শ্রাবণের মেঘ পর্ব_০১

0
2757

#শ্রাবণের_মেঘ?
#পর্ব_০১
#Tabassum_Kotha

কান ধরে চৌরাস্তার মোড়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে কথা। কাঁধে স্কুল ব্যাগ, মাথায় দুই বেণী করা তার। সামনের ছোট চুল গুলো মুখে এসে পরছে বারবার। গোধূলী লগ্ন শুরু হয়েছে মাত্র। দিনের শেষ রোদের ফালি কথার কপালে এসে পরছে। আশেপাশের উৎসুক জনতা বেশ উৎসাহের সাথে হা করে দেখে যাচ্ছে তামাশা। কানাঘুসার সাথে সাথে ঠাট্টাও শুরু করে দিয়েছে। এ যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি তাদের জন্য।

মাথা নিচু করা অবস্থাতেই চোখ চারদিকে ঘুরিয়ে দেখছি কতোজন অপরাধী আমার অসহায়ত্বের মজা নিচ্ছে। গুণেছি, মোট তেতাল্লিশ জোড়া পা দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমার অপমান দেখছে। এর মধ্যে দুই জোড়া পা আমার দুইটা কুত্তি বান্ধবীর। দেখে নেবো দুজনকেই। তুলিকে হালকার উপর ছেড়ে দিলেও নিতুকে ন্যাঁড়া করে গাঁধার পিঠে চড়াবো। কারণ নিতুর ভাইয়ার জন্যই এভাবে দাড়িয়ে আছি। ভাই-বোন দুজনেই অপরাধী। বোন প্রপোজ করার আইডিয়া দেয় আর ভাই প্রপোজ করলে মাঝ রাস্তায় কান ধরে দাড় করিয়ে রাখে। যত্তসব! মশাগুলোও আজ বেইমানি করছে। কামড়ে মনে হচ্ছে খেয়েই ফেলবে।

একটু ঝুঁকে মশা তাড়াতে গেলেই সামনে দাড়িয়ে থাকা যমরাজটা চেচিয়ে উঠলো,
— এই কথা! তুই নিচে ঝুঁকলি কেনো? তোকে আমি সোজা হয়ে দাড়িয়ে থাকতে বলেছি না?

— আমি কি করবো মশা কামড়াচ্ছে তো।

— মশা শুধু তোকেই চোখে দেখে তাই না! আমিও তো বসে আছি কোই আমাকে তো দিলো না কামড়।

— মশা তিতা রক্ত খায় না,, আপনার রক্ত তিতা। মশা মিষ্টি রক্ত খায় যেমন আমার।

— কি বললি? আমার রক্ত তেতো?

— আর নয়তো কি? তিতা না হলে সবসময় মুখ থেকে নিমের রস পরে কেনো?

— চুপ একদম চুপ। একদম ফালতু কথা বলবি না।

— দেখেন নীল ভাইয়া আমি ফালতু কথা বলি না।

— ওই আমি তোর কোন জনমের ভাই লাগি? তুই কি আমার মায়ের পেটের বোন যে কথায় কথায় ভাই ডাকিস!

— ছিঃ ছিঃ!! মায়ের পেটের ভাই হতে যাবেন কেনো? এলাকার বড় ভাই লাগেন আর কাব্য ভাইয়ের বেষ্টফ্রেন্ড আপনি সেই সুবাদে আর কি।

— কোনো সুবাদ টুবাদ নেই। আমি তোর স্যার লাগি। আমাকে স্যার বলেই ডাকবি।

— হুম। এখন যাই? স্যার!!

— শাস্তির শর্ত অনুযায়ী দশবার কান ধরে উঠবস বাকি আছে।

— অ্যাঅ্যা স্যার! মাঝরাস্তায় কান ধরে দাড় করিয়ে রেখেছেন সেটা কি যথেষ্ট নয়? বলি কি উঠবস টা না করলে হয় না?

— তুই যদি এখন উঠবস না করিস তাহলে আমি কাব্যকে বলে দেবো তুই আমাকে প্রপোজ করেছিস।

— এই না না নীল ভাইয়া আপনি কাব্য ভাইয়াকে এসব বলবেন না প্লিজ। বাবা জানতে পারলে আমাকে মেরে কুচিকুচি করে ফেলবে।

— তাহলে বল প্রপোজ কেন করেছিলি?

— ডেয়ার ছিল তাই করেছিলাম।

— কিহ! প্রপোজ করার ডেয়ার! মাথা নষ্ট তোর কথা? আস্ত একটা ছাগলি তুই। এই ধরনের ডেয়ার কেউ নেয়?

— বকছেন কেনো? সরি বলেছি, শাস্তিও দিয়েছেন। এখন বাসায় যাই? সন্ধ্যা নেমে যাবে কিছুক্ষণপর।

— আচ্ছা ঠিক আছে যা। তবে ভবিষ্যতে এই ধরনের কাজ যেনো আর না হয়। সকালে কোচিং এ ঠিক সময়ে আসবি।

— হুম। নীল ভাইয়া!!

— কি হলো?

— আপনাকে নেভি ব্লু শার্টে অনেক হ্যান্ডসাম লাগে!!

— যা এখান থেকে! ছ্যাঁচড়া মেয়ে কোথাকার!

— তুই ছ্যাঁচড়া তোর বাপ ছ্যাঁচড়া তোর চৌদ্দগোষ্ঠী ছ্যাঁচড়া। (কথা বিরবির করতে করতে সেখান থেকে সরে এলো)

চৌরাস্তার মোড় থেকে সরে এসে নিতু-তুলিকে আর পেলাম না। শাকচুন্নি দুইটা মার খাওয়ার ভয়ে পালিয়েছে। কাঁধের ব্যাগটা আরেকটু টেনে হাটা ধরলাম বাড়ির দিকে।

আমি কথা রহমান। কিশোর রহমান ও কলি রহমানের দুইমাত্র সন্তানের মধ্যে ছোট। আমার বড় একটা ভাই আছে। যে কিনা মূলত একটা কষাই। দিনের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তেইশ ঘন্টা আমায় প্যাড়া দেয়। ভাইয়ার নাম কাব্য। আর এতোক্ষণ যে আমাকে কান ধরিয়ে দাড় করিয়ে রেখেছিল সে হলো নীল। শ্রাবণের বৃষ্টির দিনে জন্মেছিল, তাই তো স্বভাবটাও বর্ষণের মতো,, হিহিহি।।

নীল ভাইয়ার বাবা আমাদের এলাকাল চেয়ারম্যান। তার ছোট বোন নিতু আমার বেষ্টফ্রেন্ড। নীল এবার অনার্স ফাইনাল ইয়ারে আছে কাব্য ভাইয়ার ব্যাচমেট। এলাকার সব মেয়ের একমাত্র ক্রাশ নীল ভাইয়া। হয়তো মেয়েদের ক্রাশ লিষ্টের দ্বিতীয় স্থানে আমার ভাইয়াও আছে। শুধু দেখতেই হ্যান্ডসাম কিন্তু আসলে আস্ত একটা বাদুড়। হিহিহি।

?

গোধূলী লগ্নের শেষ প্রহর চলছে। এই সময় টা বরাবরই আমার পছন্দের। মাঝে মাঝে পড়ার টেবিলে বসে স্বপ্নের জগতে হারিয়ে যাই। কোনো এক শ্রাবণের দিনে আকাশে খুব মেঘ করবে,, আর সেই মেঘের লুকোচুরি দেখতে দেখতে গোধূলি বেলায় প্রিয়তম এর হাত ধরে নদীর তীর বেয়ে অজানায় হারিয়ে যাবো!!

স্বপ্নের জগত থেকে আমাকে টেনে বের করে আনলো আমার আম্মিজান। বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে, ঝাসির রাণীর রূপ ধারণ করে। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় ঢাল তলোয়ার নিয়ে মাঠে নেমে পরবে।

— এতো দেরি কেনো করলি কথা?

— নীল ভাইয়ার কোচিং এ গিয়েছিলাম।

— আমি বুঝি না এই নীল ছেলেটা তোকে আর তোর ভাইকে কি জাদু করেছে! কিছুই বুঝিস না তোরা ওকে ছাড়া।

— আম্মু! মাত্রই বাড়ি এলাম সারাদিন পর তাও এমন কেনো করছো ভিতরে যেতে দাও।

— হ্যাঁ হ্যাঁ আমার কথা কি আর তোমাদের ভালো লাগে নাকি। মা তো নই যেনো কাজের লোক শুধু।

টুয়েন্টি ফোর আওয়ারের অটো রেকোর্ডার শুরু হয়ে গেলো। এখন বেশকিছুক্ষণ একা একাই আমাদের তিনজনকে সাবান পানি ছাড়া ধোবে। আব্বু বাসায় থাকলে আর কথা বলতে পারতো না। আব্বু খুব রাগি। তার রাগ কে আমরা সবাই ভীষণ ভয় পাই।

ঘরে গিয়ে রোজকার মতো ব্যাগটা ছুড়ে বিছানায় ফেলে দিলাম। তবে আজকে একটু জোরে ফেলেছি। কারণ আজ আমি রেগে আছি। নীল ভাইয়া আমাকে মাঝ রাস্তায় অপমান করেছে। তাকে একটা শায়েস্তা না করলেই না। অনেক বার বেড়েছে সে। ছোট বলে কি আমার আত্মসম্মাণ নেই! কিন্তু শত হলেও দোষটা আমার, তার সামনে আমার সব আত্মসম্মাণ বিসর্জন!!

ফ্রেশ হয়ে চিপসের প্যাকেট হাতে টিভির সামনে বসে আছি, বুক ধুকধুক করছে! নীল ভাইয়া হুমকি দিয়েছে কাব্যকে সব বলে দেবে,,, সত্যি যদি বলে দেয়! তাকে আমি বিশ্বাস করি না, ভারী ডেঞ্জারাস লোক সে। কদিন আগেই লুকিয়ে পার্কে যাওয়ার কথাটা কাব্য ভাইয়া কে বলে দিয়েছে।

চিন্তায় আছি, টম এন্ড জেরিতেও মনযোগ দিতে পারছি না। চিপস্ গুলো করুণ দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে কখন আমি তাদের খেয়ে সাবার করবো। কিন্তু ওইযে চিন্তায় আছি তাই খাওয়ার দিকে মুড নেই।

ঘড়িতে সন্ধ্যা ৭:৫৬ বাজে, আর চার মিনিট পর নবাবজাদা বাড়ি ফিরবেন। কারণ আব্বু বাড়ি ফেরেন ৮:২০ এ। আর কাব্য ভাইয়া আব্বু বাড়ি ফেরার আগেই আসবেন। অস্থিরতা আমাকে গ্রাস করে নিয়েছে। ভাইয়া যদি বাবাকে বলে দেয় প্রপোজ করার কথা!! বাবা তো আমাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবেন মাটি তে!! ইয়া খোদা এই অবলা কথা কে বাঁচাও তুমি।

— মা! ও মা! জানো তোমার মেয়ে কথা আজ কি করেছে? (কাব্য)

যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। যমরাজ টা সব বলে দিয়েছে কাব্যকে আর কাব্য এখন বাবা কে বলে দেবে! ইচ্ছে করছে এক গ্লাস পানিতে ডুবে মরে যাই। ভাইয়াকে যতোই চোখের ইশারা করছি সে ততো জোরে চেচাচ্ছে।

— কি হলো চেচাচ্ছিস কেনো? কি করেছে কথা? (কলি বেগম)

— মা তোমার মেয়ে আজ!! তোমার মেয়েকে আজ নীল কানে ধরিয়ে দাড় করিয়ে রেখেছিল!(কাব্য)

— কিহ! কি বললি তুই? কিন্তু কেনো? কি করেছিস তুই কথা? কাব্য কি বলছে এসব!

মা বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যতো দোয়া দূরদ জানা ছিল মনে মনে সব পড়ে শেষ করে ফেলেছি। কিন্তু ভাইয়ার রাগি মুখটা স্বাভাবিক হচ্ছে না। আজ হয়তো আর শেষ রক্ষা হবে না। মা যেমন তেমন আব্বু আমাকে মেরে তক্তা বানিয়ে দেবেন। হয়তো আজকেই নীল ভাইয়ার কোচিং এ যাওয়ার শেষ দিন ছিল আমার। বেটা যমরাজ আজ যদি আমি বেঁচে যাই তবে কাল তোকে দেখে নেবো। নাহলে আমার নামও কথা না হুহ!!

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে