#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [২৯]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
মাহিম ফাইজার সাথে বিয়ে ভেঙে দেবার পরে রাগ করে রুনা এতদিন ভাইয়ের বাড়িতে আসেনি। অনেক শখ ছিল ভাতিজাকে মেয়ের জামাই করার। ফাইজা মা’কে বুঝিয়েছে,
-মা আমারও তো এই বিয়েতে ইচ্ছে ছিল না। মাহিম ভাইকে আমি কখনও ওভাবে কল্পনা করতে পারিনি। বিষয়টা আমার জন্যই এতটা কঠিন ছিল, তাহলে মাহিম ভাইয়ের জন্য কতটা কঠিন ছিল ভাবো? মাহিম ভাই তো কোনদিন আমাকে মৌরি আপুর থেকে কম ভাবেনি।
রুনা মেয়ের কোন বোঝই মানতে রাজি না। তার একটার কথা।
-ঠিক আছে মানলাম তোরা রাজি ছিলি না। কিন্তু মাহিম এই কথা প্রথমেই বলেনি কেন? শুরুতে বললেই তো আমার মন এভাবে ভাঙত না।
মায়ের ছেলেমানুষী দেখে ফাইজা হাসে। যার বিয়ে ভেঙেছে তার মন ভাঙেনি। কিন্তু তার মা’র মন ভেঙে বসে আছে।
-তোমার ভাইয়েরই তো ছেলে। মাফ করে দাও। একমাত্র ফুপু তুমি।
-আমি একমাত্র ফুপু হলে ওই গরুটাও তো আমার একমাত্র ভাইপো।
-এজন্যই তো বলছি রাগ ঝেড়ে ফেলে মাফ করে দাও। জানো তো ক্ষমা মহৎ গুণ।
-তোকে জ্ঞান দিতে হবে না। আমি সব জানি।
-তাহলে আজ মামাদের বাড়িতে চলো প্লিজ। মৌরি আপু এসেছে। কতদিন আপুকে দেখি না।
”
”
পিহুর সাথে মাহিমের দেখা হচ্ছে না। কথাও হয়না ওদের। পিহু হয়তো এখনও জানে না মাহিম ফাইজাকে বিয়ে করতে না করে দিয়েছে। বাবা মা’কে এই কথাও বলেছে সে বিয়ে করলে নিজের পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করবে। পিহু তার থেকে নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব বজায় রাখছে। মাহিমের এই জিনিসটাই ভালো লাগছে না। আজ সে নিজে থেকেই পিহুকে কল করেছে। এত রাতে মাহিমের কল পেয়ে পিহু কিছুটা বিরক্ত হলো।
-ফিয়ন্সেকে কল দিতে গিয়ে ভুলে কি এখানে কল দিয়ে ফেলেছো?
-তোমার নাম্বার ‘লাইফ লাইন’ এর সাথে একটা লাল হৃদয় দিয়ে সেভ করা। ভুলে কল ঢোকার চান্স নেই।
-আমি এখনও তোমার লাইফ লাইন আছি! আমার নাম্বার ডিলিট করে দাও। তোমার বউ দেখলে ঝামেলা হবে।
-ঝামেলা যেন না হয় সেজন্যই নাম্বার ডিলিট করতে পারব না।
-রাতদুপুরে বাজে বকছো। বাদ দাও। আমার ভাবীকে তোমরা আসতে দিচ্ছ না কেন?
মাহিম অবাক হয়ে বলল,
-আমরা আসতে দিচ্ছি না?
-এমনই তো মনে হচ্ছে। এতদিন হলো বোন বাপের বাড়িতে গেছে। এখনও শ্বশুরবাড়ি আসার নাম নিচ্ছে না।
-তোমার ভাই আমার বোনকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না। এটা তোমার ভাইয়ের ব্যর্থতা।
বাইরে মাহিমকে ডাকছে। ফুপুরা এসেছে। কিন্তু ও ঘরে পিহুর সাথে কথা বলছে। ফাইজা দরজায় টোকা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে বলল,
-ভাইয়া রুমে কী করছো? সবাই তোমাকে ডাকছে। তাড়াতাড়ি এসো।
-হুম, আসছি। যা।
পিহু ওপাশ থেকে মেয়ে কন্ঠ শুনে জিজ্ঞেস করলো।
-তোমাকে ডাকলো মেয়েটা কে?
মাহিম ইচ্ছে করেই বলল,
-ফাইজা।
-ওহ ভালো। তোমরা বিয়ে কবে করছো?
পিহুকে না দেখেও মাহিম বুঝতে পারছে পিহু ফাইজার নাম শুনে কতটা জেলাস ফিল করছে। হাসি আটকিয়ে মাহিম বলল,
-যেদিন পাত্রী বরং তার পরিবার রাজি হবে।
পাত্রীর পরিবার তো রাজিই। তাহলে এই কথা বলার মানে কী? তার সাথে মজা করছে! করবেই তো। বিয়ে করার খুশিতে মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে মনে হয়। পিহু রাগ করে বলল,
-তোমার যা খুশি করো। কিন্তু আমার ভাইয়ের বউকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দিও।
কথা ক’টা বলেই পিহু মাহিমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিয়েছে। কল কেটে যাওয়ার মাহিম ফোনের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল।
-পাগল একটা!
অনেকদিন পর সবাই একসাথে হয়েছে। আগের দিনগুলো যেন ফিরে এসেছে। যখন সবাই একসাথে হলে মজা হতো।
গল্প চলার মাঝেই মৌরির ফোন রিং হচ্ছে। মৌরি স্ক্রিনে তাশফিনের নাম দেখেই কল না তুলে কেটে দিলো। এদিকে তাশফিন মৌরির কন্ঠ শোনার জন্য অস্থির হচ্ছে। মৌরি কল না তুললেও নাছোড়বান্দার মতো তাশফিন কল করেই যাচ্ছে। মাহিম ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল,
-কে কল করছে তুলে দেখ। হয়তো জরুরি কোন দরকার।
-যে কল করছে তার সাথে আমার কোন দরকারি কথা থাকতে পারে না।
বোনের এমন কঠিন রুপ দেখে বেচারা তাশফিনের উপর মাহিমের দয়া হতে লাগলো। তাশফিন যা করেছে তা কোনভাবেই ছোট করে দেখা যায় না। ওর অপরাধ এত সহজে ক্ষমাও করে দেওয়া যায় না। কিন্তু কেউ যদি তার অপরাধ বুঝতে পারে তাহলে কি তাকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত না? ভুল থেকেই তো মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে।
”
”
লায়লা আরিয়ানকে তার বান্ধবীর মেয়ের কথা বললে আরিয়ান সোজাসুজি বলে দিল,
-আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি না। বিয়ে করলে ওই মেয়েকেই করবো।
ছেলের পছন্দের উপর লায়লার কোন সন্দেহ নেই। তার ছেলে কোন হাই ক্লাস মেয়েকেই পছন্দ করেছে হয়তো। তিনি আনন্দিত হয়ে বললেন,
-এটা তো আরও ভালো। মেয়ের বাবা কী করে?
-জানি না। কিছু একটা করে হয়তো।
-আচ্ছা। কী করে তা জানতে হবে না। কিন্তু উনার নাম কী এটা তো জানিস?
-নামও জানি না। মেয়ের বাবাকে দেখে কি আমি উনার মেয়েকে পছন্দ করেছি নাকি?
-কিছুই জানিস না তাহলে বিয়ের প্রস্তাব কীভাবে নিয়ে যাব?
বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে আরিয়ান মায়ের উপর আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলল,
-তুমি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে মম! সত্যি?
লায়লা আলতো করে ছেলের গালে আদরের চাপড় দিয়ে বলল,
-সত্যিই যাব। আমার ছেলের পছন্দ দেখতে হবে না?
-ওহ মম! আমি জানতাম তুমি আমার খুশি ছাড়া আর কিছু চাও না।
-একটাই তো ছেলে আমার। ছেলের খুশি চাইব না তো কার খুশি চাইব? ওই মেয়ের বাসার ঠিকানা জেনে নিস। আমি আর তোর বাবা কাল পরশুই যাব।
আরিয়ান ওভার এক্সাইটেড হয়ে মা’র সামনেই বলে বসল,
-ঠিকানা মৌরিকে জিজ্ঞেস করলেই জেনে নেওয়া যাবে।
কথাটা শুনে লায়লার কপাল কুঁচকে গেল। মৌরিকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে মানে? মৌরি কীভাবে ঠিকানা জানবে? সন্দিহান কন্ঠে লায়লা জিজ্ঞেস করল,
-মৌরি কীভাবে জানবে? ওই মেয়ে কি মৌরির কিছু হয়?
-ফাইজা মৌরির বোন হয় মা। ওর ফুপুর মেয়ে।
ছেলের কথা শুনে লায়লার মাথার উপর পুরো আকাশটাই যেন ভেঙে পড়ল। আরিয়ানকে ভয় পাইয়ে দিয়ে লায়লা আত্ম চিৎকার করে উঠল। আরিয়ান কানে হাত চেপে বলল,
-মম! কী হয়েছে তোমার?
লায়লা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ছেলের দিকে তেড়ে এসে বলল,
-কী বলেছিস আবার বল। কাকে পছন্দ করেছিস তুই?
আরিয়ান কিছুটা তোতলিয়ে বলল,
-ফা-ফাইজা!
-তোর সাহস কী করে হয় আমার সামনে এই কথা বলার? আমার ছেলে হয়ে তুই কীভাবে পঁচা শামুকে পা কেটেছিস? আমি কোনদিন ওই মেয়ের সাথে তোর বিয়ে হতে দিব না। তুই ওই মেয়েকে ভুলে যা। এটাই সবথেকে ভালো হবে। কারণ আমি বেঁচে থাকতে তুই মৌরির বোনকে বিয়ে করতে পারবি না। এক ছোটলোক কি কম পড়েছে? তুই বাড়িতে আরেকটা ছোটলোক আনার কথা ভাবছিস।
মায়ের এমন প্রতিক্রিয়া দেখে আরিয়ান হতভম্ব। একটু আগেই তো বলছিল, আমার ছেলের সুখই আমার কাছে সবকিছু। তাহলে ফাইজার কথা শুনে ছেলের সুখ উড়ে গিয়ে মায়ের জেদ কেন দেখা দিল! লায়লা চলে গেলেও আরিয়ান বলল,
-তুমি যা-ই বলো মম। বিয়ে আমি ফাইজাকেই করবো।
”
”
মাঝপথে হঠাৎ তাশফিনের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। এদিকটায় মানুষজনও তেমন নেই। কারো কাছে যে সাহায্য চাইবে এমনটাও সম্ভব না। প্রচণ্ড বাতাসের সাথে ধুলোবালি উড়ে এসে চোখে মুখে ঢুকছে। আকাশের অবস্থা ভালো না। যেকোনো সময় বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। তাশফিন ড্রাইভারকে কল করে অন্য একটা গাড়ি নিয়ে আসতে বলবে কিন্তু ড্রাইভার ব্যাটাই তো কল তুলছে ন। কে জানে ফোন রেখে গিয়ে কোথায় কী করছে। তাশফিন বিরক্ত হচ্ছে। গাড়ি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকলেও সেই জ্ঞান কাজে লাগানোর উপায় নেই। গ্যারেজে না নিয়ে গেলে এটাকে সারানো যাবে না। এখান থেকে হেঁটে ফিরাও সম্ভব না। বাধ্য হয়ে তাশফিন অপ্রিয় একটা নাম্বারে কল করল। রিং হচ্ছে।
-শালার এই দিনও আমার জীবনে আসতে হলো! শেষমেশ কি-না সাহায্য চাওয়ার আর মানে পেলাম না।
আবহাওয়া খারাপ দেখে আরিয়ান বাড়ি ফিরে এসেছে। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে আটকা পড়লে বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। গাড়ির চাবি আঙুলে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে আরিয়ান ভেতরে ঢুকছে। তখনই ফোন রিং হলে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলে ভ্রু কুঁচকে উঠল।
-জঙ্গলিটা আমাকে কল করছে? সূর্য আজ কোন দিক দিয়ে অস্ত গেছে!
আরিয়ান কল তুললো না। এদিকে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়ায় তাশফিনকে গাড়ির ভেতর এসে বসতে হয়েছে। তাশফিন জানে আরিয়ান সহজে তার কল তুলবে না। দ্বিতীয় বার কল হলে আরিয়ান রিসিভ করে বলল,
-আপনি ভুল সময়, ভুল মানুষকে কল দিয়ে ফেলেছেন। তাই কিছুক্ষণের মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবে।
-আমার তোর সাহায্য লাগবে।
সাহায্য! আরিয়ান কল কাটলো না। টেনে টেনে বলল,
-সাহায্য, হেল্প!
-হুম।
-কিন্তু আমি কেন তোকে সাহায্য করবো?
-তোর নিজের স্বার্থেই করবি।
-আমার স্বার্থ! আমার নিজের স্বার্থ থাকলেও তো তোকে সাহায্য করবো না। কল রাখ।
-ফাইজাকে বিয়ে করতে চাস তো!
আরিয়ানের এই একটাই দুর্বলতা। প্রসঙ্গ যখন ফাইজাকে নিয়ে তখন আরিয়ান শত্রুর সাথে আপোষ করতেও রাজি আছে। এমনিতেই মা তার আর ফাইজার বিয়ের বিরুদ্ধে। তাশফিনকেও ক্ষেপিয়ে লাভ নেই। আরিয়ান বলল,
-কী হেল্প লাগবে বল।
-কোথায় তুই?
-বাড়িতেই। কেন?
চলবে