শ্রাবণ ঝরা মেঘ পর্ব-০২

0
649

#শ্রাবণ_ঝরা_মেঘ [২]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

🌸
মৌরি প্রাণহীন বস্তুর ন্যায় বসে অবাক বিস্ময় নিয়ে তাশফিনকে দেখছে। চেনা মানুষটাও কত সহজে অচেনা হয়ে যেতে পারে! বিশ্বাসের সুতো ছিঁড়তে এক মুহূর্তও সময় লাগে না। ভালো মানুষির মুখোশের আড়ালেও মানুষের আজানা আরও কত রূপ হয়!
মৌরির বাবা মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে চোখের জল আটকাতে পারলেন না। অসহায় পিতার ন্যায় তাশফিনের সামনে এসে হয়ে বললেন,

-এই কথা কেন বলছো বাবা? আমার মেয়ে কি কোন ভুল করেছে? ও কি কোন অপরাধ করেছে? আমাকে বলো। আমি বাবা হয়ে ওকে শাসন করব।”

তাশফিনের বাবা তারেক চৌধুরীও ছেলের এমন আচরণে হতভম্ব। যে মেয়েকে বিয়ে করার কথা ছেলে নিজেই বলেছে। তাদেরকে একপ্রকার বাধ্য করে এখানে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে পাঠিয়েছে। এখন কি-না সেই ছেলেই বলছে এই মেয়েকে বিয়ে করবে না! আসলে ছেলে কী চাচ্ছে তা বাবা হয়েও তিনি বুঝতে পারছেন না। বিয়েতে তিনি রাজি ছিলেন না বলা যায়। কারণ তাদের সাথে মেয়েদের সামাজিক এবং পারিবারিক অবস্থান কোনোটাই মিলে না। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে হলেও মৌরিকে তাদের পছন্দ হয়েছিল বলেই বিয়েতে মত দিয়েছিল। মৌরির বাবা মধ্যবিত্ত হোক বা প্রভাবশালী। তার নিজের ঘরেও একটা মেয়ে আছে। তাই তিনি কখনোই চাইবেন না অন্য একটা মেয়ের অপমান হোক। সেটাও আবার নিজের ছেলের দ্বারাই। তারেক চৌধুরী চাপা ধমকে ছেলেকে বললেন,

-কী হচ্ছে এসব? এভাবে মানুষ হাসানোর মানে কী? বিয়ে করতে এসেছ চুপচাপ বিয়েটা সেরে নাও। আমি কোনরকম সিনক্রিয়েট চাচ্ছি না।”

তাশফিন বাবার দিকে ফিরল। হাসি হাসি মুখে অতি দুঃখিত ভঙ্গিতে জানাল,

-না বাবা। সিনক্রিয়েট আমিও চাচ্ছি না। তাই তো বলছি ফিরে চলো। বিয়েটা আমি করব না।”

তারেক চৌধুরী ছেলের এই নতুন নাটকে যথেষ্টই বিরক্ত হলেন। বিয়ে করার জন্য ছেলের গরজই তো সবচেয়ে বেশি ছিল। নির্লজ্জের মতো বলেছিল, বিয়ে আমি এই মেয়েকেই করব। এখন বিয়ের কিছু মুহূর্ত আগে মন পাল্টে গেছে! ইয়ার্কির একটা সীমা থাকে।

-তাশফিন! সবকিছুতে তোমাকে স্বাধীনতা দিয়েছি বলে এই না তুমি একটা মেয়েকে অপমান করবে আর আমি সহ্য করব। এনাদের সম্মান নিয়ে খেলার কোন অধিকার নেই তোমার। চুপচাপ স্টেজে গিয়ে বসো।”

মৌরির বাবা বিয়াইয়ের কথা শুনে আশার আলো দেখতে পেলেন। তিনি হবু বিয়াইয়ের কাছে ছুটে এলেন।

-ভাই সাহেব, আমাদের পক্ষ থেকে যদি কোন ভুল হয়ে থাকে তাহলে আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি। কিন্তু আমার মেয়েটার জীবন এভাবে শেষ হতে দিবেন না।”

তারেক চৌধুরী বিয়াইকে আশ্বাস দিয়ে বললেন,

-আপনি ভাববেন না। আপনার মেয়ের বিয়ে আজই হবে। আর সেটা আমার ছেলের সাথেই হবে।”

তাশফিনের মাঝে কোন অনুতাপ অনুশোচনা নেই। সে বরং সবটা উপভোগ করছে। হঠাৎ বাবা কেন এত ভালো সাজতে চাচ্ছে?

-আ’ম রিয়েলি স্যরি বাবা। কিন্তু বিয়েটা আমি সত্যিই করব না।”

তাশফিন মাথার পাগড়ি খুলে ফেলে দিয়ে প্রস্থান করছিল। মৌরি অশ্রুসিক্ত চোখে পাথরের মূর্তির ন্যায় বসে মানুষটাকে দেখছে। মৌরির বড় ভাই মাহিম তাশফিনের পথ আটকালো। ক্রোধে গর্জন তুলে সে তাশফিনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চোখ দিয়ে অগ্নিশিখা ঝেড়ে ওর শেরওয়ানীর কলার চেপে ধরল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-স্কাউন্ডেল আমি তোকে খুন করে ফেলব। আমার বোনকে বিয়ের আসর থেকে ফেলে যাওয়ার সাহস হয় কী করে তোর? তোকে কেউ কিছু বলবে না মনে করেছিস?”

মাহিমা কলার ধরে ঝাঁকাচ্ছে। তাশফিন এতেও হাসছে। মাহিমকে বোনের জন্য ছটফট করতে দেখে ওর বুকের আগুনে শীতল প্রলেপ পড়ছে। তাশফিন মাহিমের হাত কলার থেকে ছাড়িয়ে নিল। হাসি হাসি মুখে ওর কানের কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল,

-কষ্ট হচ্ছে শালাবাবু? ওপসস! বিয়েটা তো করছি না। তাই শালাবাবু হওয়ারও চান্স নেই। রাগ লাগছে? আমাকে মারতে ইচ্ছে করছে? বোনের কষ্ট সোজা কলিজায় গিয়ে লাগে, তাই না?’

কথাগুলো বলতে বলতেই তাশফিনের মুখ থেকে হাসি মুছে গেল। চোখ জোড়া হিংস্র হয়ে উঠল।

– চোখের সামনে নিজের কলিজার টুকরা বোনটাকে কষ্ট পেতে দেখে আমিও একইভাবে ছটফট করেছি। প্রতিনিয়ত প্রতিশোধের আগুনে পুড়েছি। আজ আমার প্রতিশোধ পূর্ণ হলো। আমার বোনকে ছুঁয়ে দেওয়া কথা তার ভাইটা রেখেছে। ওকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে ছেড়ে গিয়েছিলি তো তুই! আমি তোর বোনকে বিয়ের আসর থেকে ছেড়ে যাচ্ছি। দেখি তুই কী করতে পারিস। কর শালা। চোখের সামনে বোনকে একটু একটু করে শেষ হয়ে যেতে দেখবি। কিন্তু তোর কিছুই করার থাকবে না। এটা জানতে চাইবি না কেন আমি এমন করছি? কিসের প্রতিশোধ নিচ্ছি? তাহলে জেনে রাখ, তোর বোন তার ভাইয়ের পাপের শাস্তি পাচ্ছে।”
—-

বিয়ের আসর থেকে বর চলে গেছে! কেন? মেয়ের নিশ্চয় কোন সমস্যা আছে। হয়তো বিয়ের আগে করা মেয়ের কোন কুকীর্তির কথা ছেলেটা জানতে পেরেছে। মেয়ে ধোয়া তুলসীপাতা হলে কি আর বিয়ে না করে বর চলে যেত!
বধূর সাজে বসে থাকা মৌরির দিকে একবারও না তাকিয়ে তাশফিন সেখান থেকে চলে এসেছে। ও মৌরির দিকে একটিবার তাকালে দেখতে পেত মেয়েটা দু-চোখ ভরা কতটা অবিশ্বাস নিয়ে তাকে দেখছে। তাশফিন চলে যাবার পর এখানে উপস্থিত প্রতিটা মানুষের মাঝে উক্ত কথাগুলো আগুনের লাভার মতো ছড়িয়ে গেল। একটু আগের বিয়ে বাড়ির কোলাহল পূর্ণ আনন্দময় পরিবেশ এখন শোকের ছায়ায় ঢাকা পড়েছে।
মৌরি আবেগশূন্য হয়ে পাথরের মূর্তির ন্যায় বসে আছে। তার বাবা মিজানুর রহমান একমাত্র মেয়ের এই করুণ দশা সহ্য করতে পারলেন না। তিনি সেখানে জ্ঞান হারালেন। মৌরির ভাই তার থেকে বছর কয়েক বড়। যাবার আগে তার কানে বলে যাওয়া তাশফিনের কথাগুলো এখনও তার গায়ে কম্পন সৃষ্টি করছে। “তোর বোন তার ভাইয়ের পাপের শাস্তি পাচ্ছে।” তার জন্যই কি তাহলে একমাত্র আদরের বোনের জীবনটা এভাবে নষ্ট হয়ে গেল! তার ভুলের কারণে? তাশফিনের বোন কে? পিহু! পিহু প্রতিশোধ নিতে তার ভাইকে লেলিয়ে দিয়েছে! বাড়ি ভর্তি প্রতিবেশীরা অনেকে মৌরিকে সান্ত্বনা দিতে চাইল। আবার কেউ কেউ তাচ্ছিল্যের সুরে বিদ্রুপ মাখা মন্তব্য করতেও পিছুপা হলো না। এতসব কিছুর মাঝেও মৌরি নির্বিকার। কোন উপহাস, কোন তুচ্ছতাচ্ছিল্যই তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। মানুষটা তাকে এভাবে ঠকাতে পারল! কেন করলো এমন? কী দোষ ছিল তার? মানুষটাকে তো সে চিনতোও না। একরাশ অপ্রত্যাশিত মুগ্ধতা নিয়ে তার জীবনে এলো। নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে একটু একটু করে তার মনে জায়গা করে নিল। এখন সেই মুগ্ধতাকে তিক্ততার রূপ দিয়ে কেন চলে যাচ্ছে মানুষটা!

তাশফিন ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা হসপিটালে এসেছে। মৌরিদের বাড়ি থেকে বেরুবার পরে বাবা তার পেছন পেছন এসেছিল। তাকে শাসন করে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়েটা জোড়া লাগাতে চেয়েছিল। কিন্তু তাশফিন তো কারো কথা শুনবে না। সে তার প্রতিশোধ পূর্ণ করেছে। হসপিটালের ভেতর পা দিলেই ফিনাইলের তীব্র গন্ধ নাকে লাগে। এই গন্ধটার সাথে তাশফিন পূর্ব পরিচিত থাকলেও এর সাথে সে কোনদিনই অভ্যস্ত হতে পারেনি। এই ঘ্রাণটাই তাকে অনেক কথা মনে করিয়ে দেয়। যা তার জন্য সুখকর স্মৃতি না। এই ঘ্রাণে নিজেকেও কেমন অসুস্থ মনে হয়। লম্বা লম্বা পা ফেলে তাশফিন কাঙ্ক্ষিত সেই কামরায় চলে এলো। ভেতরে ঢোকার আগে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নিল। চোখ বন্ধ করে বড়ো করে দম নিয়ে বলল,

“প্রতিবার আসার আগে ভাবি এবারই হয়তো শেষ। কিন্তু তার পরেও আবার আসতে হয়। তাই এবার আর এটা ভাবব না। তোর যতদিন মন চায় আমাকে জ্বালাতন কর। আমি হাঁপাব না।”

ভেতরে ঢুকে বেডে শয্যারত ছোট্ট দেহটির দিকে দেখলে তাশফিনের বুকটা হাহাকার করে উঠে। আজ একুশটা দিন ধরে তার কলিজার টুকরাটা এভাবে শুয়ে আছে। তাকে সামনে দেখেও ছুটে এসে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ছে না। ভাইয়া ডেকে এটা সেটা আবদার করছে না। সে কষ্ট পাচ্ছে দেখেও একবার উঠে বলছে না, ভাইয়া তুমি কেঁদো না। তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমারও ভীষণ কান্না পায়।
তাশফিন বেডের পাশে একটা চেয়ার টেনে পিহুর মাথায় পাশে বসলো। বোনের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

“তোর প্রতিশোধ আমি নিয়ে এসেছি ছোট্ট পাখি। দেখ, তোর ভাই এখনও বর সাজেই আছে। আমার ছোট্ট পাখিটার এই অবস্থার জন্য যারা দায়ী, আমি তাদের সবাইকে সেইম কষ্টটা ভোগ করানোর ব্যবস্থা করে এসেছি। তুই একা কেন কষ্ট পাবি? সেই মানুষটারও তো সমান কষ্ট প্রাপ্য তাই না? পাবে। আজকের পর থেকে সে-ও আমার মতোই প্রতিশোধের আগুনে জ্বলবে। একমাত্র বোনের কষ্ট কোন ভাই-ই তো সহ্য করতে পারে না। কিন্তু তার হাতে প্রতিশোধ নেওয়ার কোন উপায় রাখিনি আমি।”

প্রতিশোধের আনন্দে তাশফিনের চোখ জোড়া ঝলমল করছে। বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা আগুন একটু শীতল হয়েছে।

“আমি তো আমার কথা রেখেছি। এবার তুইও তোর কথা রাখ। এভাবে শুয়ে না থেকে উঠে পড় তো। আর ভালো লাগছে না। এরকম কেউ করে? মানলাম ভুল আমার ছিল। আমি তোর খেয়াল রাখতে পারিনি। আমার উচিত ছিল এটা দেখা তুই কার সাথে মিশছিস। তুই যাকে নিজের জীবনে জায়গা দিচ্ছিস সে তোর যোগ্য কি-না এটা দেখার দায়িত্ব আমারই ছিল। দায়িত্ব পালন করিনি। তাই বলে শাস্তিটা কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে।”

তাশফিন এত কথা বলে যাচ্ছে কিন্তু তার বোনটা ভাইয়ের কোন কথা শুনছেই না। তার দিকে তাকাচ্ছেও না। পিহুর মুখের দিকে তাকিয়ে তাশফিনের চোখ জ্বালা করতে লাগল। ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। পিহুটা তাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে কেন?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে