#শ্রাবণ_মেঘের_ভেলা
#১৬তম_পর্ব
ঐন্দ্রিলার কোনো মতামত ই নেই এই ব্যাপারে। বসার দরকার বসে আছে সে। হঠাৎ বেশ কটা শাড়ি তার সামনে রেখে শারমিন বেগম বললেন,
– দেখো ঐন্দ্রি মা তোমার কোনটা ভালো লাগে। এই প্রতিটা শাড়ী আমার পছন্দ হয়েছে।
শাড়িগুলো বেশ জমকালো, ভারী। ঐন্দ্রিলার এতো ভারী শাড়ি বরাবরের মতোই পছন্দ নয়। তবুও কিছুই করার নেই, ঠোটে হাসি টেনে জ্বী বলে উঠতে গেলে অভ্র বলে,
– ছোট মা, এর মধ্যে একটি শাড়িও আমার পছন্দ হয় নি। অভ্র চৌধুরীর বউ পরবে, সে হিসেবে এগুলো কোনোটাই স্টান্ডার্ড নয়। অহেতুক ভারী এবং জমাকালো।
– কিন্তু অভ্র বিয়েতে তো সবাই এমন পোশাক ই পড়ে।
– সবাই পড়ে তাই ঐন্দ্রিকে পড়তে হবে এমন তো কোনো কথা নেই।
অভ্রের কাটকাট উত্তরে শারমিন বেগম আর কথা বাড়ালেন না, অভ্রের স্বভাব তার খুব ভালো করেই জানা আছে। পিউ এবং আহানা ও চুপ। অভ্র যেহেতু বলে দিয়েছে তার মানে সে ঐন্দ্রিলাকে এগুলো একটাও বিয়েতে পড়তে দিবে না। ঐন্দ্রিলার কখনোই বাড়াবাড়ি পছন্দ হয় না, একটা বিয়ে যার কোনো ভিত্তি নেই সেই বিয়েতে সে কি পরলো না পরলো তাতে আদৌ ও কি কিছু যায় আসে! কিন্তু অভ্র চৌধুরীর লোক দেখানো স্বভাবের জন্য এটা করতে হবে। সারা দোকান তন্ন তন্ন করে একটা শাড়ি অভ্রের পছন্দ হলো শেষমেশ। অবাক করা ব্যাপার এটাই এই শাড়িটা ঐন্দ্রিলার ও বেশ ভালো লেগেছে। ওফ ওয়াইট মসলিনের জমিনে গোল্ডেন কাজ, পাড়টা টকটকে লাল। না বেশী জমকালো না বেশি ভারী। পিউ এবং আহানা ঐন্দ্রিলাকে খোঁচাখুচি করছে, আসলেই অভ্রের পছন্দ আছে বলতে হবে। অভ্র শাড়িটা ঐন্দ্রিলার হাতে দিয়ে বলে,
– যাও পড়ে আসো
ঐন্দ্রিলা ও বাধ্য মেয়ের মতো শাড়িটা পড়ে আসে। ড্রেসিং রুম থেকে যখন ঐন্দ্রিলা বের হয় অভ্রের দৃষ্টি যেনো সরানো দায় হয়ে উঠেছিলো। এতো অপরুপ লাগছিলো তার ঐন্দ্রিলাকে যে সে হয়তো ভাষায় প্রকাশ করা যাচ্ছিলো না। ঐন্দ্রিলার চাপা রংটা ও শাড়ির সৌন্দর্যের নিচে ঢাকা পড়ছিলো না, বরং আরোও সুন্দর লাগছিলো। অভ্রের কাছে লাগছিলো তার সামনে কোনো প্রতিমা দাঁড়ানো। পিউ অভ্রের সাথে মজার ছলে বলে,
– ভাইয়া আপনার পছন্দ আছে বলতে হবে, কি ইউনিক একটা শাড়ি চুজ করলেন
– আমার বউটি তো ইউনিক, সুতরাং তার ক্ষেত্রে সব কিছুই ইউনিক ই হবে।
ঐন্দ্রিলার কেনো যেনো অভ্রের দৃষ্টিতে বেশ লজ্জা লাগছিলো। অভ্রের সুনিপুণ দৃষ্টি তার হৃদয়ে বিদ্ধ হচ্ছিলো। অভ্রের দৃষ্টিতে ছিলো শুধু একরাশ মায়া, ভালোলাগা। যা ঐন্দ্রিলাকে বেশ অস্বস্তিতে ফেললে সক্ষম। সবার দৃষ্টির অগোচরে অভ্র তার কাছে এসে কানের কাছে মুখ এনে বলে,
– তোমায় লজ্জা পেলে আরোও বেশি সুন্দর লাগে।
বলেই চোখ টিপ্পনী দেয় অভ্র। অভ্রের কথা শুনে ঐন্দ্রিলার গাল আরো বেশি লাল, বেগুনী হতে থাকে। আচ্ছা লোকটা কি সকালে উঠে ভুল কোনো ঔষধ খেয়েছে নাকি মাথায় চোট পেয়েছে। এতোটা মিষ্টি আচরণ তার দ্বারাও সম্ভব এটা ভেবেই কুল কিনারা খুজে পাচ্ছে না ঐন্দ্রৎলা। নাকি এটাও লোকদেখানো। পরমূহুর্তে খেয়াল করলো পিউ এবং আহানা হাসাহাসি করছে। ঐন্দ্রিলার বুঝতে বাকি নেই অভ্রের ভালো ব্যবহারের রহস্য। মানুষের সামনে নিছক লোক দেখানো ভালোবাসা এটা। ব্যাপারটা ভাবতেই ঐন্দ্রিলকার বুকের বা পাশে চিনচিন ব্যাথা অনুভূত হলো, সে তো অভ্রের কাছ থেকে কিছুই এক্সপেক্ট করে না তবে এতো কেনো নিরাশ হচ্ছে সে। অভ্র আর তাকে তো লোক দেখানো সম্পর্কই সবার সামনে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে তবে কেনো এতোটা খারাপ লাগছে। তবে কি তার মনে কোথাও না কোথাও এই বিয়েটা জায়গা করে নিচ্ছে! না এটা হলে তো চলবে না। তাকে দূর্বল হলে চলবে না। অভ্র তাকে কখনোই ভালোবাসবে না, সুতরাং অভ্রের প্রতি দূর্বল হলে তাকেই ভবিষ্যৎ এ তাকেই কষ্ট সহ্য করতে হবে।
বিকেল ৪.৩০,
সারাদিনের শপিং এর পর একটা গাড়িতে করে শারমিন বেগম, পিউ এবং আহানা “মেঘের ভেলা” তে ফেরৎ গেলেন। পিউ দু একদিন ওখানে থেকে নীলাদ্রিদের বাড়ি যাবে। তাই অভ্রকেই ঐন্দ্রিলাকে বাড়ি পৌছে দিতে হবে। গাড়ি যেহেতু শারমিন বেগমরা নিয়ে গেছেন তাই পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করেই ঐন্দ্রিলা এবং অভ্রকে যেতে হবে। রাস্তার ধার দিয়ে পাশাপাশি হেটে যাচ্ছে ঐন্দ্রিলা এবং অভ্র। সময়টা পড়ন্ত বিকে্ বাতাস ছেড়েছে হয়তো বৃষ্টি হবে। ঐন্দ্রিলার পরণে একটা নীল সালোয়ার কামিজ, চুলগুলো হাফ পাঞ্চ করা, খোলা চুলগুলো বেশ অবাধ্য হয়ে উড়ছে। অভ্রের খুব ইচ্ছে করছে সাধারণ কাপলের মতো ঐন্দ্রিলার হাতটা ধরে হাটতে। কিন্তু কোথাও একটা বাধা কাজ করছে। হাতটা ঐন্দ্রিলার হাতের কাছে নিতে যেয়েও পারছে না। মেয়েটার সাথে তো কম কিছু করে নি সে, কোথায় যেনো একটা বাঁধা থেকেই যায়।
হাটতে হাটতে সিগন্যালের কাছে এসে পড়েছে। সিগন্যাল পাড় হয়ে ওপাশে যেতে হবে, তারপর রিক্সায় উঠতে হবে। ঐন্দ্রিলা আপন মনে হাটছিলো, তার আশেপাশের গাড়ির দিকে লক্ষ নেই। মন শুধু অবান্তর চিন্তায় মশগুল। হঠাৎ দেখলো তার হাত টেনে অভ্র নিজের কাছে নিয়ে আসলো। অবাক চোখে তকাতেই অভ্র কড়া কন্ঠে বললো,
– মন কোথায় তোমার, আরেকটু হলেই তো গাড়ির নিচে পড়তে।
অভ্র শক্ত করে তার হাতটা নিজের মুষ্টিবদ্ধ করলো। দেখে দেখে রাস্তা পাড় হলো তারা। এরপরেও হাতছাড়ার নাম নেই। হাত ধরেই হাটছে, এখানে তো কেউ নেই। এখন কাকে দেখাচ্ছে সে? রিক্সায় উঠেও যখন শক্ত হাতে কোমর ধরে আগলে রাখলো অভ্র ঐন্দ্রিলা অভিমানী সুরে বলেই বসলো,
– এখানে কেউ নেই, এখানে আমাদের অভিনয় না করলেও হবে
– আমি নিজের বউকে আগলে রাখবো এতে অভিনয়ের কি আছে সেটাই তো বুঝছি না।
অভ্রের কাটকাট উত্তরে হতবাক হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় পাচ্ছে না ঐন্দ্রিলা। এই বিয়েটার তো মানেই নেই তার কাছে তবে একথাটা কেনো বললো সে। অভ্র কি তবে ঐন্দ্রিলাকে নিজের স্ত্রীর সম্মান দিবে! নাকি নিছক মরীচিকা এটা! ঐন্দ্রিলার নজর অভ্রের দিকে, লোকটা রহস্যের মায়াপুরী। একটা রহস্য ভেদ করলেই আরেকটা সামনে আসে। এ লোকের মন বোঝা হয়তো ঐন্দ্রিলার পক্ষে সম্ভব নয়।
১৮.
নীলাদ্রি এবং পিউ পাশাপাশি বসে রয়েছে, হলুদের দায়িত্ব পড়েছে দুজনের ঘাড়ে। অভ্র এবং ঐন্দ্রিলার হলুদের অনুষ্ঠান একই সাথে হবে। যেকারণে দুজন দুবাড়ির পক্ষ থেকে হলুদের সব যোগাড় একই সাথে করছে। ফুলের দোকানের এসেছে তারা। হলুদের জন্য সাজাতে ফুলের কথা বলতে আসা। ফুল বিক্রেতা রমিজ সাহেব তাদের বসিয়ে রেখেছে আধ ঘন্টা যাবৎ। এখানের কাজ সেরে কার্ডের দোকানে যেতে হবে। তারপর বিয়ের ভেন্যুতে, সেখানে জোগাড়যন্ত্র দেখে বাড়ি ফিরবে তারা। পিউ এর অধৈর্য লাগছে, একে সকাল থেকে না খেয়েই এই কাজে লেগেছে। এখনো প্রচুর কাজ বাকি। মানুষের বাড়িতে নিমন্ত্রণ এ যেতে হবে। উফফফ রমিজ ভাইয়ের সময় জ্ঞান নেই। নীলাদ্রি খেয়াল করে দেখলো পিউ থেকে থেকে লাফালাফি করছে। না পেরে বলেই বসলো,
– পেটে ক্রিমি হয়েছে লাফাচ্ছো কেনো?
– ক্ষুধা লেগেছে
করুণ চোখে নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে কথা বললে আর কোনো কথা বলার থাকে না নীলাদ্রির। পিউ মাথা নিচু করে বসে থাকলে নীলাদ্রি তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
– কোথায় যাবো আমরা?
পিউ প্রশ্নের উত্তরস্বরুপ……
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি