#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#১৭তম_পর্ব
পিউ মাথা নিচু করে বসে থাকলে নীলাদ্রি তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
– কোথায় যাবো আমরা?
পিউ প্রশ্নের উত্তরস্বরুপ শুধু ঠোঁটে বাকা হাসি টেনে হাটা শুরু করলো। নীলাদ্রির এমন আচরণে পিউ যে শুধু অবাক হলো তাই নয় বেশ চিন্তায় ও পড়ে গেলো। এতো কাজ বাকি আর এই লোক কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাও বলছে না। নীলাদ্রি তখন কাউকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে তাদের আসতে দেরি হবে। পিউ এর হাত ধরে দোকান থেকে বেড়িয়ে গেলো সে। পিউ বারবার জিজ্ঞেস করছে কোথায় যাচ্ছে অথচ তার মুখে উত্তর নেই। পিউ আর কথা বললো না, একে ক্ষুধা উপর থেকে নীলাদ্রি যেনো মুখে তালা ঝুলিয়েছে অহেতুক শক্তি নষ্ট করে লাভ নেই। নীলাদ্রি পিউকে গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। কোথায় যাচ্ছে কিছুই বলছে না। হঠাৎ করে ব্রেক কষায় পিউ খেয়াল করলো নীলাদ্রি সুলতান ডাইনস এর সামনে গাড়ি থামিয়েছে। অবাক চোখে তাকাতেই উত্তর দিলো নীলাদ্রি,
– নামো, ক্ষুধা লেগেছে। দেড় টা বাজে লাঞ্চ করে সব কাজ করবো। চলো
পিউ এর বুঝতে বাকি নেই লোকটা তাকে খাওয়াতে নিয়ে এসেছে। আচ্ছা এতে এতো লুকোচুরির কি আছে! বললেই তো হতো। না লোকটার সব কিছুতেই একটু হিরো হিরো ভাব নিতে হবে।
সুলতান ডাইনস এর একটা টেবিলে মুখোমুখি বসে রয়েছে পিউ এবং নীলাদ্রি। তেলযুক্ত খাবার পছন্দ না হওয়া সত্ত্বেও নীলাদ্রির মুখ বুঝে খেতে হচ্ছে। কারণ পিউ এর বিরিয়ানি খুব বেশি পছন্দ, মেয়েটার এক চিলতে হাসির জন্য দুনিয়ার সাথে লড়ে যেতে পারে নীলাদ্রি এটুকু বিরিয়ানি তো কোনো ব্যাপার ই না। মেয়েটাকে সে যে এখন থেকে ভালোবাসে না। দীর্ঘ এগারো বছরের সুপ্ত প্রেম। কখনো বলার সুযোগ হয়ে উঠে নি। অতীতের দিনগুলো হয়তো চাইলেও ফেরাতে পারবে না নীলাদ্রি। তখন ভেবেছিলো এতো বাচ্চা একটা মেয়েকে কি ভালোবাসার কথা বলা যায়, আগে নিজের পায়ে দাঁড়েবে তারপর না হয় তাকে বিয়ে করেই নিজের করে নিবে সে। কে জানতো ভাগ্যের তো অন্য রকম কিছু পরিকল্পনা ছিলো। তার ভালোবাসা অন্যের ঘরের বধু হয়ে গেলো, আর নীলাদ্রির ও প্রেম নিবেদন করে হলো না। পিউ একদিন বলেছিলো,
– যেদিন আপনি কাউকে ভালোবাসবেন সেদিন নাহয় আমাকে জ্ঞানগুলো দিবেন। সেদিনও যদি মনে হয় আমার কাজগুলো পাগলামি তবে আপনি যা বলবেন আমি তাই শুনবো।
ঠিক বলেছিলো সে, ভালোবাসলে সঠিক ভুল এর জ্ঞান থাকে না। নীলাদ্রি এগারোটা বছর ধরে পিউকেই ভালোবেসে এসেছে, এখনো সে পিউকেই ভালোবাসে। পিউ যদি তাকে একটিবার সুযোগ দেয় তবে সে পিউকে তার ভালোবাসার আসিয়ানায় আগলে রাখবে। কিন্তু সেটা আদৌ হবে কি না সেটার নিশ্চয়তা নেই। নীলাদ্রির মনের কথা পিউ এর সামনে রাখতে ভয় হয়, যদি পিউ তাকে ভুল বোঝে। যদি ভাবে নীলাদ্রি তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতেই আর বলা হয়ে উঠে না নীলাদ্রির। বিরিয়ানি নিয়ে শুধু নাড়াচাড়া করছে নীলাদ্রি, এটা দেখে পিউ তাকে জিজ্ঞেস করে,
– আপনার নাকি খুব ক্ষুধা লেগেছে, খাচ্ছেন না যে।
– না কিছু না। ভাবছিলাম
– কি ভাবছিলেন?
– তেমন জরুরি কিছু না। তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো?
– হুম করেন
– কেউ যদি তোমাকে এখন ভালোবাসার প্রস্তাব দেয়, তার নিজের মনের কথা তোমায় বলে তুমি কি করবে?
– …………
– যদি তোমার অতীতকে জানার পর ও তোমাকে ভালোবেসে আপন করে নিতে চায় তুমি কি তাকে সুযোগ দিবে?
– হঠাৎ এই প্রশ্ন?
– কৌতুহল বলতে পারো
– জানি না, ভালোবাসতে ভয় হয়! আর সত্যি বলতে আহাশের প্রতি আমার ভালো লাগা বলুন কিংবা ইনফ্যাচুয়েশন কিংবা ভালোবাসা যাই বলুন না কেনো সেটা এখনো রয়ে গেছে। কাউকে এখনো ভালোবাসবো কিংবা আমার জীবনটাকে সাজাবো এটা নিয়ে এখনো চিন্তা করি নি। তার প্রতি আমার অনুভূতিগুলো ছিলো কিশোরী মনের প্রথম ভালোবাসা। আমি সত্যি জানি না। আহাশের জায়গাটা খালি হয়ে আছে। এতোদিন আমার কল্পনাতে সে ছিলো, এখন নেই। ভবিষ্যৎ এর কথা কে বলতে পারেন বলুন।
পিউ এর কথায় নীলাদ্রি কিছুই বললো না। তার এখন অনেক কাজ, পিউ এর মনের ফাঁকা জায়গাটুকু ভরতে যে প্রচুর সময় লাগবে। তবে এবার একটা শেষ চেষ্টা করবে সে, হয় এস্পার নউ ওস্পার। হাল ছাড়বে না।
সন্ধ্যা ৭টা,
মোটামুটি কাজ সব শেষ। এখন কিছু আত্নীয়ের বাড়ি যাওয়া বাকি রয়েছে সেটা কাল তারা যাবে। পিউকে খুব ক্লান্ত লাগছে। আজ বেশ গরম ও পড়েছে। চুলগুলো হাফ পাঞ্চ করা ছিলো, পিউ চুলগুলো নিয়ে খোপা করে রাখলো। খোপায় নাকি মেয়েদের অনেক সুন্দর লাগে নীলাদ্রি সেটা হাতে নাতে প্রমাণ পেলো। তার কাছে এই ক্লান্ত পিউ যেনো পৃথিবীর সব থেকে সুন্দরী মহিলা। গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়েছে পিউ। এখন ই বোধ হয় ঘুমিয়ে যাবে। রাস্তার জ্যাম ছাড়ার নাম নেই। নীলাদ্রি স্টেরিং হুইলের উপর হাত ভাজ করে মুখ ঠেকিয়ে এক দৃষ্টিতে পিউকেই দেখে যাচ্ছে নীলাদ্রি। হঠাৎ ধীর গলায় বললো,
– তোমাকে পিউ ডাকার অধিকার কি আমি পেয়েছি মোবাশশিরা?
নীলাদ্রির এমন অদ্ভুত প্রশ্নে বেশ তব্দা খেয়ে যায় পিউ। অবাক দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকাতেই খেই হারিয়ে ফেলে সে। এ চোখ জোড়া যে বেশ ভয়ংকর, এ চোখে যে শুধু আছে মায়া, অনেক মায়া আর রয়েছে নেশা। যা যে কাউকে গ্রাস করতে যথেষ্ট। পিউ এর মুখে কোনো কথা নেই। এত কঠিন কোনো প্রশ্ন নয় তবুও উত্তর দিতে পারছে না সে।
১৯.
আজ হলুদ ঐন্দ্রিলা এবং অভ্রের। ঐন্দ্রিলাকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। কাঁচা হলুদ পাড়, সাদা জমিনের উপর কলাপাতা রঙ্গের সুতোর কাজের সুতি শাড়ি তার পরণে, গলায়, কানে ফুলের গহনা। হালকা সাজে মেয়েটাকে এতো স্নিগ্ধ লাগছে যা বলার বাহিরে। আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে একবার দেখে নিলো সে। এতোদিন অনেক কেঁদেছে, যেহেতু বিয়েটা ফাইনালি হচ্ছেই সুতরাং এখন এতো ভেবে লাভ নেই। অভ্র চৌধুরীর সাথে সংসার করতে সে প্রস্তুত। সাথে অভ্রকে শায়েস্তা করতেও। এখন তার হারানোর কিছুই নেই। ঠোটে হাসির রেখা টেনে চললো ঐন্দ্রিলা স্টেজের দিকে চললো ঐন্দ্রিলা।
স্টেজে আগ থেকেই অভ্র বসা। কাঁচা হলুদ পাঞ্জাবী আর সাদা কোটি সাথে চুড়িদার পায়জামা পড়া। পাঞ্জাবীর হাতা কনুই অবধি উঠানো, হাতে কালো ঘড়িটা বেশ মানিয়েছে তাকে। চুলগুলো বেশ স্টাইল করে রেখেছে। বেশ সুদর্শন লাগছে তাকে। অপেক্ষায় বসে রয়েছে তার বউ এর। যে অভ্র বিয়ে করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলো সে আজ একটা মেয়েকে দুবার বিয়ে করছে। তবে একটাই আফসোস এখনো ঐন্দ্রিলাকে মনের কথা বলা হয় নি। সে পরিকল্পনা করে রেখেছে বিয়ের রাতে ঐন্দ্রিলাকে ভালোবাসার প্রকাশ করবে। ঐন্দ্রিলা যদি নাও করে কি যায় আসে! একটা সময় না সময় তাকে ভালোবাসতেই হবে। হ্যা অভ্র চৌধুরী ঐন্দ্রিলাকে ভালোবাসে, খুব ভালোবাসে। এতোদিন শুধু মেয়েটার সাথে খুনসুটি করতে ভালো লাগতো, কিন্তু ধীরে ধীরে মেয়েটাকে ভালোলাগতে শুরু করলো, তারপর ভালোবাসার সূচনা। মাঝে মাঝে ভাবতেও অবাক লাগে অভ্রের। এতো অপরুপ সুন্দরী মেয়েকে ছেড়ে এই সাধারণ মেয়েটাকেই তার মনে ধরলো। এখনো আসে নি ঐন্দ্রিলা, অপেক্ষার প্রহর গুনতে ভালো লাগছে না। আজ হলুদের দিন একটা মারাত্নক কাজ করবে অভ্র। ভেবেই রেখেছে অনেক আগ থেকে এতে যদি ঐন্দ্রিলা রাগ করে তাহলে সেটাতেও রাজী সে। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি