#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_২১
#Tabassum_Kotha
” কথা এতোক্ষণ লাগলো তোর দরজা খুলতে! কি করছিলি এতোক্ষণ?”
কথা দরজা খুলে দিতেই কলি বেগম রাগী চোখে কথাটা বলেন।
— ওয়াশরুমে ছিলাম তাই দেরি হয়েছে দরজা খুলতে। আসলে গোসল টা সেরেই পড়তে বসতাম।
— তোর যে পরীক্ষা এতোটুকু গুরুত্ব কি আছে?
— এখনই পড়তে বসছি।
— শোন বিকেলে গিয়ে নিতুর কিছু কাপড় নিয়ে আসিস খান বাড়ি থেকে।
কলি বেগম চলে গেলে কথা দরজা বন্ধ করে একটা সস্তির নিশ্বাস নেয়।
একটু আগে কলি বেগম দরজায় টোকা দিলে খুব দ্রুত নীল কে উঠিয়ে ব্যালকোনি দিয়ে নিচে নামিয়ে দিয়ে দরজা খুলে দেয় কথা। দরজায় হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে উঠে কথা ছুট লাগায় ব্যালকোনির দিকে, উদ্দেশ্য নীল কে একনজর দেখা। ব্যালকোনির কার্নিশে দাড়িয়ে কথা এদিকে ওদিকে তাকায় কিন্তু নীল কে আর দেখতে পায় না। হয়তো নীল চলে গেছে!
.
ঘুম থেকে উঠে বসে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই চোখ কপালে উঠে যায় নিতুর। ঘড়িতে ৯:২৩ বেজে বসে আছে আর সে কি না এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিল! লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে দৌড় লাগায় নিতু। তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে এসে কোনোরকম নিজেকে পরিপাটি করে রান্না ঘরের দিকে ছুটে যায়।
কলি বেগম আগেই সব রান্না একা শেষ করে ফেলেছেন। কাব্য আর কিশোর সাহেব সকালে নাস্তা করে নিজেদের কাজে চলে গেছেন। যেহেতু নিতু আর কাব্য এর বিয়ে টা পারিবারিক ভাবে হয় নি, তাই কোনো রীতি নীতিই পালন করা হয় নি। নিতু কলি বেগমের সাথে কাজ করতে গেলে কলি বেগম নিতু কে কথার ঘরে পাঠিয়ে দেয় পড়ার জন্য। কারণ নিতু আর কথা দুজনেই এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী।
” ননদিনী কি পড়তে বসেছেন নাকি?”
কথার ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে কথাটা বললো নিতু।
— ভাবি জি! আসেন আসেন ননদিনীর ঘরে আসেন।
— তুই পড়ছিস! ইশ আমার কতো পড়া বাকি রে, এই বিয়ে বিয়ে করে পড়ায় মনোযোগই দিতে পারি নি এতোদিন!
— সে না হয় সব বুঝলাম। তা ভাবি জি, বাসর কেমন কাটলো! (চোখ মেরে)
— হাহ! আমার আর বাসর! হ্যাঁ রে কথা, আমার ভাই তো নিরামিষ আমি জানতাম। কিন্তু তোর ভাই আরও বড় নিরামিষ। জানিস কাল সারারাত আমাকে দিয়ে,,
— তোকে দিয়ে!!!
— যাহ পেত্নি দূর হ। তোর ভাই আমাকে দিয়ে তার পা টিপিয়েছেন।
— লে হালুয়া! এই ছিল তোর বাসর! হিহিহি। এপিক বাসর ছিল তোর। আমার ভাই পারেও বটে। হিহিহি।
— একদম দাঁত কেলাবি না বলে দিলাম।
— কেলাবো! কেলাবো! একশো বার কেলাবো!
— কেলা তুই দাঁত! আমিও দেখে নেবো তোর বাসর এ কি হয়! নীল ভাইয়াকে বলে যদি তোর বাসর এর বারোটা না বাজিয়েছি না তো আমার নাম নিতু না হুহ।
বাসর আর নীল এর কথা উঠতেই কথার হাসি মুখখানা নিমেষে মলিন হয়ে গেলো। কি ভাগ্য তার! বিয়ে তো তার হয়েছে, কিন্তু সেই বিয়ের কথা কেউ জানেই না!
— কিরে কি ভাবছিস?
— কিছু না। পড়া শুরু কর।
— হুম।
.
.
.
.
.
?
পড়ন্ত বিকেল। সূর্য পশ্চিমে হেলে পরেছে। খান বাড়ির গেইটের ভিতর ঢুকতেই কথার চোখে মুখে খুশির ঝলক ভেসে উঠে। সকাল থেকেই তার মন খারাপ ছিল। কাল রাতে আবেগের বশে নীল এর ভালোবাসায় সাড়া দিলেও এখন কথার মধ্যে অনেক অপরাধবোধ কাজ করছে। এভাবে লুকিয়ে বিয়ে করা আবার লুকিয়ে সংসার করা মোটেও ঠিক হচ্ছে না কথা আর নীল এর। আজ কথার খান বাড়িতে আসার পিছনের উদ্দেশ্য মূলত নীল এর সাথে এ ব্যাপারে খোলাখুলি কথা বলা। কথার পক্ষে আর মিথ্যে বলা সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে পুরো পরিবারকে ঠকিয়ে তারা কখনই সুখী হতে পারবে না!
.
খান বাড়ির উঠোনে নীল এর জিপ দাড় করানো দেখেই কথার ঠোঁটে হাসির রেখা ফুঁটে উঠে। নীল বাড়িতেই আছে। নীল এর সাথে কথা বলাটা সহজ হয়ে যাবে।
কথা খান বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই সবার আগে নয়নতারা বেগমের মুখোমুখী হয়।
— তুই এখানে?
— খালাম্মা আমি নিতুর মানে ভাবির কিছু জিনিসপত্র নিতে এসেছি।
— যা ওর ঘর থেকে নিয়ে নে।
— জি।
কথার যাওয়ার দিকে একনজর তাকিয়ে থেকে নয়নতারা বেগম মুনতাহার ঘরের দিকে যায়।
মুনতাহা তার ঘরে বসে মোবাইলে কিছু একটা কাজ করছিল। নয়নতারা বেগম হন্তদন্ত হয়ে সেখানে পৌঁছে মুনতাহা কে নীল এর কাছে পাঠায়। যাথে করে কথা নীল এর সাথে একা দেখা করতে না পারে। নয়নতারা বেগম খুব ভালো করেই জানেন কথা আর নীল দুজন দুজনকে ভালোবাসে, এক কথায় যেটা কে বলে প্রেমের সম্পর্কে আছে। কিন্তু নয়নতারা বেগম নীল এর বউ হিসেবে মুনতাহাকেই আনবেন, সেটা যেকোনো মূল্যেই হোক।
.
কয়েকদিন যাবত নজরুল সাহেবের শরীর টা তেমন একটা ভালো যাচ্ছে না। তার ওপর কালকে নিতু আর কাব্য এর এমন একটা কাজে নজরুল সাহেবের বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা লেগেছে। নিজের দুর্বলতা কাউকে দেখাতে চান না তিনি, কিন্তু শরীর যে আর মানছে না। ব্যবসার সব দায়িত্ব এখন ছেলেদের হাতে তুলে দিতে পারলেই সে মুক্ত। অবশ্য সে ইতোমধ্যে কিছুটা চিন্তামুক্ত আছেন। কেননা নীল এর হাতে ব্যবসার অনেকটা কাজ তুলে দিয়েছেন। নীল আগে থেকেই নজরুল সাহেবের কাজে সাহায্য করতো, যার কারণে তার কাজ আয়ত্ত করতে বেশি কষ্ট হচ্ছে না।
.
সকালে কথাদের বাড়ি থেকে আসার পর থেকে কাজ করছে নীল। বিছানায় আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিল নীল তখন মুনতাহা নীল এর ঘরে প্রবেশ করে। প্রতিদিনের মতো আজকেও মুনতানা শিফনের একটা বেগুনি রঙের শাড়ি পরে আছে। মুনতাহা তার লম্বা খোঁপা করা চুল গুলো খোঁপা থেকে খুলে পিঠে ছড়িয়ে দিলো। এমনিতেই সুন্দর সে, তার উপর থেকে আজ তার সাজসজ্জাও বেশ আবেদনময়ী।
পিঠ থেকে চুল গুলো কাঁধের উপর টেনে এনে ঠোঁটে হাসি ফুঁটিয়ে তোলে মুনতাহা নীলের উদ্দশ্যে বললো,
— সারাদিন এভাবে একা বসে থাকো কেনো নীল? আমাকে একদমই সময় দাও না তুমি!
মুনতাহার কথায় বেশ অবাক হয়ে নীল উত্তর দেয়,
— তোমাকে আমার সময় দেওয়া টা কি খুব দরকার? বাসায় কি আর কেউ নেই?
— এভাবে বলছো কেনো? আমি কি তোমার কেউ নই?
— না আসলে আমি সেটা বলি নি। আমি কাজ করছিলাম। আর বাড়িতে অনেক মানুষ আছে তোমায় সময় দেওয়ার জন্য।
মুনতাহা কিছু বলতে যাবে তার আগেই নীল এর মোবাইলটা বেজে উঠলে নীল বিছানা ছেড়ে উঠে ব্যালকোনিতে চলে যায়। মুনতাহা উঠে দরজার কাছে চলে গেলেও কিছু একটা ভেবে আবার নীলের ঘরে ফিরে আসে। নীল ফোনে কথা শেষ করে ব্যালকোনি দিয়ে ঘরের ভিতর প্রবেশ করছিল, ঠিক তখনই মুনতাহা একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে নীলের সাথে ধাক্কা খায়। আচমকা ধাক্কা লাগাতে নীল টাল সামলাতে না পেরে মুনতাহাকে নিয়েই পরে যায়। পাশে বিছানা থাকায় তারা দুজনেই বিছানার উপর পরে।
.
নিতুর কাপড় চোপড় গুছিয়ে রেখে কথা নীল এর ঘরের দিকে পা বাড়ায়। আজ নীল কে যেভাবেই হোক সে রাজি করাবে বাড়িতে সবাইকে তাদের বিয়ের কথা বলে দেওয়ার জন্য। এক হিসেবে এভাবে এসে সে নীল কে সারপ্রাইজও দিয়ে দেবে। হঠাত করে কথাকে দেখে নীল কিভাবে রিয়েক্ট করবে,, ভাবতে ভাবতে নীল এর ঘরে ঢুকে পরে কথা। যেহেতু ঘরের দরজা খোলাই ছিল সেহেতু নক করার প্রয়োজন মনে করে নি সে।
নীল এর ঘরের ভিতর ঢুকতেই কথার হাসি মুখটায় মুহূর্তেই অন্ধকার নেমে আসে। নীল কে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এসেছিল সে এখানে। উল্টো তার জন্য এখানে এতোবড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে সেটা কে জানতো! কথা বাকরুদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে নীল এর দরজার সামনে আর তার ঠিক সামনে মুনতাহার বুকের উপর শুয়ে আছে নীল!
.
নীলকে মুনতাহার বুকের উপর দেখার আগে হয়তো অন্ধ হয়ে যাওয়া ভালো হতো আমার জন্য। নিজের স্বামীকে অন্যের বুকে সহ্য করার ক্ষমতা কোনো মেয়ে থাকে না। কথারও নেই সেই ক্ষমতা। কথার পায়ের নিচ থেকে ধীরে ধীরে মনে হচ্ছে মাটি সরে যাচ্ছে। দুচোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পরছে তার। এই দৃশ্য কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে।
নীল নিজেকে সামলে মুনতাহার উপর থেকে উঠতে গেলে মুনতাহা নীল এর হাত চেপে ধরে। মুনতাহার ব্যবহারে নীল বেশ অবাক হয়। এরকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার উপর থেকে মুনতাহার এমন ব্যবহার! প্রচন্ড রাগ হচ্ছে নীল এর।
” হাত ছাড়ো মুনতাহা!”
রাগ নিয়ন্ত্রণ করে দাঁতে দাঁত চেপে মুনতাহাকে কথাটা বললো নীল।
নীল এর রাগী মুখ দেখে মুনতাহা অনেকটা ঘাবড়ে যায়। নীল নিজের হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাড়ায়। নীল উঠে দাড়াতেই দরজার সামনে কথাকে দেখতে পায়। মুনতাহা বিছানা ছেড়ে উঠে শাড়ি ঠিক করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
” কথা তুই যা ভাবছিস একদম তা নয়। আমি ঘরে ঢুকছিলাম তখন মুনতাহা এসে ধাক্কা লাগলো আর আমরা,,,”
নীল বলতে নিলেও নীলকে থামিয়ে দিয়ে কথা বলতে শুরু করে।
— আর কিছু শুনতে চাই না। ভাবাভাবির তো কোনো প্রশ্নই আসে না। যা দেখার নিজের চোখেই তো দেখে নিলাম।
— আমার কথাটা শোন প্লিজ।
— কি কথা শুনবো? এটাই তাহলে সত্যি! এতোদিন হয়ে গেছে বিয়ে করেছেন তারপরেও কাউকে বলেন নি! কারণ আপনি মুনতাহাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন।
— কথা তুই ভুল বুঝছিস।
— আমি হয়তো এখনই সঠিক বুঝেছি। মুনতাহার রূপ আপনাকে বশ করে নিয়েছে এইতো! মুনতাহাকে বিয়ে করবেন, আর আমি? আমি কে আপনার? আমার পরিচয় কাউকে দিতে পারবেন না? কারণ সবার চোখে আপনার স্ত্রী হবে মুনতাহা। আর আমি? আমি কি আপনার রক্ষিতা হয়ে থাকবো?
— ছিঃ কথা! এসব কি বলছিস! আমাকে বোঝানোর সুযোগটা তো দে একবার।
— কি বোঝাবেন? বলুন কি বুঝাবেন আপনি আমাকে? কি মনে করেন নিজেকে আপনি? আর আমাকেই বা কি মনে করেন? আমাকে কি পুতুল মনে হয় আপনার? যখন যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে খেলছেন। আমি যে রক্ত মাংসে গড়া মানুষ সেটা কি আপনি ভুলে গেছেন? আপনি কাউকে না জানিয়ে আমাকে বিয়ে করেছেন, আমি আপনার এক কথায় রাজী হয়েছিলাম। কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি। বিয়ে করার এতোদিন পরেও আপনি কাউকে জানান নি। আমি সেটাও মেনে নিয়েছি। কাল রাতে আমার এতো কাছে এসেছেন সেটাও মেনে নিয়েছি,, ভেবেছিলাম সবকিছু আপনার ভালোবাসা ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সবটাই আমার ভুল ধারণা ছিল। সবটাই আপনার নাটক ছিল। আমাকে রক্ষিতা বানিয়ে রেখে মুনতাহাকে বউ বানাতে চান তো! কিন্তু সেই স্বপ্ন আপনার কখনও পূরণ হবে না। আপনি মুনতাহা কে ভালোবাসেন ভালো,, খুব ভালো। থাকেন মুনতাহাকে নিয়ে। আমিই আপনাদের মাঝ থেকে সরে যাবো।
কথার এমন পাগলের মতো বকা প্রলাপে নীল রেগে গিয়ে ঠাস্ করে একটা থাপ্পড় মেরে বসে কথার গালে। থাপ্পড়টা এতোটাই জোরে ছিল যে কথার ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে এসেছে। নীল কথাকে সোজা করে নীল এর দিকে ঘুরিয়ে কথার মুখ তার দুহাতের আজলে নিয়ে নেয়।
— আই এম সরি কথা। প্লিজ ক্ষমা করে দে আমাকে। আমি এভাবে তোর গায়ে হাত তুলতে চাই নি। কিন্তু তুই আমার কথাটা শোন। মুনতাহার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি শুধু তোকেই ভালোবাসি। নিজের থেকেও অনেক বেশি অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি তোকে। বিশ্বাস কর!!
চলবে,,