শ্রাবণের মেঘ পর্ব_১৬

0
1406

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_১৬
#Tabassum_Kotha

??

সকালের মিষ্টি এক ফালি রোদ ব্যালকোনির কাঁচ ভেদ করে কথার চোখে মুখে এসে পরেছে। সামনের ছোট চুল গুলো এলোমেলো ভাবে চোখে মুখে এসে পরেছে। নীল মুগ্ধ দৃষ্টিতে কথার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে রোদ পড়াতে কথার সৌন্দর্য যেনো আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। কথার এই এলো চুলের সৌন্দর্য যেকোনো অপ্সরীকে হার মানাতে বাধ্য। কথার বাচ্চামোগুলো নীল কে খুব করে টানে তার দিকে। তাই তো এই পাগলির প্রেমে পাগল হয়ে বসে আছে সে। কথার চোখের উপর থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু খায় নীল। আলতো করে কথার ঠোঁট জোড়ায় ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে ব্যালকোনি টপকে নিচে নেমে যায়।

ঘুম থেকে উঠে আড়মোরা ভেঙে উঠে বসতেই বিছানার অপর পাশে ফিরলাম। পাশে তো নীল নেই, গায়ে থেকে চাদরটা সরিয়ে ওয়াশরুমের দরজা খুলেও নীল কে পেলাম না। খানিকটা হতাশ হয়ে বিছানার সামনে আসতেই বেড সাইড টেবিলে রাখা নোট প্যাডের দিকে নজর পরলো। গুটি গুটি অক্ষরে দুটো লাইন লেখা আছে।

” আমি চলে যাচ্ছি, ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসবি। একদম টাইম ওয়েষ্ট করবি না। চাচা হয়তো তোকে আর কোচিং এ আসতে দেবে না।”

নোট টা হাতে পেয়ে আমার কেমন রিয়েক্ট করা উচিত জানি না। নীল চলে গেছে ভাবতেই বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যথা করে উঠলো। কেমন পরিস্থিতিতে পরেছি, বিয়ে হয়েছে অথচ স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় দেওয়ার অধিকার নেই!!









সময় আপন গতিতেই চলে যায়,, মাঝে কেটে গেছে দুই দিন। এই দুইদিনে অনেক কিছু ঘটে গেছে। আতিকা ফুপি আব্বুকে নিয়ে খান বাড়িতে নিতু আর আদনান ভাইয়ার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। দেখা স্বাক্ষাতের পর তারা আদনান ভাইয়াকে পছন্দ করে বিয়েও পাকা করে ফেলেছেন। আদনান ভাইয়া অবশ্য প্রথম প্রথম বিয়েতে অমত দেখিয়েছিলেন। কিন্তু আতিকা ফুপির জেদের সামনে তাকে হার মানতেই হয়েছে। আব্বুও বিষয়টা সহজ ভাবে মেনে নিয়েছেন। আদনান ভাইয়ার ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে যেতে হবে খুব তাড়াতাড়ি যার জন্য নিতু আর তার বিয়ে সামনে সপ্তাহেই ঠিক করা হয়েছে। সবাই সবার মতো চলছে। মাঝখান থেকে আমার আর নীল এর দেখা করা বন্ধ হয়ে গেছে। আব্বু এই দুই দিনে একবারের জন্যও আমাকে বাসা থেকে বেরুতে দেন নি।

প্রথম দুই রাত নীল লুকিয়ে এলেও কালকে আসতে পারেন নি। ফোনেই টুকি টাকি কথা হয় উনার সাথে। সেটাও আবার লুকিয়ে।

খান বাড়িতে কাজের ধুম পরে গেছে। এই অল্প কয়েকদিন আগে এক মেয়ের বিয়ে করিয়েছেন নজরুল খান। মাস ঘুরতেই ছোট মেয়েরও বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ব্যস্ততা যেনো রাখার জায়গা নেই তার। নয়নতারা বেগম খুব করে চেয়েছিলেন আগে নীল আর মুনতাহার বিয়ে করাবেন। কিন্তু নিতুর বিয়ে স্বয়ং নজরুল খান ঠিক করেছেন। স্বামীর মুখের উপর কথা বলার সাহস তার নেই। তাই তো না চাইতেও কথার ফুফাতো ভাইয়ের সাথে নিজের মেয়ে বিয়ে দিচ্ছেন। নয়নতারা বেগমের ধারণা, কথা আর নীল এর সম্পর্কে খান বাড়িতে একমাত্র তিনিই সব জানেন। আর তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন যাতে অন্য কেউ এই ব্যাপারে টের না পায়। আদনান শিক্ষিত, ভদ্র ঘরের ছেলে, ভালো ব্যাবসা করে। সব দিক বিবেচনা করেই আতিকা বেগমের এমন হুট করে বিয়ে করানোর প্রস্তাবে রাজী হয়েছেন নজরুল খান।

আদনান আর নিতুর বিয়ে নিয়ে বাকি সবাই খুশি থাকলেও খুশি হতে পারছে না নিতু। এভাবে হুট করে তার বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে সে ভাবতেই পারে নি। নয়নতারা বেগমের ঘরের সামনে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে নিতু।

— নিতু! ওখানে দাড়িয়ে আছিস কেনো? আয় ভিতরে আয়, দেখে যা তোর বাবা কতো গয়না কিনেছে তোর জন্য! (নয়নতারা বেগম)

— মা! এভাবে হুট করে বিয়ে টা না করলে হয় না!

— কি বলছিস এসব? তোর বাবা বিয়ে ঠিক করেছেন। এখানে মানা করার প্রশ্নই আসে না।

— আসলে মা।

— কি হয়েছে বলতো!

— আমি বিয়ে করতে চাই না মা!

— নিতু! আমার দিকে তাকা। তুই বিয়ে করতে চাস না নাকি আদনান কে বিয়ে করতে চাস না? কোনটা?

— মা আমার একটা আবদার রাখা যায় না? আমি এই বিয়ে করতে চাই না!

— কারণ টা জানার অধিকার কি আমার আছে?

— এভাবে বলো না মা! আমি বুঝতে পারি নি এভাবে বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে। আমি বিয়ে করতে চাই না।

— কারণ জানতে চাইছি নিতু! আদনানকে পছন্দ নয়? কোনো খারাপি আছে আদনানের?

— আদনানের কোনো দোষ নেই। দোষ আমার। আমি ভালোবেসে ফেলেছি।

নিতুর কথায় যেনো নয়নতারা বেগমের মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো। তার নিজের মেয়ের মুখ থেকে তার এই কথা শুনতে হবে, তা সে স্বপ্নেও ভাবে নি।

— কিহ! কি বললি তুই?
নয়নতারা বেগম দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজা ভিতর থেকে আটকে দিলেন যাতে কেউ কিছু শুনতে না পারে।

— কি বললি তুই? শেষমেষ আমাকে এই দিন দেখালি তুই? বল ছেলেটা কে? কতোদিনের সম্পর্ক চলছে?

— মা বিশ্বাস করো, আমার কোনো সম্পর্ক নেই। সেই মানুষটা তো জানেই না আমি তাকে ভালোবাসি। শুধু এটুকুই জানি আমি এক তরফা তাকে ভালোবাসি।

— পাগলের মতো কথা বলিস না নিতু। ছেলেটা কে সোজাসুজি বল।

— কিশোর চাচার ছেলে, নীল ভাইয়ার বন্ধু কাব্য ভাইয়া!

কথাটা নিতুর মুখ থেকে বের হতে সময় লাগলেও নিতুর গালে ঠাস্ করে একটা থাপ্পড় মারতে সময় নেয় নি নয়নতারা বেগম।

— ওরে মুখপুড়ি শেষ পর্যন্ত এই দিন দেখালি আমাকে। বিয়ের পাঁচ দিন আগে বলছিস অন্য একজন কে ভালোবাসিস। তাও আবার এমন একজনকে যে কি না জানেও না তুই তাকে ভালোবাসিস।

— মা তুমি কিছু একটা করো। আমি আদনান কে বিয়ে করতে পারবো না। আমি সত্যি কাব্যকে ভীষণ ভালোবাসি। অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।

— চুপ কর মুখপুড়ি। লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছিস! লজ্জা করছে না এসব কথা মুখে আনতে।

— তুমি কি সারাজীবন আমার কষ্ট সহ্য করতে পারবে? আমি তো কখনই অন্য কারো সাথে সুখী হতে পারবো না! মনে কাব্য এর নামের ভালোবাসা নিয়ে অন্যকারো সংসার কিভাবে করবো আমি!

— ছিঃ! ভাবতেই গা ঘিনঘিন করছে তোকে আমি পেটে ধরেছি। মায়ের সামনে এসব কথা বলার আগে গলায় দড়ি দিলি না কেনো?

কাব্য এর বিষয় নিয়ে নয়নতারা বেগম আর নিতুর মধ্যে বেশকিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হলেও নয়নতারা বেগম বিয়ে ভাঙার ব্যাপারে রাজি হন না। নয়নতারা বেগম বিয়ে ভাঙতে চাইলেও তেমন কোনো লাভ হবে না সেটা সে ভালো করেই জানে। খান বাড়িতে নজরুল খানের কথাই শেষ কথা।

নিতু কান্না করতে করতে নিজের ঘরে এসে বালিশে মুখ গুজে দিলো। ছোট বেলা থেকেই কাব্য কে চিনে সে, নীল এর সাথে তাদের বাড়িতে আসতো কাব্য। যখন থেকে বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই কাব্য এর প্রতি অনুভূতি জন্ম নিয়েছে তার মনে। সময়ের সাথে সাথে সেই অনুভূতিটাকে সে ভালোবাসার নাম দিয়েছে। মুখ ফুঁটে কখনও বলতে না পারলেও অন্যকাউকে মনে জায়গা দেওয়া সম্ভব না তার পক্ষে।

?

?

সারাদিনের ব্যস্ততায় নীল আর কথার একবারও কথা হয় নি। আদনানের বাবা নেই যার জন্য ছেলে পক্ষের সব কাজ কিশোর সাহেব আর কাব্য এর কাঁধেই পরেছে। কিশোর সাহেব যদিও বিয়েতে খুশি নন তবুও বড় বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে মুখে কৃত্তিম হাসি ফুঁটিয়ে সব কাজ করে যাচ্ছেন।
.
.
.
.
.
.
.

রাত প্রায় নয়টার বেশি, কথাদের বাসায় সবাই খাওয়া দাওয়া শেষে যার যার ঘরে চলে গেছে। আদনান খুব জরুরি কাজে চট্টগ্রামে গেছে, যদিও পরদিন চলে আসবে। কাব্য তার ঘরের দরজা ভিতর থেকে আটকে লাইট বন্ধ করে রেখেছে। ভরা পূর্ণিমার রাত, চাঁদের আলোয় পৃথিবী মেখে আছে। সেই চাঁদের আলোই কাব্য এর ঘরের ব্যালকোনির কাঁচ ভেদ করে ঘরে এসে পরেছে। বিছানার পাশের পড়ার টেবিলে রাখা ডায়েরি টা থেকে একটা ছবি বের করে হাতে নিয়ে কাঁচের বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে কাব্য। ছবিটার দিকে না তাকিয়েই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো কাব্য এর। তার না হওয়া বউ এর ছবি এটা। তানিয়ার ছবি! এক বছর আগে তায়েবা আপুর মেয়ে রাইসার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে লুকিয়ে ছবিটা তুলেছিল সে। ছবিটা তুলার পর থেকে কতো হাজার বার দেখেছে আর কতো কথা বলেছে ছবিটার সাথে তার হিসেব রাখা হয় নি। অবশ্য সে চাইলেও সে হিসাব রাখতে পারতো না,, অগনিত বার সে তার প্রিয়তমার ছবি দেখেছে। তার না হওয়া বউ, তার প্রিয়তমা, তার ভালোবাসা,,, এখন অন্য কারো বুকে মাথা রেখে সুখ খুঁজে!!!

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে