#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_১৪
#Tabassum_Kotha
রাতের অন্ধকার ভেদ করে সূর্য তার আলো দেওয়ার দায়িত্ব শুরু করেছে অনেকক্ষণ হয়েছে। সরু রাস্তার দুই ধারে স্থির দাড়িয়ে থাকা গাছ গুলোর ছায়া পিছনে ফেলে ছুটে চলছে নীল এর জিপ। জিপ এ অবশ্য কথাও আছে নীল এর সাথে। কাল রাতে মুনতাহা আর নীল এর বিয়ের কথা জানার পরপরই কিছু হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে নীল। সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়িত করার জন্যই তারা ছুঁটে চলছে। যদিও এই সিদ্ধান্ত তাদের ভাগ্যে সুখ আনবে নাকি কষ্ট সেই ধারণা এখনও নীল এর হয় নি। কিন্তু এই মুহূর্তে তার এই সিদ্ধান্তই সঠিক।
সারারাত চিন্তায় ঘুমাতে না পারায় ক্লান্তিতে গাড়িতেই চোখ লেগে গিয়েছিল কথার। হঠাত গাড়িতে ব্রেক কষায় আঁতকে উঠে কথা।
নিজেকে সামলে চোখ খুলতেই চোখ কপালে উঠে গেলো আমার। নীল জিপ থেকে নেমে দাড়িয়ে আছেন। আর সামনে বড় বড় অক্ষরে লেখা “কাজী অফিস!” কাজী অফিসের নাম দেখেই বড় সড় একটা ঢোক গিললাম। জানি না কেনো কপাল বেয়ে চিকন ঘাম দিচ্ছে। কি হতে চলছে আমার সাথে!
— এখনও বসে আছিস! নাম জলদি। আমাদের সিরিয়াল এসে পরেছে হয়তো এতোক্ষণে!
— অ্যা কিসের সিরিয়াল?।
— আমাদের বিয়ের। আমার বন্ধুরা সব কিছু রেডি করে ফেলেছে এখন শুধু আমরা গিয়ে কাবিননামায় সিগনেচার করবো আর কবুল পড়বো। চল।
— কি বলছো! বিয়ে তাও আবার এমন হুট করে! সে কি করে সম্ভব?
— হুট করে না আমি সারা রাত চিন্তা করেছি।
— পাগল হয়েছো? আব্বু আম্মু ভাইয়া তোমার পরিবার, কেউই তো জানে না। কিভাবে আমরা বিয়ের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ কারো অনুমতি ছাড়াই করতে পারি?
— অনুমতির অপেক্ষা করে তোকে হারাতে পারবো না আমি। তুই কি চাইছিস যে আমি সবার অনুমতির অপেক্ষা করি আর এদিকে কিশোর চাচা তোর বিয়ে করিয়ে দেন!
— আমরা সবাইকে রাজী করাতে পারি!
— তুই কি চাচা কে চিনিস না? সে কি কখনও মেনে নেবে আমাকে জামাই হিসেবে কখনও!
— কেনো মানবে না? আমরা বোঝাবো!
— চেষ্টা তো করেছিলি, কি লাভ পেলি? আজকে তো তোকে কোচিং এ ও আসতে দেয় নি। পালিয়ে এসেছিস।
— তবুও এভাবে একা একা বিয়ে করা টা ঠিক হবে না।
— তুই কি চাস আমাদের ভালোবাসা এভাবেই হারিয়ে যাক!
”
”
”
”
”
”
”
”
”
”
”
”
”
”
দুচোখ ভর্তি পানি আর মনে অনুশোচনা নিয়ে কাবিন নামায় স্বাক্ষর করে দিলাম। সন্তান হিসেবে আজ হয়তো সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজটাই আমি করলাম। কিন্তু সত্যি আমি নিরুপায়। নীল কে হারিয়ে বেঁচে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আব্বু কখনও নীল কে মেনে নিবেন না এটাও আমি জানি। আমাকে ক্ষমা করে দিও আব্বু আম্মু। প্রতিবারের মতো এবারও তোমাদের সাথে আমি অন্যায় করলাম। একটা নতুন সম্পর্কের লোভে পরে আমি আমার রক্তের সম্পর্কের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলাম। আব্বু আম্মু আমাকে কখনও ক্ষমা করবেন না।
যেই নীল কে আমি আমার প্রতিটি নিশ্বাসে স্বামী হিসেবে চেয়েছি তাকে আজ স্বামী হিসেবে পেয়েও আমি খুশী হতে পারছি না। বাবা মা কে কষ্ট দিয়ে সুখী হওয়া যায় না। হয়তো এই কারণেই আমার জীবনের চরম কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে পেয়েও আমি খুশি নই।
কাজী অফিসের বারান্দায় দাড়িয়ে আছি কাবিন নামা টা হাতে নিয়ে। এক টুকরো কাগজের ভিত্তিতে নীল আর আমি স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলাম। খুব মনোযোগ সহকারে খুটে খুটে দেখছি কাবিন নামা টা। নীল এর নামের সাথে কথার নাম জুড়ে আছে। অবশেষে এই কথা তার নীল এর হয়েই গেলো! দেনমোহর এক লক্ষ্য এক টাকা ধারণ করেছে নীল। খান বাড়ির ছেলের কাছে এক লক্ষ্য টাকা খুবই সামান্য। কিন্তু আমার কাছে এই এক লাখ টাকা এক কোটি টাকা কেও হার মানাবে।
অবশেষে আমি আমার ভালোবাসা কে পেলাম। বারান্দায় রাখা বেঞ্চিতে বসে পরলাম। নীল তার বন্ধুদের সাথে কোনো একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করছেন। আমার বিয়ে হয়ে গেছে, আমি এখন নীল এর বউ ভাবতেই কেমন গা সুরসুরি দিয়ে উঠছে। সেই সাথে ভয়ও করছে। যখন নীল আমাকে নিয়ে খান বাড়ি যাবেন তখন সবাই আমাদের মেনে নেবে তো? নাকি আমাদের তাড়িয়ে দেবে? আমাদ আব্বু তো কখনই মানবে না। তবুও আমি দৌড়ে গিয়ে আব্বুর পায়ের উপর পরে যাবো। ততোক্ষণ ছাড়বো না যতোক্ষণ না ক্ষমা করছেন। আচ্ছা আমি যতোটা সহজ ভাবছি আদৌ কি পরিস্থিতি ততোটা সহজ হবে?
” কথা!” — নীল এর ডাকে কথার ভাবনার ঘোর কাটে।
— কি ভাবছিস? সারাদিন কি এখানেই বসে থাকবি নাকি? চল বাসায় চল।
— সব কাজ হয়ে গেছে?
— হ্যাঁ এখানের সব কাজ শেষ। এখন বাসায় যাবো চল।
বেঞ্চি থেকে উঠে দাড়িয়ে নীল এর দিকে হাঁটা ধরলাম। আজ নীল এর দিকে তাকাতে বেশ লজ্জা লাগছে আমার। যদিও লাল বেনারসি পরি নি তবুও বউ বউ ফিলিং আসছে। মনে হচ্ছে গাল দুটো ফুল গেছে লজ্জায়। না না নীল এর সামনে এভাবে গেলে নিশ্চিত পচানি দেবে। কুল কথা কুল। নিজেকে নরমাল কর।
জিপে উঠে বসলাম। নীল এর দিকে তাকাতে পারছি না লজ্জায়। নতুন বউ হলেই বুঝি সব চেঞ্জ হয়ে যায়! এই কি সেই নীল যাকে কালকেও আমি জরিয়ে ধরেছিলাম! এসব কিছুই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল কিন্তু পরক্ষণেই আবার আব্বু আম্মুর কথা মনে পরলো। কতো বড় জঘন্য একটা কাজ করেছি আমি। তারা কি আমাকে কখনও ক্ষমা করবেন?
ভেবেছিলাম নীল আমাকে প্রথমে খান বাড়িতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু আমাকে বেশ অবাক করে দিয়ে আমার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে চৌরাস্তার মোড়ে জিপ থামালেন। আরও বেশি অবাক হলাম।যখন নীল আমাকে জিপ থেকে নেমে বাসায় যেতে বললেন। প্রথমে ভাবলাম হয়তো সেও সাথে যাবেন কিন্তু এবার আমাকে অবাকে শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়ে উনি আবার জিপে উঠে পরলেন।
— আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
— বাসায় যাচ্ছি। কেনো?
— আমাকে একা রেখে চলে যাচ্ছেন যে? আবার কি নিতে আসবেন?
— আবার নিতে কেনো আসবো? তুই তোর বাড়ি যাবি আমি আমার বাড়ি যাবো। এমনিতেও তোর পরীক্ষার বেশি দিন বাকি নেই। বাসায় গিয়ে সোজা পড়তে বসবি।
নীল এর কথায় আমি হ্যাবলা কান্তের মতো উনার দিকে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে ডেট ওভার গঞ্জিকা সেবনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে উনার মধ্যে। একটু আগে বিয়ে করে এখন বলছে তুই তোর বাড়ি যা আমি আমার বাড়ি যাবো!!
— আপনি এসব কি বলছেন? আপনি না আমাকে একটু আগে বিয়ে করলেন? এখন এসব কি বলছেন!
— বিয়ে করেছি বলেই তো অর্ডার দিচ্ছি যে গিয়েই পড়তে বসবি।
— আমি তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারছি না। আমাদের বিয়ে হয়েছে, এখন তো তুমি আমাকে তোমার সাথে তোমার বাড়িতে নিয়ে যাবে তাই না?
— না। এখন আমি তোকে আমার বউ হিসেবে খান বাড়িতে নেবো না। আমি এখন তোকে বিয়ে করেছি শুধু তোর বিয়ে আটকানোর জন্য। আমার বাড়ির কাউকে তোর আর আমার কথা বলা হয় নি, এছাড়াও আমি এখনও কোনো কাজ করি না। হুট করেই তোকে নিয়ে বাড়িতে উঠলে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেবেন।
— তোমার কি মাথা ঠিক আছে? তুমি নিজে বুঝতে পারছো তুমি কি বলছো? তুমি আমাকে বিয়ে করেছো কিন্তু তোমার বাড়িতে নিতে পারবে না। এটা কেমন কথা নীল? যদি দায়িত্বই নিতে না পারো তাহলে এভাবে হুট করে বিয়ে করলে কেনো? নিজে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছো কিন্তু আমার জীবনের সাথে ঠিকই খেলতে পারলে। কেনো এসব কথা তোমার বিয়ে করার আগে মনে পরে নি? কি ভেবে করলে বিয়েটা? উত্তর দাও!
— তোকে হারাতে চাই নি। এজন্যই ঠিক বেঠিক সব ভুলে আগে নিজের করে নিলাম। এখন আস্তে আস্তে সব ঝামেলা সামাল দেবো।
— ঝামেলা সামাল দেওয়ার কথা তো পরে আসবে। তুমি ঝামেলা আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছো।
নীল এর বোকামি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না আমি। ভীষণ রাগ হচ্ছে। রাগ করে নীল এর সামনে থেকে চলে এলাম। পিছন থেকে উনি অনেক বার ডেকেছেন কিন্তু আমি সাড়া দেই নি। কি সাড়া দেবো! বিয়ে করেছে কিন্তু সবার সামনে স্বীকার করার সাহসটুকু তার নেই। আসলে ভুল টা আমার। এমন একজন মেরুদন্ডহীন মানুষকে ভালোবেসেছি, বিশ্বাস করে বিয়ের মতো এতো বড় একটা ডিসিশন নিয়ে ফেললাম হুট করে। এখন মনে হচ্ছে নীল এর কথামতো তাকে বিয়ে করে ভুল করেছি।
?
?
ভীষণ বিরক্তি আর অপরাধবোধ নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। ভিতরে ঢুকতেই আতিকা ফুপি আম্মু আর নিতু কে একসাথে বসে থাকতে দেখলাম। আমি বাড়িতে না থাকলে সাধারণত নিতু আসে না। তবে আজ হঠাত কি মনে করে। আর ফুপি আম্মুই বা কখন এলেন? তবে কি সে আমার আর আদনান ভাইয়ার বিয়ে ঠিক করতে এসেছেন? বুকে এতো জোরে জোরে ধুকপুকানি হচ্ছে মনে হয় সেই শব্দ বাইরের মানুষও শুনতে পারবে। একটু আগেই তো বিয়ে করে এলাম এখন আবার বিয়ের কথা চলবে। ইয়া খোদা আমার এই প্যাড়া আর ভালো লাগে না। দড়ি ফালাও আমি উপরে উঠে যাই!!
— কথা বাইরে দাড়িয়ে আছিস কেনো? এতোদিন পর আমি এসেছি তবুও কাছে আসছিস না যে! (আতিকা ফুপি)
— না আসলে হঠাত আপনাকে দেখেছি তো তাই সারপ্রাইজ্ড হয়েছি।
— আয় বস আমার কাছে।
ফুপি আম্মুর কাছে গিয়ে বসে পরলাম। নিতুও তার সাথেই বসে আছে। নিতুর এখানে থাকার কারণ টা এখনও স্পষ্ট হয় নি আমার কাছে। আম্মু খাবার টেবিলে খাবার সাজাচ্ছেন আর কটমট করে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। ভাগ্যিস ফুপি আম্মু ছিল, নয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এখনই বেঁধে যেতো।
ফুপি আম্মুর সাথে কুশলাদি বিনিময় শেষে আমি আর নিতু আমার ঘরে চলে এলাম। নিতুর সাথে কথা বলে যেটুকু জানতে পারলাম তা হলো, ফুপি আম্মু আমাদের বাড়ি আসার পথে এক্সিডেন্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। আর তাকে বাঁচিয়েছে নিতু। নিতুই তাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে এসেছে আর এতোক্ষণ তারা দুজন গল্প করছিল।
— তোর কি কিছু হয়েছে কথা?
— কই না তো!
— আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে তুই একটু টেনশনে আছিস।
— না না তেমন কিছুই না। তুই তাহলে বাড়ি যা, পড়তে হবে তো।
— হুম। ভালো মতো পড়িস।
কি মনে করে নিতুর কাছে থেকে আমার আর নীল এর বিয়ের কথাটা লুকালাম জানি না। মনের মধ্যে ভীষণ অপরাধবোধ কাজ করছে। মনে হচ্ছে বিয়ের কথাটা জানতে পারলে আব্বু আম্মুর মতো নিতুও আমাকে ঘৃণা করবে।
?
শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে আছি চোখ বন্ধ করে। সকাল থেকে অনেক কিছু ঘটে গেছে আমার জীবনে। কালকে পর্যন্ত আমি সাধারণ একটা মেয়ে ছিলাম যে কি না একটা যমরাজের প্রেমে পাগল ছিল। আজ আমি সেই যমরাজের বিবাহিতা স্ত্রী কিন্তু সে কথা কাউকে বলতে পারছি না! কি ভাগ্য আমার!!
অজান্তেই একটা ম্লান হাসি ফুঁটে উঠলো কথার ঠোঁটে।
বেশ লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হতেই আম্মু হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে গেলো।
— তোর হয়েছে টা কি বলতো কথা! সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিলি?
— ককোই কোথাও না তো। একটু কলেজে গিয়েছিলাম। সামনে পরীক্ষা কতো কাজ বাকি।
— তোর ফুপি আম্মুকে আজকে এক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচিয়েছে নিতু।
— হ্যাঁ নিতু বলেছে।
— আতিকা আপা যে আদনানের জন্য নিতুকে পছন্দ করেছে এটা বলে নি তোকে?
— কিহ! আদনান ভাইয়ার জন্য নিতুকে পছন্দ করেছে মানে?
— হ্যাঁ আসলে তোর আব্বু শুধু তোর ফুপিকে আসতে বলেছিল। আদনান আর তোর বিয়ের কথা বলে নি। তোদের বিষয়ে কথা বলার আগেই আতিকা আপা নিতুকে পছন্দ করে ফেলেছে। এমনিতেও নিতু অনেক ভালো মেয়ে। ছোট বেলা থেকে আমার সামনেই বড় হয়েছে। তাই আমি আপা কে বলেছি যে আদনানের জন্য একদম ঠিক আছে নিতু।
— আম্মু তুমি কি বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
— বুঝবি কি করে মাথায় তো শুধু গোবর ভরা। নিতু আর আদনানের বিয়ে টা হয়ে গেলে তোর আর নীল এর রাস্তা অনেকটা ক্লিয়ার।
— আম্মু তুমি সত্যি বলছো? তুমি আমার আর নীল এর সম্পর্ক মেনে নিয়েছো?
— না মানার কি আছে। তোরা একে অপরকে ভালোবাসিস। কিন্তু তোর বাবা কে রাজি করানো না অনেক কষ্টকর হবে।
চলবে…