রি বলে,
– এগুলো কর না পিউ, নিজেকে অসহায় লাগে। এগারো বছর করে ভালোবাসার পর না পাওয়া এই ব্যার্থতাটা কেবল আমার। এতে তোমার কোনো দোষ নেই। আমি কখনো আর প্রেমের দাবি নিয়ে তোমার কাছে দাঁড়াবো না পিউ। শুধু নিজেকে আমার থেকে আড়াল করো না।
বলেই সেখান থেকে চলে যায় নীলাদ্রি। নীলাদ্রির প্রতিটা কথা যেনো ভোতা চুরির মতো পিউ এর কলিজায় লাগছে, কষ্ট হচ্ছে তার। কারণ অজানা, তবে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। এ যেনো কিছু হারানোর বেদনা, আহাশের মৃত্যুর সত্যিটা মানার সময় এই কষ্টটা হয়েছিলো। আজ আবার এ কষ্টটা হচ্ছে। কেনো? কেনো? কেনো?
বরপক্ষকে অনেক সাদরে বরণ করেছেন আসমা বেগম। পিউ তাদের সাথে আসে নি, আগ থেকেই কনে পক্ষ হয়ে অভ্রকে আসমা বেগমের সাথে বরণ করেছে। সব খুব সুষ্ঠভাবে দু ঘন্টার মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। বিয়ে সম্পন্ন হবার পর যখন ঐন্দ্রিলাকে অভ্রের কাছে এনে তার পাশে বসানো হয়, অভ্রের চোখ যেনো সরতে চাচ্ছিলো না। দোকানের সেদিন থেকেও আজ বেশি সুন্দর লাগছে তাকে। বুকের হৃদস্পন্দন গুলো বেরেই চলেছে। অবশেষে মিসেস অভ্র চৌধুরীর ফাঁকা জায়গাটা পূরণ হলোই। বিয়ের সব কার্যক্রম শেষ, এবার বিদায় পালা। শরীফুল সাহেবের চোখ বারংবার ভিজে আসছে। যতই হোক মেয়ে তার, আর ঐন্দ্রিলা হাউমাউ করে কাঁদছে। একটা সময় অভ্রের বিরক্ত লেগে গেলো, এসব কান্না টান্না তার একেবারেই ভালো লাগে না। সবার আগে সে গাড়িতে গিয়ে বসলো। সবার কাছে বিদায় নিয়ে…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি