শ্রাবণ ঝরা মেঘ পর্ব-০৪

0
586

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [৪]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

🌸
-এইতো বৌমা চলে এসেছে।”

লায়লার কথা শুনে তাশফিন হেলা করে ওদিকে তাকালে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না। নেশা কি মিসেস চৌধুরীর হয়েছে, নাকি তার? মুহূর্তে তার মুখ থেকে হাসি চলে গেল। সেখানে হাসির বদলে রাগের আভাস মিলল। এই মেয়েকে নিজের বাড়িতে দেখে তাশফিনের মেজাজ চরম পর্যায়ে খারাপ হয়ে গেল। সে দু’হাতে টেবিলের উপর জোরে শব্দ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। নির্দিষ্ট করে কাউকে বলল না। কিন্তু হুংকার ছেড়ে প্রশ্ন করল,

-এই মেয়ে এখানে কী করছে?”

তারেক চৌধুরী উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না।
উত্তরটা মৌরিই দিল।

-বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর বাড়িতে থাকে। এটা যেহেতু আমার স্বামীর বাড়ি তাই আমারও এখানেই থাকার কথা।”

মেয়েটা জবাব দিতে পারে। লায়লা মনে মনে পুরো সিচুয়েশনটার মজা নিচ্ছে। তাশফিনকে শায়েস্তা করার জন্যই সে এত সহজে এই ছোটলোক নিচু ঘরের মেয়েটাকে বৌমা হিসেবে মেনে নিয়েছে। প্রথম থেকেই এই বিয়েতে সে রাজি ছিল না। কিন্তু তার রাজি নারাজি দিয়ে এই ছেলের কোন ফারাক পড়বে না। একবার যেহেতু বলেছে এই মেয়েটাকে বিয়ে করবে, তাহলে করবেই। তারেক চৌধুরীও শেষ পর্যন্ত ছেলের কাছে হার মানলেন। লায়লা কাল ইচ্ছে করেই বিয়েতে যায়নি। কিন্তু বিয়েতে না গেলেও ওখানে কী ঘটেছে সব খবর তার কাছে এসেছে। সব শুনে ভীষণ খুব হয়েছিল সে। কিন্তু আজ সকালে দারোয়ান এসে জানাল একটা মেয়ে এসেছে। নিজেকে এই বাড়ির বউ দাবি করছে। দারোয়ানকে বলে লায়লা মেয়েটাকে ডেকে পাঠাল। মেয়েটার সাথে তার কথা বলতে হবে। শোনা যাক কী উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছে। মেয়েটার কথা শুনে লায়লা তাকে তাৎক্ষণাৎ বাড়ি থেকে বের করে দিল না। এই কাজটা তাশফিন নিজেই করবে। কিন্তু সে পর্যন্ত বিনোদন দেখতে তো নিষেধ নেই। এইতো আসল বিনোদন এবার শুরু হয়েছে। মৌরির কথায় তাশফিন তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল,

-স্বামীর বাড়ি? কে কার স্বামী? আমার সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে?”

-আমাদের দু’জনের পরিবার ও সমাজের মানুষের সামনে গতকাল আমাদের বিয়ে হয়েছে।”

তাশফিন মৌরির সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোখেমুখে কৌতুকের হাসি।

-আমি কবুল বলেছিলাম?”

-না। কিন্তু আপনার হয়তো একটা কথা মনে নেই। ব্যাপার না। আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। আইনের চোখে, কাগজে কলমে কিন্তু আমরা স্বামী স্ত্রী। আপনি আমি দু’জনই কাবিননামায় সই করেছি।”

-আমি তোমাকে স্ত্রী হিসেবে মানতে চাচ্ছি না। তারপরও তুমি জোর করে আমার বাড়িতে থাকবে?”

-আমার জানা মতে বিয়েটা করতে আপনাকে কেউ জোর করেনি। আপনি নিজের ইচ্ছায় আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। এখন বিয়ে করার পর স্ত্রীকে কেন মানবেন না এই জবাব আপনার কাছে চাইব না। কিন্তু আমাকে তো বিয়েটা বয়ে নিতে হবে। আপনার মতো অস্বীকার করার উপায় নেই।”

-তুমি এক্ষুনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে।”

-যদি না যাই?”

-তাহলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করব।”

এতক্ষণ তারেক চৌধুরী চুপ করে শুনলেও এপর্যায়ে তিনি চুপ থাকতে পারলেন না। ছেলেকে দেওয়া শিক্ষা নিয়ে তিনি নিজেই লজ্জা বোধ করছেন।

-তাশফিন! এই শিক্ষা দিয়েছিলাম তোমাকে? নিজের স্ত্রীর সাথে তুমি এভাবে কথা বলছো! কাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে তুমি? এই বাড়িটা কার? কাউকে এই বাড়িতে রাখা বা বের করে দেওয়ার অধিকার একমাত্র আমার আছে। বৌমা এবাড়িতে থাকবে এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত।”

বাইরের একটা মেয়ের জন্য বাবা তাকে অপমান করল! এই মেয়েটা বাবার কাছে তার থেকে বেশি হয়ে গেল। তাশফিন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

-তাহলে আপনি এবং আপনার বৌমাকে এবাড়ি মোবারক হোক। আমি নিজেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি।”

তাশফিন রাগ করে না খেয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। লায়লার চোখমুখ অপ্রত্যাশিত খুশিতে চকচক করছে।
যে কাজ লায়লা এতগুলো বছরে এত চেষ্টার পরও পারেনি। তা এই মেয়ে আজ বাড়িতে পা রাখা মাত্রই করে দিল! এই মেয়েকে হাতছাড়া করা যাবে না। কাটা দিয়ে কাটা তোলার কথাটা এতদিন শুনলেও লায়লা এবার নিজেই পথের কাটা তোলার জন্য আরেকটা কাটা পেয়ে গেল। আসল কাটাটা তুলে ফেলতে পারলে এই কাটাকেও ছুড়ে ফেলতে বেশি সময় লাগবে না।
তারেক চৌধুরী বৌমার দিকে তাকালেন। মেয়েটাকে দেখলে তার নিজের উপর লজ্জা হয়। এমন একটা ছেলের বাবা হয়ে লজ্জা পাওয়া ছাড়া আর কী আশা করতে পারেন তিনি? গতকাল মেয়েটাকে ওভাবে ফেলে আসতে তার বড্ড মায়া হচ্ছিল। বৌমার কাছে এসে গলার স্বর নরম করে বললেন,

-মা তুমি ওসব নিয়ে ভেবো না। এটা তোমারই বাড়ি। আমার ছেলের কোন কথা তুমি কানে নিও না। এই ছেলের থেকে আমি ভালো কিন্তু প্রত্যাশাও করি না। তুমি ঘরে যাও। আমি তোমার ব্যাগ রুমে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

এই মানুষটা এত ভালো কেন? মানুষটার মাঝে মৌরি তার বাবাকে দেখতে পায়। এই মানুষ না থাকলে হয়তো মৌরির এবাড়িতে থাকা আরও কঠিন হয়ে যেত। মৌরি মনে মনে দীর্ঘশ্বাস চাপল। সে জানে এই বাড়িতে থাকা তার জন্য সহজ হবে না। জেনেই সে এসেছে। তাশফিন তাকে বিয়ে করেছে। মৌরি যেভাবেই হোক স্ত্রীর অধিকার আদায় করে ছাড়বে।
মৌরি জানে না কোনটা তাশফিনের রুম। তাই সে জিজ্ঞেস করল,

-বাবা আমার রুমটা…

-ওহ হ্যাঁ। সালেহা বৌমাকে ঘরে দিয়ে এসো। আর ওর ব্যাগটাও রুমে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। বৌমার যেন কোন প্রকার অসুবিধা না হয়। আজ থেকে বৌমার দেখাশোনা করার দায়িত্ব তোমার।”

সালেহা নামের মানুষটাকে অনুসরণ করে হাঁটতে হাঁটতে মৌরি আশেপাশে দেখে নিচ্ছে। যত দেখছে মৌরি অবাক হচ্ছে। এটা বাড়ি নাকি রাজপ্রাসাদ! সালেহা পেছন ফিরে মৌরিকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে বলল,

-বউ মনি আসো।”

-হুম।”

মৌরিকে তাশফিনের ঘরে পৌঁছে দিয়ে সালেহা হেসে বলল,

-এইটা বাবার ঘর। মানে তোমার বরের ঘর। আজ থেকে তোমারও। তোমার কিছু লাগলে আমারে ডাকবা।”

-আচ্ছা।”

সালেহা চলে গেলে মৌরি এই ঘরটাকে দেখতে লাগল। বাড়িতে তার রুমটা এই রুমের কাছে কবুতরের খোপ। কিন্তু নিজের রুমটা তার কাছে ভীষণ প্রিয় ছিল। সবকিছু নিজের হাতে সাজিয়েছিল। মৌরির এখানে আসার সিদ্ধান্ত শুনে বাবা মা ভাই কেউ রাজি ছিল না। কোন দরকার নেই ওই বাড়িতে যাওয়ার। কিন্তু মৌরি কারো কথা শুনেনি। নিজের সাথে হওয়া অন্যায় সে এত সহজে কেন মেনে নিবে? মন চাইল বিয়ে করতে চলে গেল। মন চাইল বিয়ে অস্বীকার করল। সে তো কোন পুতুল না।
মৌরির পরনে এখনও বিয়ের শাড়ি। কাল ওই ঘটনা ঘটার পর থেকে এখন পর্যন্ত একই শাড়ি পরে আছে। মুখও ধোয়নি। এখন ফ্রেশ হতে না পারলে এবার নির্ঘাত জ্ঞান হারাবে। মৌরি তার লাগেজ খুলে সবুজ রঙের একসেট সালোয়ার কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। গোসল সেরে ভেজা চুল মুছতে মুছতে রুমে এসে ফোনের রিংটোন শুনতে পেল। ইশ বাড়িতে একবারও কল করেনি। বাবা মা নিশ্চয় দুঃশ্চিন্তা করছে। কল তুলে মৌরি কথা বলার আগেই ওপাশ থেকে মা বলল,

-কোথায় ছিলি তুই? কতক্ষণ ধরে কল করছি। কল তুলছিলি না কেন?”

-ওয়াশরুমে ছিলাম মা। মাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছি। কেমন আছো মা?”

-তোকে ওবাড়িতে পাঠিয়ে আমি কীভাবে ভালো থাকতে পারি? কেন গেলি ওবাড়িতে? কত করে বারণ করলাম। কারো কথাই শুনলি না।”

-আমি ভালো আছি মা। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো।”

-কেমন ভালো আছিস আমাকে বোঝাতে হবে না। যে স্বামী বিয়ের দিন বউকে ফেলে চলে যায় তার বাড়িতে গিয়ে তুই তো অনেক ভালো আছিস।”

-আমার শ্বশুর শাশুড়ী অনেক ভালো মা। উনারা আমার এতটুকুও অসম্মান হতে দেয়নি।”

-আর স্বামী? সে কি তোকে সম্মান দিবে? তুই চলে আয় মা। তোর বাবা মা এখনও বেঁচে আছে। তুই কেন ওবাড়িতে পড়ে থাকবি?”

-তুমিই তো বলতে মা, বিয়ের পর স্বামীর বাড়িই মেয়েদের আসল ঠিকানা। আমি তো আমার স্বামীর বাড়িতে আছি।”

-কতদিন থাকতে পারবি মা? স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা না থাকলে সেই সংসার কতদিন চলবে? দু’জন মানুষের মধ্যে ভালোবাসা, সম্মান, বিশ্বাস না থাকলে একসাথে থাকা কোনদিনও সম্ভব হবে না।”

-চেষ্টা তো করে দেখি মা।”

-কী চেষ্টা করবি? জোর করে তুই কারো মনে তোর জন্য ভালোবাসা তৈরি করতে পারবি?”

-হয়তো পারব। না পারলেও তেমন ক্ষতি হবে না। আমি জানি, আমার বাবা মা’র দরজা কোনদিনও আমার জন্য বন্ধ হবে না। চেষ্টা ব্যর্থ হলে তোমাদের মেয়ে আবার তোমাদের কাছে ফিরে আসবে।”

মৌরি শ্বশুরবাড়ি ঘুরে দেখছে। এত বড় বাড়ি। কোন দিক দিয়ে ঢুকেছে আর কোন দিক দিয়ে বের হবে বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে হারিয়ে গেছে। নিজের রুম কোনদিকে এটাই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ নিজের ঘাড়ের উপর তপ্ত নিঃশ্বাস অনুভব করে ঝট করে পেছন ফিরল মৌরি। তার থেকে একহাত দূরত্বের কমে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মৌরিকে ঘাবড়ে যেতে দেখে ছেলেটার মুখে অদ্ভুত একটুকরো হাসি দেখা দিল। মৌরি কাঁপা গলায় তেজের সাথে জিজ্ঞেস করল,

-কে আপনি? এটা কেমন অসভ্যতা!”

ছেলেটা কৌতূহলী চোখে মৌরিকে দেখছে। মৌরি চোখ ঘুরিয়ে একবার আশেপাশে দেখে নিল। কাছেপিঠে কেউ নেই। এই ছেলেটা কে? এর তাকানোর ভঙ্গি তার কাছে ভালো লাগছে না।

-আমি কে?’

ছেলেটা আহত ভঙ্গিতে বুকে হাত রেখে বলল,

-কষ্ট পেলাম ভাবি। একমাত্র আদরের দেবরকে আপনি চিনতে পারলেন না!”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে