শ্রাবণের মেঘ পর্ব_০৩

0
1585

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_০৩
#Tabassum_Kotha

“শরীর দেখিয়ে ছেলেদের বশ করতে চাইছিস! জানিস তো পতিতা রাও এই ঘৃণ্য কাজ টা করে না। তুই তাদের চেয়েও!! অন্যসব ছেলেরা তোর শরীর দেখে তোর ফাঁদে পা ফেললেও আমি তোর শরীরের মোহে পরছি না।” — নীল।

নীল ভাইয়ার কথা শুনে চমকে উঠলাম আমি। এতো বাজে কথা আমি আজ পর্যন্ত শুনেছি কি না সন্দেহ। মুহূর্তেই দুচোখের কোনায় পানি জমা হয়ে গেছে আমার। নীল এখনও স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা আমার দুচোখের পানি কি তার চোখে পরছে!

কিছুক্ষণ আগে,,,

সবাই তানিয়া আপুকে হলুদ লাগাতে ব্যস্ত, সেই ফাঁকে আমি নীল এর কাছেই যাচ্ছিলাম তখন কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে নিচে পরে গেলাম। কোমড়ে অনেক ব্যথা পেয়েছি। পরে যাওয়াতে আমার খোঁপা করা চুল গুলো খুলে গেছে। এতো কষ্ট করে সাজলাম আর সেটা কি না এই আহাম্মক টা মাটি করে দিলো! মাথা তুলে তাকাতেই দেখি কাব্য ভাইয়া সামনে দাড়িয়ে আছে।

ভাইয়াকে এই অবস্থায় দেখে আমি অবাকের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। ভাইয়ার চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে। দেখে যে কেউ বলে দেবে ভাইয়া কান্না করছিল। ভাইয়াকে আমি হাসতে দেখেছি, রাগ করতে দেখেছি কিন্তু কখনও কাঁদতে দেখি নি। ভাইয়ার হাতে হলুদ লেগে আছে, হয়তো তানিয়া আপু কে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে এলেন। কিন্তু ভাইয়ার এই অবস্থার কারণ কি?

আমি উঠে দাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবো তার আগেই ভাইয়া সেখান থেকে চলে গেলেন। নিজেকে সামলে আমিও ভাইয়ার পিছেন পিছন গেলাম। ভাইয়া সরাসরি নীল ভাইয়ার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ভাইয়ার দরজায় নক করবো ঠিক তখন নিতু সেখানে এলো।

— আচ্ছা মুসিবত মেয়ে তো তুই। এখানে কি করছিস? ফাংশন চলছে উঠানে।

— আরে কাব্য ভাইয়া এই ঘরে ঢুকেছেন।

— ঢুকেছেন তো তোর কি হয়েছে! কাব্য ভাইয়ার বেষ্ট ফ্রেন্ডের ঘর এটা সে ঢুকতেই পারে। এখনও তোর ঘর হয়ে উঠে নি এটা বুঝলি?

— আমি কি সেটা বলেছি নাকি?

— এই তুই একটু চুপ কর তোর কিছু বলতে হবে না। তুই নিজেও পাগল সাথে আমাকেও পাগল বানাবি। নিচে চল এখন। তানিয়া আপুকে হলুদ লাগাবো।

— কিন্তু!

— কোনো কিন্ত টিন্তু নয় চল তুই।

নিতু আমাকে টেনে সেখান থেকে নিয়ে গেলো, ব্যস্ততায় কাব্য ভাইয়ার বিষয় টা আমার মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো। উঠানে গিয়ে নিতু আর আমি দৌড় লাগালাম তানিয়া আপুর কাছে। অনেকগুলো হলুদ নিয়ে আপুর সারা শরীরে মাখিয়ে দিলাম।

নিতু আমার মুখে হলুদ লাগিয়ে বাড়ির ভিতরের দিকে পালালো। আমাকে হলুদ লাগিয়ে এতো সহজে পালিয়ে যাবে! সেটা তো হতে পার না। আমিও হলুদ হাতে নিয়ে পিছন পিছন ছুটলাম। বিপত্তি টা ঠিক সেখানেই ঘটলো। শাড়ির আঁচলে লাগানো সেফটিপিন টা কিভাবে খুলেছে জানি না, কিন্তু আঁচল খুলে মাটিতে পরে গেলো। আর সেই আঁচলে পা লেগে আমি মাটিতে পরে যাচ্ছি।

আচমকা সব হওয়াতে নিজেকে সামলানো তো দূরেই থাক বুঝতেই পারি নি কি থেকে কি হচ্ছে! চোখ মুখ খিচে আছি, একটু আগেও পরে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি,, এবারো পাবো। কিন্তু মনে হচ্ছে আমি হাওয়ায় ভাসছি। কেউ আমার কোমড় জরিয়ে ধরে রেখেছে! আচ্ছা এই কেউ টা নীল নয়তো! হতে পারে সেও আমাকে ভালোবাসে তাই আমাকে পরে যাওয়া থেকে বাঁচাচ্ছে।

ধীরে ধীরে চোখ মেলছি আর মনে মনে চাইছি সামনে যেনো নীল কে দেখতে পাই। কিন্তু আমার স্বপ্নের সেগুড়ে বালি। নীল এর ভাই নীরব আমাকে জরিয়ে ধরে রেখেছে। কোথায় ভেবেছিলাম আমার জামাই টা আমাকে বাঁচাবে তা না বাঁচিয়েছে দেবর জি। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি নীরব ভাইয়ার কাছ থেকে। কিন্তু নীরব ভাইয়া তো এক ধ্যানে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কি মুশকিল এমনভাবে দেখছেন যে একটু পরেই আমাকে খেয়ে ফেলবেন।

ঠিক তখনই কাঁচ ভাঙার শব্দে নীরব চমকে উঠে আমাকে ছেড়ে দিলো। নিজেকে সামলে আঁচল ঠিক করে সামনে তাকাতেই দেখি অনেকগুলো কাঁচের গ্লাস ভেঙে মেঝেতে পরে আছে। আর নীল অগ্নিমূর্তি ধারণ করে আমার আর নীরবের দিকে তাকিয়ে আছেন। নীলের চোখ দেখে মনে হচ্ছে আগুন বের হচ্ছে আর সেই আগুনে আমাকে পুড়িয়ে দেবে। আমি ভয়ে পুরোই শুটকি হয়ে গেছি। কি করবো ভেবে না পেয়ে দৌড়ে বাড়ির ভিতর চলে এলাম। ফাংশন চলাকালীন আমি আর নিচে যাই নি।

?

রাত প্রায় ১ টা বাজে, ঘুম আসছে না। আমার এতোদিনের প্ল্যানিং বাস্তবায়িত করার সময় এসে পরেছে। নিতু আমার পাশেই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। বেচারা নিতুর জামাই টার কপাল পুড়া, যেই জোরে নাক ডাকে নিতু। রাতে আর ঘুমাতে হবে না তার।হিহিহি।

আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে ব্যাগ থেকে একটা কালো শাড়ি আর কালো কাঁচের চুড়ি বের করে, পরে তৈরি নিলাম। তারপর ব্যাগের এক কোনায় রাখা গোলাপ ফুলটা হাতে নিয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে হাটা ধরলাম। নিতুর কাছে থেকে আগেই খবর নিয়েছি লাইটিং এর কাজের জন্য নীল রাত দুইটা পর্যন্ত ছাদে থাকবেন। এর থেকে সুবর্ণ সুযোগ আমি আর পাবো বলে মনে হয় না। রাতের বেলা একা প্রপোজ করলে নীল কিছুই করতে পারবে না। আজকে তো আমি তাকে আমার ভালোবাসার কথা বলেই ছাড়বো।

সিড়ি বেয়ে উঠে চলেছি,, কাজলে দুই চোখ ভরিয়ে তুলেছি। নীলের পছন্দের লম্বা চুল গুলো ছেড়ে দিয়েছি। ঠোঁটে হালকা গোলাপী লিপষ্টিক পরেছি। পুরো সাজটাই নীল এর পছন্দের। আজকে ঝড় আসুক আর সুনামি, আমি আমার ভালোবাসার কথা নীল কে বলেই দম নেবো। হাটুতে বসে গোলাপ টা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলবো, “নীল আমি আপনাকে ভালোবাসি।”

ছাদের কার্নিশ ঘেসে দাড়িয়ে আছে নীল,, ধোয়া জাতীয় কিছু উড়ে যাচ্ছে। হয়তো স্মোক করছে। একটু এগিয়ে সামনে যেতেই কিছু একটার সাথে হোচট খেয়ে গোলাপ টা হাত থেকে নিচে পরে গেলো। নিচু হয়ে গোলাপ খুঁজতে গেলে আঁচল টা কাঁধ থেকে পরে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে নীল ভাইয়া আমার দিকে ঘুরে তাকান। আর আমাকে এতো বাজে মন্তব্য করেন।

বর্তমান,,,

ভীষণ কষ্ট হচ্ছ, যাকে ভালোবাসি তার মুখ থেকে নিজের জন্য এই ধরনের কথা মেনে নেওয়া যায় না। এতোক্ষণ নীল এর প্রতি যেই ভালোবাসা না উতলে উঠছিল সেখানে একরাশ অভিমান এসে জমা হয়ে গেছে। দুচোখ বেয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো।

— এখনও বেহায়ার মতো দাড়িয়ে আছিস। সন্ধ্যার মতো আঁচল ফেলে ছেলেদের শরীর দেখানো শেষ নাকি?

— চুপ করে আছিস যে! তুই যে কাব্যর আপন বোন সেটা আমার বিশ্বাসই হয় না। কতোটা বেহায়া তুই সেটা তো কাব্য জানেই না। তা বলি কি নীরবকে শরীর দেখানো শেষ নাকি যে আমার কাছে এসেছিস?

— কতোবড় নির্লজ্জ তুই এখনও আমার সামনে দাড়িয়ে আছিস!

— হ্যাঁ আমি নির্লজ্জ, বেহায়া, ছ্যাঁচড়া। আমি জানি এই উপাধি গুলো বিশেষভাবে আমার জন্যই বানানো। বানিয়েছেন আপনি। অবশ্য দোষ আপনার না। দোষ আমার, অনেক বেশি আবেগী তো আমি, তাই এই উপাধি গুলো আমার পাওনা। কিন্তু পতিতা!!
একবার বিবেক খাটিয়ে বলুন তো, আমি কি সত্যি পতিতা! এই উপাধি টা তো আমার পাওনা ছিল না। আমার ধ্যানে, জ্ঞানে শুধু একটাই নাম,, একজনকেই মনে জায়গা দিয়েছি। একজনের প্রেমেই বৈরাগী হয়েছি,, আর আজ সেই একজনই আমাকে কলঙ্কিনী বানিয়ে দিলো!
আমি আপনাকে ভালোবাসি নীল! আপনি কি বুঝতে পারেন না? একবারের জন্যও কি আমার চোখে আপনার জন্য ভালোবাসা দেখতে পান না! আমার মনে যে আপনার নামের ভালোবাসা আকাশ ছুয়েছে বুঝতে পারেন না! দুই বছর ধরে পাগলামি করে আসছি,, একবারের জন্যও কি বুঝতে পারেন নি আমার পাগলামির পিছনের কারণ কি হতে পারে! সেদিন বিকেলে আপনাকে ভালোবাসি বলতে গিয়েছিলাম। আপনার ভয়ে পরে মিথ্যা বলেছি। আজকেও হয়তো ভালোবাসি বলার পর আপনার ভয়ে মিথ্যা বলতাম।

আপনি জানেন আপনাকে কতোটা ভালোবাসি আমি? আপনাকে একদিন না দেখে থাকতে পারি না, পাগল মনে হয় নিজেকে। উঠতে, বসতে শুধু নীল, নীল আর নীল। এই নীল নাম টা তেই যেনো আমার পুরো পৃথিবী আটকে গেছে। আপনার কালো রং পছন্দ বলে সপ্তাহে দুই দিন কালো ড্রেস পরে আসি, শুধু আপনাকে দেখাবো বলে। আজ পর্যন্ত যতো মেয়েরা আপনাকে প্রপোজ করেছে সবাই কে মিথ্যা বলে বলে আপনার কাছে থেকে সরিয়েছি শুধু ভালোবাসি বলে,, নিজের ভালোবাসার ছায়া টাও অন্যকারো সাথে সহ্য করতে পারবো না বলেই এতো ছ্যাঁচড়া, বেহায়া, নির্লজ্জ আমি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি পতিতা কিংবা চরিত্রহীন নই আমি মন থেকে আপনাকেই ভালোবেসেছি। শুধু ভালোবেসেছি।
কিন্তু আজকের পর থেকে আর কখনও আপনার সামনে আসবো না ভালোবাসার দাবী নিয়ে। নিজের এক তরফা ভালোবাসার আগুনে সারাজীবন পুড়তে হলেও পুড়বো। তবুও কখনও ভালোবাসি বলতে আসবো না। কখনও না। এই নির্লজ্জ কথা আর কখনও আপনাকে জ্বালাবে না।

দুচোখে পানি ছেড়ে দিয়ে কথা সেখানে থেকে দৌড়ে নিচে নেমে গেলো। সবকিছু সহ্য করা গেলেও প্রিয়জনের ধিক্কার সহ্য করার ক্ষমতা সবার থাকে না। কথারও নেই সেই ক্ষমতা। কাঁদতে কাঁদতে যাওয়ার সময় কথা নয়নতারা বেগমের সাথে হালকার উপর একটা ধাক্কা খেলো। নয়নতারা বেগম পানি নেওয়ার জন্য কিচেনে এসেছিলেন। ধাক্কা সামলে কিছু না বলেই কথা নাক টানতে টানতে নিতুর ঘরে ঢুকে গেলো।

কিছুক্ষণ সময়ের জন্য নয়নতারা বেগমের সামনে ছিল কথা, কিন্তু সেই অল্প সময়েই নয়নতারা বেগম কথার চোখের পানির মানে বুঝে গেছেন। কিছু না বলে নয়নতারা বেগম ঘরের দিকে আগালেন।

পুনরায় ছাদের কার্নিশ ঘেসে দাড়িয়ে আছে নীল। বাইরের ব্যক্তিত্ব টা যতোই কঠোর তার, ভিতরের মানুষটা ততোই দুর্বল। সে জানে নিজের দুর্বলতা বাইরের কাউকে দেখানো বোকামি। তাই তো এই কঠোর আবরণটা ধারণ করেছে সে। বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যথা করছে। সাইড টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেট টা হাতে নিয়ে আরেকটা সিগারেট জ্বালালো নীল।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে