শ্রাবণ ঝরা মেঘ পর্ব-০৯

0
521

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [৯]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

হসপিটাল থেকে কল এসেছে পিহুর অবস্থার অবনতি হচ্ছে। তারা যেন এক্ষুনি হসপিটাল যায়। লায়লা খবরটা শুনে বিরক্ত হলো। এখন আবার হসপিটাল ছুটতে হবে। তারেকও বাড়িতে নেই। কিন্তু লায়লা জানে তার আগেই তারেক চৌধুরী খবর পেয়ে গেছে। লায়লা ওয়ারড্রবে গিয়ে কাপড় খুঁজছে। হসপিটালে পরে যাওয়ার মতো একটা শাড়ি বের করে চেঞ্জ করে এলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সময় নিয়ে মেকআপ করল। মেকআপ করা শেষ হলে আয়নায় নিজেকে দেখে বলল,

-পারফেক্ট। মন থেকে দুঃখ না আসলেও মেকআপের জোড়ে অন্তত দুঃখী দুঃখী লাগবে।”

শাড়ির সাথে ম্যাচ করে ভ্যানিটি ব্যাগ ঝুলিয়ে লায়লা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। লায়লাকে দেখে তার বয়স আন্দাজ করা কঠিনই না। বরং অসম্ভব ব্যাপার। এই বয়সেও নিজকে এতটা ফিট রেখেছে যে একুশ বাইশ বছরের তরুণীও তার সামনে হার মানবে। যৌবন ধরে রাখতে নিয়মিত জিম এক্সারসাইজ ইউগা পার্লার কী কী করে না? আরিয়ানকে সাথে নিয়ে এখনও কোন পার্টিতে গেলে মানুষ বিশ্বাসই করতে চায় না এটা তার ছেলে। লায়লা জানে যতদিন সে নিজেকে আকর্ষণীয় করে রাখতে পারবে ততদিনই তারেক তার হাতের মুঠোয় থাকবে। আরিয়ান আজ বাড়িতেই ছিল। মাকে বেরুতে দেখে বলল,

-কোথাও যাচ্ছ মম?”

লায়লা দাঁড়িয়ে আরিয়ানের দিকে ফিরে তাকাল। বলল,

-ওহ, তুমি বাড়িতেই ছিলে?”

-হ্যাঁ। কিন্তু তুমি কোথায় যাচ্ছ?”

-হসপিটালে। তুমিও আমার সাথে যাচ্ছ। দু’মিনিটে চেঞ্জ করে এসো। কুইক।”

-আমি কেন? তুমি যাচ্ছ যাও না। আমাকে প্লিজ এসবের মধ্যে টানবে না। ওই মেয়েকে নিয়ে আদিখ্যেতা করার জন্য তাশফিনই যথেষ্ট।”

-তোমাকেও আদিখ্যেতা করতে হবে ব্যাটা। তোমার পাপা এসব আদিখ্যেতা দেখেই খুশি হয়। তুমি চাও না পাপা সবসময়ের মতো এবারও তোমার উপর খুশি থাকুক?”

-পাপার খুশির জন্যই না চাইতেও তোমার সব কথা মানতে হয়।”

-এটাই তোমার জন্য ভালো ব্যাটা। আমি কি তোমার খারাপ চাই? আমি যা করি তোমার ভালোর জন্যই করি।”

-হুম।”

-তাহলে আর কথা না। এক্ষুনি চেঞ্জ করে এসো। আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি।”

আরিয়ান ড্রাইভিং সীটে বসতে বসতে বলল,

-পাপাও কি হসপিটালে?”

-এতক্ষণে নিশ্চয় পৌঁছে গেছে।”

-আপদটা পুরোপুরি না মরে অর্ধেক ঝুলে আছে। এটা না থাকলেও আমাকে একটা শত্রু কমত। তাশফিনকে আমি পুরোপুরি একা দেখতে চাই। ওর পাশে যেন কেউ না থাকে।”

-পিহু না থাকলেও এখন তো ওর বউ এসে গেছে।”

-বউও বেশিদিন থাকবে না।”

লায়লা ছেলের দিকে তাকাল। আরিয়ান কি কিছু প্ল্যান করেছে?

-তোমার প্ল্যানটা কি? আমাকে বলবে?”

-কোন প্ল্যান না মম। দেখো না জঙ্গলিটা বউয়ের সাথে কেমন আচরণ করে। তোমার মনে হয় এই মেয়ে বেশিদিন টিকবে?”

-টিকতেও পারে। মেয়েটাকে বাইরে থেকে যেমন দেখা যায় আসলে ভেতর থেকে ও অনেক বেশি শক্ত। নইলে তাশফিন বিয়ে না করে ফেলে আসার পরেও আমাদের বাড়িতে চলে আসত পারত না। তাশফিন কত অপমান করে চলে যেতে বলেছে। কিন্তু এই মেয়ে গেছে কি? ভবিষ্যতেও যে যাবে আমার মনে হয় না।”


তাশফিন সবার আগে হসপিটালে এসে পৌঁছেছে। তার আসার একটু পরেই তারেক চৌধুরী এসেছেন। তিনি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছেন। তাশফিনকে এতটা ভেঙে পড়তে দেখে তারেক চৌধুরী ছেলের কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,

-কিছু হবে না। পিহু ঠিক হয়ে যাবে।”

বাবার এসব সান্ত্বনা তাশফিনের কষ্ট কমাতে পারছে না। পিহুর কিছু হলে সে নিজেকে কোনদিনও ক্ষমা করতে পারবে না। কারণ পিহু তার দায়িত্ব ছিল। সে ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করলে পিহু ওই প্রতারকের হাতে পড়ত না।
লায়লা আরিয়ান যেটুকু শোক প্রকাশ করছে সেটাও তারেক চৌধুরীকে দেখানোর জন্য। মন থেকে না। লায়লা তাশফিনের কাছে গিয়ে দুঃখি গলায় বলল,

-তুমি ভেঙে পড়ো না তাশফিন। পিহু সুস্থ হয়ে যাবে। ডাক্তাররা দেখছেন তো।”

আরিয়ান এখানে এসেছে এটাই যথেষ্ট। তাকে নিয়ে এসব নাটক হবে না। তাই সে মন খারাপের ভাব ধরে দূরে দাঁড়িয়ে রইল। লায়লা তারেক চৌধুরীকে বললেন,

-তাশফিনকে বুঝাও। ছেলেটার কষ্ট আমি দেখতে পারছি না। আরিয়ানও ভীষণ আপসেট হয়ে পড়েছে।”


মৌরি পুরো বাড়ি খুঁজেও কাউকে পেল না। গেল কোথায় সবাই? একটু আগেও তো তার শাশুড়ী মা আর আরিয়ানকে বাড়িতে দেখেছে।

-এটা বাড়ি না অন্য কিছু? মানুষজন এই আসছে, এই যাচ্ছে। বাড়ির কোন নিয়মশৃঙ্খলা নেই। যে যার মর্জি মতো চলে।”

মৌরি তার একমাত্র সাথী সালেহা খালার কাছে চলে এলো। এবাড়িতে খালাই তার একমাত্র ভরসা। খালা না থাকলে দুটা কথা বলার জন্যও মানুষ খুঁজতে হতো।

-খালা সবাই কোথায় গেছে জানেন?”

-বেগম সাহেবা মনে হয় আরিয়ান বাবারে নিয়ে হাসপাতালে গেছে?”

-কেন? আরিয়ানের কিছু হয়েছে?”

-আরিয়ান বাবার কিছু হয় নাই। পিহুরে দেখতে গেছে।”

-ওহ। পিহুর কী হয়েছে খালা?”

সালেহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

-অনেক বড় অ্যাক্সিডেন্ট হইছে গো মা। হাসিখুশি মেয়েটা কোমা না কী জানি বলে, ওইখানে চলে গেছে। অনেকদিন ধরে হাসপাতালে। তাশফিন বাবা দিনের পর দিন বাড়ি না ফিরে হাসপাতালে বোনের কাছে কাটিয়ে দেয়। আল্লাহ মেয়েটারে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দিক। মেয়েটার জন্য মন কাঁদে গো মা।”

কোমা! কোমায় চলে গেছে মানে অনেক গুরুতর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। বিয়ের আগেও তাশফিন কখনও তার বোনের কথা তুলেনি। মৌরি পিহুর কথা সত্যিই জানত না। মা যাবার সময় তাকে নিয়ে গেল না কেন? সে-ও পিহুকে দেখত।
তাশফিন দু’হাতে মুখ ঢেকে চেয়ারে বসে আছে। আরিয়ান অনেকক্ষণ আগেই কাজের বাহানা দিয়ে বেরিয়ে গেছে। লায়লা স্বামীর সাথে আছেন। ডাক্তার জানিয়েছেন পিহুর কন্ডিশন এখন আগের থেকে কিছুটা ভালো। হুট করে অবস্থার অবনতি দেখা দিলে উনারা ভয় পেয়েই বাড়িতে খবর দিয়েছে। কিন্তু এখন ঠিক আছে। লায়লা ঘড়িতে সময় দেখল। আলতো করে তারেক চৌধুরীর কাঁধে হাত রেখে মৃদু গলায় বলল,

-এখনও টেনশন করছো? তুমি জানো না তোমার জন্য টেনশন নেওয়া ঠিক না। ডক্টর তো বলেছে পিহু এখন বেটার আছে। হসপিটালে বসে থেকেও তো আমরা কিছু করতে পারব না। তাশফিনকে বুঝিয়ে চলো বাড়ি নিয়ে যাই। ছেলেটা সারারাত এভাবেই বসে থাকবে।”

-হুম।”

তারেক চৌধুরীকে ছেলেকে বোঝাতে গেলে তাশফিন উল্টো বাবাকে বলল,

-তোমরা বাড়ি চলে যাও। আমি পিহুর কাছে আছি।”

-তোমারও তো রেস্ট প্রয়োজন।”

-তোমরা যাও। রেস্ট নাও গিয়ে। আমি ঠিক আছি। আর আসার জন্য ধন্যবাদ।”

-ধন্যবাদ দিচ্ছ কেন? পিহু কি আমার কেউ না? তুমি যেমন আমার ছেলে, পিহুও তেমন আমার মেয়ে।”

-পিহুকে মেয়ে ভাবার জন্যও থ্যাঙ্কস।”

তারেক চৌধুরী হার মেনে নিলেন। এই ছেলের থেকে ভালো কিছু আশা করাও বোকামি। তাশফিন কোনকিছুই সহজে ভুলতে পারে না। মাঝে মাঝে ওর রাগ, জেদ, অভিমান দেখে তারেক চৌধুরী ভয় পান। এই আচরণ থাকলে ছেলেটা জীবনে একা হয়ে যাবে।
তারেক চৌধুরী লায়লাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন। মৌরি ওদের অপেক্ষায় জেগে ছিল। বাবা মা’কে বাড়ি ফিরতে দেখে বলল,

-বাবা পিহু কেমন আছে? ডক্টর কী বলেছে?”

-তুমি এখনও জেগে আছো কেন বৌমা?”

-ঘুম আসছিল না। আপনি বলুন না, পিহু এখন কেমন আছে?”

-এখন আগের থেকে ভালো। তাশফিন পিহুর কাছে থেকে গেছে। আমাদের সাথে চলে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু এলো না। চিন্তা করো না। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো।”

-ঠিক আছে।”

তারেক চৌধুরী চলে গেলে লায়লা মৌরিকে বলল,

-ছেলেটা হসপিটালে একা আছে। বলেছিলাম চলে আসতে। কিন্তু বোনকে অনেক ভালোবাসা তো। তুমি কল করে জিজ্ঞেস করো কোন সমস্যা হলো কি-না। ছেলেটা বাচ্চাদের মতো কেঁদেছে। ওর পাশে তোমাকে প্রয়োজন।”

মৌরি ঘরে এসে শাশুড়ির কথা মতো তাশফিনকে কল করল। প্রথম কয়েকবার রিং হয়েছে। তারপর ফোন অফ যাচ্ছে। মৌরি চিন্তিত মুখে ঘরজুড়ে পায়চারি করছে। অনেক রাত পর্যন্ত মৌরির ঘুম এলো না। কাল কি পিহুকে তার দেখতে যাওয়া উচিত?


তাশফিন সকালে বাড়ি ফিরেছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাতে ঘুম হয়নি। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। তাশফিনকে রুমে যেতে দেখে মৌরিও পিছন পিছন এলো। তাশফিন রুমে এসে আলগোছে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে বাম হাতে কপাল ডলছে। ঘুম না হওয়ায় মাথা ব্যথা করছে। মৌরি দরজা দিয়ে ঢুকে তাশফিনকে শুয়ে থাকতে দেখে ডাকল না। কাল রাতে মানুষটার উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। রাতে তো মনে হয় কিছু খায়ওনি। মৌরি কি উনার খাবার ঘরে নিয়ে আসবে? মৌরি এসব ভাবতে ভাবতেই তাশফিন চোখ খুললো। মৌরির সাথে সে এখনও অভ্যস্ত হয়নি। তাই বারবার ভুলে যায় সে ছাড়াও যে এই ঘরে আরও একজন থাকছে।
মৌরিকে দেখে তাশফিনের মেজাজ তিক্ত হয়ে উঠলেও এমুহূর্তে কিছু বলল না। সে উঠে ওয়াশরুমে যেতে নিলে মৌরি বলল,

-আপনার খাবার ঘরে এনে দেব?”

-কেন?”

এই কেন’র উত্তর মৌরি কী দেবে ভেবে পেলো না। তাশফিন ওখানে দাঁড়িয়েই বলল,

-আমার বউ হবার চেষ্টা করবে না একদম।”

-বউ তো হয়েই এসেছি। এখন বউ হওয়ার দায়িত্ব পালন করছি।”

মেয়েটার সাহস দিনদিন বাড়ছে। মুখে মুখেও কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। পিহুুর ব্যাপারটা নিয়ে তাশফিন আগে থেকেই ডিস্টার্বড ছিল। মৌরির পাল্লা জবাব শুনে রাগ সামলাতে পারল না। তাশফিন মৌরির সামনে এসে দু’বাহু শব্দ করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-বউ বানানোর জন্য তোমাকে বিয়ে করিনি। তোমার ভাইয়ের থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বিয়ে করেছি। যার জন্য আমি জ্বলছি তাকেও জ্বালানোর আয়োজন করেছি। বোনের কষ্টে ভাই কতটা কষ্ট পায় সেটাই তোমার ভাইকে বুঝিয়েছি।”

মৌরি ভাবেনি তাশফিন হঠাৎ এতটা রেগে যাবে। সে হাতে ব্যথা পাচ্ছে। আর তাশফিন এসব কী বলছে? কিসের প্রতিশোধ? বোনের কষ্টে ভাইয়ের কষ্ট এর অর্থ কী? মৌরি যতই নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে তাশফিন যেন আরও শক্ত করে ধরছে।

-কিসের কথা বলছেন আপনি? আমি কিছু বুঝতে পারছি না৷ আমার ভাইয়ের থেকে কিসের প্রতিশোধ নিবেন আপনি?”

-বুঝতে পারছো না? নাকি বুঝতে চাচ্ছ না? ভাইয়ের পাপ লোকাতে চাচ্ছ তাই না!”

-আমার ভাই কোন পাপ করেনি যে লোকাবো।”

-পাপ করেনি? তাহলে তো আমিও তোমাকে বিয়ের দিন ফেলে এসে কোন পাপ করিনি। আমাকেও তুমি অপরাধী বলতে পারবে না।”

-আমার ভাই আপনার মতো কাউকে ছেড়ে দেয়নি।”

তাশফিনের হাসি পেলো। সে মৌরির চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল,

-তুমি কি এতটাই বোকা? নাকি নিষ্পাপ! কোনটা বলব? তোমার ভাই কাউকে ছাড়েনি? তাহলে আজ আমার বোনের এই অবস্থা কেন? কার জন্য পিহু এতটা কষ্ট পাচ্ছে? ভাইয়ের প্রতি এত বিশ্বাস আসে কোত্থেকে? মনে হচ্ছে তোমার ভাই পাক্কা খেলোয়াড়। বাড়ির মানুষের সামনে ভালোমানুষির মুখোশ পরে আছে।”

মৌরির বিশ্বাস হচ্ছে না। তার ভাই কোন মেয়ের সাথে এরকম কিছু করতে পারে না। তাশফিন মিথ্যা বলছে। নাহয় তাশফিনের বুঝতে ভুল হচ্ছে।

-আপনার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে।”

তাশফিন মৌরিকে ধাক্কা দিয়ে হাত ছেড়ে দিল। তাচ্ছিল্যের সুরে হাসতে হাসতে বলল,

-মৌরি সত্যটা তুমি নিজেও মানতে চাচ্ছ না। ভুল আমার না। তুমি তোমার ভাইকে চিনতে করেছ। আমার কথা বিশ্বাস না হলে নিজের ভাইকেই জিজ্ঞেস করো। জিজ্ঞেস করো পিহু নামের কাউকে চেনে কি-না। পিহুর সাথে ওর কী সম্পর্ক ছিল? অবশ্য এটা দেখার বিষয় তোমার ভাই তোমার কাছে স্বীকার করে কি-না।”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে