শ্রাবণ ঝরা মেঘ পর্ব-৩১

0
607

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [৩১]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

মৌরি ওয়াশরুমে ছিল। ওর ফোনে টুং করে মেসেজ আসার শব্দ হলে কৌতূহলী থেকে ফাইজা ফোন হাতে নিলো। রাত সাড়ে এগারোটায় আপুকে কে মেসেজ দিবে! মৌরির ফোনে কোন লক দেওয়া থাকে না। আর থাকলেও সেটা বাড়ির সব বাচ্চাদের জানা থাকে। আরিয়ান মৌরিকে মেসেজ করেছে দেখে ফাইজা তাড়াতাড়ি করে মেসেজ সিন করলো।

-দেখি তো আমার বোনের সাথে কী এত কথা!

~তুমি বাইরে না এলে তোমার জঙ্গলি বর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নিজেকে শেষ করে দিবে। দুই ঘন্টা ধরে তোমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে তোমাদেরকে ফাঁসানোর জন্য জঙ্গলিটা এসব নাটক করছে। তুমি কিন্তু বাইরে এসো না।

মেসেজটা পড়ে ফাইজা চুপ মেরে বসে রইল। কী হারামি মানুষ! নিজের ভাইয়ের দুঃখের দিনেও ষড়যন্ত্র করছে! তাশফিনের উপর ফাইজারও রাগ ছিল। লোকটাকে দেখতেই পারতো না। কিন্তু এখন বেচারার উপর দয়া হয়। আপু একটু বেশিই কঠিন হয়ে গেছে। মানুষ ভুল করলে ক্ষমা করতে হয়। মৌরি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ফাইজার হাতে তার ফোন দেখে বলল,

-তুইও কি বাচ্চা হয়ে গেছিস? নাকি তোরা আমার মোবাইলটাকে সরকারি পেয়েছিস?

ফাইজা হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে এসে মৌরিকে ধরে টেনে ব্যালকনিতে নিয়ে যেতে লাগলো। ওর হঠাৎ এমন পাগলামিতে মৌরি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-আরে পাগল, কী করছিস? কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে?

-ব্যালকনিতে।

-বৃষ্টির সময় ব্যালকনিতে যাব কেন? ভিজে যাব তো।

-আহ আপু! এত কথা বোলো না তো।

এদিকে বৃষ্টিতে ভিজে শীতে তাশফিনের দাঁতে দাঁতে বারি লাগছে। জ্বর এসেই পড়েছে মনে হয়। আরিয়ান দিব্যি আরাম করে গাড়িতে বসে আছে। তাশফিনও বুঝতে পারছে আরিয়ান তাকে বাগে পেয়ে মজা নিচ্ছে। ব্যাপার না। দিন তারও আসবে।

ব্যালকনিতে এসে নিচের দিকে চোখ পড়তেই তাশফিনকে দেখা গেল। ফাইজার চোখ সবার আগে পড়েছে। বেচারা ভেজা কাক হয়ে গেছে। বৃষ্টির ছাঁট গায়ে লেগে মৌরি ভিজে যাচ্ছে। সে ফাইজাকে শাসন করে বলল,

-তোর যতসব পাগলামি। শুধু শুধু ব্যালকনিতে নিয়ে এলি কেন?

-শুধু শুধু না আপু। একবার নিচের দিকে তাকাও।

মৌরি ফাইজার কথামতো ওদিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। এটা কি তাশফিন? পাগল লোক বৃষ্টির মধ্যে এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন? তাশফিনও কাঁপতে কাঁপতে দোতলায় তাকালে মৌরিকে দেখতে পেলো। এবার কি মৌরির মন৷ গলবে? ফাইজা বলল,

-আপু উনি কিন্তু দুই ঘন্টা ধরে এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।

মৌরি প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে ফাইজার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-তুই কীভাবে জানিস?

-আরিয়ান তোমার ফোনে মেসেজ করেছে। আমি সেটা দেখেছি। এভাবে বেশি সময় বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকলে উনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

-আমি কি বলে দিয়েছি বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকতে? নিজের ইচ্ছেতে থাকছে।

-তুমি কিছু করবে না? এত পাষাণ কবে থেকে হলে?

-তুই এত দরদী কবে থেকে হয়েছিস? তোর তো লোকটাকে পছন্দ না।

-পছন্দ না তা বলে আমি কারো খারাপ চাই না। তুমি উনাকে বুঝিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বলো।

-আমি কেন বলবো? আমার এত কিসের দায়?

ফাইজা অবিশ্বাস্য চোখে বোনকে দেখছে। তার এই বোন রাস্তার একটা কুকুর বেড়ালকেও কষ্ট পেতে দেখতে পারতো না। আজ একটা মানুষের প্রতিও মায়া আসছে না। কতটা পাল্টে গেছে! ফাইজা তাশফিনের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলল,

-এইযে শুনছেন৷ দুলাভাই, আপনি বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বাড়ি চলে যান প্লিজ।

ফাইজার মুখে দুলাভাই ডাক শুনে তাশফিনের নীলচে হয়ে যাওয়া ঠোঁটে হাসি ফুটলো। কাঁপা কন্ঠে জবাব দিল।

-উপায় নেই। তোমার বোন আমাকে কষ্ট পেতে দেখতে চায়। তাই নিজেকে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করছি।

-আপনিও কি আপুর সাথে পাগল হয়ে গেছেন? আপুর নাহয় মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আপনি তো বোঝমান মানুষ।

ফাইজার গলা শুনে আরিয়ানও গাড়ির ভেতর বসে থাকতে পারলো না। সে-ও বেরিয়ে এলে ফাইজা আরিয়ানাকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। দুই ভাই কি তাহলে মিলে গেছে? আরিয়ান মৌরিকে বলল,

-মৌরি তুমি নিচে না এলে এই পাগল এখান থেকে নড়বে না। তুমি প্লিজ নিচে এসে ওকে যেতে বলো।

-তুমি কেন এখানে এসেছ আরিয়ান? কেউ ইচ্ছে করে পাগলামি করতে চাইলে তাকে আটকানোর ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু তুমি বৃষ্টিতে ভিজো না। বাড়ি ফিরে যাও।

আরিয়ান চাপা গলায় তাশফিনকে ধমক দিয়ে বলল,

-গাধা নাকি তুই? জীবনে মুভি টুভি দেখিস নি? এই সিচুয়েশনে কী করতে হয় জানা নেই? চোখ বন্ধ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়। হিরো জ্ঞান না হারালে হিরোইন ছুটে আসবে না।

আরিয়ান কথা শেষ করার সাথে সাথেই তাশফিন মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। ব্যালকনি থেকে এই দৃশ্য দেখে ফাইজা আত্মচিৎকার দিয়ে উঠলো। মৌরি নিজেকে যতটা কঠিনই দেখাতে চাক না কেন, তাশফিনের কিছু হলে সে নিজেও যে ঠিক থাকতে পারবে না। ফাইজা, মৌরি নিচে আসার আগেই মৌরির বাবা মিজানুর রহমান ছাতা মাথায় বাইরে বেরিয়ে এলেন। তাশফিনের গাড়ি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ানোর পর থেকে তিনি লক্ষ্য রাখছিলেন। আরিয়ান তাশফিনের মাথার কাছে বসে আছে। একজন লোককে বাড়ি থেকে বের হতে দেখে বলল,

-কে যেন আসছে। তোর শ্বশুর কি-না বলতে পারছি না। দম বন্ধ করে পড়ে থাক।

-মৌরি আসেনি?

-কথা বলছিস কেন হারামি? তুই জ্ঞান হারিয়েছিস। ঠিকঠাক মতো নাটকটাও করতে না পারলে আমি আর তোর সঙ্গ দেব না।

মিজানুর রহমান এসে ওদের কাছে দাঁড়ালেন। তাশফিনকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

-এখানে কী করছো তোমরা? ওকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছ না কেন?

আরিয়ান তাশফিনের মাথা কোলের উপর নিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে কাতর গলায় বলল,

-কীভাবে নিয়ে যাব আঙ্কেল? ওর বউ বাপের বাড়ি চলে এসেছে। আমার ভাই এতটাই বউ পাগল যে বউকে ছাড়া বাড়ি ফিরবে না। আপনি কি আশপাশেই থাকেন? এই বাড়ির মানুষ গুলোকে একটু ডেকে দিন না।

এতক্ষণে মৌরি আর ফাইজাও চলে এসেছে। ওদেরকে বৃষ্টির মধ্যে ছুটে বাইরে আসতে দেখে মাহিমও পেছন পেছন চলে এসেছিল। এখানে এসে বাবাকে দেখে মৌরি, মাহিম দু’জনই থেমে গেল। মিজানুর রহমান ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-ওকে ধরে ভেতরে নিয়ে চলো।

-জি বাবা।

আইডিয়া কাজে দিয়েছে। মাহিম আরিয়ানের সাথে তাশফিনকে ধরে কোনরকমে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল। তাশফিন মনে মনে এটুকু স্বস্তি পাচ্ছে, যাক শ্বশুর আব্বার রাগ তাহলে কেটে গেছে। এবার উনার মেয়ের রাগও বেশিদিন স্থায়ী হবে না। মৌরিদের বাড়ির সকলে হলরুমে এসে জড়ো হয়েছে। মৌরির মা চিন্তিত মুখে বললেন,

-কী হয়েছে ওর? ওর জামাকাপড় ভেজা কেন?

মিজানুর রহমান ছেলেকে ইশারা করে বোঝালেন তাশফিনকে মৌরির ঘরে নিয়ে যেতে। মাহিম বলল,

-ওকে আগে ঘরে নিয়ে যাই মা। পরে সব বুঝিয়ে বলবো।

-হ্যাঁ হ্যাঁ নিয়ে যা।

তাশফিনের চোখ পিটপিট করছে। জঙ্গলিটা ভালো করে অজ্ঞানও হতে পারে না। আরিয়ান পা দিয়ে জোরে তাশফিনের পায়ে ঠেলা দিলো। সে তাড়াহুড়ো লাগিয়ে দিয়ে বলল,

-এক্ষুনি ওর ভেজা কাপড় পাল্টে দিতে হবে। জ্বর তো মনে হয় এসেই গেছে। বৃষ্টি না থামলে আমরা ফিরতেও পারবো না।

আরিয়ানও মাহিমের কাপড় পরে চেঞ্জ করে বাইরের বেরিয়ে এসেছে। ফাইজা সুযোগ খুঁজছিল আরিয়ানের সাথে কথা বলার জন্য। ওকে একা পেয়ে গিয়েই চেপে ধরলো।

-তুমি তো বলেছিলে তোমরা সৎভাই। তোমাদের মধ্যে কোন মিল নেই। এখন দেখছি ভাইয়ের জন্য বৃষ্টিতে ভিজছো।

আরিয়ান ফাইজাকে কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল,

-সব তো তোমার জন্যই করছি আমার অবুঝ পাখি। তাশফিন মৌরির সম্পর্ক ভেঙে গেলে তোমার বাবা আমাদের বাড়িতে সম্বন্ধ করতে রাজি হবে?

ফাইজা চোখ পাকিয়ে আরিয়ানকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল,

-অসভ্য হচ্ছ দিনদিন!

-অসভ্যতাও তো সীমার মধ্যে থেকে করতে হচ্ছে। সীমা অতিক্রম করতে পারছি কই?

-আমার মনে হয় আপুর রাগ এবার ভেঙে যাবে। আমার বোন বাইরে থেকেই কঠিন হওয়ার ভান করছে। কিন্তু আমি জানি ওর মনটা তোলার মতো নরম।

-হুম আমিও এটাই দোয়া করছি। মৌরি আমাদের বাড়িতে যাবার পরের দিনই আমি তোমার বাবার কাছে যাব।

মৌরি এর আগে কখনও এরকম পরিস্থিতিতে পড়েনি। মুখে কাউকে ঘৃণা করে বললেই কি মন থেকে মানুষটাকে ঘৃণা করা যায়? তাশফিনকে ওভাবে চোখের সামনে লুটিয়ে পড়তে দেখেই মৌরির হাত-পা কাঁপতে শুরু করে দিয়েছিল। একটা সময় মানুষটাকে ভালোবেসেছিল। হয়তো এখনও বাসে। তাশফিন এখন মৌরির ঘরের বিছানায় শুয়ে আছে। একটু আগেই এঘর থেকে সবাই বেরিয়ে গেছে। মৌরি এখনও শরীরের কম্পন থামাতে পারছে না। এত ভয় সে জীবনে পায়নি। মানুষটা কি পাগল? তাশফিনের এখনও জ্ঞান ফিরছে না ভেবেই মৌরির অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। কাঁপা হাতে তাশফিনের কপাল ছুঁয়ে দেখল জ্বর এসেছে কি-না। কপাল যথেষ্ট গরম।

-এমন পাগলামি কেন করেন? কেন আমার কথা শুনেন না? এসব করতে কে বলেছে আপনাকে?

-তুমিই তো বলেছ।

তাশফিন চোখ বন্ধ রেখেই কথাটা বলে উঠেছে। ও জেগে আছে, সব শুনতে পারছে বুঝতে পেরেই মৌরি সরে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই তাশফিন মৌরির হাত ধরে ফেলে। চোখ খুলে মৌরির দিকে তাকিয়ে বলে,

-আমাকে কষ্ট পেতে দেখে তো তোমার খুশি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমার কেন মনে হচ্ছে তুমি খুশি হওনি। বরং আমার জন্য চিন্তিত হচ্ছ। এই চিন্তার কারণ কী জানতে পারি? তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না। তাহলে আমার কিছু হলেই বা তোমার কী?

-আপনি এতক্ষণ জেগে ছিলেন?

-উঁহু, এটা তো আমার প্রশ্নের উত্তর না।

-আপনার কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।

তাশফিন ককিয়ে উঠে মৌরির হাত ছেড়ে দিয়ে বুক চেপে ধরে বলল,

-আহ!

মৌরি এতেই অস্থির হয়ে পড়ল। রাগ অভিমান ভুলে গিয়ে বলল,

-কী হয়েছে আপনার? বুকে ব্যথা করছে নাকি? বলুন না কী হয়েছে?

-তোমার কথাটা বুকে গিয়ে লাগলো বড্ড। একটা রোগী মানুষের সাথেও কেমন ভাবে কথা বলছো। একটু মিষ্টি করে তো বলতে পারো।

মৌরি ভেবেছিল সিরিয়াস কিছু হয়েছে। কিন্তু এই লোক তার সাথে মজা নিচ্ছে।

-আপনি কোনদিন শোধরাবেন না।

-তুমি আমাকে শুধরে দেওয়ার দায়িত্ব নিলে অবশ্যই আমি শুধরে যাব। শাসনের অভাবে যতটুকু নষ্ট হয়েছি এবার মনে হয় বউয়ের শাসন পেলে ঠিক হয়ে যাব।

ভাইয়ের চিন্তায় পিহুর চোখে ঘুম নেই। রাত তো এখনও কম হয়নি। ভাইয়া এখনও ফিরছে না কেন? কলও ঢুকছে না। কী করছে কে জানে। তারেক চৌধুরী পিহুকে এখনও জেগে থাকতে দেখে বললেন,

-কিরে মা এখনও ঘুমাসনি কেন?

-ভাইয়া এখনও ফিরেনি আঙ্কেল।

-ওর অপেক্ষায় থাকলে পুরো রাতই জেগে থাকতে হবে। তুই গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।

-ভাইয়ার ফোনও লাগছে না। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।

তারেক চৌধুরী ছেলের কাছে এর থেকে বেশিকিছু আশাও করেন না। এই ছেলে কোনদিনই তার কথা শুনেনি। বাড়ির অন্য কারো কথা না ভাবুক অন্তত ছোট বোনটার কথা তো ভাবতে পারে। মেয়েটা শুধু শুধু রাত জেগে ভাইয়ের অপেক্ষায় বসে আছে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে