শ্রাবণ মেঘের ভেলা সূচনা পর্ব

0
3495

#শ্রাবণ মেঘের ভেলা
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

০১.
বিয়ের প্রথম রাতে বিধবা হওয়া এই ঘটনাটা হয়তো কারো কারো কাছে সমবেদনাপূর্ণ তো কারো কারো আছে অবিশ্বাস্য তো আবার কারো কারো কাছে খুব হাস্যকর একটা ঘটনা। কিন্তু যার সাথে এইরুপ ঘটনা ঘটে তার জন্য ঘটনাটা কেবলমাত্র বিষাদময়। বছর কেটে গেলেও অতীতের কালো রেশ রয়েই যাবে। যেমনটা পিউ এর ক্ষেত্রে ঘটেছে। কোনো এক ঝলমলে দিনে সেও লাল বেনারসি পড়েছিলো, সেও নববধু সেজেছিলো। তার মনেও অনেক আশা ছিলো, অনেক স্বপ্ন তার আঁখিজোড়াতেও সেজেছিলো। কিন্তু ঝলমলে দিন শেষে কালরাত আসে সেটা হয়তো তার জানা ছিলো না।

১২ডিসেম্বর, ২০১৭
নববধুর ন্যায় সাজানো “মেঘের ভেলা” বাসাটি। সাজানো হবে নাই বা কেনো বাসার ছোট ছেলের আহাশ চৌধুরী বিয়ে ভলে কথা। শারমিন আক্তার কেবল তার বউ মাকে বরণ করে নিলেন। লাল বেনারসী পরা নববধু রুপে সজ্জিত মেয়েটি পা রাখলো “মেঘের ভেলা” তে। মেয়েটির নাম মোবাশশিরা জাহান। ভালোবেসে সবাই পিউ নামে ডাকে। পিউ এর বরণের পর আহানা অর্থাৎ তার ননদ তাকে আহাশ এবং তার রুমে নিয়ে যায়। রুমটি বেশ সুন্দর এবং পরিপাটি। রুমের এক পাশের দেয়ালে আহাশের মেডেল নেবার ছবিটা টাঙ্গানো, তার পাশে বিশাল আলমারি, অন্য পাশে একটা বুক সেলফ, তারপাশেই একটা সেলফ যেটা শুধু আহাশের মেডেল, ক্রেস দ্বারা ভর্তি; রুমের মিডল বরাবর বেড যা গোলাপ এবং জার্বেরার সমন্বয়ে সুন্দর করে সাজানো। রুমের দক্ষিণ পাশে একটি বিশাল বারান্দা আছে। আহানা পিউকে গোলাপের পাঁপড়ি বিছানো বিছানাতে বসিয়ে চলে যায়। পিউ এর জন্যে মূহুর্তগুলোর অনুভূতিটা অনেকটা এলোমেলো; ভয়, আনন্দ আবার উত্তেজনাময় একটা অনুভূতি। এখন অপেক্ষা কাঙ্ক্ষিত মানুষটির, যার সাথে কেবল দু কি তিনবার কথাবলার ভাগ্য হয়েছিলো পিউ এর। তথাকথিত অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছে তার। আহাশ চৌধুরী পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চে কর্মরত একজন অফিসার। পাঁচ ফুট ১০ ইঞ্চির সুঠাম দেহী পুরুষকে প্রথম দেখাতে মনে ধরেছিলো পিউ এর। দেখাদেখির দু সপ্তাহের মাঝেই বিয়ে হয় তাদের। মনের মাঝে হাজারো প্রশ্ন, কৌতুহল, ভালোলাগার অনুভূতি নিয়ে বিছানায় বসে আছে সে। দরজা খোলার আওয়াজে খানিকটা চমকে উঠে পিউ। মানুষটা ধীরে ধীরে তার কাছে এসে যখন পাশে বসলো উত্তেজনা আর ভয়ে অনেকটা শিটিয়ে যায় পিউ। পিউ কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে দেখে ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে আহাশ বলে,
– ভয় পেও না, আমি কোনো বাঘ বা ভাল্লুক নই। তোমার অনুমতি থাকলে হাতটা ধরতে পারি?

আহাশের কথায় হা করে কিছুক্ষণ নিজের বরের দিকে তাকিয়ে ছিলো পিউ। কোনো পুরুষ এতো সুন্দর করে কথাও বলতে পারে জানা ছিলো না পিউ এর। লজ্জায় লাল হয়ে যখন তাকে হাত ধরার অনুমতি দেয় ঠিক তখন ই আহাশের ফোন বেজে উঠে। ফোন দিয়ে আহাশ বারান্দায় চলে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পর বারান্দা থেকে এসে ধীর গলায় বলে,
– আমাকে এখনই একটু বের হতে হবে। আজ রাতটা তোমার এবং আমার জন্য খুব ইমপোর্টেন্ট তাও আমার যে দায়িত্বের শেষ নেই। তুমি অপেক্ষা করো প্লিজ

পিউ তখনও কিছুই বলে না শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। এটাই আহাশের সাথে তার শেষ কথা ছিলো। আহাশ শেরোয়ানি চেঞ্জ করে শার্ট, প্যান্ট পড়ে বেড়িয়ে যায়। সারারাত পিউ লাল বেনারসিতেই আহাশের জন্য অপেক্ষা করে।

সকাল ৮টা,
বাইরের শোরগোলে পিউ এর ঘুম ভাঙ্গে। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলে দেখে আহাশ এখনো আসে নি। খানিকটা অভিমান ও জমে মনে। বিয়ের রাতে যতই কাজ থাকুক নববধুকে একা রেখে কে চলে যায়! পরনের বেনারসী ছেড়ে একটা গোলাপী শাড়ি পড়ে নেয় সে। যতই হোক নতুন বউ যে, সকাল সকাল রুমে পরে পরে ঘুমানোটা হয়তো ভালো দেখায় না। তার তো জানা ছিলো না তার জন্য একটা বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিলো। বাহিরে যেয়ে দেখলো বসার ঘরে সবাই মুখ ঘোমড়া করে বসে রয়েছে। শারমিন বেগম এক পাশে বসে প্রচুর কাঁদছেন, আহানা তাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। শওকত চৌধুরী পাথরের মতো এক জায়গায় বসে রয়েছে। হচ্ছেটা কি এখনো তার বোধোগম্যের বাহিরে। কেনো জানে মনটা বড্ড কু ডাকছিলো, পা জমে গিয়েছিলো পিউ এর। আচ্ছা আহাশ ঠিক আছে তো। নিজের মনের বিরুদ্ধে আহানার কাছে হাটে যায় সে। আহানাকে জিজ্ঞেস করলে সে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– ভাবী, ভাই আর নেই। ওরা জানালো ভাই এর গাড়ি নাকি কাল রাতে এক্সিডেন্ট করেছে এবং সাথে সাথে জ্বলে গেছে। ওরা বাবাকে লাশ শনাক্ত করতে মেডিক্যালে যেতে বলেছে।

আহানার কথার কি উত্তর দিবে জানা ছিলো না পিউ এর। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে সে। মনে হচ্ছিলো স্বপ্ন দেখছে, খুব বাজে একটা স্বপ্ন। ঘুম ভাঙলেই স্বপ্নটা ভেঙে যাবে এবং আহাশকে পাশে দেখবে সে। শওকত সাহেব লাশ সনাক্ত করে এগারোটার দিকে নিয়ে আসেন। লাশ যদিও চেনা যাচ্ছিলো না কিন্তু পরণের পোশাক এবং জিনিসগুলো সব আহাশের ই। পিউ যেনো কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না যে মানুষটা তার কাল অবধি তার সামনে ছিলো অথচ আজ সে দুনিয়াতেই নেই। তার ধারণা আহাশ বেঁচে আছে এবং সে অপেক্ষা করবে।

দিন যেতে থাকে, কিন্তু তার ফেরার নাম নেই। আহশের মৃত্যুর আড়াই বছরের বেশি হতে চলেছে, পিউ এর জীবন এবং সময়ের গতি কোনোটাই আটকে থাকে নি। ছিলো। অনেকেই পিউকে অলক্ষী নাম দিতে থাকে। কারণ আহাশের সাথে বিয়ের রাতেই আহাশ মারা যায়। অনেকেই আবার পিউকে বাস্তবতার সাথে পরিচিত করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শারমিন বেগম পিউকে কেনো জানে ভালো চোখে দেখতে আর পারছেন না। তার ধারণা সে রাতে পিউ পারলেই তার ছেলেকে আটকাতে পারতো। সবাই নিজেদের দুঃখ প্রকাশ করে যাচ্ছে অথচ পিউ ওর মনের অবস্থা কেউ একটি বার বুঝার চেষ্টাও করে নি। পিউ মাটি কামড়ে শ্বশুরবাড়িতেই পড়ে রয়েছে। শারমিন বেগম তাকে দুচোখে দেখতে পারেন না। অথচ কিছু করার নেই, সে তো এই বাড়ির বউ। বাড়ির বউ এর কোনো দায়িত্ব অপূর্ণ রাখে নি সে। সাথে একটা এনজিও তে চাকরি করে যাচ্ছে। শওকত সাহেব তাকে বাধা দেন নি। পিউও স্বাভাবিক জীবনের অভিনয়ে মেতে উঠেছে। সবার সামনে ওর থেকে স্বাভাবিক মানুষ যেনো আর কেউ নয়। কিন্তু সবার আড়ালে এখনো রাতে লাল বেনারসী পড়ে অপেক্ষারত থাকে হয়তো আহাশ ফিরে আসবে, সেদিন হবে তাদের ফুলসজ্জা।

গাড়ির হর্ণে অতীতের কালো চ্যাপ্টার থেকে বের হয় পিউ। খুব বাজে ভাবে হর্ণ বাজাচ্ছে আশেপাশের গাড়িগুলো। সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে অনেকক্ষন হয়েছে কিন্তু পিউ অতীতের ভাবনায় এতোটাই ডুবে রয়েছে যে ভুলেই গিয়েছে তার গাড়ি রাস্তা ব্লক করে রেখেছে। গাড়ির কাঁচে কেউ একজন সমানে নক করে যাচ্ছে। পিউ তাড়াতাড়ি গ্লাস নামাতেই একজন কালো শার্ট পরিহিত মধ্যবয়সী পুরুষ সানগ্লাস নামিয়ে কড়া কন্ঠে বলে,
– গাড়ি চালানোর সময় যদি অন্যমনস্ক হয়ে থাকেন দেখা যাবে গন্তব্যটা বাড়ির দিকে না হয়ে সরাসরি উপরে হবে। আপনার সময়ের দাম না থাকতে পারে অন্যদের আছে, পনেরো মিনিট ধরে সমানে হর্ণ বাজাচ্ছি আপনার তো হুশ ই নেই। এখন হা করে না থেকে প্লিজ মুভ

পিউ কোনো উত্তর দিতে পারলো না, দোষটা তো তারই। লোকটাকে দেখে খুব ব্যস্ত মনে হচ্ছিলো। পিউ কথা না বাড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। গন্তব্যস্থান “মেঘের ভেলা”

০২.
রেস্টুরেন্টের টেবিলে বসে চেকের পাতায় সাইন করে নিশির দিকে এগিয়ে দিলো অভ্র চৌধুরী। নিশি অভ্রের ছয় নম্বর গার্লফ্রেন্ড। অভ্র চৌধুরী, শওকত চৌধুরীর বড় ছেলে। তিন বছর হয়েছে দেশে ফিরেছে সে। আহাশের মৃত্যুর পর থেকেই “মেঘের ভেলা” তে তার বসবাস। অভ্র নিজে অনেক বড় ব্যবসায়ী, দেশে বিদেশে তার ব্যবসা ছড়িয়ে আছে। গার্লফ্রেন্ডের লিষ্ট তার বিশাল। পোশাকের মতো গার্লফ্রেন্ড বদলায় সে। কোনো নারী যদি স্বেচ্ছায় তার সাথে শারীরিক সম্পর্কে যেতে চায় তাতে তার কোনো আপত্তি নেই। যখন বিরক্ত লাগা শুরু করে নিজ থেকেই ব্রেকআপ করে ফেলে সে। যেমনটা এখন নিশির সাথে করবে। মেয়েটা বড্ড গায়ে পড়া স্বভাবের সাথে তার জীবন কন্ট্রোল করারও ইচ্ছা পোষন করছে যা অভ্রের মোটেই পছন্দ নয়। চেকটি এগিয়ে দিতে দিতে শান্ত গলায় অভ্র বলে,
– চেকটা ধরো, ইচ্ছে মত এমাউন্ট বসিয়ে নিও।
– হঠাৎ চেক?

অবাক হয়ে প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করতেই মুচকি হেসে অভ্র জানায়,
– আমার তোমাকে আর ভালো লাগছে না। কাল বলেছিলাম, তুমি বুঝো নি। তাই তোমাকে সামনাসামনি বলতে বাধ্য হচ্ছি আমার তোমাকে ভালো লাগছে না। চেকটা ধরো ব্রেকাপ ফি। এমনি ও আমি তোমার জন্য তোমার খরচ বহনের একটা মাধ্যম ছিলাম। প্লিজ রাখো।

বলেই উঠে চলে যেতে নিলেই নিশি অভ্রের হাত ধরে কান্নাকাটি করতে লাগলে অভ্র খানিকটা চেতে যায়। কড়া কন্ঠে বলে,
– বলছি তো হাতটা ছাড়ো। শুনছো না কেনো?
– এভাবে আমার সাথে ব্রেকাপ করতে পারো না তুমি।
– প্লিজ সিন ক্রিয়েট করো না নিশি। তোমার সাথে আমি কখনোই কমিটমেন্টে ছিলাম না। আমাদের রিলেশনটা টাইমপাস ছিলো। আর তাতে তোমার ও সমান সম্মতি ছিলো। প্লিজ হাত ছাড়ো।

নিশির হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে একটা নারী কন্ঠ ভেসে আছে,
– আপনার টাকা আছে বিধায় আপনি কি নিজেকে কোথার রাজা মহারাজা ভাবেন নাকি? প্রথমে মন নিয়ে খেলবেন তারপর টাকা ধরিয়ে সেই মনটাকেই গুড়োগুড়ো করে চলে যাবেন? এতো সোজা?

একেই গা রাগে রি রি করছে উপর থেকে কথাটা শুনতেই মেজাজ আরো বিগড়ে গেলো অভ্রের। পেছনে ফিরতেই দেখে………………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে