#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#১৮তম_পর্ব
আজ হলুদের দিন একটা মারাত্নক কাজ করবে অভ্র। ভেবেই রেখেছে অনেক আগ থেকে এতে যদি ঐন্দ্রিলা রাগ করে তাহলে সেটাতেও রাজী সে। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই দেখলো ঐন্দ্রিলা ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে স্টেজের দিকে। ঐন্দ্রিলার সব কাজিনরা মাথার উপর ওড়না দিয়ে ছাওনি করে নিয়ে আসছে তাকে। অভ্র এক দৃষ্টিতে ঐন্দ্রিলার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, মেয়েটাকে যত দেখে তত ভালো লাগে তার। শাড়িটা অভ্রের পছন্দ ছিলো, কিন্তু ঐন্দ্রিলাকে শাড়িটিতে কল্পনা থেকেও সুন্দর লাগছে। ঐন্দ্রিলা ধীর পায়ে স্টেজে উঠে অভ্রের পাশে বসে। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। বাড়ির সব বড়রা একে একে দুজনকেই হলুদ লাগাচ্ছে। সবার এক কথা দুজনের জুটি নাকি বেশ মানিয়েছে। শরীফুল সাহেব হলুদ লাগাতে এসে কেঁদেই দিলেন। যত হোক তার একমাত্র মেয়ে, তাও বেশ আদুরে। আর দু দিন পর অন্যের ঘরে চলে যাবে সে। ছোট বেলায় যখন ঐন্দ্রিলা ঘর বাড়ি খেলার ছলে বউ সাজতো তখন কখনো ভাবেন নি তিনি একটা সময় আসলেই তাকে অন্যের ঘরে বউ হয়ে যেতে হবে। এই মেয়েটাই একটা বয়সে পুতুলের বিয়ে দিবে বায়না করতো। বাবার কাছে মেয়েরা বুঝি এই ক্ষুদ্র সময়ের জন্যই থাকে! একটা সময় তাদের বাবার বুক ফাঁকা করে অন্যের ঘরে যেতেই হয়। শরীফুল সাহেব কাঁদছেন সাথে ঐন্দ্রিলাও। মা না থাকলেও বাবা তাকে একই সাথে মা এবং বাবা হয়ে সামলেছে। একটা সময় অভ্রের হাত ধরে শরীফুল সাহেব বলেন,
– আমার মেয়েটাকে তোমার ভরসায় দিলাম বাবা, ওকে কষ্ট পেতে দিও না। খুব চাঁপা স্বভাবের মেয়ে আমার। নিজের খারাপ লাগাগুলো খুব সহজে আড়াল করে ফেলে। এতোদিন আমি আগলে রেখেছি, এবার তোমার দায়িত্ব বাবা
– আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, আমি ওকে কষ্ট পেতে দিবো না।
অভ্রের দৃঢ় কন্ঠের প্রতিশ্রুতিতে শরীফুল সাহেব অনেকটা শান্ত হন। তার বুকে বিশ্বাস জন্মায় যে তার মেয়ে বিয়ের পর সুখে থাকবে। যতই হোক মেয়ের বাবা সে, একটা চিন্তা থেকেই যায়। তবে অভ্রের কথায় তিনি অনেকটাই আশ্বস্ত হন। শরীফুল সাহেব স্টেজ থেকে নেমে গেলে, একটা টিস্যু ঐন্দ্রিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে কানের কাছে মুখ এনে অভ্র বলে,
– চোখটা মুছে নাও, এতো কাঁদার কি আছে আজ তো তোমার বিদায় না। কেবল হলুদ। এখনই মরা কান্না দিলে বিয়ের দিন কি করবা? কাজল লেপ্টে পেত্নীর মতো লাগছে।
অভ্রের কথায় ঐন্দ্রিলার যাও একটু কান্না পাচ্ছিলো তাও বন্ধ হয়ে গেলো। লোকটা এমন বিরক্তকর কেনো! একটু সমবেদনা তো দিতে পারে তাই না! ঐন্দ্রিলাও কম নয়, কড়া কিন্তু ধীর কন্ঠে জানিয়ে দিলো তাকে,
– এই পেত্নীর সাথেই সারাটা জীবন থাকতে হবে। খাল কেটে কুমির আনা কাকে বলে সেটা আর দুদিন পর বুঝবেন।
– তাহলে স্বীকার করছো তুমি পেত্নী?
– ভুতকে বিয়ে করলে তো পেত্নী হতেই হবে
– ঝগরাটে স্বভাবটা গেলো না তোমার?
– আমিতো আপনার সাথে ঝগড়া করছি না, আপনি পায়ে পা বাধিয়ে আমাকে উস্কাচ্ছেন
অভ্র কোনো কথা বলতে যাবার আগেই আসমা বেগম এবং বদরুল সাহেব স্টেজে উঠলেন হলুদ লাগানোর জন্য। বাধ্য হয়ে মুখে হাসির রেখা টেনে চুপ হয়ে যেতে হলো তাকে। এতো জোরে সাউন্ড বক্সে গান চলছে তাই তাদের ঝগড়া কারোর বুঝার বাইরে। কেউ বলবে না এরা দুজন এতোক্ষণ দিব্বি ঝগড়া করে যাচ্ছিলো। একের পর এক মানুষ তাদের হলুদ লাগিয়ে নেমে যাচ্ছে। আর ফাঁকতালে অভ্র জেনে বুঝে ঐন্দ্রিলাকে জ্বালাচ্ছে। ঐন্দ্রিলা ও ছেড়ে দেবার পাত্রী না, সব কথার উপযুক্ত জবাব তাকে শুনিয়ে যাচ্ছে।
রাত ৯টা,
হলুদের অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে, পিউ খাওয়া দাওয়ার দিকটা সামলাচ্ছে। হঠাৎ চোখে পড়লো, নীলাদ্রি দিব্বি আহানার সাথে হেসে হেসে কথা বলে যাচ্ছে। নীলাদ্রি কিছু একটা বলছে এবং আহানা হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। স্বীকার না করলেও কোথাও মনটা খচখচ করছে পিউ এর। আহানা এমনেই সারাদিন নীলাদ্রি নীলাদ্রি করতে থাকে। নীলাদ্রিকে একবার ছলে বলে বলেও ছিলো পিউ যাতে আহানাকে বেশি পাত্তা না দেয়। মেয়েটার বয়স এখন উঠতি, বলা তো যায় না। আর নীলাদ্রির সাথে ওর বয়সের একটা ডিফারেন্স তো আছেই। গান এতো জোরে বাজছে যে কি কথা হচ্ছে সেটা বুঝার উপায় নেই। হঠাৎ আসমা বেগমের ডাক পড়ায় নীলাদ্রির থেকে চোখ সরিয়ে কাজে যেতে হলো পিউ এর। মনে কওথাও না কোথাও খচখচানিটা রয়েই গেলো।
অভ্র এবং ঐন্দ্রিলার হলুদের স্টেজ ঐন্দ্রিলাদের ছাদে করা হয়েছে। আর নিচে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা, মোট ৩০০ জনের আয়োজন দুপক্ষ মিলে। অনেকেই খেতে বসে পড়েছেন। উপরে এখনো হলুদ দেয়া চলছে। অভ্রের সব কাজিন এবং ঐন্দ্রিলার সব কাজিনরা মিলে পরিবেশন করছে। যেহেতু অভ্র এবং ঐন্দ্রিলা কেউ ই খায় নি তাই পিউ তাদের জন্য খাবার নিয়ে যেতে এসেছে। শাড়ি পড়ে এই দৌড়াদৌড়ির কাজ করাটা হালকা কষ্টকর। দু হাতে দুই প্লেট ধরে সিড়ি দিয়ে ধীর পায়ে উঠতে লাগলো পিউ। অমনি শাড়ির কুচিতে পা বিধিয়ে পড়ে যেতে নিলেই এক জোড়া হাত তাকে সামলে নেয়। যাক প্লেট পড়ে নি বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পু। লোকটা তার পেছনে তার কোমর আকড়ে ধরেছে। লোকটার গায়ের গন্ধটা খুব পরিচিত পিউ এর, বুঝতে বাকি নেই লোকটা আর কেউ নয় নীলাদ্রি। সময় নষ্ট না করে পিউ এর হাত থেকে প্লেট জোড়া নিয়ে কড়া কন্ঠে বললো,
– আচ্ছা দিশার বিয়েতেও একই ভাবেই তুমি পড়তে গেছিলে, তখনও আমি তোমাকে সামলেছিলাম। এখনো তাই, আচ্ছা আমি আশেপাশে থাকলেই তোমার পরার শখ হয়?
– আমি এখানে? আহানার সাথে গল্প শেষ?
– প্রশ্নের উত্তর প্রশ্নে দিবে না খবরদার।
– আমার বয়েই গেছে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে। দিন প্লেট গুলো আমি উপরে যাবো।
– ধন্যবাদ দেওয়াটা তোমার দ্বারা কখনোই হবে না তাই না?
– ধন্য করেছেন আমাকে বাঁচিয়ে। আফটার অল মেয়েদের সাথে গল্প করা ছেড়ে এসেছেন কিনা। এবার পথটা কি ছাড়া যায়?
– আচ্ছা তুমি কি সামহাও জেলাস ফিল করছো?
– এই সাইন্সের লজিক কি?
– এই যে যখনই আমি আহানার সাথে কথা বলি তুমি কি রাগ করো তাতে?
– শুনুন আপনি কার সাথে কথা বলুন না বলুন তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। আমি আহানাকে নিয়ে চিন্তিত। মেয়েটা অনেক ছোট আপনার
– সত্যি তো?
– একদম
– দেখা যাক
বলেই প্লেট দুটো নিয়েই নীলাদ্রি উপরের দিকে হাটা দিলো। পিউ এর খুব রাগ লাগছে, সে কেনো জেলাস ফিল করবে এটার লজিক খুজে পাচ্ছে না পিউ আর নীলাদ্রি কি ইঙ্গিত করলো। উফফ এই লোকটাকে মাঝে মাঝে ভালো লাগলেও অধিকাংশ সময়ই তার বিরক্তের কারণ হয়। নিজেকে কোনোমতে শান্ত করে ছাদের দিকে ছুটলো সে।
২০.
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ, নিজের রুমে এসে জামা কাপড় বদলে নিলো ঐন্দ্রিলা। আজ অভ্র তাকে প্রচুর জ্বালিয়েছে। বাড়ির লোক না থাকলে হলুদের বাটিটা মাথায় ই ভাঙ্গতো তার। ঐন্দ্রিলার রুমে সে বাদে কেউ থাকে না, তাই একটু রক্ষা। এখন আরামে ঘুমিয়ে পড়তে পারবে। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বাহিরে আসতেই দেখলো রুম পুরো অন্ধকার। খানিকটা ঘাবড়ে গেলো ঐন্দ্রিলা। কারণ ইলেক্ট্রিসিটি যায় নি, বাথরুমের লাইট জ্বলছে। ধীর পায়ে এগিয়ে সুইচে হাত দিতে যাবে তখন…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি