শ্রাবণের মেঘ পর্ব_০৪

0
1606

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_০৪
#Sumaya_Tabassum_Kotha

মধ্য রাত্রি চলছে,, অন্ধকার আর নিস্তব্ধতায় নিমজ্জিত হয়েছে চারপাশ। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকাতে তারকারাজী ঢাকা পরেছে। দূর থেকে দুই একটা পেঁচার ডাক ভেসে আসছে। হয়তো মানুষ প্রজাতির সাথে সাথে বাকি পক্ষীকূলও ঘুমিয়ে পরেছে। কিন্তু দুটি অশান্ত মন দুদিকে একটি নির্ঘুম রাত পার করছে। দুজনের মনেই অশান্তি ভর করেছে। দুজনের কষ্টের পরিমাণ এক হলেও প্রেক্ষাপট ভিন্ন। একজন প্রিয়জনকে কষ্ট দিয়ে ব্যথা পাচ্ছে। আরেকজন প্রিয়জনের দেওয়া কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ব্যথা পাচ্ছে।

জলন্ত সিগারেটের ধোয়ায় চারপাশ ভারী হয়ে উঠেছে। মেঘাচ্ছন্ন রাতে এ যেনো আরও বিষন্নতা নামিয়ে আনছে। কথার আনা গোলাপ টা হাতে নিয়ে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে নীল। চোখের কোনায় টলমল করা পানিগুলো ঝরে পরার অনুমতি পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরপর দীর্ঘ নিশ্বাসের সাথে কষ্ট গুলো ঝেরে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করছে নীল।

নিতুর ঘরের ব্যালকোনিতে জরোসরো হয়ে বসে নিশ্চুপে কেঁদে যাচ্ছে কথা। কিছু সময় আগেও তার চোখ ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ছিল। আর এখন! চোখের পানিতে দুচোখের কাজল লেপ্টে একাকার হয়ে গেছে। কথা স্বপ্নেও ভাবে নি ভালোবাসার মানুষটার কাছে থেকে এতো অপমান পেতে হবে তার। প্রিয়জনের দেওয়া আঘাত সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়।

বেশকিছুক্ষণ কান্না করে নিশ্বব্দে ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়ি পাল্টে নিলো কথা। শাড়ি আর চুড়ি গুলোকে একবার দেখে পুনরায় ব্যাগের ভিতর রেখে নিতুর পাশে শুয়ে পরলো সে।

?

?

সকালে নিতুর খুব ভোরেই ঘুম ভাঙে,, সারারাত কান্না করে শেষ রাতের দিকে চোখ লাগে কথার। নিতু ফ্রেশ হয়ে দেখে কথা এখনও ঘুমাচ্ছে। তখন নিতুর বড় মা তাহেরা বেগম দরজার সামনে এসে নিতুকে কিছু বলে যায়। বড় মা চলে গেলে নিতু কথা কে ডাকতে শুরু করে।

— এই মেয়ের কোনো আক্কেল আছে কি নাই! বিয়ে বাড়ি আর উনি পরে পরে ঘুমাচ্ছে। মা আর বড় মা যদি জানতে পারে কথা এতো অলস তাহলে আর হয়েছে নীল ভাইয়ার সাথে বিয়ে। (নিতু)

— এই কথা উঠ, আরেহ এই কুম্ভকর্ণের গফ উঠ। ভুলে যাস না এটা তোর হবু শ্বশুরবাড়ি। বিয়ের আগেই বউর এমন কুম্ভকর্ণ টাইপ স্বভাব দেখলে তোকে এই জন্মে এই বাড়ির বউ করবে না।

— কি হয়েছে এমন ষাঁড়ের মতো চেচাচ্ছিস কেনো?

— আমি ষাঁড়! তাহলে তুই গাধা।

— হুহ। যা সর ফ্রেশ হতে দে আমাকে।

— শোন নীল ভাইয়ার সাথে জুয়েলারির দোকানে যেতে হবে। তানিয়া আপুর কানের দুল আর কিছু জিনিস আনতে হবে। বড় মা আমাকে বলেছিল, আমি তোর কথা বলে দিয়েছি বড় মা কে। নীল ভাইয়ার সাথে রোমান্স করে আসো ভাবি।

— নিতু তুই ই চলে যা। আমি না হয় বাসায় ই থাকি।

— ওহহ উড বি ভাবি ঢং বাদ দে,, এমনিতে তো ভাইয়ার কাছে যাওয়ার জন্য এক পায়ে দাড়িয়ে থাকিস। আজকে সুযোগ পায়ে হেটে এসেছে আর আজকে মেডামের ঢং বেরেছে। যা চট জলদি ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়।

— নীলের ছায়া টা মাড়ানের শখও আমার মিটে গেছে। (বিরবির করে)

নিতু কে আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। আয়নায় নিজেকে দেখেই বুকটা লাফ দিয়ে উঠলো। দুচোখের কাজল লেপ্টে চেহারার অবস্থা দফারফা। অন্ধকারে নিজেকে দেখলে নিজেই ভয়ে হার্ট ফেইল করতাম। ভাগ্যিস নিতু চেহারা দেখে নি, তাহলে আমার আগেই মরে যেতো।

গোসল সেড়ে বের হয়ে ব্রেড চিবুতে চিবুতে উঠানে গিয়ে দাড়িয়ে পরলাম। সকালের সময়টাই বাকি, তারপর দুপুর থেকে মেহমান আসা শুরু হবে। চারপাশে চোখ বুলাতেই সামনে নীল কে দেখলাম।

খান বাড়ির গেইটের সামনে জিপ এ হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে নীল। যদিও এতো দূরে দাড়িয়ে আছে কিন্তু তার স্থির দৃষ্টি আমাতেই নিবদ্ধ। নীল কে দেখে কাল রাতের সব কথা আবার মনে পরে গেলো। নীলের মুখে থেকে শোনা পতিতা শব্দ টা আমার কানে বাজছে। মনে হচ্ছে যেনো আমার হৃদয়ে রক্ত ঝরাচ্ছে।

উঠানে এখনও ঠায় দাড়িয়ে আছি, যাবো না নীল এর বাচ্চার সাথে। আমাকে এতো বাজে বাজে কথা শুনিয়েছে কেনো যাবো আমি তার সাথে! নীল এর বড় মা তাহেরা বেগম তায়েবা আপুর মেয়ে রাইসা কে নিয়ে আমার কাছে এসে বললেন,

— এই কথা দাড়িয়ে আছিস কেনো জলদি যা। নীল দাড়িয়ে আছে। তানিয়ার মেয়েলি কিছু জিনিস লাগবে সেগুলো তো আর নীল কে বলতে পারি না। নিতুও ব্যস্ত তাই তুই যা।

— বড় খালাম্মা, বলছি কি আমার শরীর টা ভালো লাগছে না। নিতুর হাতের কাজ টা আমি করে দেই নিতুই যাক নীল স্যারের সাথে।

— শরীর খারাপ?

— হুম।

— এই নীল! শোন এদিকে আয়।

— জ্বি বড় মা!

— শোন কথার শরীর খারাপ। শপিং শেষ করে আসার সময় ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ নিয়ে আসিস। কেমন! যা এখন জলদি যা। কতো কাজ বাকি।

— কথা!

— হুম।

— যা জিপ এ গিয়ে বস।

— হুম।

এখন আর মানা করে কি লাভ! সেই আমার যেতেই হলো যমরাজ টার সাথে!

?

সকালের মিষ্টি রোদ চার দিকে ছড়িয়ে পরেছে। শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি হয়েছে হালকা,, মেঘ ভাঙা রোদের আলো খোলা জিপের উপর এসে পরছে। নীল এর বিপরীত দিকে তাকিয়ে আছি। আর একবারও তাকাবো না তার দিকে। আর না কোনো কথা বলবো।

— একটু ভিতরের দিকে এসে বস পরে যাবি তো! (নীল)

কথা বলার আর কোনো টপিক পেলো না হয়তো। তার কথায় কোনো পাত্তা দিয়ে আমি আমার মতোই বসে রইলাম। সারা রাস্তা আর তার দিকে তাকাই নি, কোনো কথাও বলি নি। হয়তো নীল আমার দিকে দুই একবার তাকিয়েছিলেন, হয়তোবা তাকান নি।
জুয়েলারি শপ থেকে কানের দুল আর তানিয়ার আপুর সব জিনিস কিনে আমি সোজা জিপ এ উঠে বসলাম। নীল ভাইয়া এখনও ফেরে নি। হয়তো কিছু কিনছেন।

একটু পর নীল ভাইয়া ফিরে এলেন। হাতে দুইটা চকোলেট। নীল ভাইয়ার হাতে চকোলেট দেখে মন টা আকুপাকু করা শুরু করে দিয়েছে চকোলেট খাওয়ার জন্য। কিন্তু নিজেকে তার সামনে আর বেহায়া প্রমাণ করতে মন সায় দিচ্ছে না।

— কথা! নে ধর এই দুইটা। তোর আর নিতুর জন্য।

নীল ভাইয়ার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। কালকে রাতে এতো অপমান করে এখন সে আমাকে চকোলেট দিচ্ছেন। জুতা মেরে গরু দান খুব ভালোই করতে জানে। নীল এর হাত থেকে একটা চকোলেট নিয়ে নিলাম।

— এইটাও নে নিতুকে দিয়ে দিস।

— নিতুর জন্যই নিয়েছি এটা। ওটা আপনার কাছেই থাক।

— এটা তোর জন্য এনেছি। নে ধর।

— আপনার কাছে থেকে চকোলেট নেওয়াটা ঠিক হবে না স্যার। আপনার আর আমার তেমন কোনো সম্পর্কই নেই। আর আমার মনে হয় না আমার মতো চরিত্রহীন কোনো মেয়ে আপনার কেনা জিনিস ডিজার্ভ করে। বাসায় চলুন দেরি হয়ে যাচ্ছে।

কথার বলা সবগুলো কথা নীলের বুকে তীরের মতো বিঁধলো। কথা এতো রুড ভাবে বলবে এটা নীলের ধারণার বাইরে ছিল।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে