#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_১০
#Tabassum_Kotha
“এই যে মিস উঠে পড়ো। মাঝ রাস্তায় আর কতোক্ষণ বসে থাকবা? তোমার একার জন্য সব গাড়ি ব্লক হয়ে আছে।” — গাড়ি থেকে অত্যন্ত সুদর্শন একজন পুরুষ বেরিয়ে এসে উপুর হয়ে বসে কথার দিকে হাত বারিয়ে দেয়।
লোকটার কথায় কথার ধ্যান ভাঙে। মাথা উঁচু করে তাকাতেই দেখে লোকটা এখনও কথার দিকে হাত বারিয়ে বসে আছে আগের ভঙ্গিতে। লোকটার হাত সরিয়ে কথা নিজেই উঠে দাড়ায়।
— মিস ক্যান ইউ হেল্প মি?
— জি বলুন।
— কিশোর রহমানের বাড়ি কোথায়?
— কিশোর রহমান আপনার কি লাগে?
— আমার মামা হয় তিনি। আসলে আমি এব্রোড ছিলাম ছোট থেকে তাই কিছুই চিনি না।
লোকটা তাহলে আতিকা ফুপি আম্মুর ছেলে!
— আপনার নাম কি আদনান?
— হাউ ডু ইউ নো? ডো ইউ নো মি?
— না। তবে আপনার আম্মুকে চিনি। সামনের বাড়িটাই কিশোর রহমানের বাড়ি।
— হেই মিস হু আর ইউ?
— কেউ না।
— মিস কেউ না!
কথা তাদের বাড়ির পিছনের রাস্তা ধরে বাড়িতে চলে যায় আর আদনান গাড়ি নিয়ে কিশোর রহমানের বাড়ি যায়।
‘
‘
‘
দরজায় কলিং বেল দিতেই কলি বেগম দরজা খুলে দেয়। কলি বেগম আর আদনানের এর আগেও ভিডিও কলে অনেকবার কথা হয়েছে, তাই কলি বেগমের আদনানকে চিনতে সময় লাগে নি। দুজনের কুশলাদি বিনিময় শেষে কলি বেগম আদনান কে কাব্যর ঘরে থাকতে দিয়ে রান্নার জন্য চলে যায়।
?
শাওয়ারের নিচে বসে কান্না করছে কথা। তানিয়ার বলা কথাগুলো কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে। তানিয়ার বলা একটা কথা যেনো তার পুরো দুনিয়া উলোট পালট করে দিচ্ছে।
” সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। কিছু কিছু অসম্পূর্ণ ভালোবাসার কাহিনী সময়ের পাতায় চাপা পরে যায়।”
নীল এর প্রতি তার ভালোবাসাকে সে কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেবে না। কিছু কিছু ভালোবাসা সময়ের গর্ভে বিলীন হলেও নীল কথার ভালোবাসা পৃর্ণতা পাবে। নীল তার ভুল বুঝতে পেরেছে। এখন আর কথা নীল কে নিজের থেকে দূর করবে না।
বুকের বা পাশে ভীষণ যন্ত্রণা করছে তার। নীল কে কি ক্ষমা করা যায় না? সব কিছু ভুলে নীলের ভালোবাসায় ধরা দেওয়া যায় না!! কথার ভিতরে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মন বলছে নীল এর কাছে ছুটে যেতে আর মস্তিষ্ক বলছে নীল কে দূরে ঠেলে দিতে। মন আর মস্তিষ্কের লড়াইতে খুব বাজে ভাবে পিষে যাচ্ছে কথা!!
শাওয়ার শেষ করে কাব্য এর ঘরের দিকে হাটা ধরলো কথা। তানিয়া আর কাব্য এর প্রেমের কথা জানার পর থেকে তার ভিতরে কষ্টের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কাব্য এর সাথে একটু কথা বলতে পারলেও তার ভালো লাগবে।
কাব্য এর ঘরের দরজা আগে থেকেই একটু ফাঁকা করা ছিল। যার জন্য কথা নক না করেই ভিতরে ঢুকে পরলো। ব্যালকোনিতে দাড়িয়ে কাব্য বাইরের দিকে মুখ করে সিগারেটে ফুঁ দিচ্ছিল। কাব্য কে কথা কখনও স্মোক করতে দেখে নি। তার সেই ভাই আজকে কতোটা কষ্ট নিয়ে স্মোক করছে সেটা কথার আন্দাজের বাইরে। এরই মধ্যে কথার দুচোখ ভরে এসেছে।
কান্নারত অবস্থায় কথা দৌড়ে গিয়ে কাব্য কে পিছন থেকে জরিয়ে ধরলো। কথার এভাবে হঠাত করে জরিয়ে ধরায় সামনে থাকা ব্যক্তিটির হাত থেকে সিগারেট টা নিচে পরে গেলো। যদিও লোকটা ভীষণ রকম ঝটকা খেয়েছে কিন্তু তবুও স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে। আর এদিকে কথা আগের ভঙ্গিতেই দাড়িয়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে।
— তুই আমার সাথে শেয়ার করতে পারতি এটলিষ্ট। আমি কি এতোটাই পর হয়ে গেছি? জানি কিছু করতে পারতাম না কিন্তু তোর কষ্টের ভাগ তো নিতে পারতাম।
— আপনি কে আর এভাবে জরিয়ে ধরেছেন কেনো?
লোকটার কন্ঠ শুনে চমকে উঠলাম, এটা তো কাব্য ভাইয়া নয়। ঝট করে লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে এক হাত দূরে গিয়ে দাড়ালাম। লোকটা পিছন দিকে ঘুরতেই আরও বেশি অবাক হলাম। লোকটা আদনান ভাইয়া। কিন্তু সে কাব্য ভাইয়ার ঘরে কি করছে! আর ভাইয়াই বা কোথায়?
— তুমি সেই মেয়েটা না যে আমার গাড়ির নিচে পরতে পরতে বেঁচেছো?
— হ্যাঁ। কিন্তু আপনি ভাইয়ার ঘরে কেনো?
— ভাইয়া! তুমি কাব্য এর ছোট বোন কথা?
— জি। আর সরি আমি ভেবেছিলাম ভাইয়া দাড়িয়ে আছে।
— ইটস্ ওকে কথা মনি।
— আমি বাচ্চা নই। সো ডোন্ট কল মি মনি।
— কুল কুল। তোমাকে এমনিতেও পুচকিই মনে হয় তাই বললাম আর কি।
— আমি পুচকি নই।
— তোমার দুই বেণী আর সামনের এলো চুলগুলো কিন্তু তোমাকে পুচকিই বলে।
— আপনি একটা পঁচা লোক।
— এই যে প্রমাণ করে দিলে তুমি পুচকি।
— উফফ আপনার সাথে কোনো কথাই বলবো না আমি।
কাব্য ভাইয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আদনান ভাইয়ার আদৌ কোনো দোষ ছিল না, শুধু শুধুই তাকে এতোগুলো কথা শুনিয়ে দিলাম। এই নীল এর বাচ্চা আমাকে পাগল বানিয়ে ছাড়বেন, নাকি অলরেডি বানিয়ে দিয়েছে কে জানে!
!
!
!
ড্রয়িং রুমে যেতেই আব্বু আর কাব্য ভাইয়াকে একসাথে বসে থাকতে দেখলাম। দেখে মনে হচ্ছে দুজনে খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে আলোচনা করছেন। কাব্য ভাইয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। এতোটা নিখুঁত অভিনয় করতে পারে আমার ভাইয়া সেটা তো আমার জানাই ছিল না। ভাইয়া কে দেখে মনে হচ্ছে দুনিয়ার সব চেয়ে সুখী মানুষ তিনি। হয়তো তানিয়া আপুর মতো কাব্য ভাইয়াও বাস্তবতা টা মেনে নিয়েছে। তানিয়া আপুর কথাগুলো জানা হলো কিন্তু ভাইয়ার মনের কথাগুলো আমাকে জানতে হবে!আব্বুর সামনে কথা বলার সাহস আমার নেই, তাই ঘরে চলে এলাম।
রাতের নিস্তব্ধ আকাশ, চারিদিকে শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। শ্রাবণ মাস চলছে, আকাশে ঘনঘন মেঘের আলোড়ন সাথে হালকা বিদ্যুতের ঝলকানি। সব মিলিয়ে রহস্যময়ী এক পরিবেশের জানান দিচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে এক ছায়ামূর্তি ঠিক আমার ব্যালকোনির সামনে দাড়িয়ে আছে। আজকে আমি চোখে চশমা পরে আছি। তাই মূর্তির ঠোঁটে লেগে থাকা মুচকি হাসিটাও খুব ভালো মতোই দেখতে পাচ্ছি। ভাবতেই অবাক লাগছে, সকালে এতো অপমান করার পরেও নীল এতো স্নিগ্ধতাপূর্ণ হাসি ঠোঁটে এঁকে আমার দুয়ারে দাড়িয়ে আছে। কেনো যেনো নীল এর উপর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে। তার ভালোবাসায় ধরা দিয়ে তার বুকের সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
আমার ভাবনার সুঁতো কাটে আম্মুর ডাকে। রাতের খাবারের জন্য আম্মু ডেকে চলছে। কিন্তু আমি কিভাবে খাবো! নীল নিজেও না খেয়ে আছে। এখন আবার আমার রাগ হচ্ছে, এতো কিছু করেও লোকটা শান্তি পায় নি। না খেয়ে রাত নয়টার পরে আমার বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে। এই লোকটাকে সত্যি আমি একদিন খুন করে ফেলবো।
আম্মুর কাছে থেকে বাহানা দিয়ে খাবার নিজের ঘরে নিয়ে এলাম। আমার সামনে নীল খাবার না খেয়ে মশার কামড় খেয়ে দাড়িয়ে থাকবে সেটা তো আমি মানতে পারবো না! খাবার প্লেট টা সেন্টার টেবিলে রেখে ঘরের দরজা ভিতর থেকে আটকে ব্যালকোনি টপকে নিচে নেমে পরলাম। এর আগেও অনেকবার ব্যালকোনি টপকে বাড়ি থেকে পালিয়েছি। সেই অভ্যাস টা আজকে কাজে এসেছে। নিজেকে সামলে উঠে দাড়িয়ে নীল এর কাছে চলে গেলাম।
— এতো রাতে নিচে নেমে এলি যে! ভুতের ভয় নেই বুঝি?
— আমি ভুত টুত ভয় পাই না। আর আপনিও তো এতো রাতে আমার বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছেন।
— কাব্যর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।
— মিথ্যাও এমন বলা উচিত যেটা মিথ্যার মতো মনে হয়! খুব ভালো করেই জানি কেনো এখানে দাড়িয়ে আছেন।
— জানিস যখন তাহলে আবার জানতে চাইছিস কেনো?
— পাগল যে আমি! বেহায়া, নির্লজ্জ, ছ্যাঁচড়া আরও না জানি কতো কি। তাই তো নিজেকে আপনার থেকে দূর করতে পারি না।
— এইবার তো আর দূরে যেতে বলি নি। তাহলে কেনো দূরে যাওয়ার কথা বলছিস!
— কাছে আসার কথাও তো বলেন নি!
— খেয়েছিস রাতে?
— আমার সামনে এভাবে একজন না খেয়ে দাড়িয়ে থাকলে আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে কিভাবে?
— যা খেয়ে নে। তারপর ঘুমিয়ে পড়।
— সবসময় তো অর্ডার দেন। আর আমি মেনেও নেই। আজ যদি কিছু আবদার করি রাখবেন সেটা?
— আজ যদি তুই এই জীবন টাও চেয়ে নিস সেটাও দিয়ে দেবো!
— তোমার জীবনে একটু জায়গা কি দেওয়া যায় না আমাকে? একটুও কি ভালোবাসা যায় না আমাকে? আমি যে ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে নীল! আমাকে কি তুমি ভালোবাসতে পারো না!
— এই প্রশ্নের উত্তর কি আমার স্পর্শ তোকে দেয় নি? আমি তো ভেবেছিলাম আমার প্রতিটি স্পর্শ তোকে জানিয়ে দেবে আমিও তোকে ভালোবাসি।
— কেনো এতো রহস্যময় তুমি? তোমার প্রতিটি কথা কেনো রহস্যের জাল মনে হয় আমার?
— সরাসরিই তো বললাম, ভালোবাসি তোকে। তবুও বুঝতে পারলি না। আর এতোদিন ভালোবাসি ভালোবাসি করে আমার মাথা খেয়ে নিয়েছিস। আজকে যখন আমি বলছি আমি তোকে ভালোবাসি তখন তুই বুঝতে পারছিস না!
— তুমি মজা করছো তাই না?
— যাহ বাবা ভালো না বাসলেও দোষ আবার বাসলেও দোষ।
— সত্যি বলছো?
— আমি নীরবের মতো গোলাপের গুচ্ছ নিয়ে মাঝ রাস্তায় প্রপোজ করতে পারি নি। আর পারবোও না। কিন্তু কালকে আমার পছন্দের কদমের গুচ্ছ আর নীল শাড়ি এনেছিলাম। কিন্তু সেটা তো তুই ফেলে দিয়েছিস।
— তুমি সত্যি আমাকে ভালোবাসো?
— এখনও সন্দেহ আছে?
— একবার বলো ভালোবাসি!
— একবার কেনো? বারবার বলবো হাজার বার বলবো ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি,,,, তোকে অনেক ভালোবাসি কথা।
নীল এর মুখ থেকে ভালোবাসি কথা শুনে কথা নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁদে ফেললো। কথার কান্না দেখে নীল অট্টহাসি তে ফেঁটে পরে কথা কে বুকে জরিয়ে ধরলো।
— ওয়াদা করো সারাজীবন তোমার বুকে ঠিক এই ভাবে আগলে রাখবে আমাকে! কখনও নিজের থেকে দূরে যেতে দেবে না।
— ওয়াদা করছি। শেষ নিশ্বাস অব্দি এভাবেই বুকে জরিয়ে ধরে রাখবো তোকে। কখনও চোখের আড়াল হতে দেবো না।
— নীল!
— উম।
— এটা স্বপ্ন নয়তো? চোখ খুললেই স্বপ্নটা ভেঙে যাবে নাতো? আমরা আবার দূরে হয়ে যাবো নাতো!
— এমন কেনো মনে হলো?
— ভয় করছে ভীষণ। তোমাকে হারিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না। আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে তো?
— কেনো পূর্ণতা পাবে না আমাদের ভালোবাসা একটু শুনি?
— জানি নি। দেখেছি অনেকের ভালোবাসা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
— আমাদের ভালোবাসা সম্পূর্ণ হবে। আমরা করবো। আর তোকে তো আমি আমার বউ বানিয়েই দম নেবো।
— হ্যাঁ তোমার বউ আমিই হবো। “নীলের বউ” নিতু পেত্নির ভাবি হবো আমি। হিহিহি।
আরও একবার শক্ত করে জরিয়ে ধরলো নীল কথা কে।
চলবে..