#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_০৫
#Sumaya_Tabassum_Kotha
আহত দৃষ্টিতে কথার দিকে তাকিয়ে আছে নীল, কাল রাতে হয়তো অনেক বেশি বলে ফেলেছে সে। কথাকে এতো কিছু বলা অন্যায় হয়েছে তার, কিন্তু সেই বা কি করবে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম সে! সারা সন্ধ্যা চেষ্টা করেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি। সেই চাপা রাগটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় কথার শাড়ির আঁচল নিচে পড়া দেখে। এজন্যই কথাকে নির্দ্বিধায় এতো বাজে কথা বলেছে সে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিপ এ উঠে বসলো নীল।
— বড় মা তোকে ডাক্তারের কাছে নিতে বলেছেন, তোর শরীর নাকি খারাপ!
— আমার মতো একটা পতিতা কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া টা আপনাকে শোভা দেয় না! আপনি বরং আমাকে বাড়িই পৌঁছে দিন। যতো দ্রুত আমার থেকে দূরে যাবেন ততো কলঙ্ক মুক্ত থাকবেন।
নীল বাকরুদ্ধ হয়ে স্থির দৃষ্টিতে কথার দিকে তাকিয়ে আছে। নীল এর ভাবতে বেশ অবাক লাগছে, এই কি সেই কথা যে এতোদিন পাগলের মতো ভালোবাসার ঝুলি নিয়ে নীল এর পিছনে পরেছিল! এই কি সেই কথা যে হাজার অপমানের পরেও হাসিমুখে ফিরে আসতো! অবাক চোখে প্রতিবার নীল কে দেখতো! কতোটা তফাত হয়ে গেছে এক রাতের মধ্যে!
বাড়ি ফেরার সময় দুজনের কেউই আর কারো সাথে কথা বলে নি। নীরবতার মধ্যেই পথটুকু পাড়ি দিয়েছে। খান বাড়ি পৌঁছে আবারও ব্যস্ত হয়ে পরেছে নীল। বোনের বিয়ে বলে কথা, ভাইদের হাজার টা কাজ থাকে।
তানিয়া আপুর জিনিস গুলো নিয়ে তার ঘরে যাচ্ছিলাম। তখন কাব্য ভাইয়া কে তানিয়া আপুর ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম। কাব্য ভাইয়াকে দেখে কাল রাতে তার ফোলা চোখের কথা মনে পরে গেলো। ওই নীল যমরাজ টার জন্য আমার ভাইয়ার কথাও ভুলে গেছি আমি। কেমন বোন আমি ছিঃ! ভাইয়ার সাথে কথা বলা খুব জরুরি কিন্তু হাতে একদম সময় নেই। কিছুক্ষণ পরেই বিউটিশিয়ান এসে পরবে।
তানিয়া আপুর ঘরে ঢুকতেই দেখলাম আপু ওয়াশরুম থেকে বেরুচ্ছেন। আপুকে দেখে মনে হলো সে আমাকে দেখে জোরপূর্বক একটু হাসির রেখা ঠোঁটে ফুঁটিয়ে তুললেন। চোখ দুটোও কেমন ফোলা ফোলা। আচ্ছা এসব কি হচ্ছে আমার আশে পাশে। সব কেমন রহস্যের জালে আবদ্ধ লাগছে! আচ্ছা কাব্য ভাইয়া আর তানিয়া আপুর মধ্যে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক নেই তো! না না সে কি করে সম্ভব! তানিয়া আপু তো ভাইয়ার বয়সে বড় আর তাদের কখনও এক সাথেও দেখি নি। হয়তো সম্পূর্ণটাই আমার মনের ভুল!
আপুকে জিনিসপত্র গুলো দিয়ে আমি নিতুর ঘরে চলে গেলাম। সেখানে তুলি আগে থেকেই উপস্থিত ছিল।
— ভাবি এসেছো! ভাইয়াকে তো মনে হয় আজকে প্রপোজ করেই দিয়েছিস তাই না! (নিতু)
— আরেহ এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয় নাকি! কথার মতো পাগলী কি আর এতো বড় সুযোগ মিস করেছে নাকি! (তুলি)
— তা ভাবি, ভাইয়াকে কিস টিস করার সুযোগ দিয়েছেন নাকি আপনিই সব করে দিয়েছেন? (নিতু)
— নিতু, তোর যে নিরামিষ ভাই! কি মনে হয় সে নিজে থেকে কিছু করবে! আমার তো মনে হয় কথাই সব করে দিয়েছে। (তুলি)
— আচ্ছা তোরা শুরু টা করেছিস কি বলতো! বাইরে থেকে এসেছি কোথায় একটু রেষ্ট নিতে দিবি তা তো না উল্টো প্যাড়া দিচ্ছিস। (কথা)
— যা ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নে,, আবার সাজগোজ শুরু করতে হবে। (নিতু)
— খিদে নেই। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
— ভাইয়ার সাথে খেয়ে এসেছো বুঝি ভাবি! (তুলি)
— ফাজলামো বাদ দে তো। কারো সাথে খাই নি, ফ্রেশ হয়ে এসে খাবো। আমি কেনো না খেয়ে থাকতে যাবো! এই নিতু জলদি যা আমার জন্য খাবার নিয়ে আয়।
— তুই যা ফ্রেশ হো। খাবার টেবিলে রাখছি।
?
খাবার সামনে নিয়ে বসে আছি, কিন্তু খাওয়ার একদম ইচ্ছে নেই। কেনো যেনো অনেক অশান্তি লাগছে। কিছুই ঠিক নেই। কেনো ঠিক নেই? নীল কে আমি নিজের থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসি। তাহলে কেনো তার ভালোবাসার যোগ্য নই আমি! কি কমতি আছে আমার মধ্যে? কেনো সে আমাকে এইভাবে অপমান করে। তার করা হাজার অপমান সহ্য করতে আমি রাজি, তবুও যদি সে একবার আমাকে ভালোবাসতো!
আমিও না অনেক বেশি আবেগি। সে আমাকে কেনো ভালোবাসবে! আফ্টার অল একটা পতিতা কে আর যাই হোক ভালোবাসা যায় না।
খাবার মুখের সামনে নিয়েও ফিরিয়ে নিলাম। নীল কি খেয়েছে? সকাল থেকে শুধু কাজ করতেই দেখলাম। তায়েবা আপুর মেয়ে রাইসা কে সামনে দেখে ডাকলাম।
— রাইসা মামনি। তোমার নীল মামাই খেয়েছে?
— মামাই তো সকাল তেকে কাত কলে।
— মামনি আমার একটা কাজ করে দেবে। তোমাকে চকোলেট দেবো।
— তক্কেত!
— হ্যাঁ। এই প্লেট টা তোমার নীল মামাইকে দিয়ে আসো। বলবে খেয়ে নাও।
— টিক আতে।
রাইসা গুটিগুটি পায়ে খাবার প্লেট টা হাতে নিয়ে উঠানে চলে গেলো। দরজার আঁড়াল থেকে লুকিয়ে দেখছি। আমি নিশ্চিত নীল কিছু খায় নি।
— মামাই তোমাল খাবাল। খেয়ে নাও।
— ওরে আমার বাবাই টা আমার জন্য খাবার এনেছে!
— না কথা খালামনি পাতিয়েতে।
— কথা!
— হুহ। তুমি খাও আমি যাই।
— দাও বাবাই আর তুমি ঘরে গিয়ে খেলো।
নীল খাবার প্লেট টা হাতে নিয়ে আনমনেই একটা ম্লান হাসি আঁকে ঠোঁটে।
নীলের হাতে রাইসা খাবার দিয়ে এলে রাইসাকে চকোলেট দিয়ে আমি ঘরে চলে এলাম।
মেহমান আসা শুরু হয়ে গেছে। তানিয়া আপুকে সাজাচ্ছে সবাই। আমি, নিতু আর তুলি তিনজনেই লাল রঙের লেহেঙ্গা পরেছি। যদিও নিতু আর তুলি অনেক সেজেছে, আমি সাজি নি। আসলে ইচ্ছে হয় নি। আমার সব সাজ তো নীল এর জন্য কিন্তু তার আমার সাজা আর না সাজায় কিছু আসে যায় না। তাই আমার সাজসজ্জারও কোনো মানে হয় না।
হালকা কাজল, লিপষ্টিক আর খোলা চুলে আমি তৈরি। বরযাত্রী এসে পরেছে। সবাই বর আর মেহমানদের সামলাতে ব্যস্ত। আমি এক কোনায় দাড়িয়ে সবটা দেখে যাচ্ছি। কাল বিকেল পর্যন্তও তানিয়া আপুর বিয়ে নিয়ে অনেক উৎসাহ ছিল। কিন্তু রাতে নীল এর সেই কথা গুলো আমার মন টাকে কেমন মলিন করে দিয়েছে। ঘুরে ফিরে সেই কথা গুলোই কানে বাজে।
নীল একটা সাদা সুতির কাজ করা পাঞ্জাবী পরেছে। এমনিতেই এতো সুদর্শন তার উপর সাদা রং। আরও বেশি আকর্ষনীয় লাগছে তাকে। সত্যি আমি অনেক বেহায়া না চাইতেও চোখ বারবার তার দিকে যাচ্ছে।
কাজী সাহেব তানিয়া আপুর বিয়ে পড়াচ্ছেন। একটু পর হয়তো আপুকে বিদায় করে দেবে। মেয়েদের জীবনটাও কতো বিচিত্রময়। জন্মের পর থেকে যাদের আপন করে বেঁচে থাকে, সুখে-দুঃখে সব মুহূর্তে যারা পাশে থাকে,,, কবুল আর একটা স্বাক্ষর তাদের সবাইকে পর বানিয়ে দেয়।
— কথা! তানিয়া আপুর আলমারিতে গয়নার একটা বাক্স আছে, যা তো নিয়ে আয়। (নিতু)
— আচ্ছা।
বাড়ির ভিতরে গিয়ে সোজা তানিয়া আপুর ঘরে ঢুকে পরলাম। আপুর আলমারির চাবি কোথায় থাকে সেটা আগে থেকেই জানতাম। আলমারি খুলে গয়নার বাক্স বের করতেই বক্সের সাথে আটকে একটা চিরকুট নিচে পরে গেলো। কৌতুহল-চঞ্চল মন আমার চিরকুট টা না দেখলে অস্থিরতাতেই মরে যাবো। কিন্তু চিরকুট টা খোলার আগেই তুলি চলে এলো ঘরে আমাকে ডাকার জন্য।
— এখানে টাইম পাস করছিস ওদিকে তোর শাশুড়ী নয়নতারা বেগম পাগল হয়ে গেলো ডাকতে ডাকতে।
— সো সরি চল জলদি চল।
তাড়াহুড়ায় চিরকুট টা হ্যান্ড ব্যাগে রেখে নিচে চলে গেলাম।
তানিয়া আপুর বিদায় পর্ব শেষ, তুলিও বাসায় চলে গেছে। এখন আমারও যাওয়ার পালা।
— আজ আমার কাছে থেকে যা না কথা! তানিয়া আপু চলে গেছে মনটা ভীষণ খারাপ। (নিতু)
নিতুর জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে কিন্তু আমি নীল এর সামনে আর এক মুহূর্তও থাকতে পারবো না। অনেক কষ্টে নিজেকে স্ট্রং বানিয়েছি। তার সামনে থাকলে আবারও দুর্বল হয়ে পরবো। নিতুকে বুঝিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম।
খান বাড়ির উঠানে দাড়িয়ে আছি, বুকের বা পাশে অসম্ভব রকম যন্ত্রণা হচ্ছে। ভেবেছিলাম এই দুইদিন এ নীল কে আমার ভালোবাসার উপলব্ধি করাবো। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস! নীল কে সারাজীবনের মতো হারিয়ে যাচ্ছি। অনেক স্বপ্ন ছিল এই খান বাড়িতে নীল এর বউ হয়ে ফিরে আসবো। সেই খান বাড়ির উঠানেই আমার সব স্বপ্ন মাটি চাপা দিয়ে যাচ্ছি।
— কথা বাইকে উঠে বস। রাত নেমে এসেছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। — কাব্য
— চলো।
শেষ বারের মতো খান বাড়ির চারদিকে হণ্যে হয়ে একটা মুখ খুঁজছি। হাতে একদম সময় নেই। শেষ বার কি দেখতে পারবো না নীল কে? না নীল কোথাও নেই। এক বুক কষ্ট নিয়ে কাব্য ভাইয়ার সাথে চলে এলাম।
?
ছাদের কার্নিশ ঘেসে দাড়িয়ে আছে নীল। বেশকিছুক্ষণ হয়ে গেছে কথা চলে গেছে। কথার যাওয়ার প্রায় অনেকক্ষণ আগে থেকেই সে এখানে দাড়িয়ে আছে। কথার অস্থির দৃষ্টি, একবার তাকে দেখার অধীর আগ্রহ সবটাই সে নিশ্চুপে দেখেছে। হয়তো কাল রাতের পর সামনে যাওয়ার সাহস হয় নি তাই দূর থেকেই দেখেছে।
রাতের অন্ধকার আর নীল এর জ্বালানো সিগারেটের ধোয়া একসাথে মিশে ভৌতিক একটা পরিবেশ তৈরি করেছে। আর এই পরিবেশে নীল একটা প্রেতাত্মার ভূমিকা পালন করছে। বুকে কষ্টের পাহাড় জমে আছে তবুও ভীষণ ভালোলাগা কাজ করছে। এতোদিনে সে বুঝতে পেরেছে কথা তাকে কতোটা ভালোবাসে। কথা নীল কে ভালোবাসে সে আগেই জানতো কিন্তু কাব্যর সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট হবার ভয়ে কখনও কথার আবেগ কে প্রশ্রয় দেয় নি। বুকের বা পাশের ব্যথাটা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। নীল নিজেও জানে না তার কি হচ্ছে!
মধ্য রাত্রি পাড় হয়েছে অনেকক্ষণ হয়েছে হয়তো কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। প্রতিদিন বেলা আট টা পর্যন্ত ঘুমানো মেয়ের চোখে রাত ৩:৩০ টার দিকে ঘুম নেই। কেউ কি বিশ্বাস করবে এটা! কষ্ট হচ্ছে, বারবার নীলের মুখটা চোখের সামনে আসছে। চোখ বন্ধ করেও শান্তি নেই, ঘুমের ঘোড়ে নীলকেই দেখতে পাই। নীল কি কখনই আমাকে ভালোবাসবে না! আমার মনের অবস্থাটা কি সে কখনই বুঝবে না!!
?
পরদিন তানিয়া আপুর বউভাতের অনুষ্ঠান। নিতু অনেকবার বলেছিল সাথে যেতে কিন্তু মন সায় দেয় নি পুনরায় নীলের সামনে যেতে। সেদিনের পর নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নীল এর থেকে দূর করে নিলাম। আমার ধ্যানে জ্ঞানে নীল থাকলেও মুখে আর কখনই সে থাকবে না। ভালোবাসাকে বুকেই চাপা দিয়ে রাখবো সবসময়।
তিন দিন পাড় হয়ে গেছে কোচিং এ যাই না। নীল স্যারের কোচিং এই পড়ি, না চাইলেও কোচিং এ গেলে তার মুখোমুখি হতে হবে। এজন্য না যাওয়াটাই ভালো মনে হলো। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষা এগিয়ে আসছে। বাসায় আম্মু আর ভাইয়া তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দিয়েছে। এখন নাকি আব্বুর কানে দেবেন কোচিং এ না যাওয়ার কথাটা। আব্বু জানতে পারলে মেরে আলু ভর্তা বানিয়ে দেবে। না আব্বুর মার খাওয়ার থেকে ভালো কোচিং এ চলে যাই।
কলেজের ড্রেস পরে, দুই বেণী করে কাঁধের ব্যাগটা বারবার টেনে কোচিং এর দিকে হেটে যাচ্ছি। কিন্তু কেমন সব ঘোলাটে ফিলিং আসছে। কি একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পরবো নীল এর সামনে সেটা আমি আন্দাজ করতেই পারছি।
হাটতে হাটতে কোচিং এর সামনে এসে পরেছি। বুকের বা পাশের চিনচিনে ব্যথা টা প্রকট আকার ধারণ করেছে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে চাই না। নীল এর সামনে নিজেকে আর ছোট করতে চাই না।
চলবে..