শ্রাবণ ঝরা মেঘ পর্ব-৩০

0
476

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [৩০]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

আরিয়ানের গাড়ি ঠিক তাশফিনের গাড়ির পাশে থামলো। জানালার কাচ নামালেই ভেতরে বৃষ্টি আসবে। তাশফিন গাড়িতে বসে বসে বোর হচ্ছিল দেখে মিউজিক চালিয়ে নিজেও চোখ বুজে ঠোঁট মেলাচ্ছিল। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলে চোখ খুলে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। কল তুললেই আরিয়ান বিরক্ত গলায় বলল,

-চোখ খুলে আশেপাশে দেখ। বাড়ি ফিরতে চাইলে নেমে আয়।

তাশফিন বুঝলো আরিয়ান চলে এসেছে। সে আরিয়ানকে আরেকটু জ্বালাতে বলল,

-কীভাবে নেমে আসবো? বৃষ্টিতে ভিজবো নাকি! ছাতা আনিসনি?

আরিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলালো। রেগে না গিয়ে বলল,

-ছাতা আনার কথা বলেছিলি?

তাশফিন হতাশ গলায় বলল,

-এই কথাও তোকে বলে দিতে হবে! বৃষ্টি হচ্ছে ছাতা নিয়ে বেরুনোটা কমনসেন্স।

-তোর কমনসেন্স তোর কাছেই রাখ। যেতে চাইলে নেমে আয়। নইলে আমি চলে যাব।

কী আর করার? আরিয়ানকে বেশি খেপিয়ে দিলেও তারই লস। তাশফিন বৃষ্টির মধ্যেই গাড়ি থেকে নেমে এলো। কিন্তু আরিয়ান এবার বদলা নিচ্ছে। তাশফিন এসে তার গাড়ির কাঁচে টোকা দিলেও আরিয়ান দরজা খুলতে সময় নিচ্ছে। এদিকে তাশফিন অর্ধেক ভিজে গেছে। আরিয়ান গাড়ির দরজা খুলে দিলে তাশফিন গাড়িতে বসে সবার আগে একটা কথাই বলল,

-আমার শালিকার টেস্ট এত খারাপ জানা ছিল না।

আরিয়ান রেগে গিয়ে বলল,

-এই কথা কেন বললি?

-তোকে পছন্দ করেছে আর কী বলবো!

-তাহলে তো বলতে হয় তোর বউয়ের টেস্টও খারাপ। তোকে পছন্দ করেছিল! অবশ্য এখন তোকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল শুধরে নিয়েছে। মৌরি বুদ্ধিমতী মেয়ে।

তাশফিন কটমট করে আরিয়ানকে দেখছে। কিন্তু আরিয়ান ওকে পাত্তাই দিচ্ছে না। গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ির পথ ধরলো। তাশফিনের শার্ট ধরতে গেলে পুরোপুরিই ভিজে গেছে। ভেজা কাপড়ে থাকলে ঠান্ডা লাগতে সময় লাগবে না। কিন্তু চেঞ্জ যে করবে সেই উপায়ও নেই।
আরিয়ান তাশফিনকে দেখেও দেখছে না। তাশফিন অলরেডি এক দুইটা হাঁচি দিয়ে ফেলেছে। গাড়িতে দু’জন মানুষ থাকলেও কেউ কারো সাথে একটা কথাও বলছে না। ওদের নিরবতা ভাঙিয়ে দিয়ে আরিয়ানের ফোন বাজলো। তাশফিন লক্ষ্য করলো ফোনে কথা বলতে গিয়ে ওর গলার টোনই পাল্টে গেছে। এত মিষ্টি করে নিশ্চয় ফাইজার সাথে কথা বলছে। ওদের কথা শোনার ইচ্ছে না থাকলেও তাশফিনকে শুনতে হচ্ছে। সে তো আর কান চেপে ধরে রাখতে পারবে না। এরা নিব্বা নিব্বির মতো প্রেম করছে! বিশেষ করে আরিয়ানের কথাগুলো শুনে তাশফিন রীতিমতো অবাক হচ্ছে।

-লাভ ইউ ময়না পাখি। তোমাকে যত শীঘ্রি পারি আমার কাছে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছি। তুমি জানো না সারাটা দিন আমি তোমাকে কত্ত মিস করেছি।

ওপাশ থেকে ফাইজার কথা তাশফিন শুনতে পারলো না। কিন্তু আরিয়ানের হাসি কান পর্যন্ত গিয়ে ঠেকল এটা দেখতে পেলো।

-মিস ইউ টু সোনা।

তাশফিন আর শুনতে পারছে না। এপর্যায়ে কানে হাত চেপে তাশফিন বলে উঠল,

-আস্তাগফিরুল্লাহ! তওবা! নাউজুবিল্লাহ! আমার কান দুটোই অপবিত্র হয়ে গেল। বাবু, সোনা, কলিজা, পাখি টাখি কিছুই বাদ রাখলো না পাপীর দলেরা। এবার কি বড় ভাইয়ের সামনে উম্মা চুম্মাও দেওয়া শুরু করবি! কিছু তো শরম রাখ।

তাশফিনের কন্ঠ শুনেই ফাইজা সাথে সাথে কল কেটে দিয়েছে। কথাও শেষ করতে পারলো না। আরিয়ান রাগী চোখে তাশফিনের দিকে দেখল। তাশফিন এখনও ওভার অ্যাক্টিং করে যাচ্ছে।

-আজকালের ছেলেমেয়ে গুলার লজ্জা শরম বলতে যদি কিছু থাকতো। বিয়ের আগেই এত দূর! বিয়ের পরে বলা বা করার জন্য কিছু বাকি রেখেছিস?

-তোর নাটক দেখার জন্য এখানে কোন দর্শক নেই। তাই ফালতু ওভার অ্যাক্টিং না করে চুপচাপ বসে থাক।

আরিয়ান গাড়ি চালানোতে মন দিয়েছে। তাশফিন মুখ ভোঁতা করে বসে আছে। মৌরিকে মিস করছে। এরা তার সাথে এমন লুতুপুতু প্রেম করলো যে তারও বউয়ের কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু মৌরি তার কল তুলে না। কথা বলার সুযোগ নেই।

-গাড়ি ঘোরা।

সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে আরিয়ান কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

-কী?

-গাড়ি ঘোরাতে বলেছি।

-কেন?

-তোর ভাবীর সাথে দেখা করতে যাব। বউকে মিস করছি। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে আরও প্রেম কর। গাড়ি ঘোরা এখন।

আরিয়ান নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কতক্ষণ তাশফিনকে দেখল। তারপর কিছু না বলেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো। শূন্য রাস্তায় সর্বোচ্চ স্পিড তুলে মৌরিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটলো। তাশফিন ভাবেনি আরিয়ান তার কথা শুনবে।

-বউকে এত মিস করিস তাহলে ওর সাথে সবকিছু ঠিক করে নিচ্ছিস না কেন?

আরিয়ান আজকের আগে কোনদিন ওদের ব্যাপারে কথা বলেনি। এটা ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার ভেবে ছেড়ে দিয়েছে। এই প্রথম তাশফিনের সাথে সরাসরি এই ব্যাপার নিয়ে কোন কথা হচ্ছে। তাশফিনও আজ আরিয়ানের থেকে কিছু লুকিয়ে গেল না। বা কোন ত্যাড়া উত্তরও দিলো না।

-ঠিক করার চেষ্টাতেই লেগে আছি।

-মৌরিকে ছাড়া থাকা কষ্টের হয়ে যাবে এটা জেনেও ওর সাথে ওরকম ব্যবহার না করলেই পারতি।

-তখন তো জানতাম না ও দূরে চলে গেলে এত কষ্ট লাগবে।

-সবকিছুর পরও দোষ তোরই।

-সেটা আমিও অস্বীকার করছি না।

-বিয়ের দিন ওরকম নাটক কেন করেছিলি?

-প্রতিশোধ নিতে।

আরিয়ানের চোখ এবার সামনের পথ থেকে সরে এসে তাশফিনের উপর পড়ল। বিয়ের দিন বিশাল ড্রামা হয়েছিল এটা মম তাকে বলেছিল। কিন্তু এর পেছনের কারণ জানা ছিল না। জানতেও চায়নি। আজ কারণ জিজ্ঞেস না করে থাকা যাচ্ছে না।

-প্রতিশোধ! মৌরির থেকে? কেন?

-মৌরির ভাইয়ের থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার ছিল। একটা ভুল হয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম পিহু মাহিমের জন্য সুইসাইড করতে চেয়েছে।

ভেজা রাস্তায় ক্যাচ করে শব্দ তুলে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। আরিয়ান ঝটকা সামলাতে পারেনি।

-ওয়েট ওয়েট। মাহিম কে? মৌরির ভাই? পিহু ওই ছেলের জন্য সুইসাইড করবে কেন? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।

আরিয়ানের গাধামি দেখে তাশফিন বিরক্ত হচ্ছে। এমনিতেই তো গাধা বলে না। মাথায় গোবরও নেই মনে হয়। এই সহজ হিসেবটা মেলাতে পারছে না।

-কারণ পিহু আর মৌরির ভাইয়ের মাঝে আগে থেকেই একটা সম্পর্ক ছিল। ওরা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করত। কিন্তু মাঝখান দিয়ে ওদের ভালোবাসায় মাহিমের পরিবার তোর প্রেমিকাকে টেনে নিয়ে এলো। মানে মাহিমের সাথে ফাইজার বিয়ে ঠিক করে ফেললো। আমার শালা আস্ত কাপুরুষ পরিবারের বাধ্য সন্তান সাজতে গিয়ে আমার বোনকে ছেড়ে দিলো। পিহুর বান্ধবী ওর অ্যাক্সিডেন্টকে সুইসাইড বলে সন্দেহ করলো। আমার বোন তখন হাসপাতালে। বুকের ভেতর প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে লাগলো। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল যে আমি তখন মৌরিকে বিয়ে করে ওর ভাইকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিলাম। জীবনে এই একটা ভুল কাল হয়ে দাঁড়াল। গল্প এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু না আসল টুইস্ট তো এখান থেকেই শুরু হয়েছে। আমার বউও কারো থেকে কম না। অবলা নারী হয়ে কান্নাকাটি করে বসে থাকলো না। বিয়ের পরের দিনই আমার বাড়িতে চলে এলো। এতগুলো দিন আমার সাথে থেকে থেকে আমার মনে ওর জন্য ভালোবাসা তৈরি করলো। ভালোবাসা অবশ্য আগে থেকেই ছিল। কিন্তু প্রতিশোধের নিচে চাপা পড়ে ছিল। দুই তিনটা মাসে আমাকে এমনভাবে পাল্টে দিলো! শেষমেশ আমাকে ওর ভালোবাসায় পাগল করে নিজের উদ্দেশ্যে সফল হয়ে চলে গেল। এখন তো মানাচ্ছি, এত মানাচ্ছি। তবুও আমাকে মাফ করে ফিরে যেতে রাজি হচ্ছে না।

এক দমে কথা গুলো শেষ করে তাশফিন ছোট বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে বসে রইল। আরিয়ান ওদের কাহিনি জেনে হতবিহ্বল হয়ে বসে আছে। এটা কি কোন মুভির কাহিনি ছিল! নাকি এরা দু’জন জীবনকে মুভি সিনেমা মনে করে কাহিনিকে পেঁচিয়েই যাচ্ছে।

-থাম থাম। কোন মুভির স্ক্রিপ্ট শোনাচ্ছিস নাকি?

তাশফিন জবাব দিল না। সে জানত আরিয়ানের থেকে এরকম রিয়াকশনই আসবে। তাশফিন ডপ দিচ্ছে না বুঝতে পেরে আরিয়ান ফোঁস করে দম ফেলল।

-তোরা স্বামী স্ত্রী দুইটাই তো অস্কার পাওয়ার যোগ্যতা রাখিস। মৌরি যতদিন আমাদের বাড়িতে ছিল ততদিন কি ওর সবটাই অভিনয় ছিল? আমার সাথে এত ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। অথচ আমি একটা বারের জন্যও ওর অভিনয় বুঝতে পারিনি। তোর প্রতি ওর টান মিথ্যে ছিল বলে তো মনে হয় না।

গাড়ি এসে মৌরিদের বাড়ির সামনে থেমেছে। বৃষ্টির বেগ আগের থেকেও প্রবল হয়েছে। গাড়ির কাচ ভেদ করে আরিয়ান বাড়ির দোতলার দিকে তাকিয়ে বলল,

-এখন কী করবি?

আরিয়ানের জিজ্ঞেস করার আগেই তাশফিন মৌরিকে কল দিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু মৌরি কল তুলেনি।

-কিছুই করার নেই। মৌরি কল তুলছ না।

জীবনের প্রথম হয়তো তাশফিনের উপর আরিয়ানের মায়া হলো। সে নিজের ফোন বের করে মৌরিকে টেক্সট করলো।

-তুমি বাইরে না এলে তোমার জঙ্গলি বর
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নিজেকে শেষ করে দিবে। দুই ঘন্টা ধরে তোমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে তোমাদেরকে ফাঁসানোর জন্য জঙ্গলিটা এসব নাটক করছে। তুমি কিন্তু বাইরে এসো না।

মেসেজটা সেন্ড করে আরিয়ান নিজ মনেই হাসলো। তাকে এই ঝড়বৃষ্টির রাতে ব্ল্যাকমেইল করে এনেছে। সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র তো সে নিজেও না।

-গাড়ি থেকে নাম।

আরিয়ানের কথা তাশফিন পাত্তাই দিলো না।

-তোর বাপেরও তো সাধ্য নেই আমাকে এখন গাড়ি থেকে নামানোর।

-আমি মৌরিকে বলেছি তুই দুই ঘন্টা ধরে বৃষ্টিতে ভিজে ওর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছিস। এখন তুই যদি গাড়িতে বসে থাকতে চাস, তাহলে থাক। আমার কোন আপত্তি নেই। মৌরি এসে যখন দেখবে আমি তোর জন্য মিথ্যা বলেছি তাহলে রাগ করবে। করলে করুক। মৌরির রাগ দিয়ে আমার কী?

আরিয়ান কথাও শেষ করতে পারলো না তার আগেই তাশফিন দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। বেচারা মৌরির অপেক্ষায় বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল। এখন মৌরি মেসেজ সিন করে কি-না কে জানে। আর মেসেজ সিন করলেও বাইরে আসবে কি-না তার গ্যারান্টি আরিয়ান দিতে পারবে না। তাশফিন বৃষ্টিতে ভিজছে ভিজতে থাকুক।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে