#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [১১]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
তাশফিন রুমে এসে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে মৌরিকে দেখল। কী এক ঝামেলা! সারাদিন এভাবেই বসে থাকবে নাকি? এই মেয়ের নাটক দেখার সময়, ইচ্ছে কোনটাই তার নেই। কিন্তু সালেহা খালা মেয়েটার জন্য তাকে কথা শোনাচ্ছে। দুই দিনে এসে খালাকে পুরো হাত করে নিয়েছে। তাশফিন কি ওকে না খেয়ে থাকতে বলেছে? তাশফিন রুমে এসেছে দেখেও মৌরি ওর দিকে তাকাচ্ছে না। তাশফিন শব্দ করে হাত থেকে ফোন রেখে মৌরির মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইল। তবুও মেয়েটা তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। এবার তাশফিনের রাগ হলো। সে সরাসরি বলল,
-এই মেয়ে, ওঠো। এবাড়িতে কেউ মারা যায়নি যে তুমি শোক পালন করবে। কান্নাকাটি বন্ধ করে নিচে যাও।”
মৌরি ভেজা চোখে তাশফিনের দিকে তাকাল। একটা মানুষ এতটা নিষ্ঠুর কীভাবে হতে পারে? উনার বুকের ভেতর কি মন নেই?
-কী হলো, কথা কানে যাচ্ছে না?”
-আমি আপনার রুমে থাকায় আপনার কোন সমস্যা হচ্ছে?”
আজকের আগে মৌরি এভাবে কখনও তাশফিনের সাথে কথা বলেনি। তাশফিন কিছুটা অবাক হলেও বুঝতে না দিয়ে বলল,
-অবশ্যই হচ্ছে। জোর করে এবাড়িতে আছো। তোমার কথা লোকে আমাকেই জিজ্ঞেস করবে।”
-কে জিজ্ঞেস করছে আমার কথা?”
-যাদেরকে তুমি তোমার দলে নিয়ে রেখেছ।”
মৌরি কঠিন চোখে তাশফিনকে দেখছে। এই লোকের মতো ত্যাড়া লোক সে জীবনে দেখেনি। চোখের সামনে নিজের বউ কাঁদলেও ইনার ত্যাড়া কথা বন্ধ হয় না। অবশ্য ইনি তো মৌরিকে বউ মানেই না।
-না খেয়ে থাকার পেছনের উদ্দেশ্য জানতে পারি? উদ্দেশ্য অবশ্য বোঝাই যাচ্ছে। না খেয়ে থেকে, কান্নাকাটি করে অসুস্থ হয়ে আমার সিম্পেথি পাওয়ার চেষ্টা করছো। তোমার সুবিধার জন্য বলে রাখি। তুমি অসুস্থ হও বা মারা যাও তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তুমি কি ভেবেছ তোমার এসব নাটক দেখে আমি তোমার প্রতি দূর্বল হয়ে যাব? অসম্ভব।”
এতদিন তাশফিনের সব অপমান মৌরি সহ্য করে নিয়েছে। কোনোকথা বলেনি। কিন্তু আজ কেনই যেন পারল না। একটা মানুষ কাঁদছে দেখেও বলছে সে নাকি নাটক করছে! মৌরি উঠে তাশফিনের সামনে এসে দাঁড়াল। তাশফিন মৌরির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। মৌরি তেজের সাথে বলল,
-আপনার সিম্পেথি পাওয়ার আমার কোন ইচ্ছে নেই। আপনার সিম্পেথি আপনি নিজের কাছেই রাখুন। আসলে আপনার মতো মানুষের থেকে আমার কোনকিছুই পাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। আপনি একটা যা-তা। আপনার মতো মানুষ যে অন্যকে কাঁদিয়ে নিজে হাসে তাকে আমার কিছু বলারও নেই। আমার ভাই আপনার বোনের সাথে অন্যায় করেছে। আপনি কি আমার সাথে খুব ন্যায় করেছেন? আমার ভাই দোষী হলে আপনিও দুধে ধোয়া তুলসীপাতা না। আপনি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমাকে বিয়ে করেছেন, যেখানে আমি এসবের কিছু জানতামই না। আপনি আমার ভাইয়ের থেকে অন্যভাবেও প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু আপনি আমার এবং আমার পরিবারের বিশ্বাস নিয়ে খেলা করেছেন। আপনি আমার ভাইয়ের থেকেও বড় কাপুরুষ। আমি আপনাকে ঘৃণা করি। আপনি আমার চোখের সামনে থেকে যান। আপনাকে দেখে আমার রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি নিজেই মরে যাই।”
তাশফিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে শান্ত মুখে মৌরির কথাগুলো শুনলো। মৌরি কথাগুলো বলে ফেলেও কাঁদছে। মনের রাগ মেটানোর জন্য কথাগুলো বললেও তাশফিনের উপর যেন মৌরির কথার কোন প্রভাব পড়েনি। সে শীতল দৃষ্টিতে মৌরির দিকে তাকিয়ে আছে।
-হয়েছে? মনের ক্ষোভ কিছুটা মিটেছে? তাহলে এবার নিচে গিয়ে খেয়ে নাও।”
মৌরি অবিশ্বাস্য চোখে লোকটাকে দেখছে। এই লোক মানুষ? নাকি অন্য কিছু? এতকিছু শোনার পরেও কেমন সহজ ভাবে কথা বলছে। মৌরি রাগ দেখিয়ে বলল,
-আমার খাওয়া না খাওয়া দিয়ে আপনার কী? একটু আগেই তো বলেছেন, আমি মরে গেলেও আপনার কিছু না। তাহলে আমি না খেয়ে থেকে মরে যাব। আপনি আমাকে কিছু বলতে পারবেন না।”
-হুম। বলতাম না। কিন্তু আমার বাড়িতে মরলে তোমার ভাই ভাববে আমি তোমাকে মেরে ফেলেছি। তোমার পরিবার আমাকে জেলে দেওয়ার চেষ্টায় এতটুকু কমতি রাখবে না। তাই মরার যদি অনেক ইচ্ছে হয় তাহলে নিজের বাড়িতে গিয়ে মরো প্লিজ। এবাড়িতে মরে আমি এবং আমার পরিবারকে পুলিশি ঝামেলায় ফাঁসিয়ে যেও না।”
-আপনি, আপনি একটা… ” মৌরি কথা খুঁজে পেল না। ঠিক কী বলবে এই লোকের গায়ে লাগবে বুঝতে পারছে না। তার সব কথাই যেন লোকটা মজার ছলে নিচ্ছে। মৌরি রাগ করে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। সে খাবে না। এই বাড়ি থেকেও যাবে না। তাশফিন মৌরিকে দেখে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। এই মেয়েকে সে যতটা চিনে তাতে কথায় কাজ হবে না। শুধু শুধু কথা ব্যয় করে লাভ নেই। তাশফিন মৌরির হাত ধরল। মৌরি বিস্মিত চোখে ওর দিকে তাকাল। তাশফিন ওকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
-তোমার রাগ, অভিমান, জেদ কোনটাই আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই। আমার সাথে থাকার সিদ্ধান্তটা তোমার ছিল। তাই যতদিন থাকছো আমার কথাই শুনতে হবে। নিজের মন মর্জি চালাতে পারবে না।”
”
”
আরিয়ান মাহিমকে যেতে দেখেছিল। মাহিমকে দেখেও সে চিনতে পারেনি। তাশফিনের ঘর থেকে বের হয়েছে দেখে ভেবে নিল এটা হয়তো মৌরির কেউ হবে। মৌরিকে আজ সারাদিন দেখা যায়নি। গেল কোথায়? তাশফিনও আজ বাড়িতেই আছে। দু’জনের মধ্যে সবকিছু ঠিক করে গেল নাকি? আরিয়ান মৌরির খুঁজে তাশফিনের ঘরের সামনে থেকে ঘুরে এসেছে। কিন্তু ভেতরে মৌরি আছে বলে মনে হলো না। হাঁটতে হাঁটতে বাগানে এসে আরিয়ান মৌরিকে পেয়ে গেল। সে পা টিপে চুপিচুপি মৌরির পেছনে এসে দাঁড়াল। মৌরিকে ভয় পাইয়ে দিতে জোরে শব্দ করল। মৌরি সত্যিই ভয় পেয়েছে। মৌরিকে ভয় পেতে দেখে আরিয়ান হাসতে হাসতে বলল,
-ভয় পেয়েছ? এত অল্পতে ভয় পেলে কীভাবে হবে?”
আরিয়ান লক্ষ করল কোন কারণে হয়তো মৌরির মন ভালো নেই। কারণ মৌরিকে আজ অন্য দিনের থেকে আলাদা লাগছে। আরিয়ান হাসি থামিয়ে বলল,
-মন খারাপ?”
-না তো।”
-মিথ্যা বলছো তাই না? তোমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তোমার মন খারাপ।”
মৌরি দীর্ঘশ্বাস চেপে মনে মনে বলল,
-আমার মন খারাপের কথা যার জানা উচিত সে-ই অজানা। যার জানার কথা না সে ঠিকই জেনে ফেলেছে।”
-ভাই এসে চলে গিয়েছে তাই মন খারাপ? বাড়ির কথা মনে পড়ছে তাই না?”
মৌরির ভাই এসেছিল আরিয়ান কীভাবে জানলো? মাহিমের সাথে কি তার দেখা হয়েছিল? আরিয়ান কি জানে মাহিম কেন এসেছিল? মৌরিকে অপ্রস্তুত হতে দেখে আরিয়ান বলল,
-আমাকে বলতে পারো। প্রবলেম নেই। আমরা কিন্তু এখন বন্ধু। বন্ধুর কাছে মনের কথা বলাই যায়।”
-না। তেমন কিছু না।”
-আচ্ছা বাদ দাও। তুমি বলতে না চাইলে থাক।”
মৌরি আরিয়ানকে দেখছে। ছেলেটা তার ভাইয়ের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আরিয়ান হাসিখুশি মিশুক। মনে কোন কুটিলতা নেই। কিন্তু তাশফিন? উনার মন জিলাপির থেকেও প্যাঁচালো। বদ লোক। বদ বললেও কম পড়বে। আরিয়ানের সাথেও উনার সম্পর্ক ভালো না। আপন ভাই না হোক। তাই বলে আরিয়ানকেও সহ্য করতে পারবে না? হিংসুটে অহংকারী মানুষ।
-মন খারাপ ছিল। রুমে ভালো লাগছিল না তাই মন ভালো করার জন্য বাগানে এসেছিলাম। তুমি এখানে কেন?”
-তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এলাম।”
-আমাকে খুঁজছিলে? কোন দরকার ছিল?”
-আরে না। এমনিই খুঁজছিলাম। তোমার মনটা কি খুব বেশি খারাপ?”
-না।”
-তাহলে অল্প খারাপ। আচ্ছা, তোমার মন ভালো করার জন্য আমি কি কিছু করতে পারি?”
ছেলেটার আগ্রহ দেখে মৌরি হেসে ফেলল। বলল,
-কী করবে তুমি?”
-শুনেছি অনেক অনেক শপিং করলে নাকি মেয়েদের মন ভালো হয়ে যায়। তোমাকে আমি শপিংয়ে নিয়ে যেতে পারি। তোমার মন যেহেতু অল্প খারাপ তাই আশা করা যেতে পারে শপিং করলেই মন ভালো হয়ে যাবে। তবুও শপিং শেষে আমরা শহরের দামী কোন রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে যেতে পারি। ডিনার শেষে আইসক্রিম খাওয়াতেও আমার কোন আপত্তি নেই।”
কথার মাঝেই আরিয়ান ফোনে সময় দেখে বলল,
-সাড়ে চারটা বাজে। এখন বেরুলে দশটার আগে ফিরে আসতে পারব। যাবে নাকি?”
মৌরি বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
-তুমি কি পাগল?”
আরিয়ানও মৌরির পেছন পেছন আসতে আসতে বলল,
-কেন, কেন? পাগল হবো কেন?”
-আমার মন ভালো করার জন্য তুমি এতকিছু করবে?”
-তো? করলে সমস্যা কি?”
-সমস্যা কিছুই না।”
-তাহলে তো আমার সাথে যেতে তোমার আপত্তি থাকার কথা না। নাকি তোমার হাসবেন্ডের কথা ভাবছো। তাশফিন তোমাকে আমার সাথে যেতে দিবে না। মানছি ও আমাকে পছন্দ করে না। কিন্তু এতে তো তোমার আমার সম্পর্কে দূরত্ব আসবে না। তুমি আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র ভাবী। তোমার জন্য আমি এটুকু করতে পারি না? অধিকার নেই আমার?”
তাশফিনের কথা শুনেই মৌরির রাগ উঠে গেল। তাশফিন কে? তাশফিনের কথা মৌরি কেন শুনবে? তাশফিন আরিয়ানের সাথে ওর কথা বলা পছন্দ না করলেও মৌরি আরিয়ানের সাথে কথা বলবে। তাশফিনকে দেখানোর জন্য প্রয়োজনের থেকেও আরও বেশি বলবে। তাশফিন কী করতে পারে সে-ও দেখবে।
-তোমার ভাই না করলেও আমি তোমার সাথে যাব। তোমার ভাইকে আমি ভয় পাই নাকি? উনার সব কথা কেন আমাকে শুনতে হবে? শুনব না কোন কথা। দেখব উনি কী করতে পারেন।”
তাশফিনের কথা তুলতে মৌরি এতটা রেগে গেল? শুধু রাগেনি। তার সাথে যেতেও রাজি হয়ে গেল। মৌরি তাশফিনকে এতটা অপছন্দ করে এটা তো জানা ছিল না। যাক ভালোই হয়েছে। আরিয়ান মনে মনে হাসল। বলল,
-তাশফিন, তোর পাখি তো তোর সাথে রাগ করে নিজেই আমার খাঁচায় আসছে। আমাকে তেমন কোন কষ্টই করতে হচ্ছে না। তোর কথা বলে বলে মৌরিকে দিয়ে আমি আমার সব কথা মানিয়ে নিতে পারব।”
তাশফিন কফির মগ হাতে নিয়ে লনে আসছিল। বিকেলে মাঝে মধ্যে যদি কোনদিন বাড়িতে থাকা হয়। তাহলে সে এই সময়টুকু কফি খেতে খেতে লনে বসে কাটায়। আজ লনে এসে অন্যরকম একটা দৃশ্য দেখল। মৌরি বাগানের দিক থেকে হাসতে হাসতে ভেতরে যাচ্ছে। তার পেছনেই কিছু বলতে বলতে আরিয়ানও যাচ্ছে। তাশফিন আরিয়ানের শেষের কথাটা শুনলো। আরিয়ান মৌরিকে বলছে,
-তাহলে এটাই ঠিক রইল। কবে যাচ্ছ আমার সাথে?”
ওদের মধ্যে কোন বিষয় নিয়ে কী কী কথা হয়েছে তাশফিন সবটা না জানলেও শেষের কথাটা শুনে এটা বুঝল, আরিয়ান মৌরিকে কোথাও নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। মৌরিও হয়তো রাজি হয়ে গেছে। আরিয়ানের সাথে মৌরির এরূপ সম্পর্ক কেনই যেন তাশফিনের ভালো লাগল না। কফিতে চুমুক দিয়েও সে আর কফির মজা পেলো না। মগ হাতে নিয়ে বেঁচে যাওয়া কফিটুকু লনে ছুড়ে ফেলে তাশফিনও বাড়ির ভেতর চলে গেল।
তাশফিন রুমে এসে মৌরিকে দেখলেও সরাসরি কিছু বলল না। সে মৌরির উপর রাগ থেকেই রুমে নানান উদ্ভট কাজ করে যাচ্ছে। শব্দ করে আলমারির ঢালা খুলছে। একটা একটা করে সবগুলো শার্ট বেডের উপর ছুড়ে রাখছে। আড়চোখে মৌরিকে দেখছে। কিন্তু মৌরি তার এসব কাজে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না দেখে রাগটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। তাশফিন বুঝতে পারছে না সে এত কেন রেগে যাচ্ছে।
চলবে