#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#১৯তম_পর্ব
বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বাহিরে আসতেই দেখলো রুম পুরো অন্ধকার। খানিকটা ঘাবড়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। কারণ ইলেক্ট্রিসিটি যায় নি, বাথরুমের লাইট জ্বলছে। ধীর পায়ে এগিয়ে সুইচে হাত দিতে যাবে তখন কেউ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। চিৎকার করার আগেই লোকটি এক হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে। ঐন্দ্রিলার কানে মুখ লাগিয়ে বলে,
– চেচিয়ো না, আমি
কন্ঠস্বরটি খুব পরিচিত তার। লোকটি খুব আষ্টেপৃষ্টে ঐন্দ্রিলাকে জরিয়ে রয়েছে। তার গরম নিঃশ্বাস ঐন্দ্রিলার ঘাড়ের উপর পড়ছে, পিঠ ঠেকে আছে লোকটির বলিষ্ঠ বুক। তার হার্টবিট এতো জোরে চলছিলো সে ঐন্দ্রিলাও তা অনুভব করতে পারছিলো। একটা মাতাল কড়া গন্ধ নাকে আসছে। এই মাতাল কড়া গন্ধটি ঐন্দ্রিলার খুব পরিচিত, যতবার লোকটি তার কাছে এসেছে এই গন্ধটি সে পেয়েছে। মুখ থেকে হাতটি নামিয়ে লাইট লাগাতে লাগাতে হিসহিসিয়ে বলে উঠে,
– আপনি বাড়ি যান নি?
– একটা কাজ যে বাকি রয়ে গেছে।
বেশ স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দেয় অভ্র। হ্যা অভ্র ই ঐন্দ্রিলার রুমে এসেছে। পিউ এর সাথে এই প্লানটা আগ থেকে করা ছিলো তার। তাই এতোটা সুন্দরভাবে ঐন্দ্রিলার রুমে ঢুকে পড়েছে। ঐন্দ্রিলাকে এখনো জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র। ঐন্দ্রিলা তার কবল থেকে ছূটা পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ঐন্দ্রিলার নড়াচড়ায় বিরক্ত হয়ে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানে মুখ লাগিয়ে বলে,
– এতো নড়ছো কেনো? আর একবার নড়লে কিন্তু তুলে আছাড় দিবো
– বললেই হলো? ছাড়ুন বলছি নয়তো কিন্তু চিৎকার করবো
– নিজের বউকে ধরেছি, পাশের বাড়ির কাউকে নয়। কাজ হয়ে গেলে চলে যাবো
– এই রাতে কি কাজ আপনার শুনি?
ঐন্দ্রিলার কথা শুনে তাকে নিজের দিকে ফেরায় অভ্র। নিজের দু হাতে আলতো করে মুখটা তুলে ঐন্দ্রিলার। ধীর কন্ঠে বলে,
– নিজের বউ কে হলুদ লাগাতে এসেছি। সবাই তো হলুদ লাগালো, আমি সুযোগ ই পেলাম না।
– হ্যা? এই রাতে এই পাগলামি করতে আসছেন?
– পাগল বললে তাই, তবে হলুদ তো লাগাবোই।
– হলুদ কই পাবেন?
ঐন্দ্রিলার কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু মুচকি হেসে আলতো করে ঐন্দ্রিলার মুখটি উচু করে, তারপর নিজের গাল এগিয়ে আলতো করে ঐন্দ্রিলার গালের সাথে ঘষতে থাকে অভ্র। ঐন্দ্রিলা আগেই খেয়াল করেছিলো অভ্রের দু গাল ভর্তি হলুদ। তার মানে সে রুমে আসার আগে মুখে হলুদ মেখে এসেছে যাতে হলুদ ক্যারি করা না লাগে। কিন্তু এমন কিছু করবে সেটা কল্পনার বাহিরে ছিলো ঐন্দ্রিলার। আবেশে চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে গেলো তার। মূহুর্তের মধ্যে যেনো সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিলো ঐন্দ্রিলার। নিঃশ্বাস যেনো বন্ধ হয়ে আসছিলো। অভ্রের স্পর্শ শরীরে যেনো বিদ্যুৎ শকের মতো লাগছিলো। অভ্র ধীরে একে একে ঐন্দ্রিলার দু গালে হলুদ লাগিয়ে দিয়েছে। ধীরে ধীরে তার গলায় নেমে এসেছে অভ্র। একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে সে। আর অভ্রের গরম নিঃশ্বাস যেনো পুড়িয়ে দিচ্ছে ঐন্দ্রিলার সারা শরীর। হালকা ঠোটের উষ্ণ ছোঁয়া দিয়ে ঐন্দ্রিলাকে ছেড়ে দেয় অভ্র। নয়তো নিজেকে সামলানো বড় কঠিন হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি ঘুরে বলে,
– বাকিটুকু পরসুর জন্য রেখে দিলাম।
বলেই এক মিনিট অপেক্ষা না করে সেখান থেকে চলে যায় অভ্র। ঐন্দ্রিলা এখনো চোখ বন্ধ করে রয়েছে। অজান্তেই চোখ থেক দু ফোটা পানি বেরিয়ে যায়। তার কারণ বোধ হয়ে ঐন্দ্রিলা নিজেও জানে না। লোকটা এমন কেনো? কি করে কেনো করে ঐন্দ্রিলার বোধের বাহিরে। শুধু এটুকু জানে কেনো যেনো চাইলেও রাগ বা ঘৃণা করতে পারছে না এই লোকটার উপর। চাইলেই তখন তাকে বাধা দিতে পারতো কেনো যে দিতে পারলো না নিজেও জানে না।
অভ্র ব্যালকনি থেকে এসেছিলো। ঠিক একই ভাবে ব্যালকনি দিয়েই চলে গেছে। ঐন্দ্রিলা গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ায়। লোকটা চলে যাচ্ছে, তার গাড়ি যতক্ষণ দেখা গেছে ঐন্দ্রিলা তাকিয়ে ছিলো। যখন দৃষ্টির বাহিরে চলে গেলো গাড়িটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। ঐন্দ্রিলাকে নিজের রং এ রাঙিয়ে অভ্র চলে গেছে। একটা অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে ঐন্দ্রিলার কিন্তু প্রশ্ন করেও সেটার কারণ বের করতে পারছে না সে! তবে কি নিজের অজান্তেই ঐ বিরক্তকর, অহংকারী লোকটার প্রতি মনের একটা কোনায় জায়গা তৈরি হয়েছে? হয়তো……হয়তো___
রাত ১১টা,
এতো কাজের মধ্যে পিউ এর খাওয়া এখনো হয় নি। নিজের রক্তের কেউ না হলেও ঐন্দ্রিলা তার জন্য বোনের থেকে কোনো অংশে কম নয়, আর অভ্রকে ও নিজের বড় ভাইয়ের মতো দেখে সে। তাই তাদের বিয়েতে নিজের যতটুকু পেরেছে তার থেকেও বেশি করার চেষ্টা করেছে। সবার খেয়াল রাখতে যেয়ে নিজের খাওয়া টুকু হয়ে উঠে নি তার। আজকাল তার মন অনেক ভালো থাকে, শারমিন বেগমের সাথে তার সম্পর্কটা ভালো করার চেষ্টায় অনেকটুকু এগিয়ে গিয়েছে সে। আজ শারমিন বেগম নিজ থেকেই তাকে এই বাড়িতে থেকে যেতে বলেছেন।
কিছুদিন আগে,
শারমিন বেগমের সামনে মুখোমুখি বসে রয়েছে পিউ। শারমিন বেগমের মুখে কোনো কথা নেই। সামনে একটা শাড়ি, এইটা অভ্রের বিয়েতে ঐন্দ্রিলা পড়বে বলে শারমিন বেগম কিনে এনেছেন। শাড়িটা হালকা গোলাপি কাতান শাড়ি। শাড়িটা পিউকে দিলে পিউ সোজা বাংলায় মানা করে দেয়। শারমিন বেগম ভ্রু কুচকে তাকে কারণ জিজ্ঞেস করলে পিউ ধীর গলায় বলে,
– আপনি ই বলেছিলেন মা বিধবা মানুষ আমি, এতো জমকালো শাড়ি কি আমার গায়ে মানাবে?
পিউ এর কথা শুনে কোনো কথা বলতে পাড়ছেন না শারমিন বেগম। ঠিকই তো এতোদিন তিনিই পিউ এর সাজসজ্জা দেখে মেজাজ ঝারাপ করতেন। যদিও পিউ সাজসজ্জা করতো না, কালো অথবা সাদা জামা পড়তো তবুও নিজেকে সধবা বলে দাবি করতো সে। যা একেবারেই মানতে পারতেন না শারমিন বেগম। আর নিজের ছেলের জন্য একবার কাঁদতে না দেখে তার খুব জিদ লাগতো। পিউ আহাশের মৃত্যুর পর একবার ও কাঁদে নি যা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। কিন্তু আজ যখন পিউ সরাসরি তাকে এ কথা বলেছে তার কোথাও না কোথাও খারাপ লাগছে। পিউ মুচকি হাসি দিয়ে খুব নরম গলায় বলে,
– মা, আমি যখন এবাড়িতে আসি এবাড়ির সবাইকে আপন করে নেবার সব চেষ্টা করেছি। তবে আমার সম্পর্কটা কিন্তু আহাশের সাথেই জড়িত। কিন্তু তার সাথে আমি একদিন ও সংসার করতে পারে নি। তবুও আমি এ বাড়িতে আড়াই বছর থেকেছি, আপনাদের প্রত্যেককে নিজের পরিবার মনে করেছি। কারণ আমি একটা পরিবার চেয়েছিলাম। আচ্ছা মা, আমার দোষটা কোথায় বলুন তো? আহাশ তার কাজের জন্য বেরিয়ে গিয়েছিলো! তার মৃত্যু সেখানে লেখা ছিলো। এখানে আমার দোষটা কোথায় বলুন? আজ আল্লাহ না করুক আহানার সাথেও যদি এমন হতো আপনি একই কথা বলতেন? তাকেও কি অলক্ষ্মী বলতেন?
-…………
– মা, জন্ম কিংবা মৃত্যুর উপর কারোর হাত নেই। সেটা উপর ওয়ালা ঠিক করে দেন। লক্ষ্মী বা অলক্ষ্মী ব্যাপারগুলো সব মানুষের বানোয়াট। এটা আপনার মতো শিক্ষিত একজন নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবেন। যাক তবুও যেহেতু আপনার কাছে এসব জিনিস ই বেশি জরুরি তাহলে আমার কিছু বলার নেই মা। আমি আসছি, বেশি কিছু বলে ফেলতে ক্ষমা করবেন। আর আমি এই জমকালো শাড়ি পড়বো না
বলে সেখান থেকে চলে যায় পিউ। পিউ এর প্রতিটা কথা শারমিন বেগমকে ভাবাতে বাধ্য করে। যার ফলস্বরুপ পরদিন তিনি নিজেই পিউ এর রুমে যেয়ে শাড়িটা দিয়ে আসেন। হলুদেও বেশ সুন্দর করে সেজেছে পিউ। এবং শারমিন বেগম তার প্রশংসা ও করেছে। পিউ এর ভালো লাগছে যে শারমিন বেগম তার চিন্তাধারা বদলাচ্ছেন এবং পিউ কে কাছে ডেকে নিচ্ছেন। এসব ভেবে নিজের রুমের দিকেই যাচ্ছিলো পিউ হঠাৎ তার হাতে হ্যাচকা টান দেয় কেউ। তাল সামলাতে না পেরে মানুষটার বুকের উপর পড়ে যায় পিউ। মাথা তুলে দেখে তার সামনে নীলাদ্রি দাঁড়ানো। কিছু বলার আগেই হাত টেনে ছাদের দিকে রওনা দিলো নীলাদ্রি। রাত অনেক হয়েছে বাড়ির সবাই ক্লান্ত হয়ে যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। দিন দিন এই নীলাদ্রি নামক লোকটা রহস্যময় হয়ে উঠছে। হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় যখন নাপারগ তখন হাল ছেড়ে পিছু পিচু ছাদেই গেলো পিউ। ছাদে আসামাত্র হাত ছেড়ে দিলো নীলাদ্রি।
– আরে কি হয়েছে বলবেন তো? এই রাতে এখানে কেনো নিয়ে এসেছেন আপনি?
কোনো কথা না বলে একটা চেয়ার টেনে পিউ এর কাধ ধরে বসিয়ে দিলো সে। পিউ বারবার জিজ্ঞেস করছে কিন্তু কোনো উত্তর নেই নীলাদ্রির। এবার বিরক্ত লাগছে পিউ এর। হঠাৎ খেয়াল করলো একটা প্লেট এনে সামনে চেয়ার টেনে বসলো নীলাদ্রি। কড়া কন্ঠে বললো,
– হা করো, কোনো অজুহাত শুনতে চাই না।
নীলাদ্রির ধমকে চুপসে যাবার জোগাড় পিউ এর। এই প্রথম বেশ ধমকের সুরে কথা বলছে নীলাদ্রি। পিউ ও বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ নীলাদ্রি হাতে পুরো খাবারটা খেলো। পিউ এর অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। মা মারা যাবার পর কেউ এতো যত্নে খাওয়ায়ে দিয়েছে কিনা সন্দেহ। অজান্তেই চোখে পানি চলে আসে পিউ এর। ইশ সময়টা যদি থেমে যেতো।
– তুমি চাইলে সারাজীবন এভাবেই খাওয়িয়ে দিতে রাজী
হঠাৎ নীলাদ্রির এরুপ কথায়………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি