শ্রাবণের মেঘ পর্ব_০২

0
1773

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_০২
#Tabassum_Kotha

“মা তোমার মেয়ে এইচএসসির পরীক্ষার দুইমাস আগে কোচিং এর টেষ্ট পরীক্ষায় ফেল করেছে!!” — কাব্য।

ভাইয়ার কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি,, হঠাত করে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় ঘুরলো!

— নীল দুই বছর চেষ্টা করেও ওকে পাশ করাতে পারে নি, দেখো অবস্থা দুই মাস বাকি পরীক্ষার। আর এখন ফেল করে। আজকে আব্বুকে বলে দেবো।

— ভাইয়া, আব্বুকে বলিস না। আমি অনেক ভালো করে পড়বো,, দেখিস ফাইনালের রেজাল্ট অনেক ভালো হবে। প্লিজ বলিস না।

— ঠিক আছে। সুযোগ দিলাম। ফাইনালে যেনো রেজাল্ট ভালো হয়। আর নীল যদি এর পর বিচার দেয়, তোর একটা হাড়ও আস্ত থাকবে না।

— হুম।

সেদিনের মতো সব কথা ধামা চাপা পরে গেলো। যাক বাবা নীল কাব্য ভাইয়াকে কিছু বলে নি। মানুষটা এতো ভালো দেখেই তো তাকে এতো ভালোবাসি। হ্যাঁ নীলকে আমি ভালোবাসি। গত দুই বছর ধরে ভালোবাসি।

আগে শুধু পরিচিত ছিল কাব্য ভাইয়ার বেষ্টফ্রেন্ড হিসেবে। কিন্তু একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির পর যখন তার কোচিং এ গেলাম তখন থেকে তাকে চিনতে শুরু করলাম।

নীল অনেক হ্যান্ডসাম, এজন্য না চাইতেও তার দিকে চোখ যেতো। হালকা আবেগ হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। বুঝতে পারি নি এই হালকা আবেগ কখন ভালোবাসায় রূপ নিলো। এখন এমন অবস্থা হয়েছে আমার, নীল কে একদিন না দেখে থাকতে পারি না। তাই তো ঝড়-বৃষ্টি যাই থাকুক কোচিং মিস দেই না। কিন্তু নীল তো বোঝেই না। যখন সে ক্লাস করায় অংকের দিকে না তাকিয়ে, ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু সে বুঝেই না, উল্টো খালি রাগ করে। এখন সব সয়ে নিচ্ছি কিন্তু বিয়ের পর এমন টাইট দেবো না যে তার চৌদ্দ পুরুষ আমাকে মাথায় করে রাখবে হিহিহি।

?

প্রতিদিনের মতো আজকেও আমার ঘুম ভেঙেছে দেরিতে, কোচিং এ যেতে হবে। চট জলদি গোসল টা সেড়ে কালো চুড়িদার টা পরে নিলাম। কালো রং টা নীলের পছন্দের তাই তো আমার আলমারি ভরা কালো রঙের জামা।

ভেজা চুল গুলো পিঠে ছড়িয়ে দিয়ে চোখে কাজল পরছিলাম তখন নিতু হুরমুড়িয়ে রুমে ঢুকলো।

— তুই সারাদিন আয়নার সামনে বসে থাক আর এদিকে দুনিয়া অর্ধেক ভেঙে যাক।

— তুই একদম কথা বলবি না, অপরাধী! তুই আমার বাড়ি এলি কেনো? যাহ! যাহ! হুশ! হুশ!

— বললেই হলো! আমার ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি এটা। কে আটকাবে আমাকে?

— আমি আটকাবো। পেত্নি তোর জন্য কালকে তোর ভাইয়া আমাকে মাঝ রাস্তায় দাড় করিয়ে রেখেছে। তুই আইডিয়া দিয়েছিল প্রপোজ করার।

— ও মা এখন সব আমার দোষ তাই না! তা বলি কি প্রপোজ না করলে ভাইয়া তোকে কেনো ভালোবাসতে যাবে? সে তো জানবেই না তোর মনে কি আছে।

— কিন্তু করেই বা কি লাভ হলো! দেখলি তো কি করলো যমরাজ টা!

— তুই তো একটা গাধা,, কেনো বলতে গেলি যে ডেয়ার ছিল?

— এটা না বললে যমরাজ কাব্য ভাইয়াকে সব বলে দিতো।

— মেরি জান, যাব পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া!

— তুই অনেক পেঁকে গেছিস। তোর ভাইয়া আর আমার বিয়ের পর সবার আগে তোকে বিয়ে দেবো।

— কেনো কেনো আমি কি করলাম!

— ননদিনী তোমায় তো বিদায় করবোই। তারপর পুরো বাড়িতে আমার রাজত্ব। হিহিহি।

— আগে ভাইয়াকে পটাও ভাবি জি।

— আজকে কালো চুড়িদার পরেছি, দেখিস আমার হাটু অব্দি চুল দেখে তোর ভাইয়া ফিদা হয়ে যাবে।

— সে তো দুইবছর ধরেই দেখছে!

— আজকে রাতেই তোর ভাইয়া আমার প্রেমে পরবে দেখিস তুই।

— ভালো কথা মনে করিয়েছিস। তানিয়া আপুর হলুদের ফাংশনের পর কিন্তু আর বাসায় আসতে পারবি না। আমার সাথেই থেকে যাবি।

— আসতে চায় কে! আমি তো নীলের সাথে থাকতে চাই সবসময়। কপাল ফুঁটা তাই তোর সাথে থাকতে হবে। (বিরবির করে বললো কথা)

— কি বলছিস?

— কিছুনা, চল জলদি যাই। নয়তো আবার যমরাজ রেগে যাবেন।




ক্লাসে নীল ভাইয়ার দিকে হা করে তাকিয়ে আছি, মুখে মশা ঢুকলেও কিছু করার নেই। আজকে আমার কালো রং পরাতে কি যে খুশি লাগছে! নীল ভাইয়াও একটা কালো শার্ট পরে আছে। পুরোই ডার্ক চকোলেটের মতো লাগছে। খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

— এভাবে আমার ভাইয়ের ওপর নজর লাগিও না ভাবি।

— ননদিনী আজ নজর লাগাবো না,, আজ তো পুরোই চকোলেট লাগছে তোমার ভাইয়া!

— খেয়ে ফেলবি নাকি!

— ওরে তোরা কে কোথায় আছিস আমাকে সামলা নাহলে সত্যি খেয়ে ফেলবো উনাকে!

কোচিং এর সিনিয়র আপুরা নীলের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। সব লুচিগুলো চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে আমার জামাইটাকে। এর আগেও কতোগুলো আমার জামাই কে প্রপোজ করেছিল। সেগুলোকে কতো কষ্টে দূর করেছি তা শুধু আমি জানি। এই মেয়েগুলো আমার থেকেও বড় ছ্যাঁচরা। এমন ভাবে তাকাতে হবে কেনো অন্যের জামাইর দিকে!!

ক্লাস শেষে সবাই বেরিয়ে গেছে, নীল ভাইয়া মাথা নিচু করে কিছু কাগজ গুছাচ্ছেন। আমি তার সামনে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছি।

— কি হলো, কিছু বলবি?

— না আসলে!

— বল কি বলবি?

— নীল ভাইয়া!

— আবার ভাইয়া!

— মানে নীল স্যার! বলছি কি,, আপনি আর কালো শার্ট পড়বেন না।

— কেনো পরবো না? (ভ্রঁ কুচকে)

— আরেহ আপনি দেখেন না ওই সিনিয়র আপু গুলো কিভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে আপনাকে! কালো শার্টে আপনার ফর্সা শরীর টা আরও বেশি ফুঁটে রয়েছে। আর এসব কি হ্যাঁ! উপরের বাটন খুলা কেনো? আপনি বোঝেন না আমার হিংসা হয় কোনো মেয়ে আপনার দিকে তাকালে!

— আমার দিকে যেই তাকাক তোর কেনো হিংসা হবে? তুই আমার কি লাগিস?

— আমি আপনার,,,

— বল! কি সম্পর্ক তোর আর আমার? আমি কি তোর বয়ফ্রেন্ড?

নীল ভাইয়া কথাগুলো বলছেন আর একপা দু পা করে আমার দিকে এগুচ্ছেন। আর আমি একপা একপা করে পিছাচ্ছি। পিছাতে পিছাতে দেয়ালে আমার পিঠ ঠেকে গেছে। নীল ভাইয়া এখনও আমার দিকে আগাচ্ছেন। এক পর্যায়ে উনি একদম আমার মুখ বরাবর এসে থামলেন। এই দুই বছরে নীলের এতো কাছে কখনও আমি আসি নি। আমার নিশ্বাস খুব দ্রুত উঠা নামা করছে। বুকে কেমন ধুকধুক করছে। জানি না এমন কেনো লাগছে, কিন্তু সব মিলিয়ে বেশ অস্বস্তি লাগছে।

— কিরে বল! আমি কি তোর বয়ফ্রেন্ড নাকি প্রেমিক? নাকি জামাই? কোনটা আমি তোর?

— ককিছু ননা।

— তাহলে কেনো তোর হিংসা হয়?

নীলের প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। মাথা নিচু করে চোখ-মুখ খিচে দাড়িয়ে আছি। হঠাত কিছু ছেড়ার শব্দ কানে এলে চোখ মেলে তাকাতেই আমার চোখ কপালে উঠে গেলো।

নীল আমার পরণের কালো ওরনার বেশখানিক টা ছিড়ে ফেলেছেন!

— এটা কি করলেন আপনি? আমার ওরনা ছিড়ে দিলেন! এখন তো আমার পুরো ড্রেসটাই বাতিল হয়ে গেলো!

— বাতিল করার জন্যই ছিড়েছি। আজ তো শুধু ওরনা ছিড়েছি। এর পর যদি কখনও দেখেছি কালো রং এর জামা পরেছিস,, তাহলে ওরনা নয় সোজা জামা ছিড়বো। এখন এখান থেকে যা।

রাগে আমার ইচ্ছে হচ্ছে আমার ওরনার মতো তার শার্ট টাও ছিড়ে ফেলি। না শুধু ছিড়লে আমার রাগ কমবে না। কাঁচি দিয়ে কুচি কুচি করে কাটবো। ব্যাগ টা কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে হাটা ধরলাম। চুল গুলো হাত খোঁপা করে নিয়েছি। যার জন্য এতো কষ্ট করে সাজলাম, সে কি করলো! আমার ওরনা টাই ছিড়ে দিলো! ছাড়বো না, দেখে নেবো!

অতিরিক্ত রাগ হলে আমার চোখ বেয়ে পানি পড়া শুরু হয়। এবারও চোখ বেয়ে পানি পরছে। কি মনে করে সে নিজেকে? আমার ভালোবাসা তো বোঝেই না উল্টো এমন করে আমার সাথে। যাবো না তার বোনের বিয়েতে। আর ভালোবাসবো না তাকে। আজকেই ভুলে যাবো!!

?

বাড়িতে গিয়ে কাঁধের ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে একটা চকোলেট নিয়ে খেলাম। এখন অনেকটা ভালো লাগছে। রাগটাও অনেকটা কমে গেছে।

একটা ব্যাগে হলুদের জন্য শাড়ি আর প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র ঢুকাচ্ছি। তানিয়া আপুর হলুদে যেতে হবে না! ওই যমরাজ টার ওপর রাগ করে আমি কেনো আমার আনন্দ মাটি করবো? আমাকে কি শাবানা মনে করে নাকি যে এতোটুকুতেই কেঁদে টেদে অস্থির হয়ে যাবো!

আম্মু আব্বুর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পরলাম নীল দের বাড়ির উদ্দেশ্যে। কাল নীলের বোন তানিয়া আপুর বিয়ে। নীল স্যারের বাবা নজরুল খান দুই বিয়ে করেছেন। প্রথম পক্ষে তাহেরা বেগম আর তার দুই মেয়ে তায়েবা আর তানিয়া আপু আর এক ছেলে নীরব। তায়েবা আপুর আগেই বিয়ে হয়েছে। দ্বিতীয় পক্ষে নয়নতারা বেগম। তার ছেলে নীল আর মেয়ে নিতু। নীল স্যার বংশের বড় ছেলে। আর আমি খান বাড়ির ভবিষ্যত বড় বউ,, “নীলের বউ।” নিজেকে নীলের বউ বলতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে! ইশশ!!

ভাবনার সুতোয় টান পরলো খান বাড়ির গেইটের সামনে এসে। পুরো বাড়ি জাঁকজঁমক সাজে সজ্জিত। উঠোনে সব মহিলা রা কাজ করছে। হয়তো এখানেই হলুদের ফাংশন করা হবে।

বাড়ির সাজ দেখে তো রীতিমত আমার মুখ খোলাই রয়ে গেছে। মেয়ের বিয়েতে এতো কিছু করেছে, বাড়ির বড় ছেলের বিয়েতে না জানি কি করবে! বাড়িতে ঢুকতেই সবার আগে আমার শাশুড়ী নয়নতারা বেগমের সাথে ধাক্কা খেলাম।

— এই কথা দেখে চলতে পারিস না! জানিস বিয়ে বাড়ি হাজার টা কাজ আমার।

— সরি আম্মা লাগে নি তো!

— আমি তোর আম্মা কবে হলাম? খালাম্মা বা চাচি বলবি!

— জ্বি খালাম্মা।

আমার কপাল টাই খারাপ! জামাই তো আছেই তিতা নিম, শাশুড়ীও তেমনই। যাক কোনো ব্যাপার না একবার বিয়ে টা হতে দাও সবাই কে টাইট দিয়ে দেবো।

সন্ধ্যায় আমি আর নিতু এক সাথে সেজেগুজে তৈরি। দুজনেই এক শাড়ি পরেছি, সেজেছিও অনেক টা এক ভাবে। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই এক দফা ক্রাশ খেলাম। আজ তো নীল পুরো লাট্টু হয়ে যাবে আমাকে দেখে। এইবার তো নীল এই কথার প্রেমে পরেই যাবে।

মেহমানে পুরো বাড়ি ভরে গেছে। এতো ভীরের মধ্যেও আমার চোখ দুটো নীল কে খুঁজছে। উঠানের মাঝ বরাবর তানিয়া আপুকে সবাই হলুদ দিচ্ছে। তার এক পাশে দাড়িয়েই নীল মেহমানদের সামলাচ্ছে।

নীল একটা হলুদ পাঞ্জাবী পরে আছে। চুল গুলো সেট করা, পাঞ্জাবীর হাতা কুনুই পর্যন্ত উঠানো। এতো হ্যান্ডসাম লাগছে যে আমার চোখ সরছেই না তার উপর থেকে। আচ্ছা তার এতো হ্যান্ডসাম হওয়ার কি দরকার ছিল! এখানেও সব মেয়েরা তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই অবলা মেয়েটার জিনিসে সবাই নজর দেয়।

শাড়িটা সামলে নীল এর দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই কারো সাথে জোড়ে ধাক্কা লেগে ধারাম করে নিচে পরে গেলাম। কোমড়ে বেশ ব্যথা পেয়েছি। মাথা তুলে তাকাতেই দেখি সামনে…

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে